জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৫ /বিজন সাহা

মিউজিয়ামের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৫ 

বিজন সাহা 

তলিয়াত্তি 

আমাদের পরবর্তী যাত্রা বিরতি ছিল তলিয়াত্তি। এই শহরকে বলা হয় রাশিয়ার ডেট্রয়েট। রাশিয়ায় বিভিন্ন শহরেই গাড়ি উৎপাদন করা হয়, তবে এটা মনে হয় একমাত্র শহর যেখানে গাড়ি শিল্পকে কেন্দ্র করেই চলে জীবন। প্রথমে একটু দ্বিধা ছিল দিলীপের যাবে কি যাবে না। আমি আর দেমিদ একটু জোর করেই নিয়ে গেলাম। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল গাড়ির মিউজিয়াম দেখা। 

শহরের গোড়াপত্তন করা হয় ১৭৩৭ সালে। ভাসিলি তাতিশেভ যাযাবরদের হাত থেকে রুশ ভূমি রক্ষা করার জন্য স্তাভ্রোপোল নামে এই দুর্গ শহর গড়ে তুলেন। এই শহর প্রতিষ্ঠার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণকারী কালমিকির লোকদের নতুন বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। ১৭৩৭ সালের ২০ জুন সম্রাজ্ঞী আন্না ইয়ানভনা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণকারী কালমিকির রানীকে এই নতুন শহরের গোড়াপত্তনের খবর জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। সেদিন থেকে শুরু হয় শহরের ইতিহাস লেখা। ১৭৪৪ থেকে ১৭৮০ সাল পর্যন্ত এই শহর ছিল অরেনবুরগ প্রদেশের অংশ। বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত প্রায় একশ বছরে জনসংখ্যার তেমন পরিবর্তন হয়নি। সেখানে ৬ হাজারের মত মানুষ বাস করত আর সে সময় স্তাভ্রোপোল ছিল রাশিয়ার মাঝারি মানের শহর। কিন্তু স্তাভ্রোপোল অঞ্চলে প্রায় ২৫০ হাজার মানুষ বসবাস করত। সেখানে ছিল হাসপাতাল, ছয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছয়টি কারখানা। তবে যেহেতু স্তাভ্রোপোল অর্থনৈতিক ভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না তাই ১৯২৪ সালে একে গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে রাশিয়ায় গ্রাম, শহর ইত্যাদির উপর নির্ভর করে এলাকার উন্নয়নে ভিন্ন ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়, সেভাবেই আসে সরকারি অনুদান। ১৯৫০ সালের শুরুতে শহরের লোকসংখ্যা দাঁড়ায় ১২ হাজারের মত।  ১৯৫০ সালের ২১ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের মন্ত্রী পরিষদ ভোলগায় ঝিগুলেভ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য কুইবিশেভ রিজারভয়ার তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫৩ – ১৯৫৫ সালে পুরোটা জলের নীচে চলে গেলে শহর নতুন জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর শুরু হয় নতুন জীবন। ১০ কিলোমিটার পূর্বে কমসোমলস্ক নামে নতুন শ্রমিক পল্লী গড়ে ওঠে আর চার কিলমিটার ভাঁটিতে গড়ে ওঠে শ্লুজোভই নামে আরেক পল্লী। এই দুটো জনপদ পরে নতুন স্তাভ্রোপোলের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৭ সালে ভোলঝস্কি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ সম্পন্ন হলে সেখানে ভোলগোসেমমাস নামে ইলেক্ট্রোটেকনিক্যাল কারখানা তৈরি হয়, গড়ে ওঠে সিনথেটিক রাবার, কুইবিশেভ নাইট্রোজেন ও কুইবিশেসভ ফসফর নামে কয়েকটি কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি। ১৯৬৪ সালের ২৮ আগস্ট ইতালীর কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পালমিরো তলিয়াত্তির নাম চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য রুশ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সুপ্রিম সোভিয়েত স্তাভ্রোপোলের নাম বদলিয়ে রাখে তলিয়াত্তি। ১৯৬৬ সালে ইতালীর বিখ্যাত অটোমোবাইল কোম্পানি ফিয়াটের সাথে যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয় ভোলঝস্কি অটোমোবাইল কারখানা ভাজ। একই সাথে গড়ে ওঠে নতুন আবাসিক এলাকা। ১৯৭০ সালে শহরের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২৫১ হাজারে। ১৯৯৬ সালে শহরের নাম পরিবর্তনের জন্য গণভোটের আয়োজন করা হয়। যদিও প্রয়োজনীয় ৫০% কম মানুষ সেই ভোটে অংশ নেয়, অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৭০% তলিয়াত্তির পক্ষে মত প্রকাশ করে। তবে এখনও পর্যন্ত শহর ও শহরের বিভিন্ন রাস্তার নাম পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা দাবি তোলে। শেষ জরীপ অনুযায়ী মাত্র ৪% শহরবাসী ঐতিহাসিক নাম ফিরিয়ে দেবার পক্ষে বলে। রাশিয়ার সব বড় শহরের মত তলিয়াত্তিতেও বহুজাতির বাস। বর্তমানে ১০৪ জাতির মানুষ এখানে বাস করে। বর্তমানে শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৬৮৫ হাজার। জনসংখ্যার দিক থেকে তলিয়াত্তি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় শহর যা কিনা কোন প্রদেশের প্রধান শহর নয়। ভোলগার বাম তীর ধরে  এই শহর প্রায় ৩০ কিলোমিটার প্রলম্বিত। তলিয়াত্তির বিপরীতে ভোলগার অন্য তীরে ঝিগুলি শহর অবস্থিত। প্রায়ই দুই শহর এক করার প্রস্তাব আসে, তবে ঝিগুলির জনগণ তাতে তেমন আগ্রহ দেখায় না। সামারা থেকে ৭০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত এই শহর জুনের প্রথম রবিবার নিজের জন্মদিন বা তলিয়াত্তি দিবস পালন করে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সামারা রিজিয়ন মস্কো টাইম জোনের চেয়ে এক ঘন্টা এগিয়ে। তাই কী তলিয়াত্তি কী সামারা এখানে আমাদের ঘড়ি এক ঘন্টা এগিয়ে নিতে হয়েছিল, সেদিক থেকে আমরা বাংলাদেশ ও ভারতের এক ঘন্টা কাছে চলে এসেছিলাম। 

গাড়ির হৃৎপিণ্ড

যদিও সময়াভাবে আমাদের এসব দেখা হয়নি তবে এর বাইরেও তলিয়াত্তিতে দেখার মত অনেক জিনিস আছে। এদের মধ্যে অন্যতম জেমসস্কায়া হাসপাতাল। এটা ১৯৫৩ সালে সলিল সমাধির আগের স্তাভ্রোপোল শহরের একমাত্র নিদর্শন। এর নির্মাণ কর্ম শুরু হয় ১৮৬৮ সালে আর ১৯৭২ সালে এখানে প্রথম রুগীদের চিকিৎসা শুরু হয়। ঘানা ও ক্যানাডার পরে কুইবিশেভ রিজারভয়ার বিশ্বের বৃহত্তম জলাশয় যেখানে তৈরি হয়েছিল ঝিগুলি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই জলাশয় এতটাই বড় যে একে লোকজন ঝিগুলি সাগর নামে ডাকে। এই সাগরের জন্ম হয় হাজার হাজার বাড়িঘর ডুবিয়ে। তখন অনেকেই নিজের বাড়িঘর সরিয়ে নেয়। এদের একজন ছিল স্তারিকভ নামে এক মুচি। তার মৃত্যুর পর সেখানে গড়ে ওঠে ঐতিহ্য জাদুঘর। আছে প্রযুক্তির ইতিহাস পার্ক নামে এক কমপ্লেক্স। আছে সমসাময়িক বাস্তববাদের জাদুঘর। আছে স্পাসো-প্রিওব্রাঝেনস্কি সাবর, আছে ডেন্ড্রারিয়াম। আর আছে ভাসিলি তাতিশেভের মূর্তি, যিনি স্তাভ্রোপোল ছাড়াও বেশ কয়েকটি শহর স্থাপন করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ওসব দেখার সময় আমাদের হয়নি। তবে দেখেছি আভতোভাজের জাদুঘর। আভতোভাজ মানে ভলঝস্কি অটোমোবাইল কারখানা। যদিও এই কারখানায় প্রবেশাধিকার পাওয়া প্রায় অসম্ভব, তবে জাদুঘরে সহজেই প্রবেশ করা যায়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে স্থানীয় অটোমোবাইলের প্রতি অনেকটা নিঃস্পৃহ হলেও এই জাদুঘর অধিকাংশ মানুষের মধ্যে অন্য এক ধরণের আগ্রহ জাগায়। কারণ এটা শুধু গাড়ি নয়, এটা সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস, এই জাদুঘর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার অটোমোবাইল শিল্পের ইতিহাসের সাক্ষী।

🍂
সেখানে দেশের একেবারে প্রথম দিকে গাড়ি থেকে শুরু করে আধুনিক গাড়ি পর্যন্ত সবই আছে। এমনকি সেসব গাড়িও আছে যা স্বল্প পরিমাণে তৈরি করা হয়েছিল। কিছু কিছু গাড়ি দেখতে ফরমুলা-১ এর বলিডের মত মনে হয়। সত্যি কথা বলতে এর আগে এত রেস আর এক সাথে দেখিনি। দেখেছি কি? ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে ঝড়ে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি হয়। দুর্দশাগ্রস্থদের সাহায্যের জন্য এক কার রেসের আয়োজন করা হয়। সেই গাড়িগুলি ঢাকা যাবার পথে তরা ঘাঁটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত ফেরি পার হতে। আর আমার বাড়ি এই তরা গ্রামেই। তখন আমার বয়স ৬। বন্ধুরা মিলে সেসব গাড়ি দেখতাম। কোন কোন গাড়ি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতাম। এক দিকে ঝড়ের কারণে শোক, অন্যদিকে এসব গাড়ি দেখার আনন্দ। সে এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। এই মিউজিয়ামে শুধু গাড়ি ছিল না, ছিল যন্ত্রপাতি, মোটর। এ যেন এনাটমির জাদুঘরে কঙ্কাল, হৃৎপিণ্ড, লিভার, কিডনি এসব প্রদর্শনের মত। আমি যখন বিভিন্ন কোন থেকে প্রতিটি গাড়ির ছবি তুলছি, দেমিদ ওদিক থেকে টিপ্পনি কাটল – বিজন, ভগবান মনে হয় গাড়িতে বসে আছে!  

দুই বন্ধু

শুনেছি ডেট্রয়েট এখন ধ্বংসের পথে। কলকারখানা বন্ধ। সেদিক থেকে রাশিয়ার ডেট্রয়েট নতুন করে জেগে উঠছে। নব্বুইয়ের দশকের মন্দা কাটিয়ে সে এখন  ক্রমবর্ধমান এক শহর। অনেক বিদেশী কোম্পানির লোগো দেখা যাচ্ছে এদিক সেদিক। সেখান থেকে বেরিয়ে পাশের এক রেস্টুরেন্টে আমরা দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য সামারা। এখান থেকে ঘণ্টা খানেকের রাস্তা। দেমিদ ইতিমধ্যেই এক ভদ্রলোকের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমরা রাতটা সেখানেই থাকব, তখনও ঠিক হয়নি ক' দিন আমরা সেখানে থাকব। ঠিক করলাম, ওখানের পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেব। তবে দিলীপ বা আমি – কেউ আর খুব বেশি আশাবাদী নই এখানে দিলীপের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে।  

ভিডিওতে তলিয়াত্তি
https://www.youtube.com/watch?v=NcWEc5PrMns

তলিয়াত্তির ছবি 

http://b.ru/album.php?tag=255

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments