নির্মল বর্মন
নাট্যবিষয়ক প্রাবন্ধিক,নট নাট্যকার ,নাট্য পরিচালক শম্ভু মিত্র ভারত তথা বাংলার এক কিংবদন্তি শিল্পী পুরুষ। সম্ভবত নিজস্ব ঘরাণার প্রতিষ্ঠান। স্বনামধন্য আবৃত্তি শিল্পী, চলচ্চিত্র অভিনেতা শম্ভু মিত্র কলকাতার ভবানী পুরে পিতা - শরৎকুমার মিত্র ও মাতা- শতদলবাসিনী'র কোল আলো করে পৃথিবীর ভালোবাসা পেয়েছিলেন ১৯১৫ সালের ২২ আগস্ট।
১৯৩৯ সালে সালে বাণিজ্যিক নাট্যমঞ্চে যোগদান করে সাফল্যের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে নাট্যকার মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সৃষ্টি করলেন 'বহুরূপী' নাট্য সংস্থা। প্রায় ২১ বছর ধরে রবীন্দ্রনাথ, সফোক্লিস, হেনরিক ইবসেন ও তুলসী লাহিড়ী'র রচনা শম্ভু মিত্র' র পরিচালনায় মঞ্চস্ত হয়েছিল। শম্ভু মিত্র'র পত্নী তৃপ্তি মিত্র ও কন্যা শাঁওলি মিত্র স্বনামধন্য মঞ্চাভিনেত্রী। কন্যা শাঁওলী মিত্র'র "পঞ্চম বৈদিক" এর সঙ্গে আজীবন সংযুক্ত ছিলেন।
🍂
১৯৯৭ এ ৮২ বছর বয়সে উনিশে মে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর প্রাক্কালে "ইচ্ছাপত্রে" নাট্য ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র'র মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য---
"মোটকথা আমি সামান্য মানুষ। জীবনের অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি। তাই মরবার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনই নীরবে একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্ততার সঙ্গে গিয়ে পুড়ে যেতে পারে।"
কথিত, শম্ভু মিত্র'র মৃত্যু হল। সৎকার সমাধা হল। তারপর সংবাদ মাধ্যম খবরটা পেয়েছিল।
নাট্য প্রাবন্ধিক শম্ভু মিত্র কালের অমোঘ নিয়মে বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিকের আসন অলংকৃত করেছেন, আপাতত ভাবনায় তাই মনে হয়। প্রাবন্ধিক শম্ভু মিত্র'র নাট্য ও মঞ্চ বিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থ গুলি :-
"অভিনয় নাটক মঞ্চ", "প্রসঙ্গ : নাট্য", "সন্মারগ সপর্যা", "কাকে বলে নাট্যকলা", "নাটক : রক্তকরবী" ইত্যাদি।
১৯২৪ এ প্রাবন্ধিক শম্ভু মিত্র'র "নাটক : রক্তকরবী " 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে শোরগোল পড়ে যায়, কারণ পাঠক ভেবেছিল আবার একটা হেঁয়ালীভরা কৌতুক রচনা বাজারজাত । বিখ্যাত ডাঃ আবিরলাল মুখোপাধ্যায় মহোদয় প্রাবন্ধিক শম্ভু মিত্র কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'জলসাঘর বক্তৃতামালা'য় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নিয়ে যান।তাবড় তাবড় অধ্যাপক গন প্রায়ই লিখিত নোটের স্মরনাপন্ন হয়ে বক্তব্য পরিবেশন করেন কিন্তু শম্ভু মিত্র মুখে মুখে বক্তব্য পরিবেশন করেন। পরবর্তী সময়ে মুখে মুখে বলার কথা'র ক্যাসেট থেকে বক্তব্যটি লিপিবদ্ধ করে "কাকে বলে নাট্যকলা''গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ।
সাহিত্যিক শম্ভু মিত্রের " যুদ্ধোত্তর যুগে বাংলা মঞ্চে সংকট" প্রবন্ধটি 'পরিচয়' পত্রিকায় (১৩৪৭) প্রকাশিত হয়েছিল । প্রবন্ধের বিষয় 'দেশকালের প্রেক্ষিতে মঞ্চের স্বরূপ-এর চিত্রায়ন'। প্রবন্ধটি আরম্ভ বিশাল আপেক্ষিক ও আকর্ষণীয়:-
"আমাদের এই খণ্ড, বিচ্ছিন্ন ও মত-বিদীর্ণ বাঙালীদের মধ্যে মতৈক্য যদি কোনও বিষয়ে পাওয়া যায় তা সে হল থিয়েটারের অধঃপতন সম্বন্ধে। বুড়ো হোক বা ছোঁড়া হোক, গম্ভীর হোক বা চটুল হোক, সকলেই একবাক্যে এবং একইরকম গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে মন্তব্য করে থাকেন-থিয়েটার জাহান্নমে গেছে।"
কিন্তু থিয়েটার জাহান্নামে কেন গেছে?
তাঁরা উত্তরে অনেকে বলেন:-
"ভালো নাটক পাওয়া যায় না আমাদের দেশে, ভরসা করবার মত নাট্যকার কোথায় বলুন একটাও?"
বস্তুতঃ একথাও সঠিক সত্যে প্রমানিত যে, অন্তত সাড়ে বারো আনা খাঁটি বাঙালী নাটক দেখতে ও শুনতে ভালবাসে ও ছুতো বা সুযোগ পেলেই নাট্যে অভিনয় করবার চেষ্টা করে । তাসত্ত্বেও কেন একটা নাম করবার জন্য নাট্যকার প্রায় জন্মালো না এ দেশে।
প্রাবন্ধিক শম্ভু মিত্র কে প্রশ্ন করা হয়েছিল;-
'কাব্য, গল্প, চিত্র, নৃত্য প্রভৃতির মতো থিয়েটার জনপ্রিয় হল না কেন'?
স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব উত্তর দিয়েছেন:-
"তার কারণ বাঙালীর সাংস্কৃতিক জীবনের যে স্রোত চলেছে কাব্য-গল্প-চিত্র-নৃত্যের মধ্য দিয়ে, মঞ্চ তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জাতির সাংস্কৃতিক জীবন থেকেই সে ছিন্ন।"
অথবা
''সাধারণ লোকে থিয়েটার দেখাটা জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ বলে মনে করে না"।
বস্তুতঃ এই জটিল অবস্থা থেকে থিয়েটার ও নাটককে বাঁচাতে গেলে গবেষণার ফলাফল:- শম্ভু মিত্র গবেষণা র তথ্য বিশ্লেষণ প্রণিধানযোগ্য:-
"'আগত এই আকালের হাত থেকে বাঁচতে হলে লোকদের একবার দাঁড়িয়ে ভেবে দেখতে হবে যে, গলদ আমাদের কোথায় কোথায়"।
প্রাবন্ধিক গবেষক ও লেখক শম্ভু মিত্র মহোদয় তাই নাটক ও থিয়েটারকে বাঁচাতে ও জনসমক্ষে আস্বাদনীয় করার জন্য কয়েকটি গবেষণালব্ধ নির্দেশনা দিয়েছেন:-
১."শ্রেণী বিশেষের বা দল বিশেষের জীবন নয়, সমগ্র জাতির সমগ্র শ্রেণির সুখ-দুঃখ আশা আনন্দ নিয়ে যে মহৎ জীবন রেখায় রেখায় রচনা করে রাখছে আমাদের দেশের অনাগত ভবিষ্যতের পটভূমিকা, সেই মহৎ জীবন স্রোতকে বইতে দিতে হবে মঞ্চের মাঝখান দিয়ে, সেই স্রোতে স্নান করতে দিতে হবে দর্শকদের"।
২. নাট্যকারকে "জানতে হবে দর্শকবর্গকে। অর্থাৎ কি কথায় বা ঘটনায় তাদের হাসি পাবেই পাবে, কি তর্ক বা আলোচনা তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে শুনবেই শুনবে। অর্থাৎ তাঁকে আজকের লোক হতে হবে"।
৩."তাঁকে মনে রাখতে হবে তাঁদের মঞ্চের সুবিধে-অসুবিধের কথা-সেখানে কতটুকু করা যায়, আর কতটুকু করা যায় না।"
প্রাবন্ধিক গবেষক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র আজীবন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকারের "পদ্মভূষণ",১৯৭৬ এ "ম্যাগসেসে" পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় "দেশিকোত্তম" উপাধি দেন।যাদবপুয বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রথিতযশা নাট্য ব্যক্তিত্ব ও নাট্য প্রাবন্ধিক শম্ভু মিত্র মহোদয় কে ' D.Litt' সাম্মানিক উপাধি তে ভূষিত করেছিলেন।
প্রাবন্ধিক সমাজমনস্ক নাট্য গবেষক শম্ভু মিত্র মহোদয়ের ভাবনা চিন্তায় ও লেখালেখিতে 'যুক্তিবোধ, তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণধর্মিতা, সমকালচেতনা' থাকলেও নাট্য নির্মাতা ও অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে আগামী প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে থাকবেন কিন্তু কালের কঠোর অনুশাসনে প্রাবন্ধিক হিসেবে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments