জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে /ষড়বিংশতি পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
ষড়বিংশতি পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী        

প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
বৃন্দাবনের দোল 

      
এখান থেকে আমাদের আজকের শেষ গন্তব্যস্থল শ্রীকৃষ্ণের পালক পিতা নন্দরাজার বাসভবন নন্দগাঁও। বৃন্দাবনের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত নন্দীশ্বর পর্বতের উপরে বর্ষানা থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরত্বে এই নন্দগাঁও। নন্দবাবার বাসভবন প্রথমে ছিল গোকুলে সে কথা পূর্বে উল্লেখ করলাম। বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্নভাবে কংসের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে বালক কৃষ্ণের ও অন্যান্য গোপ গোপিনীদের জীবন রক্ষার্থে গোকুল থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে নন্দীশ্বর পাহাড়ের কোলে নন্দগাঁওয়ে নন্দবাবা তাঁর বাসভবন স্থানান্তরিত করেন। শান্ডিল্য মুণির অভিশাপে কংস বা তার অনুচরদের অগম্য ছিল এই নন্দগাঁও। নন্দগাঁওয়ে কংস বা তার কোন অনুচরের প্রবেশ ঘটলে সে প্রস্তরে পরিণত হবে এই ছিল মুণির অভিশাপ। আর এই নন্দীশ্বর পাহাড় সম্বন্ধে পৌরাণিক আখ্যান হল শ্রীকৃষ্ণের ধরাধামে অবতীর্ণ হবার পূর্বে মহাদেব তাঁর তপস্যা করে বর প্রার্থনা করেছিলেন যেন শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলা তিনি ধরাধামে থেকে স্বচক্ষে দেখতে পান। শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদে তিনি নন্দীশ্বর পাহাড় রূপে অবতীর্ণ হন শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পূর্বে। বালক শ্রীকৃষ্ণ পিতা-মাতার সাথে ছয় বৎসর বয়সে নন্দগাঁওয়ে এসেছিলেন এবং এগারো বৎসর বয়স পর্যন্ত তিনি নন্দগাঁও ও সন্নিহিত অঞ্চলে তাঁর বাল্যলীলা প্রদর্শন করেছিলেন।                                      
নিচের মূল রাস্তা থেকে ১৩০টি সিড়ির ধাপ পেরিয়ে উপরে উঠে নন্দবাবার বাসভবন বা মন্দির। বর্তমানের এই মন্দিরটি উনবিংশ শতাব্দীতে বর্ষানার জমিদার রূপরাম সিং এই ‘নন্দভবন’ নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরে নন্দবাবা, মা যশোদা, শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম, শ্রীদাম, সুদাম ও মদনগোপালের বিগ্রহ আছে। নন্দবাবার ডান দিকে শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম, শ্রীদাম ও মধুমঙ্গল এবং মা যশোদার বাঁদিকে রাধারানী, রোহিনী এবং রেবতীর মূর্তি (যথাক্রমে বলরামের মা এবং স্ত্রী)। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ব্রজভূমি পরিক্রমাকালে নন্দীশ্বর পাহাড়ের এক গুহায় নন্দবাবা, মা যশোদা ও শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ খুঁজে পেয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর ছয় গোঁসাই অন্য বিগ্রহগুলি আবিষ্কার করেন। এখানকার প্রধান উৎসব বর্ষাণার মত জন্মাষ্টমী ও রাধাষ্টমী উৎসব। এছাড়াও দোলের সময় এখানের লাঠমার উৎসব বিখ্যাত। 
🍂

ভোর সাড়ে চারটায় মন্দির খোলা হয় এবং দুপুর বারোটা পঁয়তাল্লিশে ভোগ নিবেদন করে বন্ধ করা হয়। পুনরায় বিকেল চারটায় মন্দির খোলা হয় এবং রাত্রি আটটা পনেরোতে মন্দির বন্ধ হয়। নন্দগাঁওয়ে নন্দবাবার মন্দির দর্শন করে আমরা যখন বেরোলাম তখন সন্ধ্যা ৭টা বাজে। পথিমধ্যে আর কোথাও না দাঁড়িয়ে বৃন্দাবনে এসে পৌছালাম রাত্রি সাড়ে আটটায়। সারাদিনের ভ্রমণজনিত ক্লান্তিতে আমাদের শরীর অবসন্ন।                  
পরের দিন অর্থাৎ আজ বৃন্দাবনে আমাদের থাকার শেষ দিন। সকালে স্নান করে আমাদের আশ্রমের পরে গৌড়ীয় শ্রী রাধাবল্লভ মন্দিরে দর্শন করে প্রসাদ পেলাম। এরপরে রমণরেতি রোড দিয়ে শ্রীরঙ্গনাথ মন্দির সংলগ্ন স্থানে পৌঁছে আমার স্ত্রী একটি দোকানে যেয়ে বৃন্দাবনের বিখ্যাত সুচীশিল্প সমন্বিত মহিলাদের ব্যবহার্য কাপড়ের ব্যাগ কিনতে ব্যস্ত হলেন। আমি পদব্রজে ইমলিতলা মন্দির পুনরায় দর্শন করে নিকুঞ্জবন বা সেবাকুঞ্জে প্রবেশ করলাম।                                
অতীতের সেবাকুঞ্জ দীর্ঘদিন জনগণের অজানা থাকার পরে ১৫৯০ সালে স্বামী হিত হরিবংশ এই কুঞ্জ আবিষ্কার করেন। কুঞ্জের ভিতরে নিধুবনের মতো অসংখ্য তুলসী গাছ আছে এবং গাছের শাখাগুলি অবনত মস্তক। কুঞ্জের ভিতর রাধাকৃষ্ণের একটি সুদৃশ্য মন্দির আছে যা রঙমহল নামে সমধিক পরিচিত। প্রবাদ নিধুবনের মতো এই রঙমহলেও এখনও রাধা কৃষ্ণ প্রতি রাত্রিতে এসে সখীদের নিয়ে রাসলীলা করেন। তার জন্য সন্ধ্যের সময় কুঞ্জের দ্বার বন্ধ হয়ে যায় এবং তখন এখানে একটিও হনুমানের দেখা পাওয়া যায় না। অথচ দিনের বেলায় অসংখ্য হনুমানের উপদ্রব। রঙমহল মন্দিরে রাধা কৃষ্ণের রাসলীলার চিত্রগুলি অঙ্কিত আছে। একটি চিত্রতে দেখা যাচ্ছে রাসলীলার পূর্বে শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার কেশরাজি বিন্যাস করে কবরী বন্ধন করছেন। অন্য একটি চিত্রে দেখতে পেলাম রাসলীলার পরে শ্রী রাধার পদযুগলে ব্যথা অনুভব হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পদ সংবাহন করছেন। অপর একটি চিত্রে রাধাকৃষ্ণ যুগলে হোলি খেলছেন। অন্য আর একটি চিত্রে শ্রীকৃষ্ণ বাঁশিতে সুর তুলে রাধারানীকে আহবান করছেন। সেবাকুঞ্জের ভেতরে এক জায়গায় দেখলাম লেখা আছে 'ললিতা কুন্ড'। আসলে এটি একটি কূপ হয়তো আজ থেকে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে এটি একটি কুণ্ডই ছিল। কালক্রমে ভরাট হয়ে বর্তমানে সেটি কূপের আকার ধারণ করেছে। এই কুণ্ড সম্বন্ধে প্রবাদ একদিন রাসলীলার পরে শ্রী রাধিকার অষ্টসখীর অন্যতম ললিতার পিপাসার উদ্রেক হতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বাঁশির সাহায্যে মৃত্তিকাতে আঘাত করে এই কুন্ডের সৃষ্টি করে ললিতার পিপাসা নিবারণ করেছিলেন। সেবাকুঞ্জ দর্শনের সময় সকাল আটটা থেকে বেলা এগারোটা এবং বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। সেবাকুঞ্জ দর্শন করে স্ত্রীকে নিয়ে আশ্রমে ফিরে এলাম দুপুর সাড়ে বারোটায়। 
এই কয়েকদিনের মধ্যে বৃন্দাবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা কাতায়নীর মন্দির দেখার সময় ও সুযোগ করে উঠতে পারিনি। সেজন্য আজ শেষ দিনে বিকেলে আমরা প্রথমে গেলাম কাত্যায়নী মন্দিরে। বৃন্দাবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী এই মা কাত্যায়নী। বৃন্দাবন পৌরসভার সামনে দিয়ে হাটতে হাঁটতে পৌরসভা অফিসকে ডান দিকে রেখে একটি গলির মুখে বামদিকে যাবার পরে দেখলাম আমরা মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে পৌঁছে গেছি। গেটের সামনে বিশাল তোরণ। তোরণ পথে প্রবেশ করলাম কাত্যায়নী মন্দিরের প্রশস্ত অঙ্গনে। অঙ্গনের দুপাশে ফুলের বাগান, অঙ্গনের অপর প্রান্তে নাতিদীর্ঘ একটি নাটমন্দির। নাটমন্দিরটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। পশ্চিম দিকে একটি খড়ের ছাওয়া আটচালা। তার মধ্যস্থলে হোমকুণ্ড। আর নাট মন্দিরের পূর্ব দিকে গর্ভ মন্দির। এই সময় মন্দির খোলা ছিল। আমরা গর্ভমন্দিরের সামনে এসে প্রণাম করলাম। গর্ভগৃহের মধ্যস্থলে একফুট উঁচু মূলবেদীতে মা কাত্যায়নীর অষ্টধাতু নির্মিত দ্বাদশ বাহুযুক্ত সিংহবাহিনী মা মহামায়ার অপূর্ব বিগ্রহ। বিবিধ অলঙ্কার এবং নানা রত্নরাজিতে মায়ের বিগ্রহ সাজানো। তাঁর দক্ষিণ চরণ সিংহের পৃষ্ঠদেশে এবং বাম চরণের বৃদ্ধাঙ্গুলি মহিষাসুরের দক্ষিণ স্কন্ধের উপরে স্থাপিত। চালচিত্রসহ গোটা প্রতিমাটি চার ফুটের মতো উচ্চতা। জগজ্জননী মায়ের অষ্টধাতু নির্মিত বিগ্রহের দ্বাদশ হস্তে দ্বাদশ অস্ত্র। তিনি অসুর নিধনে ব্যস্ত। মূল বেদীর নিচে একটি কাঁচে ঢাকা ছোট্ট প্রকোষ্ঠের মধ্যে একগুচ্ছ প্রস্তরীভূত সিন্ধুর লিপ্ত কেশদাম। পূজারী পূজার সময় এই কাচের ঢাকনা সরিয়ে ওই কেশদামে সিন্দুর ও কুমকুম লাগিয়ে ফুল দিয়ে পূজা অর্চনা করে আবার ঢাকা দিয়ে রেখে দেন। মূলবেদীর উত্তরদিকের কোণে মহাদেব এবং দু'পাশের কুলুঙ্গিতে সূর্য দেবতা, নারায়ন এবং গণেশের বিগ্রহ স্থাপিত। দর্শনার্থীর সংখ্যা কম থাকায় আমরা প্রণাম জানিয়ে বললাম "হংস যুক্ত বিমানস্থে ব্রহ্মাণী রূপধারিনী। কৌশাম্ভ ক্ষরিকে দেবী নারায়নী নমোহস্তুতে"। মন্দিরে প্রণাম জানিয়ে আমরা নাটমন্দিরে এসে কিছুক্ষণ বসলাম। 
                                          পরবর্তী অংশ সপ্তবিংশতি পর্বে…………..

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments