জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (ত্রিপঞ্চাশত্তম পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী- আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত (ত্রিপঞ্চাশত্তম পর্ব) 

শ্রীজিৎ জানা

উঠোনের বাইরে অন্ধকার। ঊমানাথ ঠাকুরের ঘরের ভিতর আলো ছিল। দুধ সাদা আলো। বাইরে ধানসিদ্ধ হাঁড়ির তলায় যেমন কালো রঙ,তেমনই কুচ্ছিত অন্ধকার। লোখার অন্ধকারে বড় ভয়। তার উপরে অচেনা জায়গা। ব্যস্ত হয়ে লোখা মাস্টারকে তাড়া করে,
– লাও দিখি মাস্টার,তাড়াতাড়ি গাড়ি টার্ট দাও। হেটলাইটটা জ্বলু। এত আঁধার মোকে এগদম ভাল লাগেনি।
–আচ্ছা লে, তুই চেপে পড় এবার।ভালই ত ডায়লগ দিলু আজগে স্যারের কাছে।
–তা দিলম এট্টুআদটু। সবসময় কি তমরাই বোলবে। মোকেও ত বোলতে হবে কিছুমিছু। তাই যা মনে এসছিল,বলে দিইচি। ভাল মন্দ বুজিনি।
মোটরসাইকেলের পিছনে বসা লোখা বকে যায়। বাইকের আলো সামনের গাঢ় অন্ধকার চিরে সামনের দিকে ছুটে চলে। চাঁদ খাঁ পীরের নামে চঁদপুর গ্রাম। সেই গ্রাম পেরোলে শিয়ালখালির পোল। আগে নাকি সেখানে ডাকাতের খুব উপদ্রপ ছিল। আজকাল গ্রামগঞ্জে চুরিডাকাতি হয় না। রাত নয়,এখন দিনেদুপুরে ডাকাতি হয়।আগে চুরি ডাকাতির বদনাম বেশিরভাগই বাগদিদের মাথায় উঠত। তখন তো অভাবের সময়। পেটের জ্বালায় বাধ্যও হত চুরি করতে। স্বদেশের উপকারেও চুরি করেছে অনেকে। কিন্তু এখন পড়াশুনা জানা বাবুরা এক েকটা দাগী ডাকাত। পোশাক আশাক,হাবভাবে তাদের চেনা মুশকিল। শিয়ালখালির পোল ডিঙিযে সোজা দক্ষিনে কাঁসাই পাড়ের কল্মীজোড় গ্রাম। ইংরেজদের বাংলো ছিল আগে। অনেকে বাংলাগড়া বলে। কল্মীজোড়ে প্যোড়াদের সিনেমাহল খুব নামকরা ছিল। লোখা সেই সিনেমাহলকে নিয়ে একটা শোলুক শুনেছিল। গাড়িটা বাংলাগড়ার বাঁধে উঠতেই মনে পড়ে যায় সেটা। ঢকর ঢকর ডায়নামা/ পঞ্চু পোড়ার সিনেমা/ ঘনঘন ফিলিম কাটে/ পঞ্চু পোড়ার পঁদ ফাটে। মনে মনে নিজেই হেসে ওঠে লোখা। কাঁসাই পাড় ধরে এগোলে পরের গ্রাম আসবেপাইকান দুর্যোধন গ্রাম। বলে নাকি শোভা সিংহের বংশধর দুর্জ্জয় সিংহের নামে এই গ্রামের এমন নাম। এখানে তাদের পাইক- লেঠেলরা থাকত। পািকান ছাড়িয়ে আরেকটু সামনে এগোলে দাদপুর। সেও নাকি দাউদ খাঁ নামের কোন একজনের নাম থেকে এসেছে। দাদপুরে রবি - বৃহস্পতিবার হাট বসে। কাঁসাইপাড়ের গাঁ- গাঁওলির হাট। লোখাকে জিগ্যেস করলে বোলবে,
– ই হাটকে ত বলে কনেদা- বউড়ির হাট। ঘরের যত মেইয়া বউরা এই হাটেই ভীড় করে পতি হাটবারে।
🍂

হাটের পশ্চিম কোণে ডোমপাড়া। ডোমেদের ব্যান্ডপার্টির দল আছে। ঢাকও বাজায় অনেকে। উত্তরে কুমারপাড়া। হাটবারের আগে মাটির পণে আগুন ধরায় তারা। পাড়ায় ঢুকলে দেখবে সবাই ওই চাক ঘুরাতেি ব্যস্ত। পশ্চিমে রাস্তার ধারে কামারপাড়াও আছে। মধু রাণা নামকরা কামার। তাদের পূর্বপুরুষরা এলাকার বহু কালী মন্দিরে পাঁঠা বলি করে। ঢোলের কালীমন্দিরের কামার তারাই।রাস্তার পাশ দিয়ে গেলে দেখবে ওই হাপর জ্বলছে। আর মধু কামার হাতুড়ি পিটছে। কামার পাড়া ছাড়ালেই পাবে দুলাপাতা। দুলাদের পাড়া। দাদপুরের দুলারা পালকি বইত। জমিদার ডাক্তারদের ঘাড়গে করে নিয়ে যেত। বিয়াবিবাদে তো যেতই। কিন্তু বাগদিদের তারা কখনো পালকিতে চাপায় না। তারা বলে,
– তুই বাগদি, আমি দুলা/কেনে তোদের ঘাড়ে তুলা।
বাগদি পাড়ার কোন কাজেই তারা পালকি ভাড়া দেয় না। ঊমানাথ ঠাকুর বলে, ডুলি যারা বয়,তাদের বলে ডুলিয়া। এই ডুলিয়া থেকেই দুলিয়া, পরে দুলে হয়েছে। দাদপুরের রথ খুব নামকরা ছিল এককালে।সন্তোষী পুজায় রথটানা হত। এখনো হয়। তবে আগের জৌলুস নেই। হাটতলাটা ভারী সুন্দর। একদিকে বুড়ো বটগাছ,পাশে তারচে বুড়ো আসুদগাছ। বট- আসুদের তলায় পসরা নিয়ে বসে হাটুরেরা। এখনো দাদপুরের হাটে ময়রা - মুদি দুজনেই বসে। মাস্টার মোটরসাইকেল থামিয়ে দেয়। লোখা জিগ্যেস করে,
– কি হোলো তমার? গাড়ি থামি দিলে কেনে? আজগে কি তমার ঘর যাবার ইচ্ছা নাই?
–তুইবা আজগে এত হাঁকপাঁক করুঠু কেনে? অন্যদিন ত দমে গেঁজাও! তখন ত ঘরদর কিচ্ছু মনে থাকেনি তোর।
–লাও ঠ্যালা! তুমি ত উল্টা ভাবঠ মোকে। দাঁড়ালে ইখিনে,দাঁড়াও না। রাত হয়ঠে বোলে,বোলিঠি।
— বোস না একটু নদীর পাড়টায়। চা খাবি?
— লাও, থাইলে।
লোখার অনিচ্ছা থাকলেও আপত্তি করে না। ভাবে,এই সুযোগ।যদি মাধুর কথাটা বলা যায় তবে বোলবে।লোখা জানে কথাটা বলা মাত্রই ছটপটিয়ে উঠবে সে। মাস্টারের মনের ভিতরটা না দেখতে পেলেও,বাইরের অবস্থাটা তার দেখা যাবে না। ওই যে কালবৈশাখী ঝড়ে তালহিঁড়ের তালগাছ গুলার মাথাটা যেমন পাগলের মতো মাথা ঝাঁকায়,সেইরকম করবে খগেন মাস্টার। কিন্তু না বললেও,পরে জানতে পারলে তাকে মাস্টার কথা শুনাতে ছাড়বে না। তারচেও বড় কথা কিছু একটা অঘটন হলে নিজেকে সে ক্ষমা করতে পারবে না।লোখা বলে ফেলবে বলেই স্থির করে। কিন্তু কি করে শুরু করবে সে। ভেবে অস্থির হয়। খগেন মাস্টার তখনো হাটতলার সৌন্দর্যে মাতোযারা। তন্ময় হয়ে তাকিয়ে দেখে কংসাবতীর রূপ। বাংলাগড়ার ঘাটে বোরোবাঁধে জল আটকে আছে। কাঁচপার নীলজল টলটল করছে। এরকম একটা জল টলটল করা চোখ তাকে রোজ ডাকে। সেই আহ্বান এত দুর্নিবার, তাকে কোনমতেই এড়াতে পারে না। নদী খগেন মাস্টারের কাছে একটা মোহময়ী নারীর মতন। যার কাছ থেকে দূরে যাওযা যায় কিন্তু ভোলা যায় না। যাকে ছোঁয়া যায় কিন্তু স্পর্শ করা যায় না। যাকে পাওয়া যায় কিন্তু অর্জন করা যায় না। যাকে হারালে অনন্ত সুখ- সম্পদের মাঝে দাঁড়িয়েও নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়।মাস্টারের নিষ্পলক চোখের ভঙ্গিমা দেখে লোখা হতবাক হয়। নদীর বুকের উপর চোখ রাখে সে। কিছুক্ষণ তাকাতেই তাকেও যেন ফুসলে নেই নদীটা। অন্ধকার মেশা জলের উপর ফিনফিনে ঢেউ খেলা করে।পাড়ের গায়ে ছপছপ শব্দে যেন সারিগান গায়। রিনরিন করে ঠান্ডা বাতাস সারা শরীরটাকে শিহরিত করে। লোখার মনে পড়ে,ছোটবেলায় তারা ভাইদল সুড়সুড়ানি দেওয়া খেলত। খুব গরম পড়লে উঠানে তুলসীতলার কাছে তালই বিছিয়ে শুয়ে পড়ত সবাই। এ ওর গায়ে পালক দিয়ে,নয়তো পাঁচ আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিতে হত। এর দশবার তো ওর দশবার। পালকের সুড়সুড়ি পিঠে দেওয়া মাত্রই। সারা গায়ের লোম সব খাড়া হয়ে যেত। এখন যেমন হচ্ছে। জামার ভিতর দিয়েও লোখা অনুভব করে শিহরণ। ভূতে ধরা রুগীর মতো ঘোরেই যেন তার মুখ থেকে কথা বেরোতে থাকে,
—রাতে লদীর রূপ এমন পারা হয়,মেস্টার! অনেকখন তাকি থাকলে চোখে নেশা ধরি দেয়। মনটা যেন কুথা হারি যায়। তখন ঘর দরের কথা কুনু মনে পড়েনি। তমারও কি সেইরকম হয়ঠে। নাকি আমি ভম বোকিঠি।
– এই সময় তোর বাঁশিটা খুব দরকার ছিল রে, লোখো। মনটা খুব ছটপাটাচ্ছিল।
— আজগে তমার কি হইচে বল দিখি মেস্টার। মাঝেমধ্যে তমাকে বুইতে পারিনি। সেই রুপনারানের পাড় থিকে, এই কাঁসাই পাড় অব্দি তমাকে আজগে যত দেখিঠি,শুদুই অবাক হইঠি। কি হইচে তমার মেস্টার?
–তোকে আর কি বোলবো। তুই ত সব জানু। কদিন ধরে মনটা কিছুতেই যেন ভাল নাই। বয়সটা যত বাড়চে,তত যেন বাচ্চাছেনা হই যাইঠি। তিন - চার দিন হোল,মেইছেনাটার কথা কেন জানিবনি শুদুই মনে পড়চে। সেইজন্যে আজকে তোকে নিয়ে মেলাকে গেইলম। যাবনি ভেবেছিলম কুন্তু শেষ অব্দি মনটাকে ধরে রাখতে পাল্লম নি। কেন এরকম হয়ঠে বল দিখি লোখা? মোর কি এখন এরকম করা মানায়? তবু কেন কোরিঠি? তুই মোর সেই ছোটবেলা থিকের বন্ধু। তোকে একটু মনের কথা বোল্লে হাল্কা হই। নাইলে কাকে আর বোলবো বল? ইসব কথা কি কারো কাছে বলা যায়?
লোখা যত শুনে তত অস্থির হয়। চমকে চমকে উঠে। চমকে উঠবারই তো কথা! ওদিকে মাধুর বিপদ। বর তার যে কোন মুহুর্তে মরে যেতে পারে। এদিকে খগেন মাস্টারের মন মাধুর জন্য অস্থির। যাকে যে মন দিয়ে ভালবাসে,তার বিপদের আঁচ আগাম সে জানতে পারে। সত্যিই কি তাহলে এমন হয়। লোখা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। বলে,
– মেস্টার, একটা কথা তোমাকে বোলিনি এখনো অব্দি। ভাবছিলম কালকে বোলবো। কুন্তু না গ,এখনি মোর তমাকে জানানা উচিত।
– কেনে কালকে বোলবি। বল না এখনি। কী কথা? 
— অই মাধু মেইছেনাটারই কথা।
– কেনে কি হোইচে তার? আর হোলেই মোর কি যাচ্চে! সে এখন বড় সনাবালার বউ! বোম্বে ত ভালই আছে শুনি।
– না গ মেস্টার। অই যে মেলায় বেলি কাকির বোনের সঙে দেখা হল,সে বোল্ল।
– কি বোলচে বল দিখি। অত থতমত খাউঠু কেনে। ভাল মন্দ যাই খপর শুনা,মোর কিচ্ছু হবে নি।
– উ তমার মুখের কথা মেস্টার,মনের কথা লয়। জানি তমাকে গ, শুনলে তুমি নিজেকে সামলাতে পারবেনি মোটেই। উ মাসি বোল্লে মাধুর বর আর বাঁচবেনি। এডেস রোগ হইছিল। যে কুনু মুহুত্তে মরণ খপর এসতে পারে।
লোখা কথাগুলো বলে আর মাস্টারের চোখের দিকে চেয়ে থাকে। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পায়না সে তার চোখ মুখের আবভাব। তবে বুঝতে পারে গুম মেরে গেছে সে। যেন হঠাৎ করে শিলাইয়ের পাড় ধসে গেল। যার কোন চিৎকার নেই,আছে গভীর ক্ষত। নদীর পাড় ভাঙার শব্দ যদিও কানে শোনা যায়, চোখে দেখা যায়। কিন্তু মানুষের মনের ভাঙন কেউ শুনতে ও দেখতে পায় না কোনদিন। লোখা কি করবে ভেবে পায় না। মাস্টারকে চুপ মেরে থাকতে দেখে তার চিন্তা হয়। তাকে কথা বলাতে চেয়ে বলে,
– কি গ মেস্টার চুপ মেরে গেলে কেনে? কিছু ত বল।
কথার বদলে একটা দীর্ঘনিশ্বাস আছড়ে পড়ে হাটতলায়। সেই নিঃশ্বাসের শব্দ এক মুহুর্তে যেন কাঁসাই পারের বাতাসকে থামিয়ে দেয়। নদীর ঢেউয়েরা চমকে যায়। আসুদ পাতাদের কলকলানি থেমে যায়। জিনি পোকারা আলো নিভিয়ে দেয়। লোখা ভয় পায়।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments