প্রসূন কাঞ্জিলাল
দীপাবলি উপলক্ষে পঞ্চোৎসব পালন করা হয়।
এগুলি হল যথাক্রমে --
1) ধনত্রয়োদশী বা ধনতেরাস,
2) ভুত-চতুর্দশী,
3) দীপাবলি,
4) গোবর্ধন পূজা ও
5) ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা ।
আশ্বিন মাসের চতুর্দশী তিথিতে অর্থাৎ , দীপান্বিতা কালীপুজোর আগের দিন অনেক বাড়িতেই চোদ্দ শাক খাওয়ার রীতি। কথিত আছে পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার পর ঐ দিনেই নাকি পিতৃপুরুষরা মর্ত্যের কাছাকাছি আসেন। তাঁদের উদ্দেশেই বাড়িতে জ্বালানো হয় চোদ্দ প্রদীপ।
হিন্দুশাস্ত্র মতে, সেই প্রথারই অংশ হিসাবে খাওয়া হয় চোদ্দ শাক। আকাশ, জল, বায়ু, অগ্নি, মাটি— প্রকৃতির এই পাঁচ উপাদানের মধ্যেই ছড়িয়ে রয়েছেন আমাদের পিতৃপুরুষেরা। এই রীতি পালনের মধ্যে দিয়েই তাঁদের ছুঁয়ে থাকা যায়। অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটাতে প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা চোদ্দ রকম শাক জলে ধুয়ে, সেই জল বাড়ির চারদিকে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। সাত পুরুষের উদ্দেশেই বাড়িতে জ্বালানো হয় চোদ্দ প্রদীপ। আমাদের আগের সাত পুরুষকে উৎসর্গ করে, আগামী সাত পুরুষের জন্য খাওয়া হয় এই চোদ্দ শাক। জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, ওল, পুঁই, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, পলতা, শুলকা, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা ও শুষণী। মূলত এই চোদ্দ রকমের শাক রান্না করা হয়।
সব লোকাচারের পিছনেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে। শরতের শেষ এবং হেমন্তের শুরুতে আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। নানা রকম রোগের উপদ্রব বৃদ্ধি পেতে থাকে। জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, ওল, পুঁই, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, পলতা, শুলকা, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা ও শুষণীর মতো শাক ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ। আবার হেমন্তের শুরুতে পোকামাকড়ের উপদ্রব বাড়তে থাকে। পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচতেই বাজি পোড়ানো হয়। বাজির ধোঁয়ায় তারা বেশি ক্ষণ থাকতে পারে না। খাবারে বা চোখ-মুখে পোকা যাতে না হয়, তাই প্রদীপ বা আলো জ্বালানো হয়। অর্থাৎ, পোকা দূরে রাখতেই এ সময়ে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানোর রীতি।
কোন কোন শাকের কী কী গুণ ----
জয়ন্তী—
উদরাময়, জ্বর, বহুমূত্র নিয়ন্ত্রণ করে।
শাঞ্চে—
রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
হিংচে— পিত্তনাশক।
ওল—
অর্শ, রক্ত আমাশা, বাত, চর্মরোগ কমায়।
পুঁই— হজমে সহায়ক।
বেতো— কৃমিনাশক।
সর্ষে—
যকৃৎ, চোখ যত্নে রাখে।
কালকাসুন্দে—
অর্শ, কাশি দূর করে।
নিম—
যে কোনও চর্মরোগ নাশ করে।
পলতা—
শ্বাসযন্ত্র ভাল রাখে।
শুলকা—
হৃদ্যন্ত্র ভাল রাখে।
গুলঞ্চ—
উচ্চ রক্তচাপ, যকৃৎ যত্নে রাখে।
ভাঁটপাতা—
ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক।
শুষণী— স্মৃতিবর্ধক।
গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত ১৪ শাক এবং ১৪ ভুত
যেগুলো ভুত চতুর্দশীর সময় সবার মনে পড়ার কথা ।
আবার অন্যমতে চৌদ্দ শাক-এর নাম হলো --
১) গাঁদামনি,
২) বৌ টুনটুনি,
৩) ক্ষুদে ননী,
৪) সাদা নটে,
৫) রাঙা নটে,
৬) গোয়ালা নটে,
৭) কলমি,
৮) কাঁচড়াদাম কলমি,
৯) পুনর্ণবা,
১০) ছোলার শাক,
১১) মটর শাক,
১২) রাঙা আলুর শাক,
১৩) শান্তি শাক,
১৪) পালং শাক।
আসলে এই চৌদ্দশাক খাওয়ার প্রথাটা হল গ্রাম বাংলায় হেমন্তে সহজলভ্য শাকগুলির স্মৃতিচারণ।
চৌদ্দ ভূত ----
১। মোহিনী-
প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করা মেয়ের আত্মা। সুন্দর ছেলে দেখলেই ঘাড়ে চাপে।
২। শাকচুন্নী-
স্বামীর পরকীয়া দেখে আত্মহত্যা করা মেয়ে। এরা পুরুষ বিদ্বেষী।
৩। শাকিনী -
বিয়ের পর নির্যাতনের ফলে মৃত্যু। সংসার ভেঙ্গে দেওয়ার ভূত।
৪ ডাকিনী -
অকালে মৃত সব মহিলা।
৫। চোরাচুন্নী -
মহিলা চোরের অকাল মৃত্যু। এই ভূত সুযোগ পেলেই চুরি করে। ("তা'লে কি ভূতে নিল" কথাটা এদের জন্যই)
৬। ডাইনি-
সুন্দরী মেয়ে,- যারা সাজসজ্জা, রূপচর্চা ভালোবাসতো- এমন মহিলাদের অকাল মৃত্যুর ভূত ।
৭। ব্রহ্মদৈত্য -
ব্রাহ্মণ ভূত । পুরুষ।
৮। মামদো-
মুসলমান ভূত।
৯। পেঁচাপেঁচি -
ঝগড়া করে রাত জাগা কত্তা-গিন্নিদের ভূত।
১০। নিশি -
ছেলে মেয়ে উভয়েই হয়। তান্ত্রিকদের পোষা । গভীর রাতে এরা কোনো কোনো ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে নিয়ে যায়।
১১। স্কন্ধকাটা -
মুন্ডহীন মৃতদেহ। রেল লাইনে বেশি থাকে।
১২। দৈত্য -
দেড় হাজার কিলোওয়াটের শক্তিশালি ভূত। "সিক্স প্যাক" অকালে মারা গেলে হয়।
১৩। কানাহুলা -
যে মানুষ রাস্তা ভুলে যেতো,- তাদের ভূত।
১৪। আলেয়া -
জলে ডুবে মৃত মানুষের আত্মা।
🍂
কার্তিক মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথি অর্থাত্ কালীপুজোর আগের দিনটি ভূত চতুর্দশী নামে পরিচিত। অনেক জায়গায় এই দিনকে নরক চতুর্দশী বলা হয়ে থাকে। কারণে এই দিনে নরকের দ্বার খুলে দেওয়া হয় বলে প্রচলিত বিশ্বাস। ভূত চতুর্দশীতে ভূত প্রেতে মর্ত্যে ঘোরাফেরা করে বলেও মনে করে অনেকে। সেই কারণে এদিন সন্ধের পর বাইরে বেরোতেও বারণ করা হয়।
ভূত চতুর্দশীতে বাঙালি সমাজে একটি বিশেষ রীতি প্রচলিত রয়েছে। এদিন ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয় ও ১৪ শাক খাওয়া হয়। ১৪ রকমের শাক দিয়ে ভাত খাওয়ার প্রথা প্রচলিত রয়েছে। আর সন্ধের পর বাড়ির বিভিন্ন স্থানে মোট ১৪টি প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে। কিন্তু কেন ১৪ শাক খাওয়ার প্রথা আর কেনই বা এদিন জ্বালানো হয় ১৪ প্রদীপ ? প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে ভূত চতুর্দশীর দিনে কিছু সময়ের জন্য স্বর্গ ও নরকের দ্বার খুলে যায়, তখন আত্মারা মর্ত্যে নেমে আসেন। ভূত-প্রেত নিয়ে এদিন রাজা বলিও মর্ত্যে আসেন বলে মনে করা হয়। এই দিনে অশুভ শক্তির প্রকোপ বৃদ্ধি পায় বলে একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে। এই অশুভ শক্তিকে নিজের বাড়ি থেকে দূরে রাখতেই ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয়ে থাকে। যেহেতু দিনটি চতুর্দশী, তাই ১৪টি প্রদীপই জ্বালানো হয়।
0 Comments