মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৯৬
মন্মথনাথ দাস (গবেষক, শিক্ষক, পটাশপুর)
ভাস্করব্রত পতি
স্কুলে পড়াকালীন ছড়া লিখতেন মনের খেয়ালে। অপটু হাতের আঁকিবুকি দিয়েই তাঁর সাহিত্যের আঙিনায় পদক্ষেপ ফেলার প্রাথমিক প্রচেষ্টা ছিল। সেই কবিতা ছাপাও হয়েছিল 'প্রভাতী' পত্রিকায়। উৎসাহ বেড়েছিল দ্বিগুণ। আগ্রহ জন্মেছিল সৃজনশীল লেখার প্রতি। পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের এক স্বনামধন্য লেখক, গবেষক এবং প্রবন্ধকার। তিনি মন্মথনাথ দাস।
১৯৪২ এর ১৬ ই এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন পটাশপুরের আড়গোয়াল গ্রাম পঞ্চায়েতের মঙ্গলচক গ্রামে। বাবা নিমাইচরণ দাস এবং মা বাসন্তী দাস। ১৯৫৮ তে স্কুল ফাইনাল পাস করে ১৯৬০ এ তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয় থেকে আই এ উত্তীর্ণ হন। ১৯৬২ তে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স এবং ১৯৬৪ তে এম এ ডিগ্রী অর্জন করেন। চকরসুল ইন্দ্রনারায়ন শিক্ষানিকেতনে ১৯৬৪ - ১৯৬৯ পর্যন্ত শিক্ষকতা করার পর ২০০১ পর্যন্ত মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা চালিয়ে যান। একসময় মুগবেড়িয়া ভোলানাথ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ে দুবছর (১৯৭৮-১৯৮০) স্বল্পকালীন অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে (২০০৩-২০০৪) বিদ্যাসাগর প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ হন। এহেন মানুষটি কর্মজীবনে এবিটিএ এবং এসটিইএ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অবসরের পর পূর্ব মেদিনীপুর শিক্ষক শিক্ষাকর্মী পেনসনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত হন। এছাড়াও অসংখ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছেন মেদিনীপুরের এই মানুষ রতনটি।
গবেষক প্রাবন্ধিক মন্মথনাথ দাসের লেখা ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক বইগুলি হল -- 'পুরাকীর্তি তথ্যপঞ্জী : পূর্ব মেদিনীপুর', 'স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস: ভগবানপুর থানা' (১৯৮৮, সহলেখক অধ্যাপক হরিপদ মাইতি), 'আজাদ হিন্দের গল্প' (১৯৯৪), 'বিয়াল্লিশের আগস্ট বিপ্লবে কাঁথি', 'অবিভক্ত কাঁথি মহকুমার ইতিবৃত্ত', 'প্রসঙ্গ: কাঁথি' (২০০৩), 'পটাশপুরের সেকাল একাল', 'ভগবানপুর ও ভূপতিনগর থানার ইতিহাস', 'মেদিনীপুর আঞ্চলিক ইতিহাস গ্রন্থ' (দুই খণ্ড) ইত্যাদি। এগুলি অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অনন্য দলিল হিসেবে বিবেচিত বোদ্ধামহলে। একসময় সাহিত্যিক মৃত্যুঞ্জয় মাইতির উৎসাহ পেয়েছিলেন। সেই উৎসাহ আজ তাঁকেই মেদিনীপুর জেলার অন্যতম গবেষক সাহিত্যিকে পরিশীলিত পরিমার্জিত এবং পরিবর্তিত করে তুলেছে।
আঞ্চলিক ইতিহাস হল স্বদেশ পরিচয়ের যথার্থ চাবিকাঠি। এর মধ্যে ধরা থাকে মাটি আর মানুষের প্রাণের স্পন্দন। তার অগ্রগতির পদচিহ্ন। মেদিনীপুর জেলার এগরা মহকুমার অন্তর্গত একটি ক্ষুদ্র জনপদ পটাশপুরকে নিয়ে মন্মথনাথ দাসের নিবিড় ক্ষেত্র সমীক্ষা 'পটাশপুরের সেকাল একাল'এ ধরা পড়েছে চৈতন্যদেবের শুভাগমন ও তাঁর ধর্ম আন্দোলন, বর্গীর হাঙ্গামা এবং নানা সমরাভিযানকে উপেক্ষা করে সমন্বয়ী সংস্কৃতি চেতনা, স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ শিক্ষা, সাহিত্য, সমবায়, কৃষিকর্ম ও শিল্পের বিবরণ ইত্যাদি। এছাড়াও মুগবেড়িয়া ভগবানপুর ও ভূপতিনগর জনপদের সামগ্রিক ইতিবৃত্ত তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর 'ভগবানপুর ও ভূপতিনগর থানার ইতিহাস', বইতে। প্রাচীন হিজলী রাজ্য তথা কাজলাগড়ের সুজামুঠা রাজবংশ ও বর্ধমান রাজ এস্টেট, কিশোরগড়ের মাজনামুঠা রাজপরিবার, গ্রামের তালিকা ও গ্রামনামের ইতিহাস সন্ধান, ধর্ম কর্ম মেলা মন্দির মসজিদ, উনিশ বিশ শতকের নন্দ ও হাজরা জমিদারি, জনসংখ্যা ও জনগোষ্ঠী, চতুষ্পাঠী ও স্কুল কলেজের শিক্ষা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাম আন্দোলন, সমবায় ও মুগবেড়িয়া ব্যাঙ্ক, চিকিৎসা পরিষেবা, সাহিত্য, পত্র পত্রিকা, খেলাধূলা, নাচ গান যাত্রা থিয়েটার নিয়ে নিবিড় ক্ষেত্র সমীক্ষা তিনি করেছেন একজন তন্নিষ্ঠ গবেষকের চোখ দিয়ে। 'বিয়াল্লিশের আগস্ট বিপ্লবে কাঁথি' বইটিতে তিনি লিখেছেন, 'মেদিনীপুর জেলার গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে অনেক বড়ো মাপের বই আছে। বাংলা, ইংরেজি উভয় ভাষায়। বহুমুখী বিশ্লেষণ, অজস্র পাদটীকা, নানা সারণি-পরিসংখ্যানে সমৃদ্ধ সেই সকল বই সবার হাতে পৌঁছতে পারে না। সেজন্য আগ্রহ সত্ত্বেও জেলার স্বাধীনতা সংগ্রাম সবার জানা হয়ে উঠে না। তেমন সাধারণ পাঠক সমাজের কথা ভেবে এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বইয়ের পরিকল্পনা'। আসলে আঞ্চলিক ইতিহাস, বিশেষত মেদিনীপুর জেলার গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে মন্মথনাথ দাসের চর্চা রীতিমতো উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে একটি। 'দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ', 'মুক্তিযুদ্ধে মেদিনীপুর' প্রভৃতি কয়েকটি বই সেই চর্চার ফসল। পরবর্তীতে কাঁথি মহকুমার স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। বসন্তকুমার দাস রচিত 'স্বাধীনতা সংগ্রামে মেদিনীপুর' ১ম ও ২য় খণ্ড এবং ডা. রাসবিহারী পাল ও অধ্যাপক হরিপদ মাইতি রচিত এর ৩য় খণ্ড গ্রন্থগুলিতে জেলার সামগ্রিক ক্ষেত্রের সঙ্গে কাঁথির সংগ্রাম বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ হলেও কাঁথি মহকুমার সংগ্রাম বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র বইয়ের প্রকাশ আবশ্যিক মনে হয়েছিল তাঁর। এই বইগুলি পুনর্মুদ্রণ না হওয়ায় ক্রমশঃ তা দুর্লভ হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রভিত্তিক স্বতন্ত্র বই অনুরাগীদের বেশি আকৃষ্ট করে থাকে। এমতবস্থায় তিনি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন বইটি।
মন্মথনাথ দাসের প্রথম কাব্য হল 'পৈতে কিংবা কুরুশ কিংবা' (১৯৮৩)। ১৩৭৬ থেকে সম্পাদনা করেছেন 'মহুয়া', যা পরবর্তীতে নাম হয় 'মালঞ্চ'। ১৯৭৫ থেকে সম্পাদনা করেছেন সন্ধানী এবং ১৯৮৪ থেকে 'মাটির আঁচল'। অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। 'পায়ে পায়ে হাঁটি' (২০০৫) তাঁর একটি কবিতার বই। লিখেছেন জীবনীগ্রন্থ 'দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ' (১৯৮১), আমাদের মাস্টার মশাই (১৯৯৮), স্বামী জগদীশ্বরানন্দ (২০০২), মেদিনীপুর চরিতাভিধান (২০০৭, তিনটি খণ্ড) ইত্যাদি। এছাড়া ডাঃ রাসবিহারী পাল জন্মশতবার্ষিকী ও বলাইলাল দাস মহাপাত্র জন্মশতবার্ষিকী স্মারক পত্র ফোল্ডার, কাঁথির বুকে লবণ সত্যাগ্রহ তথা আইন অমান্যের পঁচাত্তর বছর পূর্তি উদযাপন স্মারক পত্র ফোল্ডার, আগস্ট বিপ্লব উদযাপন স্মারক পত্র ফোল্ডার নির্মাণে তিনি ছিলেন অগ্রণী সেনানী। বেশ কয়েকটি গল্পও লিখেছেন -- 'পরিধি সঙ্কীর্ণতর' (১৩৯৫), জীবনের আর এক নাম সূর্য (২০০১), বিভা জিৎ (২০০৮) ইত্যাদি।পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের জন্য 'নবতর বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা', 'দেশ বিদেশের গল্প কথা', উচ্চ মাধ্যমিকের প্রবন্ধ সমৃদ্ধ 'চতুর্মুখ' পাঠ্যপুস্তক ও উপহার দিয়েছেন পড়ুয়াদের। স্বাধীনতা সংগ্রাম ভিত্তিক গীতি আলেখ্য 'স্বর্গ আমার আমাদের দেশ: পটাশপুর' (১৯৮৯), স্বর্গ আমার দেশ: ভগবানপুর থানা, বিষয়: মণ্ডল কমিশন (১৯৯০), নেতাজীর আহ্বান (১৯৯৭), চিরজীবী বিদ্যাসাগর (২০০৪), শতাব্দীর গোধূলি বেলায় (১৪০০) নামের পুস্তিকাও লিখেছেন।
মেদিনীপুরের গর্ব মন্মথনাথ দাস সম্পাদিত গ্রন্থ ও স্মারক গ্রন্থগুলি হল -- ঈশ্বরচন্দ্র প্রামাণিক: চিত্রময় একটি উজ্জ্বল জীবন (২০০২), 'অনির্বাণ' (১৯৯৭, পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দ মহোদয়ের প্রথম প্রয়াণ বার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ), 'মন্বন্তর ও একটি সংগ্রামী জীবন' (১৯৯৫, সমাজসেবী শ্রীজন্মেজয় ওঝা সম্বর্ধনা স্মারক গ্রন্থ, ডাঃ নৃপেন্দ্রনাথ জানা সম্বর্ধনা স্মারক গ্রন্থ (১৯৯৬), 'বাণীমালা' (১৯৯২), 'স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব স্মরণিকা' (কাঁথি, ১৯৯৮), 'প্রাণবন্ত প্রবোধ কুমার' (২০০৮), 'প্রধান শিক্ষক তারাপদ মাইতি প্রয়াণে স্মরণ শ্রদ্ধাঞ্জলি' (২০০৯), 'জীবন সাধক ডাঃ নৃপেন্দ্রনাথ জানা', 'মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর হাইস্কল প্লাটিনাম জয়ন্তী স্মারক গ্রন্থ' (১৯৮৮), জব্দা বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারক গ্রন্থ (২০০২) ইত্যাদি। দাস সম্পাদিত গ্রন্থ ও স্মারক গ্রন্থগুলি হল -- ঈশ্বরচন্দ্র প্রামাণিক: চিত্রময় একটি উজ্জ্বল জীবন (২০০২), 'অনির্বাণ' (১৯৯৭, পণ্ডিতপ্রবর জ্যোতির্ময় নন্দ মহোদয়ের প্রথম প্রয়াণ বার্ষিকী স্মারক গ্রন্থ), 'মন্বন্তর ও একটি সংগ্রামী জীবন' (১৯৯৫, সমাজসেবী শ্রীজন্মেজয় ওঝা সম্বর্ধনা স্মারক গ্রন্থ, ডাঃ নৃপেন্দ্রনাথ জানা সম্বর্ধনা স্মারক গ্রন্থ (১৯৯৬), 'বাণীমালা' (১৯৯২), 'স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব স্মরণিকা' (কাঁথি, ১৯৯৮), 'প্রাণবন্ত প্রবোধ কুমার' (২০০৮), 'প্রধান শিক্ষক তারাপদ মাইতি প্রয়াণে স্মরণ শ্রদ্ধাঞ্জলি' (২০০৯), 'জীবন সাধক ডাঃ নৃপেন্দ্রনাথ জানা', 'মুগবেড়িয়া গঙ্গাধর হাইস্কল প্লাটিনাম জয়ন্তী স্মারক গ্রন্থ' (১৯৮৮), জব্দা বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ সুবর্ণ জয়ন্তী স্মারক গ্রন্থ (২০০২) ইত্যাদি।
তিনি তাঁর কাজের গুনে সংবর্ধনা পেয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রেস ক্লাব (২০০৮), কাঁথির আন্তরিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (২০০১), ভগবানপুরের সিমুলিয়া মাঙ্গলিকী, পটাশপুরের রেনবো অ্যাথলেটিক ক্লাব, রামনগরের রজনীকান্ত স্মৃতি জ্ঞানমন্দির ও সংগ্রহশালা (২০০৪), এগরার সবুজ সংঘ গ্রামীণ পাঠাগার (২০০৫), সুতাহাটার মাধ্যমিক শিক্ষক শিক্ষা কর্মী সমিতি, তমলুকের জেলা গনতান্ত্রিক আইনজীবী সম্মেলন এবং ভূপতিনগরের রজনীকান্ত পাঠাগার (২০০২) থেকে। এছাড়াও পেয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের বুনিয়াদী সাহিত্য প্রতিযোগিতা পুরস্কার (১৯৭৩-৭৪), অখণ্ড মেদিনীপুর জেলা বইমেলা সাহিত্য সম্মান (২০০২), কাঁথি বইমেলা সাহিত্য সম্মান (২০০১), মেদিনীপুর জেলা শিক্ষক সম্মান (২০০১), ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র স্মারক সম্মান (২০০৭) ইত্যাদি সম্মাননা।
মেদিনীপুর আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের অন্যতম প্রাণপুরুষ এই মানুষটি আজ এই বয়সেও সমানভাবে সচল রেখেছেন তাঁর কলমের কালি খরচের প্রক্রিয়া। অসাধারণ জ্ঞানের এই মানুষটি আজ মেদিনীপুর জেলার অনালোকিত অনালোচিত এবং অনাবিষ্কৃত ইতিহাসকে আলোয় তুলে ধরতে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে হাল ধরেছেন বলা যায়।
🍂
0 Comments