জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতেপ্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
প্রথম ভাগ - বৃন্দাবন পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী        

বৃন্দাবনের দোল 
    
চতুবিংশতি পর্ব

সুলতান মাহমুদের ধ্বংসলীলার পরে গোকুল মহাবনের ধার্মিক ব্যক্তিরা সুদৃশ্য স্তম্ভ যুক্ত কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা মন্দিরগুলি ভেঙে এই সমস্ত মন্দিরের আশিটি স্তম্ভ নিয়ে মসজিদ নির্মাণ করে। পরবর্তীকালে এই মসজিদের স্তম্ভগুলি তুলে নিয়ে নতুন করে যে নন্দ ভবন নির্মিত হয় সেটিকেই চৌরাশিখাম্বা বলা হয়েছে। এই চৌরাশিখাম্বা দেখতে দরবার কক্ষের ন্যায় একটি বিরাট হলঘর। চার সারিতে চুরাশিটি স্তম্ভের চতুর্দিকে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার রঙিন ছবি আছে। মন্দিরের দুটি অংশ- নাট মন্দির ও গর্ভ মন্দির। এখানেই যোগমায়ার ও বলরামের জন্মস্থান। একে একে রোহিনী প্রাসাদ, শ্যামলালা মন্দির, মা দুর্গার মন্দির সব দেখার পরে গেলাম সামনে যমুনার তীরে ব্রহ্মাণ্ডঘাট দেখতে। প্রবাদ এখানেই শিশু কৃষ্ণ মা যশোদাকে তার মুখগহ্বরের ভিতরে বিশ্বরূপ দর্শন করিয়েছিলেন। সেই প্রসঙ্গে সামান্য আলোকপাত করছি। একদিন খেলার পরে বলরাম, শ্রীদাম, সুদাম প্রভৃতি গোপ বালকেরা শিশুকৃষ্ণকে মা যশোদার কাছে নিয়ে এসে বললেন " মা, কানাইয়া আজ মাটি খেয়েছে"। এই কথা শুনে কানাইয়া বললেন "না মা, আমি মাটি খাইনি"। মা যশোদা তখন কপট রাগত স্বরে বললেন "কানাইয়া তুমি হাঁ করো, দেখি তোমার মুখের ভিতরে কতখানি মাটি আছে" কানাইয়া বললেন "না মা, আমি মাটি খাইনি"। মা যশোদা বললেন "ঠিক আছে, তুমি মুখ খোলো"। এই কথা বলার পরে কানাইয়া যখন হাঁ করে মাকে মুখের ভেতর দেখাতে গেলেন তখন মা যশোদা দেখলেন সেখানে মাটির পরিবর্তে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড লাট্টুর মত ঘুরছে। এই দৃশ্য দেখে মা যশোদা মনে মনে কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন আর বললেন 'বহু জন্মের পূণ্য ফলে আমি তোমাকে পেয়েছি বাছা'। গোকুলের অন্যতম দর্শনীয় তীর্থস্থান ব্রহ্মাণ্ডঘাটের সামনে কয়েকটি তেতুল ও কদম্ব গাছ আছে। যমুনার তীর রেলিং দিয়ে ঘেরা। ব্রহ্মাণ্ডবিহারীজীর মন্দিরে কোন মূর্তি নাই পরিবর্তে রয়েছে মা যশোদা ও বাল গোপালের একটি ছবি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে শিশু কৃষ্ণ মাটিতে বসে আছেন এবং বলরাম, দাম, সুদাম ও মা যশোদা দাঁড়িয়ে আছেন। যমুনা তীরের মাটি এখানে ব্রহ্মাণ্ড মাটি বলে বিক্রি হচ্ছে। আমিও এক প্যাকেট মাটি কিনলাম কারণ বৃন্দাবনে আসার পরে আমার এক কনিষ্ঠ সহকর্মী ফোনে ব্রহ্মাণ্ড মাটি নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।       
🍂
        
এই নতুন গোকুলের শ্রীবৃদ্ধি হয় ১৪৭৯ থেকে ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দের সময়ের মধ্যে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের পুষ্টি মার্গের প্রবক্তা আচার্য বল্লভাচার্যের সময়ে। এঁদের প্রধান কর্মকেন্দ্র এই নতুন গোকুলে আর পুরাতন গোকুল বা গোকুল মহাবন গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থ। নতুন গোকুল যমুনার বাম তীরে। বল্লভাচার্যের অনুগামী বৈষ্ণবদের মতে নতুন গোকুল হল আদি গোকুল আর গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের মতে গোকুল মহাবনই হচ্ছে নন্দ রাজা ও মা যশোদার প্রকৃত গোকুল। দুই সম্প্রদায়ের এই ভেদাভেদ দূরে রেখে আমরা গোকুল মহাবন এবং নতুন গোকুল দু জায়গারই তীর্থ মন্দিরগুলি দর্শন করলাম। 
এখান থেকে আমরা পরবর্তী গন্তব্যস্থল গোবর্ধনের উদ্দেশ্যে চললাম। গোবর্ধনের কাহিনীটি এই রূপ। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অষ্টম বৎসর বয়সে শরৎকালের শেষ দিকে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে গোবর্ধন ধারণ লীলা করেছেন। ইন্দ্র পূজার পরিবর্তে তিনি গোবর্ধন পূজার প্রবর্তন করেন আর সেই কারণে দেবরাজ ইন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রজভূমি ধ্বংস করার জন্য প্রবল বৃষ্টিপাত, প্রচন্ড ঝড় ঝাপটা ও বজ্রপাত করতে উদ্যত হলে শ্রীকৃষ্ণ বাম হাতের তালুতে গোবর্ধন পর্বত ধারণ করে তার নিচে ব্রজবাসী গো-গোপ-গোপিনীদের আশ্রয় প্রদান করে তাদের রক্ষা করেন এবং ইন্দ্রের দর্প চূর্ণ করেন। এই গোবর্ধন পর্বতে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গোপ বালকদের সঙ্গে নানাস্থলে নানা ক্রীড়া করেছেন এবং সেই সব স্থল মহাতীর্থ রূপে পরিণত হয়েছে। গোবর্ধন পর্বতের যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বালকদের সঙ্গে ক্রীড়া করতে করতে চোখ ঢেকে লুকিয়ে ছিলেন সেই স্থানটি লৌকিক তীর্থ নামে বিখ্যাত। গোবর্ধন পর্বতে অবস্থিত কদম্ব খন্ড তীর্থটি শ্রীকৃষ্ণের নানা লীলার সাক্ষীস্থল। যে স্থলে শ্রীরাধার সঙ্গে নানা রকম শৃঙ্গার ও রসবিলাস করেছিলেন সেই স্থলটি শৃঙ্গার মন্ডল নামে বিখ্যাত। যে মূর্তিতে বালক কৃষ্ণ গোবর্ধনগিরি ধারণ করেছিলেন শৃঙ্গার মন্ডলে তাঁর সেই মূর্তি এখনো রয়েছে, তবে তা অপ্রকট। গর্গসংহিতায় দেবর্ষি নারদ বলেছেন কলির প্রথম ভাগে গোবর্ধন গুহা থেকে গিরিধারীর সেই স্বতসিদ্ধ মূর্তি প্রকট হয়ে সকলের দৃষ্টিগোচর হবেন।     
গোবর্ধন পর্বত নিয়ে গিরিধারীর এ যুগের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের আদি গুরু শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরী যে সময়ে শ্রী বৃন্দাবন দর্শনে গিয়েছিলেন সেই সময় তিনি একদিন গোবর্ধন পর্বত পরিক্রমা করেন ও গোবিন্দ কুন্ডে স্নান করে শ্রান্ত, ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে এক গাছের তলায় এসে বসেছিলেন। একটু পরে এক গোপ বালক একপাত্র গরম দুধ এনে মাধবেন্দ্রপুরীকে তা পান করতে বলে। শ্রান্ত, ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত মাধবেন্দ্রপুরী আনন্দে সেই দুধ পান করলেন। বালকটি সেখান থেকে চলে যাবার পরে মাধবেন্দ্রপুরী সেই গাছ তলায় বসে হরিনাম করতে করতে রাত্রে স্বপ্নে দেখলেন যে বালকটি তাঁকে দুধ খেতে দিয়েছিল সেই বালকটি তাঁর কাছে এসে তাঁর হাত ধরে তাঁকে নিয়ে একটু দূরে গাছ ও পাথরে ঢাকা একটি নির্জন কুঞ্জ দেখিয়ে বলল "শোন, আমি এই কুঞ্জে বহুদিন হলো বাস করছি। শীত বৃষ্টি রোদ্র তাপে আমার খুবই কষ্ট হয়। তুমি আমাকে এই কুঞ্জ থেকে উদ্ধার করে এই পর্বতের উপরে একটি মন্দির নির্মাণ করে সেখানে আমাকে স্থাপন কর। স্থাপন করার পূর্বে আমাকে ঠান্ডা জলে স্নান করাবে। আমি বহুদিন থেকে তোমার আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করছি"। মাধবেন্দ্রপুরী স্বপ্ন থেকে উত্থিত হয়ে পরের দিন প্রাতঃকালে স্নান করে গোবর্ধনের পাশের গ্রামে গিয়ে করুণাসিন্ধু গোবর্ধনধারীর এই কৃপার মহিমা প্রচার করলেন। গ্রামের লোকজনদের ডেকে সেই স্থানের গাছ কেটে পাথর, মাটি সরিয়ে গুহার ভেতর থেকে ঘাস ও মাটিতে ঢাকা ভগবানের শ্রীমূর্তি বের করলেন। তারপরে স্বপ্নে যেভাবে জেনেছিলেন সেই ভাবে সেই শ্রীমূর্তি পর্বতের উপরে মন্দির নির্মাণ করে পাথরের সিংহাসনে স্থাপন করেন। গ্রামবাসী ভক্তদের সক্রিয় সাহায্যে মাধবেন্দ্রপুরী এই শ্রীমূর্তির মহাস্নান সমাপন করে নানাবিধ ভোগ নিবেদন করলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই শ্রীমূর্তি এখন আর গোবর্ধন পর্বতের সেই মন্দিরে নেই। বল্লভাচার্য সম্প্রদায়ভুক্ত বৈষ্ণবগণ সেই মূর্তি গোবর্ধন পর্বত থেকে নিয়ে গিয়ে রাজস্থানের নাথদ্বারে তাঁকে স্থাপন করেছেন এবং আজও মহাসমারোহে তাঁর সেবা করে চলেছেন। এখানে উল্লেখ করা সমীচীন হবে ২০০১ সালে রাজস্থান ভ্রমণ কালে আমরা সেই শ্রীমূর্তি নাথদ্বারে দর্শন করে এসেছি। গোবর্ধন পর্বতের শ্রীমূর্তিকে দেবদমন ও শ্রীনাথ বলে বৈষ্ণবগণ অভিহিত করে থাকেন। ভারতের চারিদিকে যেমন নারায়ন চার মূর্তিতে বিরাজিত তেমনি গোবর্ধন পর্বতেও তিনি শ্রীনাথ রূপে বিরাজিত।                               
পাশে গোবর্ধনের একটি মন্দির আছে এবং অন্যটি মূল রাস্তা থেকে গলিপথে প্রায় এক কিলোমিটার যাবার পরে মানসীগঙ্গার তীরে। দু' জায়গাতে একইরূপ মূর্তি। এই মানসীগঙ্গার তীরে মন্দিরে দেখতে পেলাম বালক কৃষ্ণ বামহস্তের করতলে গোবর্ধন পর্বতকে ধারন করে আছেন। মনে হলো মানসীগঙ্গার তীরের মন্দিরটি আদি মন্দির। রাস্তার ধারের মন্দিরটি পরবর্তীকালে নির্মিত হয়েছে। গর্গসংহিতায় বলা হয়েছে মানসীগঙ্গা গোবর্ধনের চোখ, চন্দ্রসরোবর নাক, গোবিন্দকুণ্ড ঠোঁট আর কৃষ্ণকুণ্ড তাঁর চোখ। আমরা কেবলমাত্র মানসীগঙ্গার তীরে গোবর্ধন মন্দির দর্শন করে ফিরে এলাম। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল শ্যামকুণ্ড, রাধা কুণ্ড ও ললিতা কুণ্ড।
                                          পরবর্তী অংশ পঞ্চবিংশতি পর্বে…………..

Post a Comment

0 Comments