জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—লিবিয়া (আফ্রিকা) রাজামশাইর রাতের ঘুম /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প—লিবিয়া (আফ্রিকা) 
রাজামশাইর রাতের ঘুম 
চিন্ময় দাশ

ভূমধ্য সাগরের তীরের এক দেশ লিবিয়া। অনেক দিন আগের কথা। লিবিয়ার একজন রাজা ছিলেন, বেশ গুণগ্রাহী মানুষ। রাজ্যের বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষের ভীড় হোত তাঁর দরবারে। 
লেখক, কবি, গাইয়ে—কত দূর দূর থেকে কতজনই না আসেন তাঁর সভায়, তার লেখাজোখা নাই। রাজা তাঁদের কথকতা শোনেন। কবিতা শোনেন। গান শোনেন। গুণী মানুষদের ভারি কদর করেন রাজামশাই।
তবে, দরবারে একজনই আছে, যে মানুষটি রাজার সবচেয়ে প্রিয়। তার নাম হোল মহম্মদ। ভালো ভোজবাজি জানে সে। সুর করে কৌতুক শোনাতে ওস্তাদ। এমনকি, নাচও দেখাতে পারে মহম্মদ। রাজাকে হাসিখুশি রাখাই তার কাজ। দরবারের অন্যরা ‘রাজামশাইর বয়স্য’ বলে থাকে তাকে।
মহম্মদের একটি ব্যাপার রাজার ভারি অপছন্দ। ভারি পেটুক সে। সকাল হওয়া থেকে রাত পর্যন্ত একটাই কাজ তার—খাওয়া। খাচ্ছে, তো কেবল খেয়েই যাচ্ছে। তাকে নিয়ে রাজামশাইর একটাই ভয়। এমনটা চললে তো, কোন দিন খেয়ে খেয়েই না মারা পড়ে।
একদিন দরবারের সব মন্ত্রী, রসুইখানার বাবুর্চি, কাজের লোক, সবাইকে জড়ো করে বলে দিলেন—যা বলি, মন দিয়ে শোন সবাই। আগামিকাল যেন মহম্মদকে কোন খাবার না দেওয়া হয়। রুটি-মাংস, ফল-মূল, এমনকি কোন রকম পানীয়—কিছুই দেবে না কেউ। এক টুকরো রুটিও না। কাল খাবার সময়, আমার টেবিলে আসনও থাকবে না মহম্মদের। কথাটা মনে থাকে যেন সবার।
মন্ত্রীরা বলে উঠল—ঠিক বলেছেন আপনি। বড্ড বেশি মোটা হয়ে যাচ্ছে ও।
পরের দিন। ভোজের আসর বসেছে। মহম্মদ এসে দেখল, টেবিল ভর্তি। একটা চেয়ারও খালি নেই। ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকাল মহম্মদ। একটা জিনিষ চোখে পড়ল, কেউ তাকিয়ে দেখছেও না তার দিকে। 
অগত্যা, কী আর করে? একটা দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। নিশ্চয়ই খানসামারা তার খাবার নিয়ে আসবে। অপেক্ষা করে রইল মহম্মদ।
কিন্তু তেমনটা ঘটছে না। খানসামার দল আসছে। চলেও যাচ্ছে তার পাশ দিয়ে। কিন্তু সামনে খাবার নিয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো কেউ! কিন্তু কাউকে খাবার চাইছে না মহম্মদ। চাইবে কী করে? রাজামশাইর নিশ্চয় রাগ হয়েছে তার উপর! 
একথা ভাবতে গিয়ে, বুকটা ধড়াশ করে উঠল। যার উপর রাজামশাইর রাগ হবে, তাকে আল্লাতালাও বাঁচাতে পারবেন না। তার মৃত্যু নিশ্চিত। 
এদিকে খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ। সামনে সবাই আয়েস করে চেটেপুটে খেয়ে যাছে। চোখে মুখে কষ্টের ছাপ ফুটে উঠেছে। সেসময়ই এক খানসামা, খাবার নিয়ে যাওয়ার সময়, খুব সাবধানে এক টুকরো রূটি ফেলে দিয়ে গেল তার সামনে। মহম্মদও আরও সাবধানে টুক করে কুড়িয়ে নিল টুকরোটা। 
মনে ভাবল, গোপনে খেয়ে নিতে হবে রূটিটা। রাজামশাইর চোখে যেন না পড়ে যায়। 
ভোজ শেষ হোল। এবার গান-গল্পের আসর শুরু হয়েছে। কবির দল কবিতা পড়ছে। বাদ্যকররা বাজাচ্ছে নানান বাজনা। নর্তকীর দলের নাচ চলছে। মন দিয়ে দেখছে শুনছে সবাই। 
🍂

মহম্মদের চোখে মুখে একটু আলো ফুটে উঠল। রাজামশাই এখন নাচ-গানে মশগুল। এদিকে চোখ নাই। এই সময় রুটিটা খেয়ে ফেলি।
কিন্তু রাজার চোখ তো সারাটা সময় মহম্মদকেই নজরে রেখেছে। মহম্মদ সবে পকেট থেকে রুটিটা বের করেছে, কামড় বসাবে বলে। রাজামশাই বলে উঠলেন—মেয়েরা, একটু থামাও তোমাদের গান। একটা জরুরী কথা সেরে নিই মহম্মদের সাথে। 
মহম্মদের হাত তড়িঘড়ি পকেটে। বুক ঢিপঢিপ। এবার তাহলে, মৃত্যুদণ্ড উচারণ করবেন রাজামশাই। রাজামশাই বললেন- মহম্মদ, একটু এদিকে এসো।
কাঁপতে কাঁপতে রাজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মহম্মদ। -- তোমার একটা সুন্দর গাধা আছে শুনলাম। রাজামশাই বললেন—তা, কোথায় পেলে গাধাটাকে? 
--ত্রিপোলি গিয়েছিলাম তো। সেখানে হাট থেকে কিনেছি। 
--ওহ, আচ্ছা। ঠিক আছে।
আবার নাচ-গানের আসর শুরু হোল। বাজনদাররা বাজাচ্ছে। মেয়েরা নাচ শুরু করেছে। মহম্মদ ভাবল—বড় জোর বেঁচে গেছি। ফাঁড়া কেটেছে। এবার রুটিটা মুখে দেওয়া যেতে পারে। এই ভেবে, পকেট থেকে রুটিটা বের করেছে। অমনি রাজামশাই তাকে আবার ডেকে পাঠালেন। আবার রুটির টুকরোটা মহম্মদের হাত বেয়ে, সুড়ুৎ করে পকেটে চালান হয়ে গেল। 
--আচ্ছা, মহম্মদ! ত্রিপোলিতে গাধাটা কত দামে কিনেছিলে তুমি?
মহম্মদ বলল—গুণে গুণে ষোলটা দিনার দিতে হয়েছিল, হুজুর। একটুও কম নিল না। 
--ওহ, আচ্ছা। এখন যাও।
রাজামশাই এইভাবেই এটা ওটা প্রশ্ন করেই যেতে লাগলেন। যেই না মহম্মদ পকেট থেকে রুটির টুকরোটা বের করে, অমনি রাজামশাই একটা প্রশ্ন করে বসেন। একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতেই লাগল নাটকটা। 
রাত নামতে, আবার ভোজসভা বসল। আবার চেয়ার ফাঁকা নাই মহম্মদের জন্য। 
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ নাই কোত্থাও। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে, সোজা রসুইখাখানায় গিয়ে হাজির হল মহম্মদ। কিন্তু তার কপাল মন্দ। সেদিনই রসুইঘরে তালা লাগানো। এমনটা তো কোন দিনই হয় না! 
অগত্যা পকেটের রুটির ছোট্ট টুকরোটা চিবিয়ে, শুয়ে পড়ল বেচারা। কিন্তু পেটে তো ছুঁচোর কেত্তন চলেছে তখন। পেটের কী দোষ? সারাটা দিন কিছুই পড়েনি পেটে।
রাজামশাই তার উপর রাগ করেননি, এটা মহম্মদ বুঝে গিয়েছে। এখন খিদের জ্বালায় মরীয়া হয়ে উঠল বেচারা। একটা ফন্দী এল মাথায়। বিছানা ছেড়ে, সোজা রাজামশাইর শোবার ঘরে দরজায় গিয়ে হাজির হোল। 
টক-টক, টক-টক টোকা পড়ল দরজায়। রাজামশাই বিরক্ত হয়ে বললেন—কে রে? এত রাতে দরজায় টোকা কেন? 
মহম্মদ বলল—আমি মহম্মদ, হুজুর। বেদম একটা ভুল হয়ে গেছে আমার। গাধাটা কোথায় পেলাম, আপনি জানতে চেয়েছিলেন না। তাড়াহুড়োয় ভুল বলে ফেলেছি আমি। ত্রিপোলিতে নয় তো। বেনঘাজি থেকে কিনেছিলাম ওটা। 
ভিতর থেকে আওয়াজ হোল—বাহ, বেশ ভালো কথা। এখন যাও এখান থেকে।
রাজার কথা শুনে চলে তো এলো। কিন্তু পেটের কথাটা তো শুনতেই হবে। খালি পেটে ঘুম আসছে না চোখে। আবার বিছানা ছেড়ে উঠল মহম্মদ। আবার রাজার দরজায় টোকা—টক-টক, টক-টক। 
কাঁচা ঘুম আবার চটকে গেল রাজামশাইর। ভিতর থেকে হেঁকে উঠলেন—আবার কে রে দরজায়? 
--আজ্ঞে, আমি মহম্মদ। বিকেল বেলা আরও একটা ভুল কথা বলা হয়ে গেছে আপনাকে।
রাজামশাই বললেন—কী কথা?
 --ঐ যে গাধার দাম জানতে চাইলেন আপনি। আমি বলেছি ষোল দিনার দাম লেগেছে। সেটা ঠিক নয়। পাক্কা কুড়ি দিনার দাম নিয়েছিল আমার থেকে।
রাজামশাই গর্জে উঠলেন—তবে রে, হতভাগা! তখন থেকে এই এক গাধার ছেঁদো গল্প বলে বলে আমার ঘুমের বারোটা বাজাতে লেগেছিস? দেখাচ্ছি মজা তোকে। কাল দরবারে আসবি। নিজের হাতে মুণ্ডু কাটবো তোর। তারপর শেয়ালদের ডেকে খাওয়াবো তোর শরীরটা।
গলা তো নয় রাজার, যেন বাঘের গর্জন! কিন্তু এবার তাতে ঘাবড়াল না মহম্মদ। বলল—আজ্ঞে হ্যাঁ, সেটা যে হবেই, তা আমি ভালো করেই জানি। তো, বলছি কী, মারা পড়বার আগে, আমার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করে দেবেন না আপনি? 
রাজা গর্জে উঠলেন—কী তোর শেষ ইচ্ছা? বলে ফেল তাড়াতাড়ি। 
মহম্মদ বলল—রাতের খাবারটা পেট ভরে খেতে চাই। 
বুঝতে কিছুই বাকি রইল না রাজামশাইর। বিকট একটা হাসি হেসে উঠলেন। ঘরবাড়ি ভেঙে পড়বার সামিল হোল হাসির চোটে। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন রাজামশাই। খানসামাদের ডাক পড়ল সেই মাঝরাতে। থালা ভর্তি খাবার সাজানো হোল মহম্মদের জন্য।। 
রাজামশাই নিজে টেবিলে বসে থাকলেন। ভারি যত্ন করে খাওয়ালেন মহম্মদকে। বাকি রাতটা হাসি-ঠাট্টা, গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দিলেন দুজনে। 
সেদিন থেকে মহম্মদের খাওয়ার উপর কোন বিধিনিষেধ নাই রাজামশাইর। মহম্মদও আর বেয়াদপি করে না। কোনদিন দরজায় টোকা মেরে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দেয় না তাঁর।

Post a Comment

0 Comments