জ্বলদর্চি

বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস /দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস

দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

যক্ষ্মা একটি সংক্রামক মারণ ব্যাধি। প্রতিদিন এই রোগে প্রায় ৪৪০০ মানুষ প্রান হারান এবং প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এই রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টায় ২০০০ সাল থেকে আনুমানিক ৭৪ মিলিয়ন জীবন বাঁচিয়েছে। সর্বশেষ গ্লোবাল যক্ষ্মা রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হাইলাইট করেছে যে, এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো আনুমানিক  যক্ষ্মা সংক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যু বেড়েছে।

প্রত্যেক বছর ২৪শে মার্চ দিনটিতে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। যক্ষ্মা 
 রোগ যাকে আমরা টিবি বলে জানি, যার পুরো নাম হলো টিউবারকুলোসিস। এটি একটি মারণ রোগ। বিশ্বব্যাপী এই মহামারী এবং মারণ রোগ নির্মূল করার প্রচেষ্টা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করার জন্য এই দিনটি পালন করা হয়। ২০১৮ সালের ১০মিলিয়ন মানুষ টিবিতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এবং প্রায় ১.৫ মিলিয়ন লোক এই রোগে মারা গিয়েছিলেন। বেশিরভাগ মানুষই নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যম আয়ের দেশের ছিলেন। এটি একটি সংক্রামক রোগ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে উঠতে পারে।

বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস হলো ,বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ,রোগ দিবস,বিশ্ব রক্তদাতা দিবস, বিশ্ব অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ, বিশ্ব টিকাদান সপ্তাহ, বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস সহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা চিহ্নিত এগারটি সরকারি বিশ্বের জনস্বাস্থ্য প্রচারণার একটি। 

বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসের পটভূমি যদি দেখি তাহলে বলতেই হয়, ১৮৮২ সালের ২৪ শে মার্চ দিনটিকে স্মরণ করে ডক্টর রবার্ট কোচ বার্লিনের ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একটি ছোট দলকে ঘোষণার মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে চমকে দিয়েছিলেন, যে তিনি যক্ষ্মা রোগের কারণ টিবি ব্যাবিলাস আবিষ্কার করেছেন। সহকর্মী পল এহরলিচের মতে," এই স্মরণীয় অধিবেশনে কোচ একটি ঘোষণা নিয়ে জনসাধারণের সামনে হাজির হন, যা একটি ভয়ংকর মানব সংক্রামক রোগের গল্পে একটি বাঁক-বিন্দু চিহ্নিত করে। স্পষ্ট ভাষায় বলা যায় যে কোচ এটিওলজি ব্যাখ্যা করেছিলেন। দৃঢ় প্রত্যয়ী শক্তির সাথে যক্ষ্মা রোগের, অনেক মাইক্রোস্কোপ স্লাইড এবং অন্যান্য প্রমাণ উপস্থাপন করেন। বার্লিনে কোচের ঘোষণার সময় যক্ষ্মা ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, যার ফলে প্রতি সাত জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছিল। কোচের আবিষ্কার যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় ও নিরাময়ের পথ খুলে দেয়।

যক্ষ্মা রোগের ইতিহাস সম্পর্কে বলা যায় যে, ১৯৮২ সালে রবার্ট কোচের উপস্থাপনায় শতবার্ষিকীতে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট এগেইনস্ট ইউবারকুলোসিস এন্ড লং ডিসিস(IUATLD) প্রস্তাব করেছিল যে ২৪ শে মার্চকে একটি অফিসিয়াল বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হবে। এটিআইইউ এটিএলডি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা "টিবিকে পরাজিত করুন এখন এবং চিরতরে"থিমের অধীনে একটি বছরব্যাপী শতবর্ষে প্রচেষ্টার অংশ। বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস কে এক দশকেরও বেশি সময় পর পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশ এবং জাতিসংঘ কর্তৃক বার্ষিক ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
১৯৯৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং রয়েল নেদারল্যান্ডস টিউবারকুলোসিস ফাউন্ডেশন নেদারল্যান্ডের দ্য হেগে প্রথম বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসের এডভোকেসিস পরিকল্পনা সভা আয়োজন করে। একটি ইভেন্ট তারা আগামী কয়েক বছর ধরে সহ স্পনসর চালিয়ে যাবে ।১৯৯৬ সালে ডাবলু এইচ ও, কেএনসিভি, আই ইউ এটি এল ডি এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি বিশ্বযক্ষ্মা দিবসে বিস্তৃত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যোগ দেয়।
১৯৯৭ সালে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসের জন্য একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক হিরোশি নাকাজিমা ঘোষণা করেছিলেন যে, "ডটস এই দশকের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য অগ্রগতি, জীবন অনুযায়ী আমরা বাঁচাতে সক্ষম হব"। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল টিবি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ডক্টর আরাতা কোচি, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে,"আজ বিশ্বব্যাপী যক্ষ্মা মহামারীর পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে চলেছে। কারন আমরা একটি অগ্রগতি অর্জন করেছি। এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার অগ্রগতি। শুধুমাত্র ধনী দেশগুলিতেই নয়, উন্নয়নশীল বিশ্বের সমস্ত অংশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ করা, যেখানে এখন সমস্ত যক্ষ্মা মামলার ৯৫ শতাংশ নির্মূল হয়ে গেছে"।

১৯৯৮ সালের মধ্যে প্রায় ২০০ টি সংস্থা বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসে জনসাধারণের প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করে। 'বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস' ১৯৯৮ সালে লন্ডনের সংবাদ সম্মেলনের সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমবারের মতো বিশ্বের শীর্ষ ২২ টি দেশকে চিহ্নিত করে যেখানে সবচেয়ে বেশি টিবি রোগী রয়েছে। পরের বছর ১৯৯৯ সালে বিশ্ব যক্ষা দিবসের তিন দিনের ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এবং এনএলসিভি পরিকল্পনা সভায় ১৮ টি দেশের গুরুত্বপূর্ণ টিবি অ্যাডভোকেট অংশগ্রহণ করেন।
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল কিল্টন ভারতের হায়দ্রাবাদের মহাবীর হাসপাতালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রস্তাবিত ডাইরেক্টরি অফ থেরাপি শর্ট কোর্স (ডটস) রোগীদের চিকিৎসা মাধ্যমে "বিশ্ব টিবি দিবস" ২০০০ চিহ্নিত করেছেন। যক্ষ্মা রোগের বিস্তার একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা যার জন্য কোন জাতি অনাক্রম্য নয়।

কানাডায় ন্যাশনাল কোলাবেরিটিং সেন্টার ফর ডিটারমিনার্স অফ হেলথ ২০১৪ সালে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসে উল্লেখ করেছে যে, জাতীয়ভাবে রিপোর্ট করা টিবি মামলার ৬৪ শতাংশ বিদেশি জন্মগত ব্যক্তিদের মধ্যে এবং ২৩% আদিবাসীদের মধ্যে, স্বাস্থ্য সমতা নিয়ে উদ্বেগের একটি প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে টিবি কে হাইলাইট করে।
আজ স্টপ টিবি পার্টনারশিপ, টিবি প্রতিরোধকারী সংস্থা ও দেশগুলির একটি নেটওয়ার্ক( আইইউএটি এলডি একটি সদস্য এবং ডব্লিউ এইচ ও জেনেভায় স্টপ টিভি পার্টনারশিপ সেক্রেটারি রয়েছে।) সাধারণত এই রোগ কিভাবে হয় এবং প্রতিরোধ কিভাবে করা যায়? নিরাময়ই বা কিভাবে হয়, এই সমস্ত কিছু তুলে ধরার জন্য এই দিবসটির আয়োজন করা হয়।

প্রত্যেকটি বিশ্ব দিবসের একটি থিম থাকে, ঠিক সেই রকম বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসেরও প্রতিবছর একটি করে নতুন থিম থাকে। ১৯৯৭ সালের থিম ছিল, "ডটস আরো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করুন"। সেরকম ২০২৩ সালের যক্ষ্মা দিবসের দিন ছিল, "হ্যাঁ! আমরা টিবি শেষ করতে পারি।"
আমাদের প্রত্যেককে আরো বেশি করে স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে এবং ভবিষ্যতে পৃথিবীতে যক্ষ্মা মারণ ব্যাধিকে নির্মূল করার জন্য যে, যে উপায়েগুলো নিতে হবে তা আরো বেশি করে আলোচনা করতে হবে।

🍂

Post a Comment

0 Comments