জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন /পর্ব -২ /মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব -২
                 
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া 
     
মৌরি ফুলের মধু 

এক মুঠো মৌরি লজেন্স হাতে দৌড়চ্ছিল সে। দে বলছি ঝিনি,না দেব না তুই কেন আমার মাছ টফিটার সবটা খেলি? দাঁড়া,দ্যাখ তোর কি করি,বলতে বলতে ছোড়দা তার ঘাড়ে এসে পড়ে আর মুঠো থেকে ছড়িয়ে যায় খুদি খুদি মৌরি লজেন্স। খুব জোরে খিমচে দেয় সে।
        খিমচোনো জায়গাটাতে খানিক হাত বুলিয়ে ছোড়দা বলে,তুই,ঝিনি আমাদের বাড়ির মেয়েই নোস। তার মানে কি?এমনিতেই লজেন্সের শোকে তার চোখে জল গড়াচ্ছিল। আরে গাধা,রোজ সকালে করিম ভাই যখন বাগানের কাজ করে,রুবিদি চা রুটি আর বিড়ি দেয় না ছটা করে,বিড়ির বান্ডিলে লেখা থাকে মন্টু বিড়ি ফ্যাক্টরি;তুই ওই মন্টু বিড়িদের মেয়ে। আমরা তোকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। মোটেও কক্ষনো আমি মন্টু বিড়িদের মেয়ে হব না, বাজেদের মত কথা বলবি না, ঝিনির হাত পা চলতে থাকে।    
       ছোড়দাও কিছু থেমে থাকে না ফলে খানিক বাদেই কাঁদতে কাঁদতে মার কাছে দৌড়োয় সে। মা, আমি ঝিনি না? হ্যা,তুমি তো ঝিনিই। তুমি কোথায় পেয়েছিলে আমাকে? আমি কোথায় থেকে এলাম? ইস্কুলের খাতা দেখছিল মা। মুখ তুলে জলভরা ব্যাকুল তার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে মা বললো,সে তো এক গল্প। সন্ধেবেলা গা ধুয়ে বাগানে বেড়াচ্ছিলাম তো আর চাঁদও উঠেছিল বাঁকা একখানা। আর ওর ছোট্ট ছোট্ট তারা? হ্যা, ওই তারাই তো দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম ছোট্ট ওই তারার মত মিষ্টি একটা মেয়ে যদি থাকত গো! স্নোহোয়াইটের রাণীর মত ভাবলে? এক্কেবারে ওরকম।তা ভাবতে ভাবতেই দেখি টুপ করে একটা তারা খসে পড়ল ওই কুন্দ ফুলের ঝোঁপটাতে। দৌড়ে গিয়ে দেখি,ওমা! তারা কোথায়, এতো ছোট্ট একটা মেয়ে।
         সাত ভাই চম্পার মত দেখলে? মাটিতে পড়েই রাজপুত্তুর হয়ে যাওয়ার মত? অবিকল সেরকম। কি করলে তখন? অতটুকু বেবীতো, দোলা দিতেই ঘুমিয়ে গেল। সেইতো আমার ঝিনুক মা। এখন পড়তে বোসোগে,চা করতে হবে আমায়।  
          মার কাছ থেকে লাফাতে লাফাতে দাদাদের কাছে গিয়ে বলে মন্টু বিড়ি বলবি না,মা বলেছে কুন্দ ফুলের ঝোঁপে কুড়িয়ে পেয়েছে আমায়। তারা হয়ে ছিলাম।ওই দ্যাখ,কুড়িয়ে পেয়েছে বলেছে না? বিড়িরা ফেলে গেছিল,আমরা পেয়ে গেলাম। সত্যি?সত্যি নাতো কি? ধাঁধায় পড়ে যায় সে আর চোপসানো তার মুখের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ছোড়দা হাসে। অনেক দিন পর্যন্ত  ঝিনুক নামের মেয়েটা জানতো সে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে!
     রাতে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে হ্যারিকেনের
 আলোয় খাতা দেখতে বসেছে মা। মা, ও মা আমার পাশে শোও না। উঁহু বিরক্ত করো না। অনেক খাতা দেখা বাকি। আর ছোড়দা এসেই,
আ্যই সর সর,সরে শো। খুব মজা না?রোজ রোজ মার পাশে শোওয়া বার করছি তোর।শো না, তুইও শো মা'র ওপাশটায়।অত খায় না।তুই জানলার ধারে তারপর আমি আর এপাশে মা।আলো নেভালেই জানলা দিয়ে...মা দ্যাখো না ছোড়দা ভয় দেখাচ্ছে! আর তুই চিমটি কাটলি কেন?পেত্নী কোথাকারে।নাকে সিকনি!তুই তো খ্যাংরাকাঠি আলুর দম!হি হি বলেছে না জিতেন কাকু গান শেখাতে এসে?
     খুনসুটি থেকে স্টার্ট করে মারামারি চ্যাঁ ভ্যাঁ সারাদিন খেটেখুটে মা আর পারে না পাখার ডাঁটি বা স্কেল দিয়ে দুজনকেই বেশ সিধে করে ছেড়ে দেয়।
‌         তার চাইতে খানিকটা  বড় পিঠোপিঠি দুই দাদারই ভারি পছন্দ বোনের পেছনে লাগা। পড়ে থাকা বেতের দোলনাখানাতে বোনকে চাপিয়ে এমনিতে তারা পাইপাই করে ছুটছে মুখে বিচিত্র আওয়াজ শুনে পরিস্কার যে গাড়িই চালাচ্ছে তারা। বোনকে হাতে ঝুলিয়ে ঘোরাচ্ছে বনবন অবিকল নাগরদোলা। কিংবা দুই দাদা তাদের চারখানা হাত গেঁথে পালকি বানিয়ে তাকে চড়িয়ে হুহুমনা হুহুমনা পাল্কি চলে রে ...।
       আঙুলের ফাঁকে বাসের টিকিট জানলায় দড়ি বেঁধে টিংলিং টিংলিং বলে দড়ি টেনে বাস ছেড়ে দিল ছোড়দা। উঠুন উঠুন আ -আস্তে   লেডিস বলে কন্ডাকটরের হাঁক ছেড়ে জানলায় ধুপধাপ বাড়ি কষিয়ে থামিয়েও ফেলল।‌মা'র পুরনো একটা ব্যাগ কাঁধে, গামছা পাকিয়ে মাথায় মস্ত খোঁপা বেঁধে সেও গম্ভীর হয়ে জানালার তাকে চড়ে বসল। টিকিট টিকিট বলে কন্ডাকটর সামনে হাত নাড়ে। খানিক বাদে এসে গেছি,রোককে আবার জানলায় দুমদাম বাড়ি দিয়ে বাস থেমে যায়।
      এসব তো বেশ ভালোই আবার সে আর রুবি দিদি লুডো খেলতে বসলে দাদারা স্রেফ রুবি দিদির দলে।ওই তো ছক্কা তিনে ঝিনির গুটি খাওয়া দেখতে পাস না? কাণা নাকি?ইসস রুবি দিদির চোখ এড়িয়েও গুটিটা বাঁচানো গেল না তার ওপর তার দানের সময় দুপাশ থেকে পুট পড় পুট বলতেই থাকবে আর সত্যি যদি পুট পড়েই  বসে তাহলে  লন্ডভন্ড বোর্ড উল্টে  কাঁদতে না বসে সে করে কী?
         চেঁচামেচি শুনে মা এসে হাতের নাগালে তাকেই পেয়ে ধাঁই ধাঁই দুচারটে পিঠের ওপর।দাদারা ততক্ষণে হাওয়া ,রুবিদিও কোনো কাজের অছিলায় কেটে পড়েছে। মার দোষ নেই দূর থেকে তার গলাটাই বেশি শোনাচ্ছিল কিনা কিন্তু ছত্রভঙ্গ রণক্ষেত্রে ঠ্যাঙ ছড়িয়ে ঝিনি নিজের প্রতিই বিরাট সমব্যথী হয়ে ভাবতে থাকে কেন যে তাদের বাবাকে দূরে থেকে চাকরি করতে হয়।বাপিই শুধু মন দিয়ে তার সব কথা শোনে। দাদাদের খুব বকে তাকে জ্বালায় বলে। শনিবার এলেই ঝিনি ব্যস্ত হয়ে পড়ে কখন রাত হবে চেনা গলায় ডাক শুনতে পাবে সে।
       নিজের ভেতর খুঁজতে বসলে আজ অবধি আপনজনের জন্য অপেক্ষার মতো সুন্দর আর কিচ্ছুটি পাইনি।যদিও ফিনকি দিয়ে ওঠে চোখ, নোনা জোছনা গড়ায়,জানি তবুও এই যে সন্ধে নাগাদ  যত বেড়ে উঠি , ছায়াও লম্বা হয়, কাঠের হাত দিয়ে সরিয়ে দিই অন্ধকার যেন এক্ষুনি গান শুরু হবে।ছোট গল্প থেকে ভেসে উঠবে শান্ত কলমিলতা‌র ফুল বুড়ো পাকুড়ের নিচে পিদিম উঁচু করবে সধবা হাওয়ারা।ফরফর করে পাতা উল্টে দেবে নিচু ক্লাসের ভূগোল বই।স্বপ্ন দেখবো  ঘন্টা পড়ে গেছে  অথচ পরীক্ষার হলে পৌঁছোতে পারছি না।গ্ৰীষ্মের লোহিত সাগরে ফাটল ধরে যাবে... ততদিনে আলোর জিন পাল্টে গেছে পাল্টে গেছে অপেক্ষার মানুষও।ডেড সি'র ধারে যতদূর চোখ যায় ফায়ার বুশ গজিয়ে উঠেছে আবার।
          সমস্ত আকাঙ্ক্ষাই কি তবে শেষ হয় অপেক্ষায়? নাকি মেধার আঘাত থেকে দূরে  সাড়া না পেয়ে পেয়ে পাথুরে খাদের মোহে পড়ে যায় মানুষ?বার্চ গাছের হাওয়া আর নীল কুয়াশার বন তাকে লোভ দেখায়।ভাবে মাথাভর্তি অন্ধকার নিয়ে ছাইরঙ আকাশ বা মাটির তলায় শুতে তো হবেই।যদিও থেঁতলে গেছে ভাষা। এতদিন যারা ছিল ঋজু ও টানটান সে সমস্ত কথাদের চোরা টান ও ইশারা গোল গোল ইকো হয়ে ফিরে আসে। মা বাবার সঙ্গে যেভাবে প্রথম সমুদ্রে গিয়েছিলাম সেবার যেমন 
     পাখি ডাকছিল তখন। জল মেখে উড়ছিল বাতাস। পৃথিবীতে জালের নকশা কারা খুঁজে পেল প্রথম? নৌকোর মাথায় কাঠের চোখ এঁকে তেল সিঁদুর দিয়ে রুপোলি মাছের পাশে ঘুমিয়ে পড়ল বূঝি তারা রুপোকথা হয়ে ?কোথায় হারালে তাকে মনে নেই? কোথায় দেখেছো তাকে শেষবার ভেসে যাওয়া বন্দর শহর?
      তবু দ্যাখো কাঠের স্তুপ হয়ে ভেঙে পড়ল আজ চিঠির বাক্স। অথচ পিওনের জন্য এতকাল ঠাঁয় বসেছিল আমার জানলা।যদিও চিঠি নেই চিঠি নেই ডাকতে ডাকতে পাখি উড়ত ওদিকেই।সন্ধেও মুড়ি দিয়ে শুতো।পাড়ার কমল জেঠা ভারু পিসি বলাবলি করতো ছাল ওঠা ঠোঁটে অবিকল বিলাপের মতো দেখাচ্ছে আমায়।
    আজ বিষ্টি থামার পরপরই রুগ্ন কমলায় ভরে গেল রোদ যখন পুরনো পড়শীরা হাওয়ার সমুদ্রে গোল হয়ে দেখল আমাদের মাঠকোঠা দালানে নিমফলের মতো ঠান্ডা কপাল নিয়ে পড়ে আছে ভাঙা চিঠির বাক্স।কোটরে ভাঙা ডিম, নীল খোলস... চিঠি ঠোঁটে নিয়ে পাখি উড়ে যাচ্ছে বাংলা ভাষার জংলা খাঁড়ির দিকে....

🍂

Post a Comment

0 Comments