উনত্রিংশতি পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
দ্বিতীয় ভাগ - মথুরা পর্ব
কংস বধ
দণ্ডহাতে দণ্ডধারী
হরিবংশ ও বিভিন্ন পুরাণে কংসবধের কথা বিস্তারিত ভাবে বর্ণিত হয়েছে। এটি ঐতিহাসিক ঘটনা হলেও এনিয়ে যা কিছু বিবরণ তার মধ্যে কতটা ইতিহাস আছে সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে বলে শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক অনেক গবেষক মনে করেন। মহাভারতের সভাপর্বে কংসবধ বৃত্তান্ত যেভাবে লেখা আছে সেটি এখানে উল্লেখ করছি। এখানে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁর পূর্ব বৃত্তান্ত যুধিষ্ঠিরের কাছে বলেছেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয়ের বঙ্কিম রচনাবলী - কৃষ্ণচরিত্রের অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত করলাম। " কিয়ৎকাল অতীত হইল, কংস যাদবগনকে পরাভূত করিয়া সহদেবা ও অনুজা নামে বার্হদ্রথের দুই কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিল। ওই দুরাত্মা স্বীয় বাহুবলে জ্ঞাতিবর্গকে পরাজয় করতঃ সর্বাপেক্ষা প্রধান হইয়া উঠলেন। ভোজবংশীয় বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়গণ মূঢ়মতি কংসের দৌরাত্ম্যে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া জ্ঞাতিবর্গকে পরিত্যাগ করিবার নিমিত্ত আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমি তৎকালে অক্রুরকে আহুক কন্যা প্রদান করিয়া হিত সাধনার্থ বলভদ্র সমভিব্যাহারে কংস ও সুনামাকে সংহার করিলাম"।
শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে বৃন্দাবন থেকে আনা হয়েছিল এরকম কোন তথ্য মহাভারতে নেই। বরং শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম মথুরাতেই বসবাস করতেন এ কথার উল্লেখ আছে। মহাভারতের সভাপর্বে শ্রীকৃষ্ণকে কংসের অন্নভোজী বলে নিন্দা করেছিলেন শিশুপাল। যে সমস্ত বৃদ্ধ যাদবগন কংসের ভয়ে ভীত ছিলেন তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকে মথুরা থেকে পালাবার পরামর্শ দেন। শ্রীকৃষ্ণ অত্যন্ত শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে গুরুজনদের কথা শুনলেন। কিন্তু তাদের পরামর্শ শিরোধার্য করেন নি। জ্ঞাতিগণের মঙ্গলের জন্যই মথুরা থেকে না পালিয়ে কংসবধের উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। নিজের সুরক্ষার থেকেও জ্ঞাতিগণের মঙ্গল সাধনের ব্যাপারে তিনি বেশী চিন্তিত ছিলেন। পুরানে উল্লেখ আছে যে কংসবধের পরে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম অবন্তিকা নগরীতে সান্দিপনী ঋষির নিকট গমন করেন এবং সেখানে সান্দিপণী ঋষির কাছে মাত্র ৬৪ দিনের মধ্যে তাঁরা নানা শাস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত হয়ে ওঠেন। তাঁদের সাথে কৃষ্ণের সখা সুদামাও সেখানে গিয়ে বিদ্যাভ্যাস করেন। বিদ্যালাভের পরে গুরুদক্ষিণা স্বরূপ সান্দীপনী ঋষিকে তাঁর হারানো পুত্রকে প্রভাসের নিকটে সমুদ্রগর্ভ থেকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেন। এরপরে দুই ভাই মথুরাতে ফিরে আসেন। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে যে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম কি শুধু অবন্তিকা নগরেই শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন? তিনি যখন মথুরায় ছিলেন সেই সময় কি কোনো রকম বিদ্যাভ্যাস করেননি? দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় কোন পুরান বা ধর্মগ্রন্থে মথুরায় আমরা কৃষ্ণের এই বিদ্যাভ্যাসের উল্লেখ পাইনি। শ্রীকৃষ্ণকে যাঁরা ঈশ্বর বলে মনে করেন তাদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন ঈশ্বরের আবার শিক্ষার প্রয়োজন কি? আসলে তাঁরা একথা স্মরণে রাখেন না যে শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার হলেও তিনি মনুষ্যজন্ম গ্রহণ করে তাঁর লীলা প্রকাশ করেছিলেন। একজন মানুষের মতই তার জীবনধারা, মানুষের মতোই তিনিও শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি যে বেদ, বেদাঙ্গ পারদর্শী সেকথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে মহাভারতের সভাপর্বে ভীষ্ম উল্লেখ করে বলেছেন ‘তাঁর মত বেদবেদাঙ্গ জ্ঞানসম্পন্ন দ্বিতীয় ব্যক্তি দুর্লভ’। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের বেদজ্ঞতা সম্বন্ধে এই রূপ আরো ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যায়। এই বেদজ্ঞতা তার স্বতঃলব্ধ নয়। ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে তিনি আঙ্গিরস বংশীয় ঘোর ঋষির নিকট অধ্যয়ন করেছিলেন।
🍂
শ্রীকৃষ্ণের সময়ে মগধাদিপতি জরাসন্ধ ছিলেন মহাপরাক্রমশালী নরপতি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আমরা উল্লেখ পাই শ্রীকৃষ্ণ কৌরবদের অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী সেনা দিয়েছিলেন। কিন্তু জরাসন্ধের বিংশতি অক্ষৌহিনী সেনা ছিল বলে মহাভারতে উল্লেখ আছে। কংস ছিলেন এই জরাসন্ধের জামাতা। তার দুই কন্যা অস্তি ও প্রাপ্তিকে বিবাহ করেছিলেন কংস। কংসবধের পরে জরাসন্ধের বিধবা কন্যাদ্বয় তাঁর নিকট গিয়ে পতিহন্তার সমুচিত শাস্তি প্রার্থনা করে রোদন করতে শুরু করেন। তাদের কান্না শুনে জরাসন্ধ একবার নয় আঠারো বার মথুরা আক্রমণ করে প্রতিবারেই শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রতিহত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। সেই ঘটনা বলার আগে একটি অন্য ঘটনার কথা উল্লেখ করছি।
শ্রীকৃষ্ণের ছোটবেলার সখা উদ্ধব দেবগুরু বৃহস্পতির শিষ্য। শ্রীকৃষ্ণ ও উদ্ধবের চেহারার মিল আছে। উদ্ধব জ্ঞানী, বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপন্ডিত কিন্তু কৃষ্ণপ্রেমে বঞ্চিত ছিলেন। শুধু তাই নয় বিভিন্ন শাস্ত্রে সুপন্ডিত বলে তিনি নিজের সম্বন্ধে গর্ব অনুভব করতেন। শ্রীকৃষ্ণ তখন মথুরায় আছেন। একদিন উদ্ধবকে বললেন "সখা, অনেকদিন ব্রজধামের কোন খবরাখবর পাইনি। ওখানে গিয়ে একবার সকলের খোঁজ-খবর নিয়ে এসো"। শ্রীকৃষ্ণের কথা মত উদ্ধব শেষ পর্যন্ত বৃন্দাবনে এসে পৌঁছলেন। সেই সময় নিকুঞ্জ বনে শ্রীরাধা গোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণচিন্তায় বিভোর। উদ্ধবকে দূর থেকে দেখে শ্রীরাধার মনে হল তিনি কি ভুল দেখছেন? এ তো মনে হচ্ছে কানহাইয়া তাঁর খোঁজ নিতে ব্যস্ত হয়ে ছুটে আসছেন? পরক্ষণেই শ্রীরাধার মনে হল কৃষ্ণের মতো দেখতে হলেও লোকটি নিশ্চয়ই অন্য কেউ, কারণ তার হাতে বাঁশীও নেই এবং মস্তকে শিখীপাখাও নেই। শ্রীরাধা ও গোপীদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে উদ্ধব বললেন "কানহাইয়া তোমাদের কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন। তোমরা কে কেমন আছ খোঁজ-খবর নিয়ে মথুরায় ফিরব"। জ্ঞানগর্বে গর্বিত হয়ে উদ্ভব আরও বললেন "তোমাদের মনের এই অবস্থা দেখে আমিও কষ্ট পাচ্ছি। তোমরা শ্রীকৃষ্ণের ভজনা করো। তোমাদের কাতর আহবানে তিনি নিশ্চয়ই ধরা দিবেন"। উদ্ধবের এই কথা শুনে গোপীরা বললেন "আমাদের তো একটাই মন। সেই মন নিয়ে শ্যামসুন্দর ব্রজভূমি ছেড়ে চলে গেছেন। আমাদের আর কোন মন নেই যে তাঁর কথা ভাববো বা তাঁর ভজনা করব"। "উধো মন ন ভয়ো দশ বিশি/ এক হুতো সো গয়ো শ্যাম সঙ্গো/কো আরাধে ইশি"। শ্রী রাধিকা উদ্ধবকে বললেন "কানহাইয়া আমাদের মধ্যেই রয়েছে। তিনি এই ব্রজভূমির তমাল আর তুলসীর জঙ্গলে বিচরণ করছেন”। এর পরেই শ্রী রাধিকা উদ্ধবকে কানহাইয়ার রূপ দেখালেন। উদ্ধব দেখতে পেলেন শ্রীকৃষ্ণ রাধার সঙ্গে নৃত্য করছেন। হাজার হাজার কৃষ্ণ সখী পরিবেষ্টিত হয়ে হাসিমুখে তাঁর মোহন বাঁশিতে ফু দিয়েছেন। আর সেই বাঁশিতে সুরের প্লাবন চারিপাশে। রাধা যেন দিব্যদৃষ্টি দান করলেন উদ্ধবকে। গোপীরাও রাধিকাকে সমর্থন করে বললেন। "উধো শুধো হো গয়ে শুনি গোপীয়োকে বোল/ জ্ঞান বাজাবে ডুগডুগি প্রেম বাজায় ঢোল"। গোপীগনের স্পষ্ট কথা শুনে উদ্ধব একেবারে সিধে হয়ে গেলেন। গোপীরাও যে যথেষ্ট জ্ঞানী এবং তাঁরাও যে এক এক জনে কৃষ্ণ প্রেমের পরাকাষ্ঠায় সমুজ্বল। কৃষ্ণ ব্যতীত কেউ কিছু জানেন না। এতদিনে উদ্ধব তাঁর আত্ম অহংকারের প্রকৃত দুর্বলতার খোঁজ পেলেন। জ্ঞান পরিবর্তিত হল প্রেমে। উদ্ধব বুঝতে পারলেন গোপীদের অনন্ত প্রেম কানাইয়াকে ব্রজভূমির মাটিতে চিরকাল ধরে রেখেছে। শুষ্ক কাষ্ঠের মত উদ্ধব বৃন্দাবনে এসেছিলেন, মথুরায় ফিরে যাবার সময় তিনি কৃষ্ণপ্রেমে জ্বরজ্বর হয়ে ফিরে চললেন।
মথুরায় ফিরে আসার পরে শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবের ভেতরে এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। এই উদ্ধব আগের মত জ্ঞানগর্বে গর্বিত নন, কৃষ্ণ প্রেমে জ্বরজ্বর। উদ্ধবকে কৃষ্ণ বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন "এতদিন তুমি দেবগুরু বৃহস্পতির শিষ্য ছিলে, এখন থেকে আমার প্রকৃত বন্ধু হলে। ব্রজভূমির যে স্থানে শ্রী রাধারানী ও গোপীদের সঙ্গে উদ্ধবের কথাবার্তা হয়েছিল তার নাম জ্ঞানগুদড়ি। গুদড়ি মানে কাঁথা। যে কাঁথাতে উদ্ধব তাঁর জ্ঞান পোঁটলা করে নিয়ে গোপীদের উপদেশ দিতে এসেছিলেন। ফিরে যাবার সময় কৃষ্ণপ্রেমের জ্ঞান পোঁটলা করে মথুরায় ফিরে গেলেন। লালাবাবুর মন্দিরের পিছনে এই জ্ঞানগুদড়ি অঞ্চলটি।
(পরবর্তী অংশ ত্রিংশতি পর্ব)
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments