মিলি ঘোষ
কাজকর্ম তো সারাবছর ইংরেজি ক্যালেন্ডার দেখেই হয়। তবু, বাংলার নতুন বছর অনুভূতির দিক দিয়ে হয়তো কোথাও এগিয়ে। ছোটবেলায় কী কারণে পয়লা বৈশাখ ছিল একটা বাড়তি আনন্দের দিন, সে কথা মনে আনার খুব দরকার নেই। তখনের জীবনযাত্রার সঙ্গে এখনের জীবনযাত্রার আকাশ পাতাল তফাৎ। তখন কী ছিল আর এখন কী নেই বা তখন কী ছিল না আর এখন কী আছে সে বিশ্লেষনে যেতে চাই না। হাতে স্মার্ট ফোন নিয়ে বর্তমানের সমালোচনা না করাই ভালো। এক সময় উনুনে রান্না হতো, শীল-নোড়াতে বাটনা বাটা হতো। সেদিকে তাকিয়ে যাঁরা বলেন, পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কী রে হায়, তাঁরা বাড়িতে উনুনের ব্যবস্থা করতে পারেন। বহুতলের ছাদে উনুন ধরিয়ে দেবেন, ধোঁয়া উড়ে যাবে আকাশে বাতাসে, কারোর নাকে মুখে ঢুকবে না। জ্বলন্ত উনুন সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিচে এসে শীল-নোড়াতে মশলা বেটে নেবেন। একদিন করে দেখুন, কত সহজ!
একটা রবার দিয়ে চার ভাই বোন লেখা মুছেছেন। ঘষে ঘষে রবার কালো হয়ে গেছে, তবু নতুন রবার আসেনি। এগুলো যখন বলেন, খুব আনন্দ হয়, না? কথার মধ্যে তো বহু বছরের জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস মিশে থাকে। বলেন তাদের সামনেই, যাদের আপনারাই একটার জায়গায় চারটে রবার কিনে দেন। কেন চার জনের জন্য একটাই রবার, কেন কালো হয়ে গেলেও নতুন রবার পাননি, সে তো অন্য গল্প। তার পেছনে তো মা বাবাদের বহু রক্ত জল করা ইতিহাস রয়েছে। সে জন্য আপনার কষ্ট হতে পারে। বুকের মধ্যেটা যন্ত্রনায় তোলপাড় হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আপনার বর্তমান অবস্থান থেকে কিছুতে আপনি সেই জায়গায় ফিরে যেতে চাইবেন না। কারণ, আপনি সুখের স্বাদ পেয়েছেন। মুখে আপনি যা'ই বলুন।
এখনের ছেলেমেয়েরা বই পড়ে না। প্রশ্ন হলো, আপনি পড়েন? আপনি টিভি সিরিয়াল দেখবেন, মোবাইল নিয়ে বসে থাকবেন, আর ছেলেমেয়েরা বই খুলে পড়বে? জানি, আপনারা বইমেলায় যান। ওখানে না গেলে আপনাদের স্টেটাস থাকে না। যেমন, সোনা কিনতে পি সি চন্দ্র বা অঞ্জলি জুয়েলার্সে না গেলে স্টেটাস থাকে না। আপনার মা যেমন সংসার খরচের টাকা বাঁচিয়ে পাড়ার স্যাকরার থেকে কন্যা বা পুত্র-বধূর জন্য গয়না গড়াতেন, আপনি তা করবেন না। প্রয়োজন মতো নামী দোকান থেকে কিনে দেবেন। কারণ আপনার পকেটে এখন অনেক টাকা। স্যাকরা কিন্তু আছে। পাড়ার দোকানও আছে।
মনে পড়ে? সেই যে কাদার মধ্যে বল নিয়ে দাপাতেন। সন্ধে পেরিয়ে গেলে পিঠের ওপর মায়ের উত্তম মধ্যম। এখন পাঠাবেন ছেলেকে, খেলতে? হুম, মাঠ নেই। মাঠ থাকলেও পাঠাতেন না। তখন তো আপনার ছেলের কোচিং ক্লাস। বিকেলে খেলতে না পাঠিয়ে কোচিংয়ে পাঠানোর পেছনে আপনি একশোটা যুক্তি দেখাবেন। আর ফেসবুকে পোস্ট দেবেন, আহা! সে ছিল একদিন। কমেন্ট সেক্শন ভরে যাবে, চোখের জলে। তখন স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না, কিন্তু আনন্দ ছিল। আরও কত কী! দেখুন না স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে আনন্দ ফিরে পাওয়া যায় কিনা। খেলছে তো গ্রামের ছেলেরা। ফুটবল টিমগুলো তো গ্রামের ছেলেরাই ভরিয়ে রেখেছে। কিন্তু আপনি সেটা কিছুতে পারবেন না। পারবেন না যখন, হাহুতাশের প্রয়োজন নেই। কারণ, চয়েজ আপনার।
🍂
তাহলে এটা মানতে হবে, জীবন পরিবর্তনশীল। জীবনযাত্রাও গতিপথ পাল্টেছে। শুধু একটা বিষয় অপরিবর্তনীয়। তা হলো, জন্মিলে মরিতে হবে। জন্মের জন্য যখন আপনি নিজে দায়ী না, মৃত্যুর জন্যও দায়ী হওয়ার দরকার নেই। তাই একটাই কামনা, সবাই সুস্থ থাকুন। ঘুমের সময় ছাড়া যেন বিছানায় শুয়ে থাকতে না হয়।
শারীরিক সুস্থতার কথাই বলছি।
মানসিক সুস্থতা আর কী কামনা করব? মানুষ তো জেগে ঘুমোয়। আমরাই আমাদের অসুস্থ করে তুলছি।
চেহারা নিয়ে বন্ধু, আত্মীয় বা প্রতিবেশীকে উপহাস করছি। হতে পারেন তিনি মোটা, বেটে, কালো অথবা খুব রোগা। নয়তো দুটো চোখের মণি দুদিকে। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটেন বা মাথায় টাক। আজকাল কানে হয়তো একটু কম শুনছেন। নিজেদের নাম পর্যন্ত নেই তাঁদের। মোটু, বাটকুল, শুঁটকি, কেলে মানিক, দেড় ব্যাটারি, টাকলু-- নামের শেষ নেই। তাঁদের অপরাধটা কোথায়? আসলে অপরাধ কারওরই নেই। চেনা পরিচিতরা ভালোবেসে ডাকেন। এই ভালোবাসা যতদিন সহ্য করতে পারবেন, ততদিন আপনি খুব ভালো। একদিন অসহ্য হয়ে গিয়ে মুখ খুলুন, দেখবেন ভালোবাসার বহর। যাঁরা এই ধরনের মানুষদের নিয়ে মস্করা করে মজা পান, তাঁদের হাঁটা-চলা, চোখের দৃষ্টিতে যদি খুঁত না থাকে এবং যদি তুলনামূলক লম্বা, রোগা, ফর্সা হয়েও থাকেন, এতে তাঁদের গুণটা কোথায়? সবথেকে বড়ো কথা, এগুলো যে মানসিক নির্যাতন, বেশিরভাগ লোক তা মানতেই চান না। প্রতিবাদ করলে আপনি সিরিয়াস। ইয়ার্কি বোঝেন না। সংসারে যার পজিশন ঢিলে, নানাভাবে তাকে কোণঠাসা করাও মানসিক বিকারের লক্ষণ। সোজা কথায় র্যাগিং। র্যাগিং যারা করে, তারা সব সময় নিজের পক্ষে যুক্তি দেখায়। এটা নাকি বন্ধুত্ব। সাধারণতঃ এক দল মিলে কোনও একজনকে টার্গেট করে। জঙ্গলে বাঘ সিংহও তো এক জোট হয়েই শিকার ধরার চেষ্টা করে। বিভিন্ন দিক থেকে একটা পশুকে ঘিরে ধরে তারা আক্রমণ চালায়। নিজের শক্তির প্রতি এতটাই আস্থা কম। অন্যের উন্নতি দেখে জ্বলে যাওয়া এও এক ধরনের মনুষ্যসৃষ্ট রোগ। রাগ, ঈর্ষা মানুষের মধ্যে থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা মাত্রা ছাড়ালেই যেখানে সেখানে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ইচ্ছা করলে নিজেরাই নিজেদেরকে ভালো রাখতে পারেন এবং অন্যদেরকেও। তবে সে জন্য প্রচুর মানসিক উন্নতির দরকার। আত্ম-বিশ্লেষণ দরকার। ইটের বদলে পাটকেল খাওয়াও দরকার। তবে ছিদ্রযুক্ত দম্ভ থাকলে এখান থেকে বেরোনো মুশকিল।
চারিদিকে বৈশাখের আহ্বান। বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। কোথায় দূর হচ্ছে! অন্যকে উপহাস করে শান্তি খোঁজার চেষ্টা তো চলছেই। সেই তো 'ওল্ড ইজ গোল্ড' আঁকড়ে বসে আছেন। নতুনদের জায়গা দিন। যা কিছু ভালো সব অতীতের যেমন নয়, তেমন যা কিছু আধুনিক তাই গ্রহণযোগ্য নয়। ভালো মন্দ চিরকাল পাশাপাশি অবস্থান করে। আগেও, এখনও। নতুন পুরাতন কেউ কারোর প্রতিদ্বন্ধী নয়। আপনি পুরাতন হয়ে নতুনকে স্নেহ করুন, দেখবেন নতুনও আপনাকে শ্রদ্ধা করছে। একবার মন থেকে বলুন না--
'ওই নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়।
1 Comments
Congratulations. Porechi darun
ReplyDelete