জ্বলদর্চি

ঋত্বিক ত্রিপাঠীর কাব্যগ্রন্থ কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা : দুরন্ত গতির এক আশ্চর্য নীরবতা / সিদ্ধার্থ সাঁতরা

ঋত্বিক ত্রিপাঠীর কাব্যগ্রন্থ কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা : দুরন্ত গতির এক আশ্চর্য নীরবতা 

 সিদ্ধার্থ সাঁতরা
(কবি, সম্পাদক, চলচ্চিত্র বিশ্লেষক)


" জীবন ! কখনও মিলবে না জেনেও যাত্রা ..."

কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীকে নতুন করে পরিচয় করানোর কোনও প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।  ঋত্বিক সেই কবি যিনি মনে করেন " তিনিই কবি যার কবিতায় তিনি অন্তত একবার নিজেকে ছাড়িয়ে নিজের দেশের সীমা এড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীর নামে জয়ধ্বনি করেন। পৃথিবীর শুশ্রূষার জন্য ব্যাকুল হন।" তাঁর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' এই ধারার এক উচ্চকিত কণ্ঠস্বর বহন করছে। এই গ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুলি পড়লে মনে হয় নিজের কবিতার মধ্যে ঋত্বিক নিজস্ব ভুবন গড়ে নিয়েছেন যেখানে প্রতিটি লাইনে ধ্বনিত হচ্ছে তাঁর একান্ত নিজস্ব স্বর যা গড়ে উঠেছে বিজ্ঞান, অংক ও সাহিত্যশৈলীর নিপুণ সংমিশ্রণে। কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে ঋত্বিক কোনও নির্দিষ্ট ফর্ম ব্যবহার করেননি । নতুন ধারার কবিতায় ছবি এঁকে গেছেন অনন্ত সম্ভাবনার যা স্বপ্নের মতো আচ্ছন্ন করে পাঠককে ।

মহাকবির ব্যঞ্জনা শীর্ষক কবিতায় চারটি অংশ রয়েছে ।  গদ্য কবিতার ফর্মে সময়ের নিরিখে কবির দর্শনকে বর্ণনা করেছেন এখানে ।
" হতে পারে তিনবাহু তিনসত্তা।
ত্রিভুজের মধ্যে বৃত্ত। বৃত্তের কেন্দ্র একটাই। "
আবার একটা ধারনাকে নির্দিষ্ট করছেন যে সম্ভাবনাকে ছুঁয়ে তা হলো—
" খালি পায়ে অচেনা তিনজন দাঁড়িয়ে এক নদীর বাঁকে, পাড়ে। তাঁদের থেকে সামান্য দূরে ব-দ্বীপ, নিষ্পাপ। প্রথমজন বললেন ; নদী বাঁক ও ব-দ্বীপ পরিপূরক। দ্বিতীয়জনের বক্তব্য : দ্বীপে জেগে উঠেছে প্রাণ।
তৃতীয়জনের উচ্চারণ : প্রাণ প্রাণকে চিনে নিচ্ছে। এই হলো অভিধা লক্ষণা ব্যঞ্জনার এক জীবন উপাখ্যান।
প্রথম দুজন তৃতীয়জনকে মান্য করলেন।
একমাত্র মহাকবিই আবিষ্কার করেন ব্যঞ্জনার পথ, ত্রিভুজের কেন্দ্র।"

এখানে কবি তাঁর দায়বদ্ধতার দর্শনকে উন্মোচিত করেছেন স্পষ্টভাবে। তাই তিনি লিখেছেন "সেই রাষ্ট্রকে যিনি পৃথিবী থেকে আলাদা করে দেখেন না — তিনি কবির কবি। আর সেই রাষ্ট্রকে যিনি ক্ষমা করেন ও আমাদের ছেড়ে যাবার আগে ফের কবিতা লেখার কথা বলে যান, তিনিই মহাকবি।"

"মানুষের কথা" কবিতার দুটি অংশে মানুষের পারা না পারা নিয়ে কবির একান্ত দর্শন " শোক আর শ্লোক এড়িয়ে কবে আর সামাজিক ছিল মানুষ !" ঐ কবিতার দ্বিতীয় অংশের শেষ লাইন " বস্তুত, সময়ের দ্বিধা নিয়েই মানুষ থেকেছে মানুষের পাশে। " কয়েকটা শব্দ নিয়ে একেকটা বাক্য যা পাঠকের মনে এঁকে দিচ্ছে কিছু দৃশ্য যার থেকে প্রতিভাত হচ্ছে কবির একান্ত দর্শন। এখানে প্লেটোর ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছে ' পোয়েট্রি ইজ নিয়ারার টু ভাইটাল ট্রুথ দ্যান হিস্ট্রি ।''

' অলৌকিক প্রকল্প ' কবিতায় লিখেছেন " কখনও কখনও / আমার বুকে হাত রেখে শুয়ে থাকে / আমার ছেলে।" আবার লিখছেন " সমুদ্র পার হচ্ছে জন্ম - মূক আমার একমাত্র ছেলে / কখনও বা পারাপারে সাহায্য করছে আর কাউকে.../
কখনও কখনও / আমি শুয়ে থাকি। / সন্তান যেমন শুয়ে থাকে তার বাবার খুব কাছটিতেই।" কবিতায় টুকরো টুকরো ছবির মধ্য দিয়ে একজন মানুষের ইচ্ছে এবং অসহায়তা ফুটিয়ে তুলেছেন।

' শেষবেলা ' কবিতার কিছু শব্দ যে ছবি আঁকে যেমন "কালো পেঁচার জলছবিতে পা ডুবিয়ে / প্রতিজ্ঞা করি সমস্ত অধিকার বর্জন / করুণার পাত্র থেকে উঠে, গা ঝাড়া দিয়ে এইমাত্র / রোদে উন্মোচিত হই, গৃহযুদ্ধ, যুদ্ধে পুনর্জন্ম।  কিম্বা ' হলুদ বিকেল '  কবিতায় "মেদুর বিরহে উন্মুক্ত যুদ্ধযাত্রা শেষে / ফিরছি এখন সীমা অতিক্রমে প্রতিবিম্ব / যাপন জেনেছে পশুপাখি, ঊর্ণনাভের  ঈশ্বর " এই লাইনগুলিতে যে ছবি উঠে আসছে তা পাঠককে নিয়ে যায় অবচেতনের সীমাহীন দিগন্তে।  এই যে শব্দটি ঊর্ণনাভের ঈশ্বর অর্থাৎ অষ্টাপদ বা মাকড়সার ঈশ্বর ভাবনাটি পাঠককে নিমেষে এক ঘূর্ণাবর্তে পৌঁছে দেয়।  এই প্রসঙ্গে ওয়ার্ডসওয়ার্থের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে যিনি বলেছেন " পোয়েট্রি ইজ দা স্পন্টেনিয়াস ওভারফ্লো অফ পাওয়ারফুল ফিলিংস : ইট টেকস ইটস ওরিজিন ফ্রম ইমোশন রিকালেক্টেড ইন ট্রাঙ্কোয়ালিটি।"

' ঋতরূপ ' কবিতায় নিভৃত যাপনের মুগ্ধ কবিকে দেখি যিনি লিখছেন " এ সেই পবিত্র  ছাপাখানা / যেখানে লুকিয়ে আছে স্বস্তি, শুদ্ধচিত্ত অগ্নি / মুহূর্ত দৃশ্যে জেগে ওঠা বাতিঘরে বোধিসত্ত্ব।" শেষে লিখছেন " এ সেই অবশ্যম্ভাবী জলাধার / মায়ার শরীরে রূপক, আমার সন্তান / যেখানে লুকিয়ে আছে অলোকবর্তিকা, শেষ নিশ্বাস।"  একজন মানুষ নিরন্তর যে সম্ভাবনার সন্ধানে ব্যাপৃত থাকে সেই সম্ভাবনার স্বপ্নে কবিতার শেষ আসলে একটি ইচ্ছের সকাল। 

এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির মধ্যে ছড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো ছবির মধ্যে একজন ভবিষ্যদ্রষ্টা মানুষের যে জীবনবোধ তার সঙ্গে মিশে থাকা গল্পের যে একাত্মতা তা পাঠককে নিয়ে যায় অদৃষ্ট এক ব্যাপ্তিতে। ' দিনলিপি ' কবিতাতে দেখি  " চন্দ্রাহত নদীরা সব গাছ । / অথচ / বিকেলবেলার বৃষ্টির মতো / করতলে ধরা দিচ্ছে প্রবাহ"     আবার একদম শেষে " গাছেরা সব অন্ধকারে প্রেত হয়ে / লুকোনো চিঠি হয়ে চন্দ্রাহত নদীতে মিশে গেল। " কবিতাটির চারটি অংশের টুকরো টুকরো ছবিতে উঠে আসে ভেসে যাওয়া দলাপাকানো ফুলের মালা, পুরোনো দিনের কথা সহ নানা ভাবনার কোলাজ জ্যোৎস্না রাতের নদীতে ভেসে চলে যাচ্ছে যা ব্রিজের ওপর থেকে দেখছেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

শেষ কবিতা ' কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' যার প্রতিটি লাইনই অনন্য ।  কবিতাটির দুটি অংশ।  প্রথম অংশের শুরু " স্বনামধন্য সংসারেই থাকে নশ্বরতার প্রখর রোদ " আবার ঐ অংশের শেষ হয় " কর্ষণ অযোগ্য জেনেও গড়ে ওঠে ভূমি ও ভূমা... "।  জীবনকে, মানুষের সমস্ত কিছুকে বর্ণনা করছেন কবি। কবির অন্তর্দৃষ্টি প্রকৃত ছবিটা খুঁজে নিচ্ছে তুলে আনছে ।  দ্বিতীয় অংশে পড়ি " কারুকাজ / যা পূর্বনির্ধারিত কীলক লিপিতে, শেষপালা রাধাবিরহ / নিষ্প্রয়োজন 'খণ্ড ' লেখা। গৌণ ব্যক্তি, নক্ষত্রেপ্রলাপ / ভুর্জপত্রে লেখা থাকে সমাসবদ্ধ রোদনের গান। " কবিতার মধ্যে যে বর্ণনা সেই অপরিসীম ব্যাপ্তির প্রতিটি উচ্চারণে ধ্বনিত হয় কবির একান্তই নিজস্ব স্বর যার সঙ্গী নীরবতা, যাকে বিছিয়ে দিয়েছে এক অনুচ্চারিত মায়া। 

কাব্যগ্রন্থটিতে আছে চল্লিশটি কবিতা। প্রতিটি কবিতাই বাঁধা এক অমোঘ দর্শনে যার মূল "... অন্তত একবার নিজেকে ছাড়িয়ে নিজের দেশের সীমা এড়িয়ে সমগ্র পৃথিবীর নামে জয়ধ্বনি..." করাই কবির দায়।  কবিতাগুলি নিমগ্ন প্রতিবাদে গেঁথে যাওয়া ভাষাশৈলীর অনন্য  দর্শনে পাঠককে আকৃষ্ট করে যতই তার গড়নে আপাত নৈর্ব্যক্তিকতা থাকুক। এই কাব্যগ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুলির আর এক বৈশিষ্ট্য নানা চিত্রকল্পের উপস্থাপনা যা পাঠককে নিয়ে যায় অনুভবের গভীরে।  চিত্রকল্পের প্রসঙ্গে এজরা পাউন্ড বলেছিলেন " An 'Image' is that which presents an intellectual and emotional complex in an instant of time." এখানে ঋত্বিক যে চিত্রকল্পগুলি উপস্থাপিত করেছেন সেগুলি কবির উপলব্ধিকে বর্ণনা করেছে মূলত  উপমা ; সাদৃশ্যমূলক বা  উৎপ্রেক্ষা ; রূপক, সমাসোক্তি অলংকার নির্ভর ছন্দবন্ধে যেমন ১) বাম গালে তিল, সেখানে সন্ধে লেগে আছে..., ২) বৃষ্টিমাঠের প্রান্তে বিবর, উড়ছে চিরন্তন প্রজাপতি, ৩) যেদিকেই তাকাই, দেখি আলোয় আলো হয়ে আছে / ছোটবড় পুঞ্জ, গ্রহাণুর মতো তারা স্বাধীন, সপ্রতিভ..., ৪) পুরোহিতদের নিবিড় ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে কুমারী মা, কিম্বা ৫) চন্দ্রাহত নদীরা সব গাছ  / অথচ / বিকেলবেলার বৃষ্টির মতো / করতলে ধরা দিচ্ছে প্রবাহ / ভেসে যাচ্ছে ছিন্ন দলাপাকানো পুষ্পমালা। কবিতার পর কবিতাতে এইরকম অসাধারণ সব চিত্রকল্পের উপস্থাপনা পাঠককে নিয়ে যায় পাঠযোগ্যতা, শ্রবণযোগ্যতার পাশাপাশি দর্শনযোগ্যতার আঙ্গিকে। ঋত্বিকের কবিতায় পাঠকের অফুরান প্রাপ্তি কবির অন্যতম এই লেখন - শৈলী। এই কাব্যগ্রন্থ শব্দচয়ন, চিত্রকল্প - অলংকার এবং ভাবনা বিন্যাসের আকর্ষণীয়তার কারণে সমসাময়িক ও আগামীদিনের অনেকের কাছেই অনুকরণীয় হয়ে উঠবে বলেই আমার বিশ্বাস। এই কাব্যগ্রন্থ পাঠ আমাকে সমৃদ্ধ করলো একথা অকপটে স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই আজ। 

এই সময়ের এক উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ " কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা ", প্রকাশক সিগনেট প্রেস, প্রচ্ছদ - দেবাশীষ সাহা, মূল্য ২৫০ টাকা ।
প্রথম সংস্করণ : ডিসেম্বর ২০২৩

🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. পড়ে খুব ভালো লাগলো 🙏🏻

    ReplyDelete