জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোক গল্প—আয়ারল্যাণ্ড (ইউরোপ)এক কাঠুরিয়ার তিনটি চাওয়া /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস 
দূর দেশের লোক গল্প—আয়ারল্যাণ্ড (ইউরোপ)
এক কাঠুরিয়ার তিনটি চাওয়া

চিন্ময় দাশ

অনেক অনেক কাল আগের কথা। চারদিক সমুদ্র দিয়ে ঘেরা দেশ আয়ারল্যাণ্ড। বহুদূর ছড়ানো এক বনের ধারে বাস করে এক কাঠুরিয়া। নিত্য দিন তার কাজ বলতে একটা। সকাল হোল কী, কুড়ুল কাঁধে ফেলে, বনে ঢুকে পড়া। 
বনে ঢুকে ঘুরে ঘুরে পছন্দমত একটা গাছ বেছে নেওয়া। তার পর সেটাকে কেটেকুটে বাড়ির পথ ধরে ফিরে আসা। সেই কাঠ বেচেই, কোন রকমে টেনেটুনে সংসার চলে স্বামী-স্ত্রীর। সারাটা জীবন কুঠার চালিয়েই কেটে যাচ্ছে মানুষটার। 
একদিন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল গরীব কাঠুরিয়ার জীবনে। সকাল হয়েছে। কুঠার ঘাড়ে ফেলে, ঘর থেকে বের হোল কাঠুরিয়া। গোটা তিনেক রুটি আর খানিকটা জল ভরে দিয়েছে তার বউ। কাঠ কাটার কাজে অনেক খাটুনি। খিদে আর পিপাসা তো পাবেই মানুষটার।
বনের বেশ কিছুটা ভিতরে ঢুকে এসেছে। ঘুরে ঘুরে হয়রাণ হয়ে গেল। পছন্দ মতো গাছ আর চোখে পড়ে না। অনেক ঘোরার পর, অবাক কাণ্ড, বেশ বড়সড় একটা ওক গাছ চোখে পড়ে গেল কাঠুরিয়ার। এমন সুন্দর গাছ সচরাচর দেখা যায় না। 
আজ ভাগ্য বেশ ভালো। খুশির চোটে কুড়ুলখানা মাথার উপর এক পাক ঘুরিয়ে নিল কাঠুরিয়া। আসলে, যীশু বাবাকে পেন্নাম করে ফেলল সে। তাঁর দয়া ছাড়া, এমন গাছ পাওয়া যায় না। বেশ ভালো তক্তা বের করা  যাবে এ থেকে।
সবে কুড়ুলখানা মাথায় ঠেকিয়ে, গাছে কোপ বসাতে যাবে, কার যেন মিষ্টি আর করুণ গলা কানে বাজল। হাতের কুঠার হাতেই ধরা রয়ে গেল। কোপ বসানো হোল না। তাকিয়ে দেখল, সামনে এক পরী দাঁড়িয়ে। 
হতভম্ব ভাব কাটতে সময় লাগল একটু। পরী বলল—দোহাই তোমার, এ গাছটা কেটো না তুমি।
কাঠুরিয়া বলল—ঘরে যে একটি দানাও নাই মুখে দেবার মতো। গাছ না কাটলে পেট চলবে কী করে দুটো মানুষের! তবুও তুমি বলেছ। কথাটা রাখব আমি। এ গাছে একটি আঁচড়ও কাটব না আমি। 
এখন আর কাকুতি-মিনতি নাই পরীর হলায়। মুখে মিষ্টি হাসি ঝরে পড়ছে। বলল—তুমি জানো না, কোন সৌভাগ্যের সামনে এসে দাঁড়িয়েছ তুমি। যাইহোক, তুমি আমার কথা রেখেছ, আমি তোমাকে নিজের ভাগ্য ফেরানোর সুযোগ দেব। 
🍂

কাঠুরিয়া বোবা হয়ে যাচ্ছে পরীর কথা শুনে। পরী বলল—বাড়ি ফিরে যাও তুমি। বলতে কী, কোনও দিনই আর বনে আসতে হবে না তোমাকে। তিনটি সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে। যা চাইবে, তাই পেয়ে যাবে তুমি। তবে, ওই তিন বারই। যা চাইবে, ভেবে চিন্তে চাইবে। জীবন বদলে ফেলতে পারবে তুমি। 
বলেই পরী মিলিয়ে গেল তার সামনে থেকে। কাঠুরিয়াও বাড়ির পথ ধরল। সব কথা বউকে না শুনিয়ে পারবে না সে। কুড়ুল, খাবারের পুঁটলি, জলের বোতল, চটপট গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি রওণা হোল কাঠুরিয়া।
যখন বাড়ি এসে পৌঁছাল, কী অবাক কাণ্ড! জলের বোতল শূণ্য। পুঁটলিতেও নাই খাবারের একটি দানাও।
এও নিশ্চয় সেই পরীর যাদু। আর কীই বা হতে পারে? মাথায় ঢুকছে না কিছু। এদিকে, এত তাড়াতাড়ি তাকে ঘরে ফিরতে দেখে, বউ তো অবাক। নিত্যদিন বনে যায় মানুষটা। নিত্যদিন ঘরে ফেরে আকাশের সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়বার পর। আজ এমন অসময়ে কেন? 
--কীগো, এখন ফিরে এলে যে বড়? তাও আবার খালি হাতে! কী, হয়েছেটা কী? 
বউকে সব খুলে বলল কাঠুরিয়া। যেকোন তিনটি জিনিষ চাইলে যে পেয়ে যাব বলেছে পরী, তাও জানাল বউকে। 
শুনে তার বউ বিভ্রান্ত। বিশ্বাসই হচ্ছে না তার। কাঠুরিয়া বলল—এসব কথা পরে চিন্তা করা যাবে। এখন কিন্তু আমার একটা মাংস পুডিং খেতে মন চাইছে।
অমনি অবাক কাণ্ড! খাবার টেবিলে এক প্লেট মাংস পুডিং হাজির। টেবিলে ঠক করে প্লেট বসাবার শব্দ কানে যেতে, দুজনেই সেদিকে তাকিয়েছে। সত্যি সত্যি প্লেট ভরতি পুডিং হাজির। 
পুডিং দেখে বউয়ের চোখ কপালে উঠে গিয়েছে। এমনটা আবার হয় না কি? নিশ্চয় এটা সেই পরীর কাণ্ড। অমনি তাড়াতাড়ি বউটা তার দু’হাত দিয়ে, স্বামীর মুখ চেপে ধরল। বউ বলল-- একটা শব্দও আর মুখ দিয়ে বের করবে না তুমি। সর্বনাশ হয়ে যাবে তাতে। হাতের লক্ষ্মী হাতছাড়া হয়ে যাবে।
ফিসফিসিয়ে স্বামীকে বলল—বলো, ভালো একটা টেবিল-চেয়ার নাই। পরণে ভালো পোষাক নাই। এই উলুঝুলু ছেঁড়া জামাকাপড়ে কি পুডিং খেতে বসা যায় না কি? 
কাঠুরিয়া একেবারে পোষা তোতাপাখির মত আউড়ে গেল বউয়ের শেখানো কথা গুলো। 
অমনি আবার সেই অবাক করা কাণ্ড। কয়েক প্রস্থ জমকালো জামাকাপড়ের একটা স্তুপ সামনে হাজির। 
বউও সাথে সাথে আবার স্বামীর মুখ চেপে ধরেছে। ধৈর্য না ধরে, সামান্য কিছু যদি চেয়ে বসে মানুষটা! বউটা বলল—এবার বলবে, বাব্বা, এত দামী দামী কাপড়চোপড়? এসব তো দেশের রাজা আর জমিদারেরা পরে থাকে। এগুলোর একটা কাপড় কাচবো, সে মুরোদও তো আমাদের নাই। তবে, যদি একটা নিজের জমিদারী থাকত আমার, আর কোন ভাবনা ছিল না।
অমনি একেবারে ভোজবাজির মত কাণ্ড! কোথায় গরীবের কুঁড়েঘর? তার বদলে বড়সড় একটা অট্টালিকা। মখমলের গদি দেওয়া নরম সোফায় বসে গল্প করছে দুজনে। লোকলস্কর আসা-যাওয়া করছে বাড়িতে। 
বাইরে ঝকমকে জমকালো রেকাব চাপানো তিন-চারটে ঘোড়া। একটা জমকালো গাড়ি আর কোচয়ান। ভিতরে খাবার টেবিলে, রাজার দেওয়া একটা সনদ। গরীব কাঠুরিয়ার জন্য, আস্ত একটা জমিদারি বরাদ্দ করা হয়েছে। 
সেদিন থেকে অভাবের জীবন শেষ  হয়ে গেল কাঠুরিয়ার। ঘোড়া হাঁকিয়ে জমিদারি মহালে টহল দিতে যায় সে। তার বউ হাওয়া খেতে যায় জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে। দিব্বি দিন কেটে যায় দুজনের।
একদিন বউ জেদ ধরে বসল-- চলো না গো। সেই ওকগাছটা দেখবো। আর, যে আমাদের অভাব ঘুচিয়ে দিল, সেই পরীকে দেখবো দু’চোখ ভরে।
বনের গভীরে গিয়েছিল দুজনে মিলে। কিন্তু পরীর দেখা ত হয়ইনি। আশ্চর্য ব্যাপার, অনেক খুঁজেও, বুড়ো ওক গাছটাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি আর কোন দিন।

Post a Comment

0 Comments