জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব- ৩৮/গৌতম বাড়ই

চিত্র- মণিদীপা দাস 

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৩৮
গৌতম বাড়ই


মাসানজোরে সেই দুপুরে

সুশোভন তার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন,  বসন্তসেনা মৃদুস্বরে বলল-" বাবা তোমার সাথে আমি আমার মাকে পাশাপাশি যেতে দেখলাম। তোমরা দুজন হেঁটে চলেছ বাঁধের উপর দিয়ে। " 

-- " কী বলছিস কী! আমরা তো সবাই এই আগে পিছে মিলে চলছিলাম,  হয়ত ফুট বিশেকের দূরত্বেই সবাই  হাঁটছিলাম। আমি, তোর আলোমাসি, তুই আর ভালোমামি একদমই কাছাকাছি ছিলাম। তা কী করে হয়? ওটা তোর হ্যালুসিনেসন বা মতিভ্রম। " 
বসন্তসেনার ঘোর তখনও কাটেনি। বলল-"মা তারপর ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে হারিয়ে গেল। হ্যাঁ বাবা, আমি মাকেই দেখলাম।মা ছাড়া অন্য কেউ নয়!" 

তার আলোমাসি বলল- " হ্যাঁ রে হাসনুমা তুই ঠিকই দেখেছিস। দীপশিখা আমাদের সাথে হয়ত সবসময়ই আছে। তুই তোর মাকে কখনও যেমন মনে হারাস‌ না, তোর মা'ও তোকে ছেড়ে থাকতে পারে না। আমরা সবাই বেড়াতে এসেছি, আনন্দ স্ফূর্তি করছি, ও আমাদের ছাড়া থাকতে পারবে? সেই নশ্বর দেহে হয়ত  ধরা দিচ্ছেন না কিন্তু পরমাত্মা বলে যে শক্তি আছে, তাকে আমিও বিশ্বাস করি। " 

বসন্তসেনার ভালোমামি বলে উঠলেন-" কিন্তু হাসনু তো প্রচন্ড যুক্তিবাদী মেয়ে, তাই তো জানতাম!" 

ভালোমামি কণিকা আবার বলে উঠলেন-" মানুষের মনের খবর কে রাখে? মানুষ তো নিজেই তার মনপাখিকে চেনে না। " 


সত্যি তো তাই। আর এইসব কথার মাঝে ধীরে ধীরে 
বসন্তসেনা এবারে খানিকটা যেন বাস্তবে ফিরে এলো, তার চোখেমুখে সেই স্বাভাবিক ভাবটা সবার নজরে এলো এবারে । এরপর তারা সবাই আবার হাঁটতে লাগলো ড্যামের ওপর দিয়ে। সমস্তটা মিলিয়ে এক অপরূপ দৃশ্য এখানে। বাঁদিকের হাতে অনেক নিচে সরু সবুজ  জলের ধারায় ময়ূরাক্ষী বয়ে চলেছে, আর একদিকে দুপাশের পাহাড়ের মধ্যে মাসানজোর ড্যামের বিস্তীর্ণ জলরাশি। মাছরাঙা আর বড় বড় সারস পাখি কিছু নজরে পড়ল। বড় নির্জন, কোলাহলমুক্ত এখানের প্রকৃতি। সবার মুখেই কিছুক্ষণ পরে এই প্রশান্তি ফিরে এলো। শুরুতে এসে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়লেও , এখন সবাইকে দেখে সুশোভনেরও খুব ভালো লাগছে। কারণ, এবারের বেড়ানোর সমস্ত পরিকল্পনা তো তারই। অন্যদের আনন্দ সে নিজের অন্তরে নিস্তব্ধভাবে গ্রহণ করল। আনন্দের এই নিস্তব্ধতায় অন্তর্নিহিত প্রাণ সবার  ভেতরে যারপরনাই উছলে ওঠে। তাই তো আমরা প্রকৃতির মাঝে গিয়ে দাঁড়াই। নির্জনতা খুঁজে ফিরি বারবার। 

🍂

মাসানজোরে সেরকম ভালো খাওয়ার হোটেল নজরে পড়ল না। বিকেলের দিকে সিউড়িতে এসে এক রেস্টুরেন্টে বসে সবাই হৈ হুল্লোড় করে খাবার খেল। তবে আজকে একবেলা সবাই তারা ভাতটাকে বাদ দিয়ে রাখল। রিসোর্টে বলেই রাখা হয়েছে, আজ রাতে ওখানে দেশি খাসির মাংস দিয়ে ডিনার হবে। ভালোমামা তো গাড়িতে বসেই বোলপুর আসবার পথে বলে দিল, "আমার তো সুশোভনদা আর তর সইছে না, ডিনারের আর ক'ঘন্টা বাকি আছে? " ভালোমামি মামার কথা শুনে খ্যাক করে উঠে বলল- " উ - দেখো বাবুর একটা মাত্র দিন, শুধু দুপুরে ভাত খাওয়া হয়নি বলে , রাতের ডিনারের চিন্তা। তাও সদ্য ভাত বাদ দিয়ে মোগলাই পরোটা, কষা চিকেন দিয়ে সাঁটিয়ে গাড়িতে বসেছে। "

সুশোভন ভালোমামিকে উল্লেখ করে বলল- " আহা!  কণিকা, ও না হয় ভোজনরসিক খেতে ভালোবাসে, কিন্তু আমারও তো পরাণ তাহাই চায় গো, টোটন বলে ফেলেছে, আমি বলিনি এই যা তফাৎ। " সবাই সুশোভন কে সমর্থন করল। ভালোমামি বলল- " বাবা ভদ্দরলোকের এত জনসমর্থন আছে? " এইরকম সবাইয়ের  হাসিখুশিতে , নানান কথায়, বিভিন্ন গল্পে, তাদের গাড়ি এসে সোনাঝুরির রাস্তায় এসে দাঁড়ালো। সন্ধে হবো- হবো করছে তখন। 

আজ শনিবার। সোনাঝুরির সাপ্তাহিক হাটের দিন। কলকাতা থেকে উইকএন্ড কাটাবে বলে আজকাল ঝেঁটিয়ে লোকজন এই বোলপুর শান্তিনিকেতনে বেড়াতে আসে। সোনাঝুরির হাট  এখন বলতে গেলে সারা সপ্তাহ ধরেই বসে, তবে ছোট আকারে। আর প্রতি শনিবারে তা যেন উপচে পড়ে। সেদিন সোনাঝুরির বাস্তবিক হাটবার।দোকানি আর খদ্দেরে ভিড়ে ঠাসাঠাসি। সোনাঝুরির বনের ওপরের রাস্তায় গাড়ির সারি। এই গাড়ির জ্যামে নাজেহাল অবস্থা। সুশোভনদের সারাদিনের বেড়ানোর মজাটাই অনেকটা কেড়ে নিল এই সোনাঝুরির হাটের ভিড়। সুশোভনের মনে হল ,এই হাটবারে এখানের রিসোর্টে আর থাকা যাবে না। ভীষণ উৎপাত তো সারাদিন দেখছি।  হাটের ভেতরে বাউলদের সংগীত, বাজনা সব কানে আসছিলো। আর সবটা মিলে এ যেন এক হইচই হট্টগোলের দেশ। এই সোনাঝুরি, খোয়াই আর তার ধারে শালবন , সবটাই নাকি লোকের কাছে খুব পরিচিতি পেয়েছে একটা বাংলা টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তায়। এখন যে কোনও বেড়ানোর জায়গার মতন , এ শান্তিনিকেতনেও ছোটোবড় অসংখ্য হোটেল  আর রিসোর্ট। এর যেমন ভালো দিক আছে, আবার খারাপ দিকও, পুরোটা কংক্রিটে মুড়িয়ে ফেলবার আগে একটু বিধিনিষেধ রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের শান্তিনিকেতনর জন্য জরুরি , সুশোভনের তাই মনে হল। সন্ধের ভরাট সোনাঝুরি বনে দাঁড়িয়ে। শান্তিনিকেতন আর কতদিন আনন্দ নিকেতন থাকবে? 

সোনাঝুরির এবারের শেষরাতটুকু

বসন্তসেনারা সবাই গাড়ির থেকে ওপরের পিচ রাস্তায় নেমে পড়লেন। মেলার ভিড় ঠেলে রিসোর্টে যে যার ঘরে ফিরে ফ্রেশ হয়ে, রাত নটার মধ্যেই ডিনার সেরে নিলেন। নিচে বাউলদের অস্থায়ী আখড়া রিসোর্টর সামনে, গানের কলি ভেসে আসছিলো বাতাসে -' কে গড়েছে এমন ঘর, ধন্য কারিগর। ঘরের মাপ চৌদ্দ পোয়া চৌদ্দ ভুবন তার ভিতর। ' আবার ধরেছে সেই বাউলের গলায়, যার নামটি সুশোভন জেনেছিল পরে-' কেমনে ধরবে তারে। ও মন , মনের মানুষ বলিস যারে। সে যে রয় ধরাময় , হায় রে ধরা না যায়, অধরা কে ধরতে পারে? ------সে যে অন্তরে বাহিরে বিরাজ করে, প্রান্তরে কি ঘোর কান্তারে। ---- না জলে অনলে অনিলে হায়রে নাহি মিলে, পশ্চিমে অকুল পাথারে।' আবার কখনও গেয়ে উঠেছিল জনপ্রিয় - 'খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়। ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতাম পাখির পায়।' এ সবই গাইছিলো দিলীপ বীরবংশী বলে এক বাউল। সুশোভন গান শেষে হলে বাউলের হাতে আজকেও কিছু টাকা দিয়ে আসে শিল্পীর পারিশ্রমিক হিসেবে। 

সবাই আজ বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে, উপভোগ করছে বাউল সংগীত। ভালোমামা বলে উঠল-" এই গানের কলিগুলো কিন্তু লালন ফকিরের। ভালোমামি বলে উঠল-" দেখো বাপু তুমি আবার ঐ পথে হেঁটো না কিন্তু। দেখছি এ জগতের খোঁজ খবরও তোমার জানা আছে। তুমি বাউল হলে আমি বোষ্টমী হতে পারব না, তোমায় অন্য এক বোষ্টমী খুঁজে নিতে হবে। হুমমম।" 

আলোলিকা, বসন্তসেনার আলোমাসি আজ সাদার ওপরে হাল্কা নীলের লতা পাতার কল্কে করা কাজের সুতির শাড়ি পড়ে এসেছে, আলোমাসিকে দেখে বসন্তসেনা নিজেই মুগ্ধ হচ্ছে বারবার। বাবা আর অভিকাকুও দেখছে বারবার আলোমাসিকে হয়ত সেই মুগ্ধতায়। আলোমাসি  খুব সাধারণ শৃঙ্গার স্পর্শে নিজেকে অপূর্ব সুন্দর করে উপস্থিত করতে পারে। ভালোমামাও মামিকে লুকিয়ে যে চোরাগোপ্তা দৃষ্টি হানছে না, তা কে বলতে পারে! একমাথা চুল এখনও, যার পেছনটা এই অন্ধকারে আরও মোহময় হয়ে উঠেছে। ভালোমামিকেও আজ খুব সুন্দর লাগছে বসন্তসেনার। আর বসন্তসেনার  নিজেকে? আলোমাসি বলে দিয়েছে রুম থেকে বেরোনোর সময় হাসনুমাকে, তুই তো আমার ফুটফুটে রাজকন্যা!

সুশোভন বলেন- "আমাদের বাউল সংগীত তো আমাদের এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আজ জগতজোড়া এর খ্যাতি। ইওরোপ , আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াতেও পৌঁছে গিয়েছে এর খ্যাতির বিবরণ । তবে আমরা কী জানি আমাদের এই বাংলাভাষার উদ্ভব হল কী করে? " তারপর নিজেই বলতে শুরু করেন-" আজ তোমাদের সবার কাছে আবারও বলছি, আমি আর হাসনু-মা যৌথভাবেই একটা বাঙলা উপন্যাসে হাত দিয়েছি। এই উপন্যাসটি গড়ে উঠবে পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক যুগের সন্ধিক্ষণে এই বাঙলার এক অতীব সুন্দরী, স্বাধীনচেতা রাজকন্যা, তিনি আবার যে কে সেই নন, একদম তৎকালীন বঙ্গেশ্বরের কন্যা। তাঁকে নিয়ে। আর এইসব ঐতিহাসিক উপাদান নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়েছি, বাংলাভাষার বিভিন্ন অজানা দিক। " সবাই মনযোগ দিয়ে শুনছে বলে সুশোভন আবার বলতে শুরু করলেন-" আমাদের দেশ ভারতবর্ষ তো ভাষার অরণ্য। ভারতকে চার ভাষা বংশের দেশ বলে। যেমন, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, ভোটচিনা আর ভারতীয় আর্য ভাষাবংশ। আর্যভাষার প্রথম দিকে বৈদিক ভাষা আর সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ছিল। বৈদিকভাষা বেদ পুরাণের ভাষায় সীমাবদ্ধ থাকলেও, সংস্কৃত ভাষা লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে প্রাকৃত ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। এই প্রাকৃত থেকে এলো পালিভাষা, যে ভাষা বৌদ্ধগণ ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে আবার এর থেকে মগধ রাজ্যে মাগধীপ্রাকৃত ভাষার জন্ম হল। মাগধী প্রাকৃত থেকে শৌরশ্রেণী অপভ্রংশ, মহারাষ্ট্রী অপভ্রংশ আর মাগধী অপভ্রংশ সৃষ্টি হয়েছিল। আরও আরও পরে এই মাগধী অপভ্রংশ থেকে ওড়িয়া, অসমীয়া আর বাংলাভাষার উদ্ভব হল। এরূপ ভাষার সৃষ্টির জন্য কাছাকাছি জনবসতির ভাব আদানপ্রদানের সুবিধা হল এবং তার প্রয়োজনও ছিল। বর্তমান আসাম, উড়িষ্যা আর বাংলা তো পাশাপাশি রাজ্য। রাজকন্যা সুসীমার মা ছিলেন কলিঙ্গরাজের কন্যা। এতে বোঝাই যাচ্ছে পাশাপাশি দেশে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার রীতিও ছিল। এই হল ভাষার একটু কচকচানি তোমাদের কাছে। 

অভিকাকু বললেন-" বাহ্ ! হাসনুমা , আমি তো তোদের উপন্যাসের প্রকাশিত হবার দিনের জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলাম। শোভন, বেশ লাগলো কিন্তু শুনতে। "

-"এবারে এই বাউল নিয়ে কিছু কথায় আসছি।  " বলে, বসন্তসেনার দিকে তাকাল, এই ফাঁকে দেখল আলোলিকাকেও। সবাই বলল, তার আগে আলোদির গলায় একটা গান হয়ে যাক। আলোলিকা বললেন-" আজ কোনও রবিঠাকুর নয়, ভাওয়াইয়া নয়, লোকগীতি বা আউল- বাউল- সুফী নয়, আমি গাইব , এই টাটকা সতেজ একটি বাংলা সিনেমার গান। সবাই বলল, হ্যাঁ, তবে তাই গাও। বেশ লাগবে। আলোলিকা শুরু করলেন গলা ছেড়ে-" এই মায়াবী চাঁদের রাতে, রেখে হাত তোমার হাতে, মনের এক গোপন কথা তোমায় বলতে চাই" 
সবাই তাতে সঙ্গত দিল, বলো! শুনতে চাই---"

রাত বেড়ে চলে । তাদের আড্ডাও খুব খুব করে জমে উঠেছে রাম লখন রিসোর্টর খোলা বারান্দায়। 

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments