জ্বলদর্চি

রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের ভাবনার আলোকে ব্যবহারিক জীবনে বেদান্ত/ জয়তী ব্যানার্জী

রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের ভাবনার আলোকে ব্যবহারিক জীবনে বেদান্ত 
      
জয়তী ব্যানার্জী
           
 "তরোতি শো কং
                   তরতি পাপো মানং 
        গুহ্য গ্রন্থিভ্যো: বি মুক্ত হ 
                   অমৃতো ভবতি:"
          মানুষের চিত্ত চির আকাঙ্খিত বস্তু, কোলাহল শূন্য শান্তিময় জীবন। যে জীবন জটিল মানসিকতায় ভারাক্রান্ত নয় বা নিরানন্দের কারাগারে যে জীবনবন্দী নয় ..কিন্তু সেই জীবনের বাস্তবতা আজ কোথায়? 
        মানুষ আজ সত্যিই শান্তির ভিখারি ।বিশ্বাসের ভিত আজ এতই ঠুনকো যে সদ্যোজাত শিশুও সমাজকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়। জীবনের প্রতিটি সৎ চিন্তাকে প্রয়োগিক কর্মের সাথে যুক্ত করতে পারলেই হয় তো অপমৃত্যু এড়ানো যাবে ,হয়তবা স্বাধীন চেতনায় জীবন ছাড়পত্র পাবে। অনুভূতিতে জীবন রহস্যের যে সূত্র ধরা পড়েছিল, তা বর্তমান বেদনা ক্লিষ্ট সমাজকে হয়ত বা শান্তির রাজ্যে বিচরণ করাতে পারে। 
       অরণ্যের প্রাকৃতিক পরিবেশে শঙ্করাচার্য বেদান্তকে জীবনমুখী করার যে স্বপ্ন দেখেছি লেন, উনবিংশ শতাব্দীর বেদান্ত সাধকদের সাধনায় তা পূর্ণতা লাভ করেছে। উনবিংশ শতকে একদিকে  রক্ষণশীল সমাজ ও অন্যদিকে ব্যবহারিক বেদান্ত সাধনা প্রখর যুক্তিবাদের পথ দেখিয়েছিল। বেদান্তের যুক্তিশীল তাত্ত্বিক চিন্তাভাবনাকে কর্মের সাথে যুক্ত করে তারা তাদের বেদান্ত কে প্রয়োগিক রূপে প্রতিফলিত করেন। তাদের বেদান্তের এই প্রয়োগিক রুপ ই ব্যবহারিক জীবনে বেদান্ত নামে পরিচিত।
       কর্মজীবনে বেদান্ত বা ব্যবহারিক জীবনে বেদান্ত কথাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রশ্ন জাগে-----
       হাজার হাজার বছর পূর্বে বৈদিক ভাবনা প্রসূত উচ্চতম তত্ত্বকে বর্তমান কোলাহল ময় কর্মজীবনে ব্যবহারিক রূপ দেওয়া কিভাবে সম্ভব? 
    অথবা, 
         প্রশ্ন জাগে_____
      বেদান্ত চর্চার অধিকারী কে বা কারা? শঙ্করাচার্যের মত অনুসারে, সাধন চতুষ্টয় সম্পন্ন সন্ন্যাসীর বেদান্ত পাঠের যেমন মুখ্য অধিকার রয়েছে, তেমনি বেদান্ত চর্চায় গৃহস্থাদিরও গৌণ অধিকার স্বীকৃত।
     স্বামীজীর ভাষায়------
          আশ্চর্যের বিষয়, যুদ্ধ ক্ষেত্র এই উপদেশের স্থান বলিয়া নির্বাচিত হইয়াছে। সেখানেই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই দর্শনের উপদেশ দিতেছেন আর গীতার প্রত্যেক পৃষ্ঠায় এই মত স্পষ্টভাবে প্রকাশিত রহিয়াছে।
      তীব্র কর্মশীলতা কিন্তু তাহার মধ্যে আবার চির শান্ত ভাব এই তত্ত্বকেই কর্ম রহস্য বলা হইয়াছে। এই অবস্থা লাভ করাই বেদান্তের লক্ষ্য।
     আবার বর্তমান কোলাহলময় পরিবেশে তথা কর্মজীবনে বেদান্ত চিন্তার প্রয়োগ সম্ভব কিনা তার ইঙ্গিত মহাভারতের গীতায় স্পষ্ট। কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনের কোলাহল এর মধ্যেও অর্জুন উচ্চমার্গের বেদান্ত তত্ত্ব সেবন করেছেন এবং তার ব্যবহারিক প্রয়োগ করেছেন।
      বিবেকানন্দের ভাবনায় বলা যায়______
      বেদান্ত দর্শন কেবল অরণ্যে ধ্যানোলব্ধ নয় ,পড়ন্ত ইহার সর্বোৎকৃষ্ট অংশগুলি সাংসারিক কার্যে বিশেষ ব্যস্ত ব্যক্তিদের দ্বারাই চিন্তিত ও প্রকাশিত ।লক্ষ লক্ষ প্রজার শাসক সার্বভৌম রাজা অপেক্ষা অধিকতর কর্মব্যস্ত মানুষ আর কল্পনা করা যায় না।
🍂

      বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের কর্মজীবনে বেদান্ত বা ধারাবাহিক জীবনে বেদান্ত -----তত্ত্বটি আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই হোঁচট খেতে হয় ,উভয়ের অদ্বৈত তত্ত্বের ব্যাখ্যা নিয়ে .....একজন বেদান্তকে জীবনের সাথে জড়িয়ে অদ্বৈত তত্ত্বের ব্যাখ্যা করলেন; প্রকৃতির খেলা তার কাছে মায়ার খেলা। স্রষ্টা তার কাছে মায়ার বাঁধন ; সম্ভোগ নয় : ত্যাগ ই জীবনের পরম আদর্শ। জগৎ সংস্থার নিমিত্তে জীবনের মহৎ কর্মকে বিলিয়ে দিয়ে যিনি সন্ন্যাসী হয়ে ওঠেন, তিনিই আবার খন্ডবোধের মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হন। এই উত্তরণের চাবিকাঠি প্রেম-- প্রেম ই জীবনের বিরুদ্ধ সত্তাকে ধ্বংস করে অখণ্ড তত্ত্বের মাধ্যমে ধর্মে উত্তীর্ণ করে। 
     তাই তিনি বললেন-----
         বেদান্ত যদি ধর্মের আসন অধিকার করতে চায়, তবে উহাকে একান্তভাবে কার্যকর করিতে হইবে। আমাদের জীবনের সকল অবস্থায় উহাকে কার্যে পরিণত করিতে হইবে। শুধু তাহাই নহে ,আধ্যাত্মিক ও ব্যবহারিক জীবনের মধ্যে যে একটা কাল্পনিক ভেদ আছে, তাহাও দূর করিতে হইবে। কারণ বেদান্ত এক অখন্ড বস্তু সম্পর্কে উপদেশ দেয়।
          অপরদিকে প্রকৃতির দূত রবীন্দ্রনাথ অখণ্ডবোধকে ব্যাখ্যা করেছেন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ।রূপ রস গন্ধভরা জগত.... তার কাছে লীলার উপাদান। যেখানে সুর আর ছন্দের ঝংকারে ধ্বনিত হয়েছে তার অনুভূতি ।তাই তিনি বললেন--
         আমাদের সকল আকাঙ্খার মূলেই জ্ঞানে অজ্ঞানে সেই অদ্বৈতের সন্ধান রহিয়াছে। অদ্বৈত ই আনন্দ ।এই যিনি অদ্বৈত, তাহার উপাসনা করিব কেমন করিয়া ?পরকে আপন করিয়া ,অহমিকাকে খর্ব করিয়া , বিরোধের কাঁটা উৎপাটন করিয়া, প্রেমের পথ প্রশস্ত করিয়া----
         আত্মবৎ সর্বভূতে সু য:
         পশ্যতি স: পশ্যন্তি।
                এইভাবে রবীন্দ্রনাথ তার অনুভবের জগতকে সামনে রেখে যে চরম সত্যে উপনীত হয়েছিলেন, তা তিনি বিচার করেছেন বেদান্তের মাপকাঠিতে ।সেই চরম সত্যের সমর্থন তিনি খুঁজেছেন উপনিষদের মন্ত্রে আর তার প্রতিফলন ঘটেছে ,তারই লেখা কাগজ-কুচির পাতায়, কখনো কবিতা, কখনো গান ,কখনো প্রবন্ধ ,গল্প উপন্যাস কখনো বা ব্যক্তিগত জীবন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে ।কবির দার্শনিক চিন্তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে । তাঁর দর্শন চিন্তা কোন তত্ত্ব কথা নয় ,ব্যবহারিক জীবনেরই প্রতিফলিত রূপ। উপনিষাদিক ভাব রসে সিক্ত কবি জীবনের চরম সত্য উপলব্ধি করতে চেয়েছেন তাঁর জীবনচর্চার মধ্য দিয়ে।
      রবীন্দ্রনাথের ব্যবহারিক বেদান্তের অন্যতম প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় ,তার কর্মময় জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ।তিনি জীবনের প্রাকলগ্ন থেকেই বর্ণাশ্রমের প্রশংসা করলেও জাতিভেদের ওপর নিষ্ঠুর কষাঘাত করেন; কবির মতে, জীবনে গার্হস্হে প্রবেশ করে ,ভোগবিলাসের যেমন প্রয়োজনীয়তা আছে তেমনি ব্রহ্মচর্যে সন্ন্যাসীর ন্যায় বৈদান্তিক অনুভূতিরও তেমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শিক্ষা শুধু বাহ্যিক রূপ নয়, অন্তরের মূল্যবান অনুভূতি, তাই অন্ত:রাজ্যের চেতনার বিকাশের দ্বারা বিশ্ব মানবতা বোধকে জাগ্রত করবার ডাক দিয়েছিলেন বেদান্ত পিপাসু সন্ন্যাসী । বেদান্তের অদ্বৈত ভাবনাকে      বাস্তবে রূপদান করতে বেলুড় মঠ ও অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠা করলেন স্বামীজি ।তিনি চেয়েছিলেন বেদান্তের তত্ত্ব জীবনের সকল অনুভূতিতে ছড়িয়ে পড়ুক।
     উপনিষদের 
                 "উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত_"___
বাণীতে জাগরিত হোক অন্তঃসত্ত্বা.... তাই সন্ন্যাসীর উপদেশ-----
     "ওঠো ,জাগো ,হে মহান !
      এ নিদ্রা তোমার সাজেনা, ওঠো.... এ মোহ তোমার সাজেনা; তুমি নিজেকে দুর্বল ও দুঃখী মনে করিও না। হে সর্বশক্তিমান ওঠো; জাগো ,স্বরূপ প্রকাশ করো, জগতকে অন্তর্নিহিত শক্তি দেখাইয়া দাও।"
     তাইতো যতই আমরা বেদান্ত কে কর্মজীবনে বা বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর কথা বলি না কেন ,যতই বেদান্তের অন্বয় ভাবকে জীবনের পথে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি না কেন, বেদান্তের চরম প্রতিপাদ্য যে অখণ্ড তত্ত্ব তা জীবন তত্ত্বের অনেক উর্ধ্বে ।বেদান্তের আদর্শ আর বাস্তবের আদর্শের মধ্যে শতযোজন দূরত্ব।
      তাই সত্যই কি বেদান্তের চরম আধ্যাত্মিকতা বাদ কে প্রতিদিনের জীবনে কাজে লাগানো সম্ভব? তাই তো বলা যায়, উপনিষদের নৈতিক দর্শন নৈরাশ্যবাদী নয় ,আনন্দবাদী.... আনন্দের পথ ধরে উপনিষদ আত্মতত্ত্বকে জানতে শেখায় ,ধর্মতত্ত্বকে জানতে শেখায় যে মানব জীবন ও সত্যম্ শিবম্ সুন্দ রম্ এর ধ্বজা ধারী।
          তাইতো রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ চিন্তার পথে যে এক চরম সত্যের খোঁজ করেছেন, উপনিষদের হিরন্ময় পাত্রের উন্মোচনে যে সত্য প্রকাশিত, সে সত্যের প্রকাশেই কবি অনুভব করেন-----
      তোমারও অসীমে 
             প্রাণ মন লয়ে 
             কত দূরে আমি ধাই ই ।
       এই সত্য মানবজাতির ঘরের সীমানা ছাড়িয়ে এক অজানা অনুভূতি লোকে বিরাজ করে, যেখানে থাকে না গৃহী- সাধুর বৈষম্য... যেখানে মানুষই দেবতার আসন দখল করে। বেদান্ত ব্যাখ্যায় উপনিষদের চরম আধ্যাত্মিক তত্ত্ব নৈতিক দর্শন এ পরিণত হয়ে জীবনের প্রতিটি কর্মকে সার্থক করে। এটাই বেদান্তের অন্যতম কার্যকরী রূপ।

              

Post a Comment

0 Comments