জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে/নবম পর্ব /মলয় সরকার


সৌঞ্জেনের রোপওয়ে

উদয়ের পথে
নবম পর্ব

মলয় সরকার


সত্যি,জাপান দেশটা ছবির মত সাজানো। এমনিতেই জাপানীদের সাজানোর খ্যাতি জগদবিখ্যাত। জাপানী ফুল সাজানোর পদ্ধতি ,ইকেবানা তো জগৎ জয় করে বসে আছে। এছাড়া বনসাই, সেও তো জাপানী পদ্ধতি।আসলে আরও একটা কথা আমার মনে হয়, যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী , সে জাতি তত বেশি উন্নতি যেমন করে , তেমনই অন্যান্য সমস্ত ব্যাপারেও অগ্রণী।তা না হলে , যে দেশে অনবরত ভূমিকপ আর আগুনে সমস্ত কিছু প্রায়ই ধ্বংস হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেছে, তাদের এর পরেও এত উন্নতি কি করে হয়।আমরা তো এখানে যা কিছু দেখছি মন্দির থেকে রাজবাড়ি, তার কিছুই, শুনছি, আসলটা নয়। পরে, হয় একবার নয় তো কয়েকবার পুনর্নিমাণ হয়েছে।
আমরা সন্ধ্যার মুখে এসে নামলাম ছোট্ট পাহাড়ী শহর হাকোনে তে।আসল শিনজুকু থেকে এখানে আমাদের আসার কথা ছিল Romance car এ। কিন্তু টিকিট কাটতে গিয়ে অল্প ভুলের জন্য সে ট্রেনে আসা হয় নি। ও ট্রেনটা আর কিছুই নয়, আর একটু স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ আর বেশী গতির। আমরা এসেছি এক্সপ্রেস ট্রেনে।এটাও খুবই সুন্দর।
🍂

১৮৮৮ সালের পয়লা অক্টোবর এখানে ঘোড়ায় টানা ট্রেন দিয়ে রেল ব্যবস্থার সূচনা হয়। পরে ইলেক্ট্রিক ট্রেন চালানো হয় ১৯৩৫ সালে। মাঝে এটি ১৯১৯ সাল থেকে ফানিকুলার রেল বা মোটর দিয়ে তারে টানা রেল চালানো হয় ।
স্টেশনটি একেবারে একটি পাহাড়ের দেওয়াল ঘেঁসে। পাশ দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে হায়া নদী যা ওডাওয়ারা ও হাকোনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অতিক্রম করেছে প্রায় ২৬ কি মি দীর্ঘ পথ। আসলে এটি একটি পাহাড়ী ঝরণা নদী। স্টেশনের বাইরেই ,শহরে যাওয়ার জন্য এর কতকগুলি ব্রিজ রয়েছে।যদিও জানা রয়েছে, স্টেশনের সামনেই আমাদের থাকার জায়গা, তবু রাস্তা জানা না থাকায় এই অল্প রাস্তার জন্য, বিশেষ করে পাহাড়ী উঁচুনীচু  বলে ,ট্যাক্সি নেওয়া হল। তার পর থেকে অবশ্য আমরা আর গাড়ী নিই নি।
ক্রমশঃ ঘনিয়ে আসছে পাহাড়ী সন্ধ্যা। ঘরে ঢোকার মুখেও আমাদের আতিথ্য করার কেউ নেই, কেউ বলে দেওয়ারও নেই যে, এটাই সঠিক জায়গা কি না। একটা গ্রামীণ অথচ পরিচ্ছন্ন পাহাড়ী জায়গা।
শুধু আমাদের হাতে আছে মোবাইল আর তাতে দেওয়া পরপর কি করতে হবে তার মেসেজ গুলো।সেগুলোই ভরসা।নম্বর লাগানো লক। ঠিকঠাক করে লাগাতেই খুলে গেল চিচিং ফাঁকের দরজা।
ঢুকেই দেখি লেখা আছে, একটা নোটিস, এখানে জুতো রাখুন। তার পরেই দেওয়া আছে পায়ে গলাবার জন্য ঘরের একগাদা চটি বিভিন্ন সাইজের। অসুবিধা হচ্ছে, এই কথাটা বলার জায়গাই তো রাখে নি। ঘরে ঢুকে দেখি পরিচ্ছন্ন ঝকঝক করছে সব। এমনকি রুম হীটারটি পর্যন্ত ঠিক জায়গায় রাখা। রান্নার জায়গায় কাটলারি, রান্নার সমস্ত বাসনপত্র, মসলাপাতি সাধ্যমত, প্রাথমিক রান্নার জিনিসপত্র, ইত্যাদি সব ঠিক ঠিক জায়গায় গুছিয়ে রাখা রয়েছে। সেই সঙ্গে এটাও বলা রয়েছে, যে, ঘর নোংরা না করতে, এবং সব কিছু ঠিক জায়গায় গুছিয়ে রাখতে।আমার ঠিক মনে হল, রূপকথার ভুতুড়ে বাড়িতে যেমন রাজপুত্র বা রাজকন্যা ঢুকে দেখে যে , সব গুছানো রয়েছে, খাবার দাবার, বিছানা সব, ঠিক যেন তেমনই।
হাকোনের ট্রেন ও তার ড্রাইভার

আমরা তখনই জিনিসপত্র রেখে, আরও অন্ধকার হওয়ার আগেই, বের হলাম দু একটা জিনিস কিনে আনতে, কারণ রাত বাড়ছে। বেশ একটু চড়াই ভেঙ্গে পৌঁঁছালাম একটি ৭/১১ এর( এটি একটি আমেরিকান চেন স্টোর, যার নাম ৭/১১) দোকানে। চারিদিকে সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠছে। নিঃশব্দ চারিপাশ। তার মাঝে একা ধুনি জ্বেলে বসে আছে এই ৭/১১ দোকানটি। আর সমস্ত দোকানই বন্ধ। আসলে এই পাহাড়ি জায়গায় সন্ধ্যা ৬ টা বাজলেই সব দোকান বন্ধ হয়ে যায়।এখানেও যে সব কিছু পাওয়া যায় তাও নয়। তবে এক আধ বেলা চালিয়ে নেওয়া যায়।আমরা তাই দিয়েই সন্ধ্যাটা চালিয়ে নিলাম। বেশ ঠাণ্ডা এখানে। তবে শীতে আড্ডা মারার জন্য ভাল কম্বল , রুম হীটার আর মাটিতে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসার মত সমস্ত ব্যবস্থা দারুণ করা আছে। কাজেই আমরা আর সে সুযোগ ছাড়তেই চাইছিলাম না। গরম গরম চা আর অল্প কিছু স্ন্যাক্সের সাথে হীটার চালিয়ে এই পাহাড়ের মাথায়  ঠাণ্ডায় নিস্তব্ধ পরিবেশে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়ার মজাই আলাদা।সে মজা নিতে, আর, ছাড়ার মন চাইছিল না।মনে হচ্ছিল, এর মাঝেই ভূতের গল্প জমে ভাল।
জাপানীরা এমনিতেই নিস্তব্ধ থাকতে ভালবাসে, সে শহর বা গ্রাম যা-ই হোক । আর এখানে তো পাহাড়ী গ্রাম, একেবারে সাধনা করার মত নৈঃশব্দ্য।
এখানেও বাথরুম আর শৌচালয় অনেক দূরে।আর একটা কথা কথা, স্নানের জন্য মাথার উপর শাওয়ার নেই, ও ব্যবস্থাও হয় না ।এখানে হ্যণ্ড শাওয়ারেই যা কিছ স্নানের ব্যাপার সারতে হয়।এই বাড়ীটা, আসলে  ঠিক হোটেল নয় , ছোট একটা দোতলা বাড়ী।নীচের তলায় রান্না বা খাওয়ার ব্যবস্থা। আর দোতলায় দুটো শোবার ঘর, বেশ বড় বড়।পাশের বাড়িগুলো বেশ দূরে দূরে এবং সমস্ত পরিবেশ পরিচ্ছন্ন। 
হাকোনে রেলস্টেশনে স্ত্রী ও কন্যা

আজ  ১০ই এপ্রিল,ছেলে জিতের জন্মদিন। তাই সকালে ওকে শুভেচ্ছা জানিয়ে, ঝকঝকে শীতের রোদে বেরোনো হল।আজ যাওয়া এক নতুন জায়গায়। এবার কিন্তু আর গাড়ি নয়, হেঁটেই চড়াই ভেঙ্গে পৌঁছালাম স্টেশনে।সেখান থেকে আলাদা প্ল্যাটফর্মের গাড়িতে যেতে হল। ট্রেনটি মাত্র তিনকামরার। সুন্দর ছবির মত লাল ট্রেন। এর নাম হাকোনে ট্রোজান ট্রেন।
ট্রেন চলল, টানেল পেরিয়ে, ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে, ঝরণার উপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে। মনে হল ঠিক যেন দার্জিলিং বা শিমলার ট্রেনে চড়েছি। চারিদিকে নানা ফুল ফুটে আছে।ট্রেনে যারা চড়েছে, সবাই পর্যটক, তবে বেশির ভাগই জাপানী বলেই মনে হল।তবু অনেকেই সিট ছেড়ে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে যাচ্ছে।দেখার জন্য জানালাও বেশ প্রশস্ত।স্থানীয় বাসিন্দারাও এতেই যাতায়াত করে।এই কয়েকটা মুহুর্ত যেন মনে হচ্ছে ,যেন, সত্যিই শেষ না হয়।যে কোন ছবিই হার মেনে যাবে এর কাছে। স্টেশন গুলো ছোট্ট ছোট্ট, কোনটা বা পাহাড়ের ঢালের উপর নীচু থেকে উঁচু।অনেক জায়গাতেই সিঙ্গল লাইন। যদিও ভাবছিলাম, ‘ এ পথ যদি না শেষ হয়–, তবু শেষ হল। আমাদের নামতে হল গোরা স্টেশনে। 


এখান থেকে আর ট্রেন উঠতে পারবে না। আমাদের যেতে হবে ফানিকুলার ট্রেনে।এটি আসলে ট্রেন নয়। পাহাড়ের মাথা থেকে ভারী মোটরে তার দিয়ে এই কামরাগুলোকে টেনে পাহাড়ের মাথায় তোলা হয়, যদি খাড়াই পাহাড় হয়। এখানে এটিকে বলে কেবল কার।.এটি চলে সম্পূর্ণ ট্রেনের মতই।লাইনের উপর দিয়েই।এটি ২০৯ মিটারের উচ্চতা অতিক্রম করে। এখানে , জুনের মাঝামাঝি অসংখ্য হাইড্র্যাঞ্জিয়া ফুল ফুটে থাকে নানা রঙের সম্ভার নিয়ে , রেল লাইনের দু পাশে। তাই একে ‘হাইড্র্যাঞ্জিয়া কার’ বা ‘হাইড্র্যাঞ্জিয়া রেল’ও বলে। এটিতে সময় লাগে প্রায় ৫০ মিনিট। আমরা পৌঁছালাম সৌঞ্জেন। মাঝ রাস্তায়ও কয়েকটি স্টেশনে নামলে ,বেশ কিছু দেখার জিনিস আছে।আমাদের আর অত সময় হবে না , তাই সোজা সৌঞ্জেনেই এলাম। এখানে নেমেই দেখি বিশাল বিশাল চাকা ঘুরছে রোপওয়ের। কাজেই চেপে বসলাম রোপওয়ের বাক্সে। দারুণ সুন্দর ব্যবস্থা।
চলতে থাকুন আমার সঙ্গে। দেখা হবে পরের পর্বে–
ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments