সুজিত পাত্র: নমস্কার, জ্বলদর্চি পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন। বাংলা ব্যঙ্গচিত্রের সূচনা পর্বে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে যে শিল্পের সূচনা, সুকুমার রায়ের হাত ধরে যার দীর্ঘ পথ পরিক্রমা, বর্তমানে যাঁদের হাত ধরে এই শিল্প মাধ্যম এগিয়ে চলেছে তার মধ্যে আপনি অন্যতম, কবে থেকে আপনি ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন? আর হাস্যরস উৎপাদনের মত সিরিয়াস শৈলীর চর্চায় আপনি কিভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
দেবাশীষ দেব: প্রথমেই মনে করিয়ে দিই গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে এই শিল্প শুরু হয়নি, বাংলায় পুরোদস্তুর ব্যঙ্গ চিত্র আমবা প্রথম দেখি বসন্ত পত্রিকায়, যেগুলোর শিল্পী ছিলেন বাঙালি। তারপরে কার্টুন আধুনিক যুগে পা রাখলেন গগনেন্দ্রনাথের হাত ধরে। এবার আসি, আমি কেন কার্টুনে এলাম। কার্টুন হল একটা মজার ছবির মাধ্যমে একটি বিষয়ের পরিবেশন। অর্থাৎ আঁকার স্টাইল, আঙ্গিকটা মজাদার হবে, এখন কার্টুনের মজা জিনিসটা বাদ দিলে যেটা থাকে তা হল একটা হাস্যরসাত্মক বা কমিক আঁকা। আমি মূলত এই কমিক ছবি দেখে, যারা এঁকেছেন, যেমন শৈল চক্রবর্তী, নারায়ণ দেবনাথ, রেবতীভূষণ ঘোষ প্রমুখের আঁকা দেখে অনুপ্রাণিত হই। ছোটবেলা থেকেই এঁদের ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখে আসছি। এঁরা মূলত ইলাসট্রেটর ছিলেন। পরবর্তীকালে যখন আর্ট কলেজে যাই তখন এই মজার ছবি বা কমিক ইলাসটেশনের দিকে মনোযোগ তৈরি হয়। কার্টুন দেখতাম —নির্ভেজাল কার্টুন— তা সামাজিক, রাজনৈতিক, দেশি, বিদেশি—আর এসব দেখতে দেখতে আমার একটা চোখ তৈরি হয়েছে, একধরনের ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেটা ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে। আমি কার্টুনিস্ট হব—এরকম কোনো ভাবনা ছিল না। আর সেই অর্থে আমি কার্টুনিস্ট নইও। আমি মনে করি, আমি একজন কমিক ইলাসট্রেটর। আমার যা কিছু সাফল্য তা ওই কমিক ইলাসট্রেটর হিসেবেই। যেহেতু আমাকে বেশ কিছু ছবি আঁকতে হয়েছে, প্রবন্ধ নিবন্ধ রম্যরচনাধর্মী যেসব লেখা তার সঙ্গে ইলাসট্রেট করতে হয়েছে, তখন মনে হয়েছে ওই সব ছবির মধ্যে যদি আমি আমার একটা নিজস্ব ভাবনা বা বক্তব্য রাখতে পারি, তখন সেই ছবির আলাদা একটা বক্তব্য তৈরি হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে এই জাতীয় কাজ করেছি, যা কার্টুনের পর্যায়ে পড়ে। সেই অর্থে আমি একজন কার্টুনিস্ট।
সুজিত: যে কোনো শিল্পমাধ্যমে হাস্যরস একটা সিরিয়াস মাধ্যম। আপনি রং তুলির মাধ্যমে সেটা কিভাবে করেন?
দেবাশীষ : সেটা নির্ভর করছে আপনি কি বিষয় বেছে নিচ্ছেন আপনার কার্টুনের জন্য। নানাবিধ বিষয় আছে, তবে এগুলোর মধ্যে স্পষ্ট দুটো ধারা আছে। রাজনৈতিক বিষয়ের মধ্যে ভীষণভাবে প্রতিবাদসুলভ ব্যাপার থাকে, পৃথিবীর সেরা কার্টুনিস্টরা কিন্তু এই কার্টুনের মাধ্যমেই আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছেন। তখন তা নিশ্চয়ই সিরিয়াস। এর বাইরে নিছক মজাও আছে। সবক্ষেত্রেই আঙ্গিকটা বিশেষভাবে তৈরি করতে হয়। সেকারণে আমি বহু জায়গায় ক্লাশ নিই, ওয়ার্কশপ করি যে কিভাবে একটা মানুষের বা জন্তু জানোয়ারের চেহারা দিতে হয়। আসলে বিষয়টাকে ভেবে নিয়ে আঙ্গিকটা নিজেকে তৈরি করতে হয়—যা দেখে বা পড়ে মানুষ মজা পারে। এগুলোর রাস্তা জানতে হবে, কার্টুনিস্টদের কাজ দেখতে দেখতে যা তৈরি হয়।
সুজিত : কার্টুনের প্রবহমানতার ইতিহাস সম্বন্ধে যদি আলোকপাত করেন।
দেবাশীষ : কার্টুনের ইতিহাস বড় ইতিহাস, অনেক প্রতিভাবান কার্টুনিস্টকে আমরা পেয়েছি। গগনেন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সদ্য প্রয়াত অমল চক্রবর্তী পর্যন্ত। এটার একটা দীর্ঘ ধারা বয়ে এসেছে।
সুজিত: প্রাত্যহিক দিনযাপন হাস্যরসের ছবি আঁকাতে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে?
দেবাশীষ : আমার চারপাশে যা ঘটছে, আমার কাজের মধ্যে খুব স্বাভাবিকভাবে তা-ই রিফ্লেকটেড হয়, যেমন, বাঙালি বাংলা চর্চা থেকে সরে যাচ্ছে, কিংবা দাম্পত্য জীবনের নানারকম সমস্যা, বাবা-মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়ের একটা দূরত্ব তৈরি হওয়া, ডাক্তারদের ডাক্তারি করার সমস্যা ইত্যাদি এরকমই যখন যা দেখেছি তা-ই প্রতিফলিত হয়েছে আমার আঁকাতে।
সুজিত: ব্যঙ্গচিত্র টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে আপনার ভাবনাচিন্তা বা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যারা এই জগতে আসবে, তাদের প্রতি আপনার বক্তব্য?
দেবাশীষ : যারা কার্টুন জগতে আসবে তাদের নিজেদের রাস্তা নিজেদের ভেবে নিতে হবে, রাস্তা কিছু ছিল, কিছু বন্ধ গেছে, কিছু সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে গেছে, খবরের কাগজ বা ছাপা মাধ্যম অনুৎসাহী —সেখান থেকে একটা সংকট তো তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কি করা উচিত, আমরা কিভাবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাবো —যারা ভবিষ্যতে এই নিয়ে কাজ করবে, রাস্তা তারাই খুঁজে বার করবে, কারণ লড়াইটা তাদের। এখানে নতুন করে বলার কিছু নেই।
সুজিত: শিশু-কিশোরদের জন্য কাজ করার সময় আপনি কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেন?
দেবাশীষ : ছোটদের ভালো লাগাতে গেলে ছবির মধ্যে নানারকম উপাদান দিতে হয়, অংশত একটা ছবি নয়, কমপ্লিট পরিবেশ তৈরি করতে হয়। যার মধ্যে তারা অনেককিছু খুঁজে পাবে—এই যেমন ধরুন একটা বেড়াল, একটা ইঁদুর, একটা কাঠবেড়ালি ইত্যাদি আমি দিতে থাকি, যাতে ছোটদের বেশি ভালো লাগে।
সুজিত : আপনি ছোট-বড় নানান পত্রিকার পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিনেও কাজ করেছেন কখনো প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে, কখনো ইলাসট্রেটর হিসেবে। এখানে কাজ করার অভিজ্ঞতা শুনতে চাই।
দেবাশীষ : আমি শুধুমাত্র আঁকি না, লিটল ম্যাগাজিনের কথা বলছেন, সেখানে লেখালিখিও করি— তবে তা বেশির ভাগই কার্টুন সংক্রান্ত বা শিল্প সংক্রান্ত। বেশির ভাগ পত্রিকা আছে যারা সুন্দর করে পাঠায়, যাদের প্রকাশনা বেশ উচ্চমানের —সেখানে কাজ করতে ভালো লাগে। সবাই পারফেক্ট তা বলছি না। এ বিষয়ে নানারকম অভিজ্ঞতা আছে।
সুজিত : রাজনৈতিক ছবি আঁকার অভিজ্ঞতা যদি কিছু বলেন।
দেবাশীষ : রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে প্রচুর কাজ করেছি, করতে হয়েছে। তবে ততটা আক্রমণাত্মক কাজ করিনি। তবে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকা আমার পছন্দের কাজ নয়। আসলে আমি রাজনৈতিক ব্যাপার থেকে দূরে থাকি। তবে একবার সুব্রত মুখার্জী যখন মেয়র ছিলেন তখন তাঁকে নিয়ে একটা মজার কার্টুন এঁকেছিলাম। উনি খুব খুশি হয়ে অরিজিন্যাল কাজটা নিয়ে নিয়েছিলেন। এমনকি তাঁর ঘরে বসে তাঁর একটা ক্যারিক্যাচার করেছিলাম। তবে এখন তো পলিটিক্যাল কার্টুন বন্ধই হয়ে গেছে প্রায়।
সুজিত : হাস্যরস উৎপাদনে ভাবী প্রজন্মের হাস্যরস শিল্পীদের (মানে তেমনভাবে শুধু কার্টুনের এগজিবিশন ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায় না) আগ্রহ কি কমে যাচ্ছে?
দেবাশীষ : হচ্ছে না বলা ঠিক না, এই মুহূর্তে প্রায় একমাস ধরে একটা কার্টুন মেলা হচ্ছে। অনেকেই কাজ করছেন,বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহ, উদ্দীপনা নিয়ে কাজ হচ্ছে।
সুজিত: আপনি যখন কারও প্রতিকৃতি ব্যঙ্গচিত্রে কনভার্ট করছেন, সেসময় গ্রামাটিক্যাল কোনো পার্ট বা চরিত্রের চরিত্রায়ন ফলো করা—-কোনটিকে বেশী স্ট্রং মনে হয়?
দেবাশীষ : আসলে ক্যারিক্যাচার মানে হল একটা মানুষের চেহারাটাকে একটু বিকৃত করে দেওয়া, যেমন কারো নাকটা যদি লম্বা হয়, তখন তার নাকটা আরো বেশি লম্বা করে দেওয়া বা চোখটা বড় হলে চোখটা আরো বড় করে দেওয়া —এরকম বিষয়ের ওপর জোর দিতে হয়। কারো টাক থাকলে টাকটাকে হাইলাইট করা হল— এভাবেই শিখতে হয়।
সুজিত: সামাজিক অবস্থান বা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চরিত্রায়নের প্রতিকৃতি তৈরিতে তার গুণের তফাতে কি কোনো কায়দা করে কার্টুন আঁকেন?
দেবাশীষ : নিশ্চয়ই, চরিত্রের সামাজিক অবস্থান অর্থাৎ তিনি ফিল্মস্টার না রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, না অন্যকিছু, সেদিকে খেয়াল রেখে যখন আঁকতে হয় তখন বাড়তি জিনিস তো কিছু যোগ করতে হয়, যেমন সত্যজিৎ রায়ের ক্যারিক্যাচার যখন করেছিলাম, তখন সিনেমাটোগ্রাফির যে ক্যামেরা হয় তার উপর তিনি ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, একদিকে অস্কার ঝুলছে এগুলোর তো প্রয়োজন হয়।
সুজিত: কার্টুনিস্টদের কাছে রেখাতো একটা বিষয়, কিন্তু রঙের ব্যাপার নিয়ে যদি কিছু বলেন।
দেবাশীষ : এখন রঙিন ছবির চাহিদা বেশি। বিশেষ করে ছোটরা তো রঙিন ছবি দেখতে অভ্যস্ত, ফলে হঠাৎ সাদা কালো ছবি দিলে মুশকিল হয়, কিন্তু আপনার ছবিব বিষয় যদি দারুণ আকর্ষণীয় হয়, ছবি যদি নিজেই নিজের কথা বলে, সেখানে রঙ বা সাদা কালোর ব্যাপারটা বিশেষ বাধা সৃষ্টি করে না।
সুজিত: কোনো গল্প, প্রবন্ধ বা অন্যকিছু লেখা যখন কার্টুনের মাধ্যমে বোঝানো হয় তখন কিভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেন?
দেবাশীষ : সেখানে কোনো অসুবিধা নেই। মজার গল্পতে তো, মজার বিষয় থাকে, যেমন কোনো নাটকীয় মুহূর্ত, কোনো কমপ্লিমেন্ট—সেটাকেই নিজের মতো করে আঁকতে হয়।
সুজিত: জ্বলদর্চিকে আপনার বার্তা!
দেবাশীষ : আমার শুভেচ্ছা বার্তা রইল , আরো ভাল করে পত্রিকাটা হোক। সবাইকে অভিনন্দন।
অনুলিখন: রুম্পা প্রতিহার
🍂
0 Comments