জ্বলদর্চি

মানবিকতার অবক্ষয় : সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট/সঞ্চিতা সিকদার

মানবিকতার অবক্ষয় : সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট
সঞ্চিতা সিকদার 

মন রে কৃষিকাজ জানো না,
এমন মানবজমিন রইল পতিত,
আবাদ করলে ফলতো সোনা ...


মানবিকতার অবক্ষয়ে জন্ম নিয়েছে এক নতুন মানুষ, দেখতে তারা মানুষ হলেও মানসিকতাই নয়। মানুষ সামাজিক জীব তথা সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ শব্দটি মানবতার সমার্থক ,কারণ মানুষের মধ্যেই রয়েছে মান এবং হুশ। কিন্তু সেই মানুষ যখন হয়ে পড়ে আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর, সুযোগ সন্ধানী  ক্ষমতালোভী, অর্থলোভী, তখনই মানবিকতার অবক্ষয় ঘটে।  মানুষ নিজের স্বার্থের দ্বারাই পরিচালিত হয়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব মানুষকে মানবতা হীন করে তোলে। মানবিকতার অবক্ষয় ধীরে ধীরে সমাজকে করে তোলে ভঙ্গুর। সমাজের প্রগতিশীলতাকে ধীরে ধীরে নষ্ট করে তোলে। প্রশ্ন হলো মানবিকতার অবক্ষয় হয় কেন?

আমরা যদি একটু অন্যভাবে দেখি। প্রথমত, প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবার তার সদস্যদের চরিত্র গঠন করে। সন্তান পরিবার থেকে শিখতে পারে আদব-কায়দা, শ্রদ্ধাবোধ  দায়িত্ববোধ, নীতি কথা, নৈতিকতাবোধ মানবিকতা বোধ প্রভৃতি মানব জীবনের মৌলিক আদর্শ গুলি।  কিন্তু বর্তমানে মানুষ নিজেদের ভালো থাকার জন্য পরিবারের মধ্যে সৃষ্টি করছে ভাঙ্গন। আগের মতো আর যৌথ পরিবার দেখতে পায় না।  যৌথ পরিবার গুলি একক পরিবারের টুকরো টুকরো করে ভেঙে যাচ্ছে। একক পরিবারের সন্তানেরা হয় আয়া, নয় ক্রেশে থাকছে। গ্রামগুলিও ছুটছে শহরের দিকে। ফলে কৃষিজীবী মানুষও আজ তাদের সন্তানের শিক্ষার জন্য শহর মুখো। শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ফলে শিশুরা আজ ঠাকুরদা -ঠাকুমার সেই আদর স্নেহ ভালবাসায় লালিত হচ্ছে না। আজকের সভ্য সমাজের সন্তানেরা ঠাকুমার ঝুলি কিংবা রাজা -রানীর কাহিনী, ঘুম পাড়ানি গান শুনে বড় হয় না। শিশুদের প্রার্থিত নয় মহাপুরুষের জীবনী। আজকের সন্তানদের পরিবারে একাকীত্ব-  আত্মকেন্দ্রিকতা ছোটবেলা থেকেই গ্রাস করছে। শিশুদের শৈশব বলে আর আলাদা করে কিছুই নেই। ছেলেবেলা থেকেই শিশুরা ইঁদুর দৌড়ে অংশগ্রহণ করছে ,তাদের কাছে আগামীতে কিভাবে আমরা আশা করতে পারি এক সুন্দর সমাজের?
       আদিম গুহামানব থেকে বর্তমান সভ্য মানুষে আসার যে ধারাবাহিক বিবর্তন তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে উত্তরণ, উদ্ভাবন এবং বুদ্ধির ক্রমবিকাশের ইতিহাস। একক মানুষ ধীরে ধীরে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সমাজবদ্ধ জীবে পরিণত হয়েছে এবং ক্রমে সমস্ত জীবজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। 

       যে মানবিকতা বা মূল্যবোধের উপর দাঁড়িয়ে সমাজ ,সেই নৈতিকতা বা মূল্যবোধের অবক্ষয় বর্তমানে আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। মানুষ সামাজিক জীব। ব্যক্তির যেমন চাহিদা আছে, তেমনি সমাজেরও আছে। মানুষের কাছ থেকে সমাজ সব সময় সামাজিক আচরণ প্রত্যাশা করে। প্রত্যেক সমাজে তার সদস্যদের আচরণ পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি থাকে। নীতিহীন সমাজ হয় উচ্ছৃঙ্খল, বিভ্রান্তিকর ও অনিশ্চিত। নৈতিকতা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফলে মানুষের মধ্যে আসছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। নব্বই- এর দশকের মাঝামাঝি থেকে পুঁজিবাদ নীতি ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে লাগু হওয়ার পরে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে সরতে থাকে দেশ। " হম দো হমারা দো" নীতিতে সমাজ ও পরিবারে বেজে উঠছে ভাঙনের সুর। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সম্পর্কের বাঁধন ক্ষুদ্র। ফ্ল্যাট কালচারে দাদু -ঠাকুমা, কাকা, পিসি, মামাদের অস্তিত্ব থাকছে না ফলে নষ্ট হচ্ছে পবিত্র সম্পর্কগুলো। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ফলে বেড়ে চলেছে আত্মহত্যাসহ অন্যান্য অপরাধপ্রবণতা। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবসহ সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোতে ফাটল ধরেছে। ঢুকে পড়েছে অবিশ্বাস। 

নৈতিকতা শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন Moralitas শব্দ হতে, তার থেকেই Moral বা মানবিক কথাটি এসেছে।  নৈতিকতা হলো এক ধরনের মানসিক অবস্থা যা কাউকে অপরের মঙ্গল কামনা করতে এবং সমাজের প্রেক্ষিতে ভালো কাজের অনুপ্রেরণা দেয়। যেমন সত্য বলা, গুরুজনকে মান্য করা, অসহায়কে সাহায্য করা, চুরি, দুর্নীতি থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। এগুলো মানুষের নৈতিকতার বহির্প্রকাশ। মূল্যবোধ হচ্ছে মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী ধারণা, আদর্শ বা ভিত্তি। সামাজিকভাবে বাস করতে গিয়ে মানুষ কিছু আদর্শ বা মানদণ্ড সাধারণভাবে গ্রহণ করে নেয়। সমাজে মানুষের যা কিছু করা উচিত, তারা যা কিছু মঙ্গলজনক মনে করে তার আদর্শ রূপই হচ্ছে মূল্যবোধ।

     সাম্প্রতিক সময়ের শিশুহত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, সন্ত্রাস, নকলপ্রবণতা, খাদ্যে ভেজাল, নকল ওষুধ ইত্যাদি সমাজের করুণ রূপ। সমাজের মানুষ কেউ কারো বন্ধু নয়। প্রত্যেকে পরোক্ষভাবে একে-অপরের ক্ষতিসাধনে মগ্ন। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কোমলমতি শিশু, কিশোর ও কিশোরীরা শারীরিক-মানসিক এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর আসছে চরম আঘাত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ক্রান্তিলগ্নে সমাজরক্ষা নিয়ে চিন্তিত দেশের সব বিবেকবান মানুষ। যথার্থ জীবন আদর্শের অভাবে পরিবারগুলো এখন ভোগবিলাস ও পরশ্রীকাতর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতা ও ধনবাদী ধ্যান-ধারণায় গড়ে উঠেছে ভারসাম্যহীন সমাজ। আমাদের আজকের সমাজ পরিচালিত হচ্ছে নৈতিকতার ভিত্তিতে নয়, বরং স্বার্থের মোহে।

     তদুপরি বর্তমান বিশ্বে মানুষের সঙ্গে মানুষের অসম প্রতিযোগিতা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মানুষে- মানুষে দূরত্ব। ব্যক্তিজীবনে কমে আসছে ধৈর্যশীলতা। নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভও বিরাজ করছে মাত্রাতিরিক্ত। দেশ, জাতি, সমাজ, পরিবার ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। একজন মানুষের চরম নৈতিক মূল্যবোধের ধাক্কায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে অন্য মানুষ। তৈরি হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। এক কথায় দিন- দিন মানুষের মানসিক বিকৃতি বাড়ছে। হতাশা বা অস্থিরতা বিরাজ করছে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে বেঁচে থাকার প্রতিটি ধাপে। মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে মানুষ পাশবিক হয়ে উঠছে।
সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন চরম আকার ধারণ করছে। এমন কোনো অপরাধ নেই, যা সমাজে সংঘটিত হচ্ছে না। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, মা-বাবা নিজ সন্তানকে, ভাই- ভাইকে অবলীলায় হত্যা করছে। সমাজে সুষ্ঠু বিচার না পেয়ে বাবা-মেয়ে, মা-মেয়ে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। প্রেমের কারণে অর্থ সম্পত্তির লোভে সমাজে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অন্যদিকে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, অবিশ্বাস আর অপ্রাপ্তিতে সমাজে আত্মহননের ঘটনাও বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে না পেরে ছেলে খুন করছে বাবা -মাকে, স্বামী খুন করছে স্ত্রীকে কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে।
অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য কিংবা কাউকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার নিমিত্তে মানুষ নিজের সন্তানকে পর্যন্ত হত্যা করছে। আর যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও হত্যা তো নিত্যদিনের ব্যাপার। পারিবারিক বন্ধন, স্নেহ-ভালোবাসা, মায়ামমতা, আত্মার টান সবই যেন আজ স্বার্থ আর লোভের কাছে তুচ্ছ। কেবল তাই নয়, সমাজের উচ্চবিত্তের তরুণরা বিপথগামী হয়ে পড়েছে। তারা জড়িয়ে পড়ছে খুন, ধর্ষণ ও মাদকাসক্তিসহ নানা অপরাধে।

🍂

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ দিন দিন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছে। নিজের একক কর্তৃত্ব ও জিদকে প্রাধান্য দিয়ে মানুষ প্রিয়জনকে হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হচ্ছে। মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া বিষণ্নতা ও মাদকাসক্তি সমাজের এই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্ম দিচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের এক ধরনের মানসিক বিকৃতির লক্ষণ। সচেতনতা ছাড়া সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ দূর করা সম্ভব নয়। 
এই অস্থির, নিয়ন্ত্রণহীন বিরূপ সমাজব্যবস্থার দায় কারো একার নয়, বরং সব নাগরিকের। প্রত্যেককে ভূমিকা পালন করতে হবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায়, সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং সামাজিক অবক্ষয় রোধে। Civil society বা নাগরিক সমাজকে ভূমিকা নিতে হবে দেশের কল্যাণে। তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে যথার্থ দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তোলার; রাষ্ট্রকে জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার; সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার; সমাজের সংকটময় মুহূর্তে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর; সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করার বিষয়ে।
শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প ও প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্বসভ্যতা। আধুনিক সভ্যতার দৌড়ে হারিয়ে যাচ্ছে প্রচলিত নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। ক্রমশই বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা এবং ছিন্ন হচ্ছে সামাজিক সম্পর্ক। অস্থির হয়ে উঠছে সমগ্র সমাজব্যবস্থা। বর্তমানে চলছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। এই প্রেক্ষাপটে পরিবার-সমাজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও চিন্তা-চেতনায় বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও বিশ্বাস প্রায় শূন্যের কোঠায়। পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সমাজকে সক্রিয় হতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে জাগ্রত করতে হবে সমাজকে। সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য প্রয়োজন সামাজিক স্থিতিশীলতা। প্রয়োজন নৈতিকতা, মূল্যবোধের চর্চা ও বিকাশ সাধন। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের উপাদান তথা সততা, কর্তব্য, ধৈর্য, শিষ্টাচার, উদারতা, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, দেশপ্রেম, পারস্পরিক মমত্ববোধ, সহমর্মিতা, আত্মত্যাগ ইত্যাদি মানবীয় গুণের চর্চা বর্তমান সমাজে নেই। সমাজ চলছে বিপরীত স্রোতের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অবনতি বা সুবিচার না হওয়ার কারণে কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধীরা দিন দিন যেন আরো সাহসী হয়ে উঠছে। এটাও অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

        তাই এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে একযোগে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে যথার্থ ভূমিকা পালন করে যেতে হবে। তবে এ কথা সত্য, কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের পক্ষেই নৈতিকতা ও মূল্যাবোধের অবক্ষয় থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভম নয়। কেননা, সমাজ বা রাষ্ট্রে নানা বিশ্বাসের লোক বাস করে, এদের একজনের চরিত্র অন্যজনের সঙ্গে মেলে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তাই সর্বাগ্রে পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

Post a Comment

1 Comments