জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( অষ্টপঞ্চাশত্তম পর্ব )/ শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী- আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত ( অষ্টপঞ্চাশত্তম পর্ব ) 

শ্রীজিৎ জানা

বাবা ঝাগড়েশ্বর সাত ভোগের মাড়। দেউল বাঁশ কাঁধে নিয়ে ভোগ মুদতে চলেছে ভোক্তারা। সবার সামনে রয়েছে পাটভোক্তা। হাতে বেতের ছড়ি। মাঝে মাঝেই দিচ্ছে ডাক, বাবা ঝাগড়েশ্বরের চরণে সেবা লাগে/ সেবা করিলে তোমার সেবক/ তোমার সেবক তোমাকে ডাকে/ মহাদে এ এ এ ব..। পাটভোক্তার ডাকে ডাক মেলায় বাকিরা। একেবারে শেষে ঢাকে বোল তুলেছে নিরা ডম। ঝিনা কুড় তাকুড় তাকুড় তাকতা গাজন তাকতা গাজন। ঢোলের কাচ্চাবাচ্চা ছুটে এসে জড়ো হচ্ছে রাস্তার ধারে। অখিল বড়দোলইয়ের ঘরে দেউল যাবে। অখিলরা পূর্বপুরুষ থেকেই রাখাল মাড়ার মেছাল। শিবের থানে মাগুর মাছ দেওয়া তাদের কৌলতি। মাড় যেদিন উঠবে, সেদিন তাদের মাগুর মাছ আগে বলি হবে। আজকে তাদের ঘরে ভোগ মুদতে চলেছে ভোক্তারা। লোখা হাত তুলে দূর থেকে প্রণাম করে। তাদের গ্রামের অনেকেই এবারেও ভোক্তা হয়েছে। লোখা একবছর ছিল। হেঁদোলা সেবা করতে পারেনি। কাঁটা গড়ানও দিতে পারেনি। নিয়মরক্ষার জন্য পিঠে কাঁটা ছুঁইয়ে রেখে দিয়েছিল। তবে জিভফুঁড়া সে দেখতে যায় সববছর। সেই ছোট থেকেই যাচ্ছে। ছোটবেলায় একটু ভয় পেত। দেখত তাদের পাড়ার ভাকুদা, গেঁটকাদা, বোনাখুড়া জিভ ফুঁড়েছে। লম্বা লোহার রড জিভের এফোঁড় ওফোঁড় করা। রক্ত দু'গালি বেয়ে ঝরছে। সেদিকে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বাজনার তালে তালে নাচছে তারা। আর পয়সা চাইছে। তাদের বানে ঘি মাখিয়ে দিচ্ছে বুত্তাদা। পরের দিন পিঠফুঁড়া। পিঠফুঁড়ে চড়ক কাঠের বাঁশে ঝুলে পড়ে। আর বাকিরা তাকে পাঁইপাঁই করে ঘোরায়। পিঠের চামড়ায় পিতলের আঁঙটা গাঁথা থাকে। যখন ঝুলে তখন চামড়া এমনভাবে টানা থাকে যেন এখুনি ছিঁড়ে যাবে। কী করে হরেণ কারফার সহ্য করে আগে ভেবে থই পেত না লোখা। পরে গ্যাঁটকাকে জিগ্যেসও করেছে লোখা,
—হে রে গ্যাঁটকাদো! তুই যে জিভফুঁড়ু তোকে লাগেনি? 
—কথা শুন! লাগবে কেনে! বাবার দয়ায় কুনুকিছু বইতেই পারিনি।
— তোদের জিভটা কী করে জড়া লাগে বল দিখি?
– সবই ওই বুড়া শিবের কেরামতি। মোধা কামার শুদু বানটা খুলে,জিভটাকে জেঁকে দেয়। তারপর ঘি বুলি দেয়। আর বেলপাতা। তাকেই সব হই যায়। তবে ইসব তোর মুরাদে হবেনি। তুই লেতি পোড়বি। কি জানু ঠাকুরের উবরে বিশ্বাস দরকার।
লোখাও সেই কথা মানে। কিন্তু একটা খটকা তার মনকে হামেশাই কামড়াত। শেষে একদিন ভগী খুড়াকে জিগ্যাস করে সে,
—আচ্ছা খুড়া একটা কথা বল দিখি। রাখাল মাড়য় ভোক্তা সব জাতের লোকই থাকে। কুন্তু জিভফুঁড়া আর পিঠফুঁড়ার সময় দেখি যত বাগদি- দুলাদের। ইটা কেন বল দিখি?
— তোর কি মনে হয় আগে বল দিখি শুনি।
—দুলা বাগদির কইমাছের জান। অদের সব ডেঁড়ামাছের মত ভ্যাদকাপরা জান। একটুিতেই টেঁসে যাবে শেষকালে —- সেইজন্নে!
—সেটা নয় রে লখি! চিরকাল দুলা বাগদিদের মতো হ্যালাফ্যালা জাতের হাতেই পুজা লিতে চেইছে ভগমান। দেখুনু অখা মেছাল মাড় উঠার দিন থিকে জালঙ আর টমর কলাইয়ের ডাল লিয়ে যায়। তা দিয়েই ত বাবার থানের হব্যিষ রাঁদা হয়। তাবাদে তুই এগদিগ দিয়ে ভুল বোলুনু,মোদের জাতের ছেনাছকরা ছাড়া এই ফুঁড়াফুঁড়ির সাহস কেউ দেখাবেনি। ইসব ঠাকুরের দয়া ভেবে লে।
—ধূর বাপু! শুদুই বল মোদের জাতটাতের উবরে নাকি ভগমানের দয়া খুব। থাইলে এই হালেডালে ঘুত্তে হয়ঠে কেনে অনেককে?
— উ ত স্বভাবে রে! লোকে বলে অভাবে স্বভাব নষ্ট। কুন্তু মোদের জাতের ক্ষেত্রে উল্টা। স্বভাবের নষ্টে অভাব আর কষ্ট। বুজে কম, হঁকগঁক করে বেশি! মেস্টার বলে শুনুনু বাগদির কুথাও দশা ফিরেচে দিশা ফিরেনি। আবার কুথাও দিশা ফিরেচে দশা ফিরেনি। ভগমান কুনু লোককে দুই দুই করেনি। সে ত অভাগাদেরই বেশি ভালবাসে। যারা পেটে গরীব কুন্তু পেরাণে মনে ধনী তাদের সঙে থাকে।
— আহা গ খুড়া! মাঝেসাঝে কত্ত দামী কথা শুনাও গ তুমি!
—ই কথাটা মোর নয় রে লখী, তোর বন্ধু খগেন মেস্টারের। এগদিন কথায় কথায় মোকে বোলেছিল পুরীর মন্দিরের কথা। সেখিনে নাকি শবর জাতের পন্ডারা থাকে।
— শবর জাত কাদের দিকে বলে গ খুড়া? 
– অই আদিবাসী, নাইলে মোদের মতই কুনু জাত হবে বোধায়। 
— তারা পুরীর মন্দিরে কী করে গ?
— অই জাতের পন্ডাদের বলে দৈতাপতি পন্ডা। তারই ত জগন্নাথকে খাবায়, চান করায়। জ্বর হলে তার সেবা করে। বামুন পন্ডাদের সঙে তাদেরও সমান অধিকার অই মন্দিরে। মেস্টার বলে জগন্নাথ ঠাকুর নাকি পথমে অই শবরদের ছিল। কুন্তু হ্যালাফ্যালা জাতেদের অধিকার কেনে মানবে উঁচু জাতেরা। যদিও মেস্টার বলে জাত বোলে কিছু নাই। কর্মটাই আসল কথা। জানু ত মামা হল অসুর আর ভাগনা হল দেবতা। রক্ত ত একই রে!
— ইটা ত ঠিকই বোলেচ খুড়া! ইটা ত ভাবিনি কুনু দিন!
      লোখা দেউলের দিকে চেয়ে থাকে অনেক্ক্ষণ।  তারপরেই মাথায় অন্য ভাবনা এসে যায়। ভাবে সামনেই সংক্রান্তির জলঢালা। ময়না নিশ্চয়ই ভেবেই রেখেছে তার শাড়ী কেনার কথা। লোখা বছরে তিনবার নিজে থেকে ময়নার জন্য শাড়ী কিনে আনে। কাঁচা হলুদ রঙ লোখার খুব পছন্দ। ময়নাকেও বেশ মানায়। নতুন শাড়ী পরে কোথাও যাওয়ার আগে ময়না লোখাকে প্রণাম করে। সেইসময় লোখা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ময়নার দিকে। করঞ্জ পাতার মতো ময়নার শ্যামলা রঙ। পাকা বকুল ফলের মতো টকটকে লাল সিঁদুর কপালে তার দাউদাউ করে। শুশনি পাতার মতো নরম তার মুখখানা। লোখার তাকানো দেখে ময়না বলে উঠে,
— অমন কোরে কী দেখঠ মোর দিকে?
— দু ছেনার মা হয়ে গেছু, তোকে আবার দেখিঠি! সাবধানে যাবি,যেথা যাউঠু। তুই যা আবার হাউড়ির জাত। তালতুল কিছু ত মানবিনি।
– হঁ, তুমি ত সব জান!
মুখ টিপে হাসে ময়না। এই হাসি গ্রাম্য এক বধূর সরমের রঙে রাঙা। স্বামীর ওই চাহনি নারীর কাছে পরম পাওয়া। সেই চাহনিতে মিশে থাকে তীব্র অনুরাগ, গভীর প্রেম। ওই প্রেমের জন্যই নারী আজন্ম হেঁসেলের কারাগারে বন্দী থেকে, চরম নির্যাতন সয়ে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সংসারে। অনেকের দৃষ্টিতে তা এক ধরণের আত্ম অবমাননা।  আবার কারো কাছে তা ভীষণ গৌরবের। যদি স্বামী তার বিশ্বাস ভেঙে না দেয়,তবে স্ত্রী তার দাসত্ব মেনে নেয় হাসি মুখে। অভাবের সংসারে সে নিজেকে মহারানী বলে অহংকার করে সবার কাছে। ময়নারও গর্ব হয় তার স্বামীকে নিয়ে। তার দিকে ছাড়া আর কারো দিকে কখনো অন্য চোখে তাকায় না তার স্বামী। এইটুকুতেই ময়নার সন্তুষ্টি, এতেই তার সর্বোচ্চ সুখ। স্ত্রী জাত সবকিছুর ভাগ দিতে প্রস্তুত কিন্তু স্বামীর ভাগ মরে গেলেও ছাড়তে চায় না। 
লোখা জমি থেকে ফিরেই বাজার যাওযার তোড়জোর করে। সবে সাঁঝ নেমেছে ঢোলে। ধীরে ধীরে কালো রঙে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। ময়না তুলসী তলায় সন্ধ্যা দেয়। লোখাকে প্রণাম করে। লোখা বলে, 
– বাজার যাইঠি। কিছু আনতে হবে নাকি? 
–না, কিছু আনার নাই। তাত্তাড়ি চলে এসবে খন।


🍂

ময়নার জন্যে শাড়ী আনবে সে আজ। খুশিতে ঝকমক করে উঠবে ময়নার মুখটা। কিন্তু অন্য একটা কথা তার মাথায় পাক খাচ্ছে কদিন। ভগী খুড়ার সঙ্গে বহুবার পরামর্শ করেছে। ময়নাও তাকে একই কথা বলেছে। অথচ কে যেন তার পা টেনে রেখেছে। মাস্টারের কাছে যেতে দিচ্ছে না। মনের ভিতরে তার ঝড় বইছে অবিরাম। সে আর একা থাকতে দিতে চায়না খগেন মাস্টারকে। মানুষটার একা থাকাটা তার কাছে বড্ড অসহ্যের। ভেতরে ভেতরে পুড়ে যাওয়া তার পক্ষে দেখা অসম্ভব। কালী মা,এবার হয়তো চেয়েছে তার সব কষ্টের অবসান করতে। কদিন কাজের চাপে বেরোতে পারেনি লোখা। আজ একবার দেখা করবেই সে। বাজার যাওয়ার পথে সোজা মাস্টারের বাড়িতে হাজির হয়। জানতে পারে মাস্টারও বাজার গেছে। সাইকেল ঘুরিয়ে সোজা রওনা দেয় বাজারের দিকে। মাস্টারের ডেরা তার জানা। সন্ধেটায় মাঝেমধ্যে বাপীর চা দোকানে বসে। দোকানের সামনে সাইকেলটা ঠেকিয়ে ভিতরে উঁকি মারে। দেখে মাস্টার একাই আছে সেখানে। লোখা তার সহজাত স্বরে ডাক দেয়,
— কি গ মেস্টার! একাই বসে আছ যে। তমার ঘরকে গেইলম। শুনলম তুমি বাজার এসচ।
— চোলায়। চা খাবি যে। কদিন ত তোর পাত্তাই পাইনি।
— ধান কাটার কাজে এগবারে নিশ্বাস লিবার সময় পাইনি। তমার কি! মাস ফুরালে বেতন!
— বেশি না বোকে চা খা তুই।
— সে খাব খন। কুন্তু তমার সঙে একটা কথা ছিল। 
– বল থাইলে..
— ধূর! এই গরমে ঘুপসির ভিতরে বসে উসব কথা হবে নি। নদীপালকে চল। সেখিনে বোলব।
চা দোকান থেকে বেরিয়ে দুজনে চলে আসে শিলাই পাড়ে। বুড়াই হানার কাছে ফাঁকা জায়গাটায় বসে পড়ে। লোখা একটা বিড়ি ধরায়। আড় চোখে একবার তাকায় মাস্টারের দিকে। মুখে না বলে ইশারায় আমন্ত্রণ জানায় মাস্টারকে। যদি এক দু'টান দেয় মাস্টার। কিন্তু সম্মতির কোন আভাস পায় না লোখা। তার বদলে সোজাসুজি জিগ্যেস করে লোখাকে,
— বল, কী বোলবি?  ঘরে কী হইচে নাকি রে?
— তমার ত অই একটাই বুলি। লোখা কিছু বোলবে মানেই তার ঘরে কিছু হইচে। ত লোখের ঘর লিয়ে ত অত ভাবঠ,এবার নিজের ঘরটা লিয়ে এগবার ভাব না।
—নাহ্, শুদু এই কথাটা বোলতে তমাকে ডাকিনি। আরও কথা আছে। তুমি কুন্তু কথার মাঝে কিছু বোলবেনি।
—এগবারে ক্যাঁছা এঁটেই এসচু। বল থাইলে।
—জান ত কিষ্ট দাস শীতলামঙ্গলের আঘড়ায় অনেককিছু কথা বলে। ভগমানের কথা। বলে, মোদের জীবনে সব উপরবালার ইশারায় হয়। তার ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাও নাকি হেলে নি। উপরবালা এখন একটা ইচ্ছা করেছে। তুমি মাধুর সঙে এগবার দেখা কর, মেস্টার। এট্টু কথাও ত বোলতে পার। তাতে কী মহাভারত অশুদ্ধ হই যাবে। কে কী ভাবল,তা আর ভেবোনি। তুমি ত মাধুর ভাল চেইচ সবদিন। এখনও চাইচ। তার এরকম দুঃখের দিনে তুমিই শেষ ভরসা,মেস্টার। উপরবালাও সেটাই চায়। তমাকে জোড় হাত করি,এগবার দেখা কর তুমি।
এক নাগাড়ে বলে যায় লোখা। মাটির দিকে মুখ নীচু করে বসে থাকে খগেন মাস্টার। কোন কথা বলে না। অন্ধকারে বোঝাও যায় না তার চোখমুখের ভাব।

Post a Comment

0 Comments