নির্মল বর্মন
প্রাবন্ধিক সুধী প্রধান , গণনাট্য ও প্রগতি লেখক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক, লোকসংস্কৃতি ও গবেষণা ক্ষেত্রে প্রথমসারির নির্দেশক, ভারতবর্ষের মার্কসবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস রচয়িতা হিসেবেও সমান কৃতিত্বের মর্যাদা রেখেছেন। সুধী প্রধান ১৯১১ সালে বসিরহাট মহকুমার সগুনা গ্ৰামে জন্ম গ্ৰহন করেন। জন্মসূত্রে সুধী কনৌজি ব্রাক্ষণ। অহমিকা বোধটা কোন দিন ছিল না। জাতপাত অবহেলা করতেন। বনগাঁ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র সুধী প্রধান স্কুলের নিকট ইছামতী নদীর পাড়ে বিকেল বেলা বেড়াতে গিয়ে দেখে , নদীর চরে অনেক অব্রাহ্মণ সহপাঠী বন্ধুকে একটি ঠোঙ্গা থেকে কোন খাবার খেতে দেখলেন। সুধী সেই ঠোঙ্গা থেকে কিছু খাবার তুলে নিয়ে খেতে আরম্ভ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে অব্রাহ্মণ বন্ধুরা স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর ব্রাহ্মণত্বের কথা । সুধী চুপচাপ তার উপবীত ইচ্ছামতী নদীর জলে ফেলে দেন। জীবনে আর কোনদিন উপবীত পরিধান করেননি।সম্মাননীয় সুধী প্রধান ১৯২৬- এ মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুগান্তর বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু'র ব্যক্তিগত সহায়কও ছিলেন এবং দক্ষতার সঙ্গে কাজ ও করেছেন। সমাজ সংস্কৃতির গবেষক মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে প্রধান সাহেবের পরিচয় হওয়ার পর পার্টি'র গোপন কাজে হাত লাগিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। পার্টির গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় মুখপত্র 'জনযুদ্ধ' পত্রিকা'র দায়িত্ব যত্নসহকারে পালন করেছেন। প্রাবন্ধিক সুধী প্রধান ১৯৪২-এ সংগঠিত ফ্যাসীবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের কার্যকরী সমিতির অন্যতম সদস্য ছিলেন।১৯৪৩ এ সুধী প্রধান ভারতীয় গণনাট্য সংঘের বাংলা শাখার পূর্ণ সময়ের সংগঠকের গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেছিলেন।১৯৯৭ এর ৭ই ডিসেম্বর মৃত্যু ঘটে।
প্রাবন্ধিক সুধী প্রধান ১৯৫৭ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ছাড়েন। পরে ভারতীয় মার্কসবাদী সাহিত্য আন্দোলনের ইতিবৃত্ত লিখতেশুরু করেছিলেন। সুধী সাহেবের 'মার্কসিস্ট কালচারাল মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া' (তিন খন্ড) প্রকাশ ঘটেছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের জন্য প্রখ্যাত "রবীন্দ্র" পুরস্কার লাভ করেছিলেন। প্রাবন্ধিক গবেষক লোকসংস্কৃতি ও তার শিল্পসমাজ'কে উজ্জীবিত করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ছিলেন। ১৯৩৮ সালে বাংলার লোক-কবিদের নিয়ে জীবনগাথা রচনা করে বাংলার সারস্বত সমাজকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সমাজ মনস্ক গবেষক সুধী প্রধানের অকৃপণ প্রচেষ্টায় লোকসংস্কৃতির বেশ কয়েকটি ধারার পুনরুজ্জীবন ঘটার ফলে বাংলার সংস্কৃতির নান্দনিক মুখ খুলে যায়।
🍂
প্রাবন্ধিক সুধী প্রধান সাহেব বিরোচিত গ্রন্থ :-
''নবান্ন: প্রযোজনা ও প্রভাব'', ''সংস্কৃতির প্রগতি'', ''সুভাষচন্দ্র'', ''ভারত ও অক্ষশক্তি'' ইত্যাদি। '
সুধী প্রধান মহোদয়ের "সংস্কৃতির প্রগতি'' গ্রন্থের অন্তর্গত 'নবনাট্য আন্দোলন প্রসঙ্গে' প্রবন্ধ বিষয়টি সমালোচনা প্রণিধানযোগ্য । গণনাট্য থেকে ধীরে ধীরে নবনাট্য ধারাবাহিক বিস্তৃতি লাভ করেছিল, সেই প্রেক্ষিতে প্রাবন্ধিক বর্তমান প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রথমতঃ সুধী প্রধানের গণনাট্যের উৎপত্তি স্থল সম্পর্কে মন্তব্য:-
"গণনাট্য বা পিপ্স থিয়েটার কথাটার পিছনে ফরাসী দেশের থিয়েটর লির (স্বাধীন থিয়েটার) জার্মানীর অটো ব্রাহম-এর নব স্বাধীন থিয়েটার, ইংলন্ডের টমাস গ্রেইনর 'ইন্ডিপেন্ডেন্ট থিয়েটার' এবং রমা রলাঁর পিপ্স থিয়েটারের কথা মনে পড়ে। আমাদের দেশের কিছু কর্মী সচেতনভাবে সেই ধারা অনুকরণ করলেও ঘটনাগুলি যান্ত্রিক অনুকরণ নয়।”
দ্বিতীয়ত: প্রাবন্ধিক এরপর গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠা ও গণনাট্য আন্দোলনের অগ্রগতি'র ইতিবৃত্ত দলিলবদ্ধ করেছেন।
তৃতীয়ত: সমালোচকের ভাবনায় :-
"মনোজ বসু-র 'নতুন প্রভাত' নবনাট্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছে বলে মনে করলেও কিংবা জ্যোতির্ময় সেনগুপ্তের 'ভাঙাচাকা'র কথা মনে রাখলেও প্রাবন্ধিকের মতে 'জবানবন্দী' ও 'নবান্ন' নবনাট্য আন্দোলনের ধারার সূত্রপাত ঘটায়। এই দুটি নাটক ও তুলসী লাহিড়ীর 'দুঃখীর ইমান'কে কেন্দ্র করে শিশির কুমার ভাদুড়ী-সহ বহু নাম করা অভিনেতা অভিনেত্রীরা সমন্বিত হন"।
চতুর্থত: প্রাবন্ধিকের তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত-
“সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের তৎপরতা সৃষ্ট ভারতের প্রধান রাজনৈতিক সামাজিক বিকাশের গতিমুখে নবনাট্য আন্দোলন জন্মগ্রহণ করে নৃত্যগীতি ও অভিনয়কে সুনিশ্চিতভাবে সামাজিক বাস্তবতার দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সংস্কৃতির সমস্ত বিভাগ ভারতের শোষিত ও বঞ্চিত জনসাধারণের অবস্থা, তাদের আশা আকাঙক্ষা ও উন্নত জীবন সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের সংযোগ প্রতিষ্ঠা করে নতুন ভারত গড়ার কাজ যদি শিল্পকলার সাহায্যে অগ্রসর করতে পারে-এইদিন এ আন্দোলনের লক্ষ্য।"
সুধী প্রধান অন্যায়, অত্যাচার ,উৎপীড়ন ,সামাজিক, রাজনৈতিক ,সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অবহেলাকে তিনি বরদাস্ত করতেন না। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী,সমাজ ও জনগণের সেবার জন্য কল্যাণী ,বর্ধমান ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিক "ডি.লিট" প্রদান করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক প্রদান করেন।
প্রাবন্ধিক সুধী প্রধান অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত ও কালজয়ী হলেও সময় ও সমাজ তাঁকে যথেষ্ট পরিমাণে সম্মান তো দিলোই না। বস্তুতঃ গুণীজন হওয়া সত্ত্বেও কালের অমোঘ আকর্ষণে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক ।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments