অষ্টবিংশতি পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
দ্বিতীয় ভাগ - মথুরা পর্ব
কংস বধ
দণ্ডহাতে দণ্ডধারী
মথুরায় কংসের কাছে সংবাদ গেল শ্রীকৃষ্ণের হাতে অরিষ্টাসুর নিহত হয়েছে। ইতিপূর্বে কংস প্রেরিত পুতনা, বকাসুর, অঘাসুর এবং প্রলম্বাসুরও শ্রীকৃষ্ণের হাতে নিহত হয়েছে। শুধু তাই নয় কালীয়দহে কালীয়নাগ নামে যে বিষধর সর্প ছিল তাকেও শ্রীকৃষ্ণ দমন করেছেন। অরিষ্টাসুর নিহত হবার পরে দেবর্ষি নারদ ভোজরাজ কংসের রাজসভায় যেয়ে একদিন কথায় কথায় বললেন দেবকীর অষ্টম গর্ভের যে কন্যাকে কংস পাষানে আছাড় মেরে হত্যা করতে চেয়েছিল সে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান নয়। সে ছিল নন্দরাজার স্ত্রী যশোদার কন্যা সন্তান। দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। আর দেবকীর সপ্তম গর্ভের সন্তান গর্ভে বিনষ্ট হয়েছিল বলে কংসকে যে সংবাদ দেওয়া হয়েছিল তাও সর্বৈব মিথ্যা। দেবকীর সপ্তম গর্ভের সন্তান হলেন বলরাম। এই কথা শুনে কংস ক্রুদ্ধ হয়ে বসুদেব ও দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হলে নারদ তাকে কোনভাবে শান্ত করলেন। কংস এরপরে কেশীদৈত্যকে পাঠালেন কৃষ্ণ বলরামকে হত্যা করার জন্য, কিন্তু তাদেরও অরিষ্টাসুরের মত একই গতি হল শ্রীকৃষ্ণের হাতে। সেই সংবাদ শুনে কংস স্থির করলেন যদুকুলের অক্রুরকে পাঠিয়ে কৃষ্ণ বলরামকে মথুরায় এনে প্রথমে রাজদ্বারে ভীষণাকৃতি কুবলয়াপীড় নামের হস্তী তাদের অভ্যর্থনা করবে। কুবলয়াপীড়ের হাতে মৃত্যু না হলে দুই মল্লবীর চানুর এবং মুষ্টিক মল্লযুদ্ধে তাদের বধ করবে। এই চিন্তা করে কংস অক্রুরকে বললেন "তুমি ভোজ ও বৃষ্ণিবংশের সকলের প্রিয় এবং বিশ্বাসভাজন। তুমি রথারোহন করে তাদেরকে এখানে নিয়ে এস"। রাজার আদেশ অক্রুর যেতে বাধ্য হলেন।
পরের দিন সকালে অক্রুর বৃন্দাবনে যেয়ে কংসের পরিকল্পনা ব্যক্ত করে কৃষ্ণ বলরামের চরণে পতিত হলেন। এই সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণ বলরাম স্থির করলেন কংসকে বধ করার এক সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। সমস্ত ঘটনা নন্দরাজাকে বলার পরে তিনি যাবার অনুমতি দিলে গোপগন স্থির করলেন তারাও নন্দরাজাকে নিয়ে কৃষ্ণ বলরামের সাথী হয়ে মথুরাতে যাবেন। কিন্তু এই সংবাদে গোপিনীরা একেবারে ভেঙে পড়লেন কারণ তাঁদের প্রাণপ্রিয় কানহাইয়া বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরাতে গেলে তাঁর বিরহ তাঁরা কিভাবে সহ্য করবেন। তাঁরা অক্রুরকে অভিশাপ দিয়ে বললেন " তোমার নাম অক্রুর না হয়ে ক্রুর হওয়া উচিত ছিল। তুমি আমাদের কানহাইয়াকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যেতে এসেছ। তাঁর অদর্শনে আমরা পাগল হয়ে যাব"। কিন্তু গোপিনীদের সামর্থ্য নেই কৃষ্ণকে বাধা দেওয়ার। তাঁদেরকে আশ্বাস দিয়ে কৃষ্ণ বললেন "তিনি শীঘ্রই ফিরে আসবেন"। এই আশ্বাস দিয়ে তিনি বলরামকে নিয়ে অক্রুরের রথে আরোহন করলেন। গোপগন নন্দরাজাকে সঙ্গে নিয়ে রথের পিছনে গো-যানে যেতে লাগলেন। যতদূর দৃষ্টি যাচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে গোপিনীগণ বিলাপ করতে লাগলেন। এখানে উল্লেখ করছি যদিও শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি মথুরা থেকে ফিরে আসবেন কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি আর কখনোই বৃন্দাবনে ফিরে আসেননি, তাঁর বৃন্দাবন লীলা এখানেই শেষ হয়ে গেল। মাত্র ১১ বৎসর বয়সে বৃন্দাবন ত্যাগ করে এরপরে শুরু করবেন মথুরা লীলা। মথুরাতে দীর্ঘ ১৮ বৎসর অতিবাহিত করে তারপরে তিনি শুরু করেছিলেন দ্বারকা লীলা। এই দ্বারকা লীলাপর্বে তাঁর যেমন বিবাহ হয়েছিল তেমনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের তিনি মূল কান্ডারী ছিলেন এবং অবশেষে যাদবরা সবংশে নিহত হবার পরে তিনি মর্ত্যধামের লীলা সংবরন করেছিলেন।
🍂
কৃষ্ণ বলরামকে নিয়ে অক্রুর যমুনা তটে এসে উপস্থিত হতে সেখানে এক অলৌকিক কান্ড ঘটল। কৃষ্ণ ও বলরামকে রথে রেখে অক্রুর যমুনায় স্নান করতে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ বলরাম যমুনার জলে স্নান করছেন। এ কিভাবে সম্ভব হল অক্রুরের মাথায় কিছুই এল না। তাহলে কি অক্রুর নেমে আসার পরে দু ভাই রথ থেকে নেমে এসেছেন? অক্রুর যমুনার জল থেকে রথের দিকে তাকাতেই দেখলেন সেখানে কৃষ্ণ বলরাম পূর্ববৎ বসে আছেন। আরো একবার জলের দিকে তাকালেন সেখানে কিন্তু তিনি কৃষ্ণ বলরামকে পুনরায় দেখতে পেলেন। অক্রুরের সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। দু নয়ন কৃষ্ণপ্রেমে আর্দ্র হয়ে গেল। পরম ভক্তিভরে যমুনার জলে দাঁড়িয়ে অক্রুর শ্রীকৃষ্ণ বলরামের স্তব স্তুতি করলেন। জল থেকে উঠে এসে রথে আরোহন করে অক্রুরের রথ কৃষ্ণ বলরামকে নিয়ে ছুটে চলল মথুরার উদ্দেশ্যে। মথুরায় এসে পৌছালেন তাঁরা। কৃষ্ণ বলরামকে দেখে মথুরাবাসীরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে পড়লেন। রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় রথ থামিয়ে লোকজন তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। শ্রীমদ্ভাগবতে এই সময়ের উল্লেখ আছে "মার্গে গ্রামজনা রাজংস্তত্র তত্রোপসংগতাঃ। বাসুদেবসুতৌ বীক্ষ প্রীতা দৃষ্টিং না চাদদুঃ"।
মথুরায় শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে দু একটি অলৌকিক ঘটনার পর কংস ধ্বংসের সেই মুহূর্ত উপস্থিত। এই অলৌকিক ঘটনার মধ্যে পথিমধ্যে কুব্জার বিকৃত রূপ থেকে শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদে সুন্দরী নারী রূপে পরিণত হওয়ার ঘটনার উল্লেখ আছে শ্রীমদ্ভাগবতে এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে। সেখানে বলা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদে কুব্জা যে বিকট দর্শনা ছিল সেখান থেকে সুন্দরী স্ত্রীলোকে পরিণত হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণ তার সাথে তার ইচ্ছা অনুযায়ী তার গৃহে যেয়ে বিহার করেছিলেন।
কংসের রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করে তার শিক্ষিত হস্তী কুবলয়াপীড়কে ও দুই সেরা মল্লবীর চানুর এবং মুষ্টিককে হেলায় বধ করলেন কৃষ্ণ বলরাম। এসব দেখে আতঙ্কিত হয়ে কংস নন্দরাজাকে লৌহ শিকলে বাঁধতে আদেশ করলেন এবং বাসুদেবকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। কৃষ্ণ ও বলরামকে রঙ্গভূমি থেকে তাড়াবার জন্য সেপাই সান্ত্রীদের আজ্ঞা করলেন। তখন যে মঞ্চে মল্লযুদ্ধ দেখার জন্য অন্যান্য যাদবদের সঙ্গে কংস উপবিষ্ট ছিলেন কৃষ্ণ লাফ দিয়ে তার উপরে আরোহন করে কংসকে ধরে তাঁর কেশ আকর্ষণ করে রঙ্গভূমিতে ফেলে মুষ্ট্যাঘাতে তাঁকে বধ করলেন। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে কংস বাধা দেবার কোন সুযোগই পেলেন না। অত্যাচারী রাজার মৃত্যুতে মথুরাবাসীগন উল্লসিত হয়ে উঠলেন। মথুরার যাদবগন কংসের ভয়ে প্রকাশ্যে কৃষ্ণ বলরামকে সাহায্য করতে এগিয়ে না এলেও কংসকে কেহ রক্ষা করতে চেষ্টা করেননি। কারণ কংস তাদের সকলের উপরে অত্যাচার করেছিলেন। বৃন্দাবনের প্রেমের বাঁশী ছেড়ে মথুরায় এসে দন্ড তুলে নিতে কৃষ্ণ কালক্ষেপ করলেন না, কারণ পৃথিবীতে অধর্ম থেকে ধর্মের জয় সুনিশ্চিত করতেই তাঁর মর্ত্যভূমিতে আগমন। এই ধর্মরক্ষার জন্যই শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করেছিলেন। তিনি শৈশব থেকেই ধর্মাত্মা। কংসকে বধ করার পর তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কংসবধের এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কিছু কিছু গুন আমাদের চোখে ধরা দেয়। তিনি যেমন একদিকে পরম বলশালী তেমনি পরম কার্যদক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ। পরের মঙ্গলের জন্য তিনি সর্বদাই নিয়োজিত। এইসব কারণেই শ্রীকৃষ্ণ এক আদর্শ মানুষে পরিণত হয়েছেন।
অন্যদিকে দেখতে পাই কংসকে নিহত করে শ্রীকৃষ্ণ আনন্দে উদ্বেল না হয়ে প্রথমেই নন্দবাবাকে শৃঙ্খল মুক্ত করলেন। তারপরে কারাগারে যেয়ে বাসুদেব ও দেবকীকে শৃঙ্খলমুক্ত করে নন্দবাবা, উগ্রসেন প্রভৃতি গুরুজনদের যথাবিহিত বন্দনা করে রাজ্যাভিষেকের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। মথুরাবাসীগণ ভেবেছিলেন কংসকে বধ করার পরে শ্রীকৃষ্ণই মথুরার রাজা হবেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ এই পথে না যেয়ে এদেশের চির প্রচলিত রীতিনীতিকে অগ্রাহ্য করে কংসের পিতা উগ্রসেনকে রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন, কারণ ধর্মতঃ উগ্রসেনই মথুরার রাজা। তাঁকে জোর করে সরিয়ে কংস রাজা হয়েছিলেন। যাঁর রাজ্য তাকেই রাজ্য প্রদান করে তিনি ধর্মকেই অনুসরণ করেছিলেন।
পরবর্তী অংশ উনত্রিংশতি পর্বে…………..
0 Comments