জ্বলদর্চি

দুয়ারে জেনোসাইড-পর্ব ৪/বাসুদেব গুপ্ত

দুয়ারে জেনোসাইড
পর্ব ৪
বাসুদেব গুপ্ত 

দুয়ারে জেনোসাইড

পরের দিন বড় খবর। এক লাখ লোকের আইডি হঠাৎ ইনভ্যালিড। তাদের চিঠি এসেছে। আপনারা যে আইডি পাওয়ার যোগ্য তার যথাযথ প্রমাণ পাওয়া যায়নি তাই আপনার আইডি নাকচ করা হলো। 
ব্যাস আর কিছু নেই। কি প্রমাণ দরকার ছিলো, কেন আজ পঞ্চাশ বছর পরে হঠাৎ দরকার পড়লো, কি করলে আবার আইডি পাওয়া যাবে কিছু লেখা নেই। আমিনার বাবা চিঠিটা পড়ালো পঞ্চাত বাবুর কাছে। 
তারপর মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে সেন্সলেস। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেছে। সেখানে আজ সবাই গেছে ভিডিওতে মন্দিরপুজো দেখতে। উপরমহলের নির্দেশ। ফলে হাতের ফাঁক দিয়ে জলের মত তার পেরানটা যেতে দেখে আমিনা তার তিন ভাই আর মা, সে চোখে দেখে না বলে বুঝতেও পারেনা কি হল।

সকাল থেকেই পাশাটা গেল ঘুরে। যারা দাবীদাওয়া করছিল, মিছিল করছিল, লিলির হত্যাকারীর শাস্তি চাই বলে তুমুল আওয়াজ তুলছিলো,  তাদের মুখচোখ গেল পাল্টে। কিছু লোক জটলা পাকালো অশ্বথ্থের গাছের তলে, কিছু লোক বসে গেল গাছতলায়। দু একটা লোক টুকটুক করে  অবস্থান করার জায়গায় থেকে এড্ডু চা খেই আসি বলে খালি হতে শুরু করছে। 

পরের দিন সোমবার। নতুন আবেদনের লাইন পড়ে গেল ভোর চারটে থেকে। লোক আসছে তো আসছে। চোখে মুখে আতংক। করোনার নয়, পুলিশি হামলার নয়, জমি হারাবার নয়, চাকরি না পাবার নয়, অন্যতর এক গডজিল্লা আতংক। আইডি যে কবে কখন মানুষের, গরীব গুর্বো কাপ্তেন, নেতা, শেয়ারের দালাল সবার প্রাণ ভোমরা হয়ে গেছে কে জানতো। 
আইডি নেই কি করে চলবে? টাকা তুলতে ব্যাংকে গেলে  আই ডি। জমি কেনো বেচো আইডি দেখাও। ট্রেনে চড়ো্, আই ডি না হলে ঢুকতেই পারবে না। পরীক্ষার বসবে, বসতে পারবে না। বিয়ে করবে, রেজিস্ট্রী করতে পারবে না। 

সবচেয়ে মজার কথা আই ডি গেছে শুধু এক বিশেষ ধর্মের লোকের। যাদের খাবার বদলে দিয়ে হয় নি, মাথার ঘোমটা উঠিয়ে দিয়ে হয়নি, বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে হয়নি, স্কুল ভেঙে দিয়ে হয়নি, দাংগা বাধিয়ে আবার তাঁদেরই জেলে পুরে হয়নি, শহরে গ্রামে একঘরে করে দিয়ে হয়নি, সুদামের বর্ণিত সেই আরশোলারা যেন ফরফর করে উড়তে  শুরু করেছে বেগম স্প্রে দেবার পর। 

🍂

লোকগুলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। সুদাম ভাবে, এতগুলো মানুষ এক রাতে কেমন মুরগি হয়ে গেল। এবার ইচ্ছেমত খেলেই হয়। ওদের জমি তো আর রইলই না, আই ডিই নেই।  সবুজকে আর সাগরের জল ঢোকাতে হবে না। ওদের আই ডিই নেই, যে কোন মেয়ে তুলে আনলেই হয়। যা পুলিশে। আই ডি নেই,  ডায়েরীই নেবে না পুলিশ। 

সকাল সকাল তিন বন্ধু বসে পড়েছে তিনটে বোতল নিয়ে। আদতে গ্রামের লোক সরল। শহরের নেতাদের মত জটিল নয়। । এখনও ধান্যেশ্বরী চলে। তাও আজকের বিশেষ দিন তাই একটু আর সি মিশিয়ে দিল সুদাম। লোকটা শালা গুরুদেব। কি কায়দাটাই না দিয়েছে। একটা গুলি খরচা নেই। আরশোলাগুলো ভয়েই মরে যাবে। ঘরে থাকার অভ্যেস হয়ে গেছে কত হাজার বছর ধরে। সেই ঘর হঠাৎ হারিয়ে গেলে যে কি বীভত্স মজা হয় তে জানতো। 
শ্রীদাম বলে
-আজ থেকে হিটলার আমার গুরু। আমিও এরকম গোঁফ রাখবো। 
—হিটলার কিন্তু নিজের মাথায় গুলি করে মেরেছিল। আমাদেরও কি তাই?
—ধুর, আমরা হিটলার কেন? সে তো ছিল রাজা। আমরা হচ্ছি কাপ্তেন। 

— কাপ্তেনদেরও ফাঁসি হয়েছিল। রাজার আদেশ মানিনা বললে শোনেনি। 
পিছন থেকে চেনা গলার আওয়াজ শুনে তিনজনেই তাকায়। অন্ধকার থেকে অন্ধকার দিয়েই গড়া তিনটে মূর্তি এগিয়ে আসে। আবছা প্রতিপদের আলোয় চেনা যায় জয় মালকে। হাতে তিনটে পিস্তল। 

চমকে উঠে তিনজনেই কাউবয়ের মত কোমরে বেল্টে হাত দেয়। গোবৎসের মত খেয়াল হয় গুরুজনের দেওয়া ঠোকযন্ত্রটি চালের বস্তায় লুকানো আছে। 
—কি চাস। মারবি  নাকি ? আমরা কি আইডি ডিসকলি করেছি? আইন আইনের পথে চলবে। আমরা কি জানি। 
—জেনোসাইড কথাটা শুনেছ?
— হ্যাঁ ঐ যে গাজা না কোথায় হচ্ছে।  
—শালা আমরা সব জানি। আমার বৌ সব শুনেছে নদীর ঘাটে লুকিয়ে। 
—তা হলে তো জানিস আমরা শুধু অর্ডার পালন করছি। আমাদের কুনো দোস নাই। 

তিনটি শব্দ হয়। তিনটি রোগা বোকা লোক মাটিতে শুয়ে পড়ে। জেনোসাইডের প্রথম বলি। 
গুরুদেবের তিন কালো পোষাক রক্ষী যে সবসময় পাহারায় আছে তা সুদামরাও জানতো না। খুব খুশি হয়ে তিনজন তিনজনের বুকে পা দিয়ে দাঁড়ায় বাঘ শিকারীর মত। তারপর একগলায় বলে ওঠে 
জয় হিটলার। জয় জেনোসাইড।  জয় মালের বউ সীতা অন্ধকারের আড়াল থেকে সব দেখে। জয়ধ্বনি শুনতে শুনতে থরথর করে কাঁপতে  থাকে। একসময় অজ্ঞান হয়ে যায়। 

কদিন খুব ঠান্ডা পড়ে। কুয়াশায় ঢেকে যায় ভেড়ির জল মায়াবী রূপকথার দেশ মনে হয়। কুয়াশা কেটে গেলে আবিষ্কার হয় তিনটি বডি। তিন অজ্ঞাত পরিচয় বাংলাদেশীর মৃত্যু বলে জোরদার খবর হয়। সংবাদের সান্ধ্য মন্দিরে পুরোহিতরা গ্রাফিক্স দিয়ে বুঝিয়ে দেন, কেন নাগরিক চেনার জন্য ও অনাগরিক খুঁজে বার করা আরো কঠিন আইন দরকার।

Post a Comment

0 Comments