ভোলগার গুণ টানা মানুষেরা
ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৭
বিজন সাহা
সামারার বৃষ্টি
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি এক নাগারে বৃষ্টি হচ্ছে। না, সেটা ইয়ারোস্লাভলের বৃষ্টির মত ছিল না, যখন আমাদের শহরে না ঢুকেই পলায়ন করতে হয়েছিল। তারপরেও বোঝা যাচ্ছিল, এখানে থাকলে সময় কাটবে মূলত ঘরে বসে। তাই ঠিক করলাম এর মধ্যে অন্তত ভোলগা তীরের আশেপাশে একটু ঘুরে দেখা যাক। তবে ইতিমধ্যেই আমি নেটে সার্চ দিয়ে সামারার দর্শনীয় স্থানগুলোর একটা লিস্ট করে দেমিদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। আসলে কয়েক দিন থেকেই আমি এটা করছি। কারণ কোথাও গিয়ে খোঁজ খবর নেয়ার চেয়ে আগে থেকে খোঁজ নিয়ে যাওয়াই ভালো। তাতে সময় সাশ্রয় হয়। কিন্তু জায়গাগুলোয় না যেতে পারলে একটু মন খারাপ যে হয় না তাও কিন্তু নয়। তাই সব কিছুরই ভালো মন্দ দুটো দিকই আছে।
তাই আগে চলুন ঘুরে আসি সামারার দর্শনীয় স্থানগুলো। হ্যাঁ, সামারা আমাদের পথের অনেক শহরের মত প্রায় হাজার বছরের পুরানো নয়, কিন্তু নাই নাই করেও সে চারশ পঁয়ত্রিশ বছরের যুবা। তার আছে নিজস্ব ইতিহাস, আছে ঐতিহাসিক স্থান, আছে শহরবাসীর প্রিয় জায়গা। শেষ পর্যন্ত যেতে পারব কিনা জানি না, তবে মনে মনে সেসব জায়গায় ঢুঁ মারতে সমস্যা কী? তবে তার আগে আমরা আবার ফিরে যাব ইতিহাসে।
পাল
১৮৫০ সালে সম্রাট প্রথম নিকোলাই সামারা প্রদেশ গঠন করার নির্দেশ দেন। এই সময় সামারায় রুশ সাম্রাজ্যে সবচেয়ে বেশি গম উৎপাদিত হত। এটা ছিল ব্যস্ত বানিজ্য কেন্দ্র। শহরে তখন দুটো সাপ্তাহিক বাজার বা হাট বসত। এছাড়া প্রতি বছর তিনটে মেলার আয়োজন করা হত সামারায়। ১৮৭৪ সালে অরেনবুরগ রেলপথের কাজ শুরু হয় যা ১৮৭৭ সালে সামারা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সামারার নদী বন্দর তখন ভোলগার অন্যতম প্রধান বন্দর হিসেবে খ্যাতি পায়।
১৯১৭ সালের ১ (১৪) মার্চ সামারায় ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সংবাদ পৌঁছে। সামারার শ্রমিক, কৃষক ও সেনারা সাময়িক সরকারকে সমর্থন দেবার পক্ষে মত প্রকাশ করে। অক্টোবর বিপ্লব এখানে কোন গোলাগুলি ছাড়াই সম্পন্ন হয়। অলিম্পিক থিয়েটারের মঞ্চ থেকে কমরেড কুইবিশেভ সোভিয়েত শাসনের বিজয় ঘোষণা করেন। ১৯১৮ সালে চেকোস্লাভাকিয়া ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান যুদ্ধবন্দীদের সহায়তায় বিদ্রোহীরা বলশেভিকদের পরাজিত করে সামারার ক্ষমতা দখল করে। সে সময় এখানে রুশ রিপাবলিক নামে একটি দেশ আত্মপ্রকাশ করে। কয়েকটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত এই রিপাবলিকের রাজধানী হয় সামারা। ১৯১৮ সালের ০৭ অক্টোবর সেখানে সোভিয়েত রাজ পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৮ সালে সামারা মধ্য-ভোলগা বিভাগের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯২৯ সালে এই প্রদেশ মধ্যভোলগা ক্রাই বা অঞ্চল হিসেবে পুনর্গঠিত হয়। ১৯৩৫ সালের ২৭ জানুয়ারি সামারার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় কুইবিশেভ। ১৯৯১ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সামারা কুইবিশেভ নামেই পরিচিত ছিল। পেরেস্ত্রোইকার হাওয়ায় অনেক শহরই তাদের পুরানো নাম ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। লেনিনগ্রাদ ফিরে পায় সাঙ্কত পিতেরবুরগ নাম, কুইবিশেভ সামারা। তবে এ সবই হয়েছে রেফারান্ডমের ভিত্তিতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় – ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিম অঞ্চল থেকে অনেক কল কারখানা কুইবিশেভে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৪১ সালে ১৫ অক্টোবর প্রকাশিত হয় মস্কো থেকে রাজধানী কুইবিশেভে স্থানান্তরিত করার নির্দেশ। সোভিয়েত মন্ত্রীসভা, সুপ্রিম সোভিয়েত, ডিপ্লোম্যাটিক করপাস, বলশয় থিয়েটার, মসফিল্ম এসব কুইবিশেভে স্থানান্তরিত করা হয়। কুইবিশেভ হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী। ১৯৪২ সালের ৫ মার্চ সস্তাকোভিচ এখানে তাঁর বিখ্যাত লেনিনগ্রাদ সিম্ফনি রচনা শেষ করেন এবং এখানেই প্রথম সেটা বাজানো হয়। এছাড়াও স্তালিনের জন্য বাঙ্কার নির্মাণ করা হয়, যদিও স্তালিন শেষ পর্যন্ত মস্কো ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৫ সাল নাগাদ কুইবিশেভে শিল্প উৎপাদন সাড়ে ৫ গুণ বৃদ্ধি পায় আর শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় দেড় গুণ। কুইবিশেভ জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধের পর কুইবিশেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম বৃহৎ শিল্প ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। এভিয়েশন, মেশিনটুল, মেটালুরজি, ইলেক্ট্রিসিটি, তেল পরিশোধন ও হাল্কা শিল্পে ব্যাপক সম্ভাবনা এখানে দেখা দেয়। এর ফল স্বরূপ ১৯৬০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কুইবিশেভ ছিল বিদেশীদের জন্য বন্ধ। সামারার প্রসিদ্ধ কারখানার মধ্যে তারাসভ ফ্যাক্টরি, আভিয়াআগ্রিগাত, রকেট ও কসমিক সেন্টার প্রগ্রেস, এভিয়েশন কারখানা, মেটাল ফ্যাক্টরি মেটালিস্ট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
উপাসনালয়গুলোর মধ্যে পাক্রভস্কি কাফেদ্রালনি সাবর, যীশুর পবিত্র হৃদয়ের গির্জা, সেন্ট গিওরগ লুথেরিয়ান গির্জা, সামারা মসজিদ, সিনেগগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মধ্যে সামারা আঞ্চলিক জাদুঘর, সামারা আর্ট গ্যালারী, কারালিওভ এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম, একাডেমিক থিয়েটার, অপেরা ও ব্যালে থিয়েটার ইত্যাদির নাম প্রথম সারিতে। সামারার সতেরটি স্কয়ারের মধ্যে কুইবিশেভ স্কয়ার ইউরোপের বৃহত্তম ও বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম স্কয়ার। এছাড়া প্লসাদ স্লাভি বা প্রাইড স্কয়ার, চাপায়েভ স্কয়ার, কিরোভ স্কয়ার, আলেক্সেই রসোভ স্কয়ার, মচালভ স্কয়ার, রেভ্যুলুশন স্কয়ার খুবই জনপ্রিয়। রাশিয়ার যেকোনো জনপদের মত সামারায়ও আছে অনেক পার্ক। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্ত্রুকভ বাগান যা গোর্কি পার্ক নামেই বেশি পরিচিত। আছে গাগারিন কালচারাল ও রিক্রিয়েশন পার্ক, ভারোনেঝ লেক পার্ক, নিকোলাই শোরস শিশু পার্ক। আর সামারার বীচ তো খুবই বিখ্যাত। সামারার ভোলগা তীর ভোলগা তীরের শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম সুন্দর ও দীর্ঘতম।
তাভারিশ বা কমরেড সুখভ
যাহোক এই দীর্ঘ লিস্ট মাথায় নিয়ে আমরা বেরুলাম। তখনও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। তাই ঠিক হল আশেপাশে একটু ঘুরে আমরা আজই রওনা হব সারাতভের উদ্দেশ্যে। গতকাল সন্ধ্যায় যেখানে হেঁটেছিলাম সেখানেই গেলাম। সামনে চোখে পড়ল এক মাস্তুলয়ালা নৌকা বা জাহাজের পালের মনুমেন্ট। আধুনিক স্থাপত্য। স্টিলের তৈরি, যদিও নৌকা বা জাহাজের দেখা নেই, তারপরেও এটা যে পাল তা বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না। পাশেই শিল্পী ইলিয়া রেপিনের বিখ্যাত ছবি বুরলাকি না ভোলগে বা ভোলগার গুণ টানা মানুষেরা ছবির মেটালিক রূপ। এখন যন্ত্রচালিত নৌকার কারণে এসব আর দেখা যায় না। আমার ছোটবেলায় পালতোলা বড় বড় নৌকা যেত আমাদের কালীগঙ্গা নদী দিয়ে আর বাতাসের জোর কম থাকলে একদল লোক মাস্তুলের সাথে দড়ি বেঁধে নৌকা টেনে নিয়ে যেত সামনের দিকে, বিশেষ করে উজানের দিকে। আমাদের এলাকায় এই প্রক্রিয়াকে বলা হত গুণ টানা, তবে যারা গুণ টানত তাদের কি বলা হত সেটা জানা নেই। রুশ ভাষায় এদের বলা হয় বুরলাক। নিকোলাই চেরনিশেভের কী করিতে হইবে (একই নামে লেনিনেরও একটি রচনা আছে যা তিনি চেরনিশেভের কাছ থেকেই ধার করেছিলেন) নামে বিখ্যাত উপন্যাসে ভোলগার এই বুরলাকিদের সম্পর্কে লেখা আছে। সৌভাগ্য বশত সেই সময় নদীতে একটি জাহাজের দেখা মেলে। ফলে এই স্থাপত্যের একটি সুন্দর ছবি তোলা সম্ভব হয়। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা আরেকটু দূরে গিয়ে দেখা পেলাম সিনেমার এক হিরোর। বেলোয়ে সনৎসে পুস্তিনি বা মরুভূমির শ্বেত সূর্য নামে এই ছবিটি সোভিয়েত সিনেম্যাটোগ্রাফির এক অসাধারণ সৃষ্টি। মধ্য এশিয়ায় সোভিয়েত শাসন প্রতিষ্ঠার উপর এই ছবিটি এখন কাল্টে পরিণত হয়েছে। যে সমস্ত নভোচারী রাশিয়া থেকে মহাকাশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তাদের বাধ্যতামুলক ভাবে এই ছবিটি দেখানো হয়। এটা প্রচণ্ড প্রতিকুল পরিবেশে একজন সৈনিকের নতুন শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম। কমরেড সুখভের এই স্ট্যাচু নিঃসন্দেহে সামারাবাসী ও অতিথিদের প্রিয় স্ট্যাচুর একটি। এর বাইরেও ভোলগা তীরে রয়েছে আরও অসংখ্য স্ট্যাচু। এদের মধ্যে অ্যাংকর, ম্যাপল, প্রেমিক প্রেমিকার বেঞ্চ এসব উল্লেখযোগ্য। ইতিমধ্যেই বৃষ্টির জোর বাড়ছিল। তাই আমাদের সামারার গল্প এখানেই শেষ করতে হল। তবে দেমিদের কল্যাণে আমরা গাড়িতে বসে শহরের আরও কিছু জায়গা দেখে রওনা হলাম সারাতভের উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে বার বার মনে হল সামারা নামের উৎপত্তির কথা। আমাদের দেশে নিজদের ভাষা উন্নয়ন বা সংরক্ষণে কত গড়িমসি আর এখানে কত ভাবে ভাষা সংরক্ষণের প্রচেষ্টা। এই সামারা নাম নিয়েই কত গবেষণা। তুর্ক, কালমিক, চুভাশ, এরজিয়ান – কত ভাষায় এর উৎস খোঁজা। হ্যাঁ, এরজিয়ান হল ফিন্ন-উগ্রিক ভাষা যার মরদোভায় প্রচলিত। এরজিয়ান মরদোভা প্রজাতন্ত্রের তিনটি রাষ্ট্র ভাষার একটি। বাকি দুটো মকশানস্কি ও রুস্কি বা রুশ। আসলে রাশিয়ার সমস্ত জাতীয় প্রজাতন্ত্র যেমন তাতারস্তান, বাশকিরস্তান, চেচনিয়া, কালমিকি ইত্যাদিতে রুশ ভাষার পাশাপাশি স্থানীয় ভাষাও রাষ্ট্র ভাষা। ক্রিমিয়ার রাষ্ট্র ভাষা রুশ, ইউক্রেনিয়ান, তাতার। পৃথিবীর অনেক দেশেই একাধিক রাষ্ট্র ভাষা আছে যেমন কানাডার। মাতৃ ভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। ইউক্রেন যদি সেটা বুঝত তাহলে হয়তো আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হত না।
ছবিতে সামারা
http://bijansaha.ru/album.php?tag=257
সামারা ভিডিওতে
https://www.youtube.com/watch?v=TDb5DWGHVRo&t=27s
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments