জ্বলদর্চি

জলজমানি /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ১৬
জলজমানি

ভাস্করব্রত পতি

ছোটবেলায় প্রায়শই বন থেকে এক ধরনের পাতা তুলে আনতাম। আমরা বলতাম দই দই পাতা। একটা জামে জল নিয়ে ঐ পাতাগুলোকে চটকে চটকে রস বের করতাম। হড়হড়ে সবুজ রসে জলের ঘনত্ব বাড়লেই সেই জলটিকে একটা থালায় ঢেলে রোদে রেখে দিতাম কিছুক্ষণ। ব্যাস, এরপরেই দেখা যেত ম্যাজিক! ঐ পাতা নিংড়ানো রস ও জলের মিশ্রনটি জমে যেত! এবার ছুরি দিয়ে ঐ থালায় জমে যাওয়া জলজমানি পাতার সবুজ অংশটিকে বরফি কাটার মতো কেটে ফেলতাম। এরপর তার উপর একটু চিনি ছড়িয়ে ছোট চা চামচ দিয়ে পিস পিস করে কাটা জমে যাওয়া দইয়ের মতো টুকরো গুলো মুখে পুরে ফেলতাম। একটা স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতাম ওগুলো খাওয়ার সময়। পিৎজা, পাস্তা খাওয়া বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই খাওয়ারের স্বাদ কখনও আঁচ করতেই পারবে না। 

সাধারণ ঝোপঝাড়, নদীর পাড়, বসতভিটা, রাস্তার ধারে জন্মানো একটি লতানো আরোহী উদ্ভিদ এটি। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এবং আফ্রিকার কিছু দেশে এই জলজমানি গাছের দেখা মেলে। প্রায় তিন মিটার দীর্ঘ হয়। ডাঁটা লম্বা, নরম এবং সূক্ষ্ম রোমযুক্ত। পাতাগুলো ৪-৮ সেমি দীর্ঘ এবং ২.৫-৬ সেমি চওড়া। ডিম্বাকার বা হৃৎপিন্ড আকারের হয়। সামনের অংশ ছুঁচালো। প্রাথমিক অবস্থায় পাতাগুলো রোমশ ভেলভেটের মতো। পরবর্তীতে অবশ্য রোমগুলি দেখা যায় না। সাদাটে হলুদ বর্ণের ফুল ফোটে। পাতার গোড়ায় গুচ্ছাকারে ফুলগুলি ফোটে। 

ষোড়শ শতকের আয়ুর্বেদিক গ্রন্থে এর দেশীয় নাম 'ছিলিহিন্ট'। এটিই এখন সর্বভারতীয় বৈদ্যক সমাজের কাছে এর পরিচিত নাম। 
'ছিলিহিন্টঃ মহামূলঃ পাতালগরুড়ায়ঃ। 
ছিলিহিন্টঃ পরং বৃষ্যঃ দাহ্যঃ পবনাপহঃ' ৷৷
বাংলায় ছিলিহিন্টের চলতি নাম 'দই-এ খই-এ' বা 'হয়ের'। মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে একে 'দদৈয়া পাতা' বা 'দই দই পাতা' বলে। Broom Creeper, Ink Berry নামে সমধিক পরিচিত। হিন্দীভাষীরা বলে জলজমানি, বসন বেল, ছিরেটা, পাতালা গরুডি, ফরিদ বুটি ইত্যাদি। সংস্কৃতে এর পরিচিতি বনতিক্তিকা, বসনবল্লী, বসদানী, স্থপনী, শ্রেয়সী, প্রাচীনা, সোমাবল্লী, মহামুলা, সৌপর্ণী, গারুডী, দীর্ঘবল্লী, দীর্ঘকন্দ, অম্বষ্ঠ নামে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কন্নড়ে দাগাডি বল্লি, কাগে মারি, ওড়িয়াতে মুসাকানি, তামিলে কাট্টু কে কোটি, তেলুগুতে চিপুরু টিগা, দুসারিটিগা, কাটলাটিগা, কোঙ্কণীতে বসনবেল, মালয়লামে পাথালগারুডাক্কোটি, পাথালমূলি, মারাঠীতে বসনবেল, পাঞ্জাবীতে ফরিদ বুটি, ওয়াল্লুর, উর্দুতে ফরিদ বুটি নামে পরিচিত। 

ভারতের বুকেই এর ২০ টি প্রজাতি আছে। মূলতঃ উষ্ণপ্রধান অথবা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে জন্মাতে দেখা যায়। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Cocculus hirsutus (L.) W.Theob এবং Cocculus hirsutus (Linn.) Diels। এটি Menispermaceae পরিবারভুক্ত। এছাড়াও এর অন্যান্য যেসব প্রজাতির সন্ধান মেলে, সেগুলি হল ---
Cebatha hirsuta (L.) Kuntze (1891)
Cebatha villosa C.Chr. (1922), nom. superfl.
Cocculus villosus DC. (1817), nom. superfl.
Convolvulus gangeticus L. (1756)
Evolvulus gangeticus (L.) L. (1762)
Holopeira villosa Miers (1867), nom. superfl.
Limacia villosa W.Theob. (1883), nom. superfl.
Menispermum hirsutum L. (1753)
Menispermum villosum Lam. (1797), nom. superfl.
Merremia gangetica (L.) Cufod. (1969)
Cocculus aristolochiae DC. (1817)
Cocculus hastatus DC. (1817)
Cocculus holopeira torrida Broun & R.L.Massey (1929)
Cocculus linnaeanus Kurz (1874)
Cocculus sepium Colebr. (1821)
Cocculus villosus var. glabratus Schweinf. (1896)
Holopeira auriculata Miers (1867)
Holopeira laeviuscula Miers (1867)
Holopeira torrida Miers (1867)
Menispermum hastatum Lam. (1797)
Menispermum myosotis L. (1759), orth. var.
Menispermum myosotoides L. (1753)
Menispermum myosuroides Hill (1770), orth. var। 

এর পাতা জলের মধ্যে চটকে সবুজ রস বের করে রেখে দিলে ঐ জলটি অল্পকালের মধ্যেই জমে যায়। যা অনেকটা থকথকে জেলির মতো দেখতে। আমরা যে দই বসাই, ঐ সবুজ জমে যাওয়া জলটি দইয়ের মতোই দেখতে হয়। যা খুব উপকারী। এই গাছের এ ধরনের বিরল গুণের পেছনে কি কারন? উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এর মধ্যে আছে Bis Benzyl Isoquinoline Alkaloids। শেকড় ও কাণ্ডে আছে Jamitinine, Jamitine N Oxide, Haiderine, Shaheenine, Cohirsine, Cohirsinine এবং Hirsutine। এছাড়া পাতায় আছে Isotrilobine, D trilobine, DL Coclaurine, Protoquericitol এবং Syringaresinol। এসব অ্যালকালয়েডস থাকার জন্য এই গাছের পাতার এহেন আচরণ আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। এছাড়াও Quaternery base হিসেবে পাওয়া যায় cocsarnine, 10-ethoxy-1, 2 এবং 9-trimethoxyaporphine। এর সাথে Alkaloid glycosides এবং Sterols পাওয়া যায়। 

এটি প্রধানভাবে বৃষ্যগুণ সম্পন্ন (Rejuvenative) এবং মূলতঃ কফ ও বায়ুকে প্রশমিত করে। শুক্র তারল্যে এবং ক্ষীণতায়, পুরাতন বাত রোগ, শুষ্ক একজিমায়, স্বপ্নদোষে, লালামেহ বা শুক্রমেহ রোগে, রক্ত দুষ্টিতে, চোখের পার্শ্ব ক্ষতে, বিষ ফোড়ায়, জিহ্বা ক্ষতের নিরাময়ে জলজমানি খুব কার্যকরী। এর ভেষজগুণ নিয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের অভিমত Sedative, Hypotensive, Bradycardiac cardio tonic and Spasmolytic। তবে ইদানিং এই গাছ ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার বুক থেকে। আমাদের একটু সজাগ হওয়ার সময় এসে গিয়েছে কিন্তু। এখনকার প্রজন্মের কাছে তাই জলজমানী গাছ সমীহ আদায় করতে অপারগ।

🍂

Post a Comment

0 Comments