জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী/ষোড়শ পর্ব

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
ষোড়শ পর্ব

ক্রমে দিন যায়, রাত যায় কালের নিয়মেই। পাড়ার আর পাঁচটা মেয়ে বৌয়ের মতো বিরজাও বড়ো হয়, রজস্বলা হয়। সমবয়সী অন্যদের মধ্যে স্বামী-সংসর্গ,বর-বৌয়ের ভাব ভালোবাসা,সংসার,শ্বশুরবাড়ির কথা হয়। পুকুর ঘাটে  ফিসফাস, কার ঠোঁটে বা কার কানের লতিতে কামড়ের দাগ;আদর বিলাস, সেই নিয়ে হাসাহাসি হয়। ওসব থেকে সচরাচর দূরেই থাকে বিরজা। ওরাও ওকে এড়িয়ে যায় ওসব সময়। 
খারাপ লাগে খুব যখন একাদশীর দিনে ওর ঘরের পাল্লা ঠেসিয়ে জ্যাঠাইমা আর বৌদিদি আলতা পরে, জ্যাঠাইমার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, তাঁর বিরজা যে লাল রঙ বড্ডো ভালোবাসে, মাছ খেতে ভালোবাসে। ছোট্টো থেকে কতো আদরে মানুষ করেছেন; আজ মা হয়ে খাওয়ার পাতে তিনি মাছ মুখে দেন, আলতা-সিঁদুর পরেন;মেয়েটার পাতে হবিষ্যান্ন তুলে দিয়ে! মেয়েটার সারা শরীর বর্ণহীন! 
ছোটো থেকেই ভীষণ বুঝদার। এ ব্যথা যে কতোখানি বুকে বাজে তাঁর, তা বিরজা জানে। আর তাই, সবসময়ই হাসিমুখে থাকার চেষ্টা করে, তেঁতুল চটকে অখাদ্যটুকু খানিক গলাধঃকরণ করে, খানিক মাছকে খাওয়ায় পুকুরঘাটে গিয়ে, মাছেদের সঙ্গে, পাখিদের সঙ্গে, ঘাটপারের গাছেদের সঙ্গে গল্প করে, মন খারাপ, কান্না সব কোথায় উবে যায়। 
প্রথম প্রথম,শাঁখা-সিঁদুর খুইয়ে বাপের বাড়ি ফিরে আসার পরে, কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে। কারো সঙ্গে কথা বলতো না, কিছুই খেত না, সবসময় শীত করতো, যেন ভীষণ জ্বর গায়ে। সারাদিন সারারাত জ্যাঠাইমা ওকে আগলে রাখতো তখন। একটু সুস্থ হয়ে, পরে পরে শুনেছিল, কলার মান্দাসে একমাত্র ছেলের দেহ গ্রামপারের শিলাই নদীর খাতে ভাসিয়ে আর ঘরে ফিরতে পারেননি মা, নদীঘাটেই মাথা ঘুরে পড়ে যান, মাথায় চোট পান, তুমুল রক্তপাতে সেদিন রাতে তাঁরও মৃত্যু হয়। এসব আকস্মিক দুর্ঘটনায় বাবা ঠাকুর কেমন যেন পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করেন, তখনকার দিনের রীতি রেওয়াজ মতো উপস্থিত আত্মীয়-স্বজনেরা দোষারোপ করতে থাকে নতুন বৌকেই। 
🍂

অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছে বুঝতে পেরে, জ্যাঠামশাই বুকে পাথর চেপে কোনক্রমে জামাই বাবাজীবনের ত্রি-রাত্রিক অপঘাত মৃত্যুর পারলৌকিক কাজকর্মটুকু সেরে কন্যাকে নিয়েই বাড়ি ফিরে আসেন; আর ওমুখো হননি, খবরাখবরও নেননি। দরিদ্র তাঁরা; অর্থে বা সম্পদে, মনে নন। আত্মীয়ের অঘটনে পাশে থাকতে চেয়েই তো গিয়েছিলেন, কিন্তু যেভাবে তাঁদের কন্যাকে গালমন্দ করা হচ্ছিলো, এবং মেয়ের সহৃদয় শ্বাশুড়ীমাও প্রয়াত হলেন অকস্মাৎ, আর সেখানে মেয়ে রেখে আসতে সাহস পাননি তিনি। 
পরে পরে খবর এসেছিল, বিরজার খুড়শ্বশুর নাকি মানুষ ভালো না, বংশের কুলতিলক একমাত্র ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে হারিয়েও দুঃখ পাওয়ার চাইতে তিনি নিজের সম্পত্তি রক্ষার বিষয়েই বেশী মনোযোগী ছিলেন। বিরজার পরিবার যদি সম্পত্তির উত্তরাধিকার চায়, সেজন্যই নাকি তিনি সুকৌশলে আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে বাচ্চা মেয়েটির দুর্নাম করেন, যদিও সে অভিসন্ধি তাঁর সফল হয়নি ভবিষ্যতে, সে গল্প পরে… 

এমনই এক দিনে, কেমন এক মনকেমনিয়া ক্ষণে, বিরজা বইপত্র নিয়ে বসেছিল। ‘ব্যাধবা’ হয়ে ফিরে আসার পরে বেশ ক’য়দিন এদের সঙ্গে তার মেলামেশা ছিলনা, তাপ্পর একদিন বড় দাদা কলকেতা থেকে তারজন্য কয়টা বই এনেছিল, নিজে হাতে দিয়ে বলেছিল,পড়া শুরুর কথা।তারমধ্যে ছিল গজেন্দ্রকুমার মিত্রের ‘কলকাতার কাছেই’।প্রথম প্রথম ছুঁয়েও দেখেনি;বই হাতে নিলেই চোখে জল আসতো। পরে পরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে এবং ভবিতব্যকে যেন নিয়ে, আবার পড়তে শুরু করে, ফের আশ্রয় খোঁজে,বন্ধুত্ব পাতায় নতুন করে জন্মাবধি প্রিয় বিষয়টির সঙ্গে… 
সেদিনও শ্যামার গল্প পড়তে পড়তে কখন যে সেই সব পেয়েও কিছু না পাওয়া মহিলাটির চরিত্রে বুঁদ হয়ে গিয়েছিল, খেয়াল ছিল না। হঠাৎ গলা জড়িয়ে কার আদরস্বর… 
-’কেমন আছিস লো!’
চোখ তুলে চমকে তাকিয়ে দেখেছিল সিঁথি ভরে সিঁদুর আর লাল পেড়ে শাড়ি পরা কুমুর দিকে… 
কি তৃষ্ণার্ত সে চাহনি! 
অন্য কেউ হলে হয়তো ভুল বুঝতো, বাকি সব সমবয়সী মেয়েরা যেমন ওকে এড়িয়ে চলে, তেমন চলতো, কিন্তু কুমু তো কুমুই… 
শুনেছিল,ওর বিয়ে হয়েছে অনেকদূরে;বরের নাকি কেউ নেই।ওর গরীব বাবা ওটুকুই জোগাড় করতে পেরেছিলেন খুঁজে পেতে।তবে বিয়ের পরে,এখানে বেশি আসতে পারবে না বলে বাবাকেও ওর বর নিয়ে চলে গেছে। ওরা নাকি সেখানে ভালোই আছে। এবং সত্যিই যে সেখানে তারা ভালো ছিল, পরে তীর্থ করতে বারানসীতে গিয়ে দেখেছিলেন বিরজা। 
যাইহোক, অনেকদিন পরে দেশে ফিরে প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল সে, স্বাভাবিক সতীত্বের টানে। অন্যদের মতো এড়িয়ে যায়নি ওকে… 
বাইরের প্রখর তাপ থেকে বাঁচতে,ঘরের আগল ছিল টানা,ছায়া ছায়া অন্ধকার ঘরময় ছড়িয়ে,তারমধ্যেই বিরজা তাকিয়ে দেখলে, সত্যিই গায়ে গয়নাগাটি নেই,শুধু শাঁখাপলা আর সিঁদুর।তবু কি ভালো লাগছে ওকে…
হিংসে-দ্বেষ নয়,ওসব বিরজার ধাতে নেই,তবু খুব কাছে এসে জড়িয়ে ধরে যখন মাথা রাখলো কাঁধে, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো জল… পরস্পরেরই।
সহমর্মিতার সেই আলিঙ্গনে অনেকদিন পরে আবার বাঁধ ভাঙলো তার!'কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন…'
এবং খানিক কান্নাকাটির পরে,দুই সখী মিলে গেল পুকুরপাড়ে। সেখানে তখন পুকুরজলে রোদের খেলা চলছে, কি যেন একটা পাখি কুব কুব করে ডাকছে…
হঠাৎ বিরজার চোখ পড়লো নিজের কাঁধে; একী!ফর্সা কাঁধটি লাল হয়ে রয়েছে কুমুর সিঁদুরে…একটু আগেই…
কেন কে জানে,ভীষণ লজ্জা অথবা অনাচারের ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো মন,
-'কি হবে এবার!'
বন্ধুর বিপন্নতায় যেন হেলদোল নেই ডাকাবুকো মেয়েটির;নিশ্চিন্ত গলায় উচ্চারণ,
-'কি হবে আবার!মুছে দেব আমার আঁচলে…'
-'যদি পাপ লাগে!যদি তোর কোন অনিষ্ট হয়!
-'তুই এতো বোকা তো ছিলি না তারা!কবে থেকে এমন হলি? শোন,আমাদের কখন কার জীবনে কি হবে,তা আমরা যেমন জানি না,আমাদের দায়ও নেই তাতে। যা হওয়ার হবে।ওতো ভেবে কি হবে ভাই!'
বলতে বলতে আলতো হাতে সযত্নে মুছে দিলে সে রক্তরাগ…ওরা খেয়ালও করলো না,খিড়কি দুয়ারে দাঁড়িয়ে আরও একজন দেখলে তা;ওদের বড়ো বৌদিদি…আদরের ননদিনীর রিক্ত সাজ যে বড়ো অসহ লাগতো তাঁরও।
তবে সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়। লাল বিরজার এমনিতেই প্রিয় রঙ, তায় আবার কচি মন,রঙের নেশা তাকে যেন নিষিদ্ধ গন্ধের মতো টানছিলো। ইচ্ছে করতো প্রতিদিন যেন কুমু আসে, জড়িয়ে ধরে,রঙ লাগায়। রাতে জ্যাঠাইমার বুকের আশ্রয়েও ও সেই রঙের গন্ধই শুঁকতো। জ্যাঠাইমা হয়তো বুঝতে পারেনি, কুমু ঠিকই বুঝেছিল। তাই হয়তো যতদিন ছিলো সেই বারে, প্রতি দুপুরেই সিঁদুর ঘসাঘসি চলতো, একদিন তো আলতা পরা পাও ঘসে দিয়েছিল পায়ে… সারা সময় গা ঢেকে পা ঢেকে রাখতো বিরাজ, যেন কেউ দেখতে না পায়;তবু সাজিমাটি ঘসে সে রঙ তুলতেও ইচ্ছে করতো না;যথাসময়ে কুমু তার বরের কাছে ফিরে যাওয়ার পরেও না। 
দেখা যেতনা সে অলক্ষ্য রঙের ঢেউ… তবু প্রাত্যহিক কাজে,দিনের অবসরে,ছোট্টো মেয়েটির রাতের স্বপ্নে ভিড় করতো রঙ, রঙ, বইয়ের সাদা সাদা পাতার কালো কালো অক্ষরে তা হয়তো ডানা মেলতো অনায়াসে। (ক্রমশ)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments