জ্বলদর্চি

আমার জীবন শিক্ষক, আমার রবি ঠাকুর/জয়তী ব্যানার্জী

আমার জীবন শিক্ষক, আমার রবি ঠাকুর
          
জয়তী ব্যানার্জী

পঁচিশে বৈশাখের এই পূর্ণ তিথি টির জন্য আমরা অনন্ত প্রতীক্ষা রত। আবাল বৃদ্ধ বণিতার মুহূর্ত গোনা যখন শেষ তখন যে আমরা শুনতে পাই তার পদধ্বনি ___ শুনতে পাই সেই হৃদয় কাঁপানো ধ্বনি -----
         'আমি এসেছি তোমারি দ্বারে '
আর আমরাও যেন 'যেতে নাহি দিব' অঙ্গীকারে দিনটাকে ধরে রাখতে চাই। কারণ তিনি যে রবীন্দ্রনাথ____ আমাদের রবি ঠাকুর ;আমাদের সকলের জীবন সঙ্গী।
           খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠে এখনকার ছেলেমেয়েরা ।বিশেষ করে শহুরে অতি আধুনিক কিশোর কিশোরীরা। দু'বছর বয়স থেকেই তারা স্কুলে যায়: এবিসিডি শেখে... শেখে অ-আ-ক-খ... লিখতে শেখে. তাদের হাতে এসে যায়
        বনে থাকে বাঘ 
        গাছে থাকে পাখি 
         পাখি গান গায় 
          পাখা মেলে ওড়ে-------
     আবার আরেকটু বড় হলেই সে সুর করে পড়তে শুরু করে 
     নদীর ঘাটের কাছে 
          নৌকা বাধা আছে 
      নাইতে যখন যাই দেখি সে 
            জলের ঢেউয়ে নাচে। 
       এভাবেই কৈশোর-- কৈশোর থেকে যৌবন ---তাহলেও যেন ছোটদের দাবি বেশ জোড়ালো! আমাদের শৈশব কাল যেন 'এটা করোনা আর ওটা করোনা'--র নীতিকথায় ভরপুর। এই সব নীতিকথা কি কারো ভালো লাগে। কিন্তু যখনই হাতে পাই "শিশু ভোলানাথ "---তখন বড়দের সমস্ত বাধা নিষেধ অগ্রাহ্য করে মনে হয় রবি কবি যেন আমাদেরই লোক। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় উপদেশ নেই; নেই শাসন ; নেই চোখ রাঙ্গানি----তবে কি আছে তাতে-----
       তাতে আছে 
              আছে আকাশের কথা, 
          আছে মেঘ বৃষ্টি ঝড় বাদলের কথা ,
  আছে গাছপালার ভেতর দিয়ে ঝোড়ো বাতাসের ছুটে যাওয়ার কথা। 
         তাইতো রবীন্দ্রনাথ যে আমার তোমার সকলের। বয়স যে কোথাও আটকে থাকে না তা বাড়তে থাকে।। ক্রমশ যত বাড়ে রবীন্দ্র চিন্তার পরিসর ও যেন বাড়তে থাকে। রবীন্দ্রনাথ যেন আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠতে থাকেন। অভিজ্ঞ দৃষ্টি দিয়ে বিচার করলে বুঝতে পারি-----
            রবিবাবু যে একেবারে উপদেশ টপুদেশ দেননি তাও ঠিক কথা নয়---- সেটা তিনিও এক আধবার দেন। অবশ্যই তার কিন্তু এতই প্রচ্ছন্নভাবে গল্পের মোড়কে মুড়ে দেন যে সেটাকে উচ্চাসনে আসীন একজন সর্বজ্ঞ মাস্টার মশায়ের তর্জন বলে মনে হয় না----- কোন শিশু মনের.. তাইতো "শিশু"র 'পুজোর সাজ 'কবিতাটি এতটাই মর্মস্পর্শী।
       সেখানে নির্লজ্জ ও আঁকাট নির্বোধ যে অল্প বয়সী ছেলেটি তার গরিব বাবা-মায়ের দেওয়া সস্তা জামা কাপড় ধুলায় ফেলে দিয়ে এক বড়লোকের কাছ থেকে দান হিসেবে পাওয়া ঝলমলে সাটিনের জামা পড়ে খুব জাক করে সকলকে দেখিয়ে বেড়ায় তখন তার মা তাকে বলছে-------
       তুমি আমাদেরই ছেলে 
            ভিক্ষা লয়ে অবহেলে 
        অহংকার করো ধেয়ে ধেয়ে
             ছেড়া ধুতি আপনার 
         ঢের বেশি দাম তার 
              ভিক্ষা করা সার্টিনের চেয়ে। 
         এও উপদেশই ....কিন্তু উপদেশের এই কথাগুলি কাকে দিয়ে বলানো হচ্ছে.... না ---এক আত্মমর্যাদা বোধ সম্পন্ন অভিমানি মা'কে দিয়ে। দারিদ্র্যের গঞ্জনা সত্বেও যিনি কারো কাছে গিয়ে হাত পাতার কথা ভাবতে পারেন না, তাইতো শিশুদের কাছে কথাগুলো কিন্তু বিরক্তি জাগায় না। বরং তারা বুঝতে পারে যে মা তার ওই বোকা লোভী ছেলেটাকে বকুনি দিয়ে ঠিক কাজই করেছে।
        এই হল রবীন্দ্রনাথ। 
       আবার এই রবীন্দ্রনাথ লিখলেন 
              ছোট খোকা বলে অ আ
                   শেখেনি সে কথা কওয়া 

🍂

       এ হল সহজপাঠ---- যেখানে বর্ণ ও শব্দ শেখানোর পাশাপাশি রয়েছে ছোট-বড় অগুনতি কবিতা ।আর তার সবই ছবির মত--- ছবির পর ছবি। না সেগুলো তুলে দিয়ে আঁকা ছবি নয় সেগুলো যে শব্দ দিয়ে আঁকা ছবি.. শব্দ দিয়ে যে ছবি আঁকা যায় তা যে কেবলমাত্র রবীন্দ্র ভাবনারই ফসল ..সেই ছবি যে আমাদের চিরচেনা পরিবেশের ই ছবি।
       যেমন সেই কবিতাটি______
         অঞ্জনা নদী তীরে চন্দনী গায়ে 
                পোড়ো মন্দির খানা 
              গঞ্জের বাঁয়ে।
        এই কবিতায় আঁকা গোটা ছবিটা যেন ভাসতেই থাকে আমাদের চোখের সামনে আর আমরা পৌঁছে যাই কবিতার শেষ প্রান্তে যেখানে কবি বললেন 
     কল্লোলে কোলাহলে জাগে এক ধ্বনি 
      অন্ধের কন্ঠের গান আগমনী 
   সেই গান মিলে যায় দূর হতে দূরে
       শরতের আকাশেতে সোনা রোদ্দুরে। 
         আবার রবীন্দ্রনাথই বলতে পেরেছেন______
আবার রবীন্দ্রনাথই বলতে পেরেছেন 
       "কত গভীর কথা যে কত সহজে সহজ করে বলা যায় "
         তাইতো তার লেখনীতে ফুটে উঠেছে "ক্ষণিকা "কাব্যের 'বোঝাপড়া' কবিতাটি ...পড়ার পর যেন মনের মাঝে বারবার ধ্বনিত হতে থাকে ওই কবিতার অবিস্মরণীয় দুটি পংক্তি......
        "ভালো-মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে ".......
         তাইতো জন্মসূত্রে প্রাপ্ত যে পরিচয় ও ঠিকানা আমাদের কপালে  সেটে দেওয়া হয়েছিল তাকে চূড়ান্ত জ্ঞান না করে, আরো বড় পরিচয় ও আরো বড় ঠিকানা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা আমরা পাই রবীন্দ্রনাথের থেকেই ।গোটা পৃথিবীকে আপন দেশ ও গোটা মানব সমাজকে পরমাত্মীয় বলে গ্রহণ করার শিক্ষা। তার এই সত্য  পরিচয় যেন এক একটি শিক্ষিত মানুষের দর্পণ ।তার গান গাওয়া হয় তিনটি দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ।এ দৃষ্টান্ত তো এ যুগে বিরল ।সত্যের শিক্ষাকে আত্মস্থ করে ফেলতে হবে; রবীন্দ্রনাথ যেমন করেছিলেন ....তাইতো তিনি অকপটে বলতে পেরেছেন....
          "আমি তোমাদেরই লোক ";
       তাকে নিজের আচরণে নিজের জীবনে প্রভাবশালী করে তুলতে হবে:: রবীন্দ্রনাথ নিজে যেমন দেখিয়েছিলেন, তার জীবন বৃত্তান্ত তো আমাদের অজানা নয়। আমরা তো সবাই জানি জীবনভর কত 
           'আঘাতে আঘাতে 
                  বেদনায় বেদনায় '
    ----  জর্জরিত হতে হয়েছে তাকে... যেমন মাতৃহারা হয়েছেন বাল্য বয়সে, প্রথম তারুণ্যে হারিয়েছেন তার নতুন বৌঠানকে, তেমনি তার জীবদ্দশাতেই স্ত্রী ,তিন সন্তান আর একমাত্র দৌহিত্রের মৃত্যু ঘটেছে। জীবনের এই মর্মান্তিক ঘটনাকেও তিনি বর্ণনা করেছেন 
  '  সত্য যে কঠিন '
                         ---- এই ভাষাতে। 
     এ তার অভিজ্ঞতারই অভিব্যক্তি..... এরপরেও তিনি লিখেছেন 
       " কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।" 
    বলেছেন ,
               'কেননা কঠিনকে ভালো না বাসলে সত্যকে অস্বীকার করা হয়, সত্য থেকে যে বিচ্যুতি ঘটে। '
        তাইতো রবীন্দ্রনাথের অজস্রবিধ রচনার মধ্যে ছড়িয়ে আছে ,যেমন তার অনুভূতি ও উপলব্ধির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার রোমাঞ্চ ,তেমনি রয়েছে অজস্র রকমের শিক্ষা, তাই এই দিনান্ত বেলায় পৌঁছে আমার এটাই একমাত্র উপলব্ধ বিষয় যে....

 
                সত্যের কোন বাছ বিচার চলেনা, যা সত্য তাকে ভালো মন্দ নির্বিশেষে গ্রহণ করতে হয়..... দেশগত ধর্মগত ভাষাগত পরিচয় থেকে যা আমাদের বিচ্যুত হতে বলে না.... কিন্তু সেখানে স্থিত থেকেও আমাদের মনুষ্যপরিচয়ে উত্তীর্ণ হতে শেখায় ,ভাবতে শেখায়, 
          আমাদের চূড়ান্ত পরিচয় হল নিজস্বতা ।
        তাইতো আমাদের থেমে থাকলে চলবে না, কিন্তু পথটা যে আবার সুবিধারও নয়। তাই মাঝে মাঝেই পা হড়কায়। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না নিজের মনকে জানান দিতে হবে এই বলে যে ---
         যে মন রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে তার থেমে যাওয়া অর্থহীন।।

            

Post a Comment

0 Comments