জ্বলদর্চি

ধর্ম, উৎসব ও সংস্কৃতি /রোশেনারা খান

ধর্ম, উৎসব ও সংস্কৃতি

 রোশেনারা খান

আমার শৈশব মানে তা প্রায় ৫৫/৬০ বছর পূর্বের কথা। আমাদের গ্রামে হিন্দু  মুসলিম পাড়া একেবারে পাশাপাশি। তাই আনন্দ উৎসব বলতে  দুর্গাপুজো,  কালীপুজো, দো্ল,‌ চড়ক, রথযাত্র্‌ রাখী বন্ধন, মকর সংক্রান্তি, এসবগুলিকেই  বুঝতাম। আমাদের উৎসব মানে সংযম, ক্রিচ্ছসাধন ও দান। ইদে হিসেব মেনে ফিতরা ও যাকাত দেওয়া, নতুন সাড়ি-কাপড় বিলি করা ইদুজোহাতে কোরবানির  মাংস বিতরণ করা, সবেবরাতেও ‘দরিদ্র ভোজন’ করানো এবং টাকাপয়সা দান করা হয়।  ছোটদের এতে বিশেষ আনন্দ ছিলনা। তাছাড়া আমাদের উৎসব তো একদিনের। সকালে শুরু হয়ে রাতে শেষ। মহরম চারদিনের উৎসব হলেও, মহরম সব জায়গার সব মুসলিমরা এই শোকের উৎসব পালন করেন না। ইদ একদিনে ফুরিয়ে গেলেও অবশ্য এর শুরুটা হয় একমাস পূর্বে ১ লা রমজান থেকে। সেদিন থেকেই শুরু হয় দিন গোনা। আমাদের  ছোটবেলায় গ্রামে  ঈদ  ছিল  একেবারে  অন্য   রকম। জ্ঞাতি গুষ্টিদের মধ্যে বেশিরভাগেরই অবস্থা ভাল ছিল না।এককালে ছিল অনেক কিছুই, বাপঠাকুরদারা তলানিতুকুও শেষ করে দিয়ে গেছেন। তখন গ্রামের মানুষ অতি সাধারন জীবনযাপন করতেন। মানুষের  চাহিদাও কম  ছিল।  শহর ও  গ্রামের  মধ্যে  যোগাযোগ  ব্যবস্থা  খুবই  খারাপ ছিল। ধুলো কাদায় ভরা মাটির রাস্তা, যানবাহন বলতে ছিল গরুরগাড়ি, পালকি, সাইকেল। গ্রামে মোটরবাইকের আওয়াজ শুনতে পেলে বাচ্চারা দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ত আওয়াজের উৎস সন্ধানে।  গ্রাম-শহরের যোগাযোগ ছিল না বলে পোশাক-আসাক,  খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ- উৎসব, ভাষা- সংস্কৃতি, সবকিছুর  মধ্যেই  বেশি রকম  ব্যবধান  ছিল।   

       তখন গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে আমাদের আশপাশের বাড়িতেই দুবেলা রান্না হত না। সারাদিনের মধ্যে যখন চাল ডাল কেনার পয়সা হাতে আসত, তখন রান্না হত। তাই ঈদের দিনেও বিশেষ কিছু খাবারের ব্যবস্থা হত না। ভোরে উঠে পরনের লুঙ্গিটি কেচে মেলে দেওয়া হত,  সেই আধ শুকনো লুঙ্গি পরে আরও অনেকের মত ইয়ারচাচ, ইউনুসচাচা ঈদের নামাজ পড়তে যেতেন খড়কুশমার ঈদগায়। ফেরার সময় ময়রা দোকান থেকে শালপাতার ঠোঙ্গায় করে বোঁদে কিনে আনতেন ছেলেমেয়েদের জন্য। দুপুরে মাংসভাত আর আতপচাল জোগাড় করতে পারলে ঢেঁকিতে কূটে রাতে রুটি হত। যাদের বাড়িতে ভাত ছিল তাদের সকালে চাল গুঁড়ির সিমাই পিঠে, ফিরনি ইত্যাদি হত। রাতে হত চাল গুঁড়ির রুটি আর মাংসের ঝোল।তবে আমাদের মা শহর থেকে এসেছিলেন, তাই মামাবাড়ি থেকে বাসে সিমাই(বাড়িতে সিমাই কলে তৈরি করা)আসত। মা বাদাম কিশমিশ দিয়ে সিমাইয়ের পোলাও রান্না করতেন। এই  খেয়ে বাবা দাদারা ঈদগাতে নামাজ পড়তে যেতেন। আমরা, ছোট ছেলে মেয়েরা নতুন ফ্রক, জামা পরে নামাজ দেখতে যেতাম। তবে নতুন ফ্রক প্রতি ইদে হত না। অভাবের কারণেই হয়ত ইদে নতুন সাড়ি-জামাকাপড় কেনার চল খুব একটা ছিল না।     

        নামাজ হয়ে গেলে ফিরে এসে বাড়ি বাড়ি সালাম করতে যেতাম। বাবা বংশের বড়, সেই হিসেবে মা বড়বৌ। তাই পাড়ার ধনী-গরীব সবাই বাবা-মাকে সালাম করতে আসত।মা সবাইকে সিমাই খেতে দিতেন। রাতে আমাদের হত  পোলাও আর মোরগের মাংস। মা চাল গুড়ির রুটি তৈরিতে খুব একটা দক্ষ ছিলেন না। তাছাড়া আমরা পোলাও খেতেই পছন্দ করতাম।এখানেই ঈদ শেষ।  গানবাজনা ইসলামে হারাম, তাই কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতনা।   

      সে  সময়  গ্রামের  মানুষ  যে  সংস্কৃতি  চর্চায়  থাকতেন্  তা  ছিল  বাঙ্গালির  আদি ও নির্ভেজাল  সংস্কৃতি,  ভারতের  নিজস্ব  সংস্কৃতিও  বলা  যায়।  তখন রাস্তা দিয়ে একতারা হাতে বাউল গান গেয়ে ফিরত, পটুয়ারা মেয়ে-মরদ  নিজেদের আঁকা ছবি ও নিজেদের বাঁধা গান বাড়ি বাড়ি শুনিয়ে পয়সা চাল,পুরনো কাপড় চেয়ে নিয়ে যেত। এদের পিছন পিছন আমরা সারা পাড়া ঘুরতাম। আর একধরণের ফকির ছিল, তারা সত্যপীরের গান গাইত, এদের  জামা, লুঙ্গি ও ছাতাতে রঙ্গিন ছিট কাপড়ের অজস্র তালি দেওয়ে  থাকত। গলায় থাকত নানা রঙের পুঁতির মালা।  

               আমাদের গ্রামের    দুর্গাপুজোর সময় দিনের বেলায় হত সাঁওতালি নাচ, ও    কাঠিনাচ। মঙ্গলামাড়া (যে স্থানটিতে দুর্গাপুজো হয়)ও আটচালা ঘিরে রাজবাড়ির সামনে যে মেলা বসত(এখনও বসে)সেই মেলা ঘুরে ঘুরে এরা সাঁওতালি নাচ, কাঠিনাচ দেখাত। সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত আটচালাকে মঞ্চ করে চার কোনে চারটে হ্যাজাক ঝুলিয়ে সেখানে তর্জা, বাউলগান, গ্রামীণ যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হত। পৌষ সংক্রান্তির দিন টুসুগান শোনার জন্য ভোরবেলা শিলাবতীর পাড়ে হাজির হতাম। অন্য সময় এপাড়ায় ওপাড়ায় কেষ্টযাত্রা হত। শহুরে সংস্কৃতিকে অনুকরণ  করতে গিয়ে কবে যে কীভাবে এসব হারিয়ে গেল, টেরই পেলাম না! এই আদি সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রাখার দায়ভার বর্তমান প্রজন্ম আর নিচ্ছে না। তাই নতুন শিল্পীও উঠে আসছে না। এখন আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, মানে নাচ্‌,গানবাজনা ভেজালে ভরা।যাকে বলে বকচ্ছপের মত অবস্থা। কার মাথা আর কার লেজ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, তা সহজে বোঝা মুশকিল।রোদ্দুররা যা অবস্থা করেছে, সেখান থেকে আসপ্ল জিনিস ফিরিয়ে নিয়ে আসা কঠিন।   

       বিশ শতকের শেষের দিক থেকে শহর ও গ্রামের ব্যবধান কমতে শুরু       করে। কৃষিতে উন্নয়নের ফলে ধিরে ধিরে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে  থাকে। জীবনযাত্রাও বদলে যায়। এখন গ্রামের মানুষের শিক্ষা-সংস্কৃতি, পোশাক থেকে খাদ্যাভ্যাস সব বদলে গেছে। ‘মা’ বলতে সাড়িপরা, ঘোমটা দেওয়া, কারো কপালে, সিঁথিতে সিঁদুর আঁকা যে মুখ মনের আয়নায় ভেসে ওঠে, তা আর দেখা যায়  না। এখন গ্রামের বৌরাও সাড়ি পরেনা। গ্রামের পান গুমটিতেও এখন বিরিয়ানির মশলা পাওয়া যায় ।ইদ উপলক্ষ্যে মেলা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, সস্তার শিল্পী ভাড়া করে নিয়ে এসে রাতভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছ্বে। দুর্গাপুজো, কালী পুজোতেও তাই  হয়। তবে এটা সংস্কৃতি না অপসংস্কৃতি, তা বলা মুশকিল।আর বলবেই বা কে? সবার ঘাড়ে একটাই তো মাথা আছে!  

🍂

Post a Comment

0 Comments