জ্বলদর্চি

চার সখা সমাচার /রবীন্দ্র বন্ধুত্ব---দ্বিতীয় পর্ব/তনুশ্রী ভট্টাচার্য

চার সখা সমাচার
রবীন্দ্র বন্ধুত্ব---দ্বিতীয় পর্ব
তনুশ্রী ভট্টাচার্য

জগদীশ চন্দ্র বসু 


গীতাঞ্জলীর কবিতাগুলোর ইংরেজী অনুবাদ ইংলন্ডে পৌঁছোনার অনেক আগেই  রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প কাবুলিওয়ালা ও পোষ্টমাস্টার  বিজ্ঞানীবন্ধু  জগদীশচন্দ্রের হাতধরে ইংলন্ডে পৌঁছে গেছিল। জগদীশচন্দ্র তাঁর মাতৃসমা রমণী মার্গারেট নোবেলের ( ভগিনী নিবেদিতা  ) হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেই গল্প এবং ইংলন্ডে নিবেদিতা   সেই গল্পের ইংরেজী অনুবাদ করেছিলেন।  বিদ্বজন মহলে সেই গল্প এবং তার অনুবাদ যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল।  জগদীশ চন্দ্র বসু ও  রবীন্দ্র নাথের মধ্যে গভীর সখ্যতার এ এক অভিজ্ঞান। দুজনের ক্ষেত্র আলাদা হলেও দুজন সৃষ্টিশীল মানুষের মনের নৈকট্য  বন্ধুত্বের পরিসর তৈরী করে দেয়।পতিসরে থাকাকালীন যে বন্ধুবলয়  রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন তার একদিকে যেমন ছিলেন ব্যারিষ্টার  লোকেন পালিত অন্যদিকে ছিলেন  বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু আর পন্ডিত প্রবর প্রিয়নাথ সেন। সেই সময়ে জমিদারীর  বিচিত্র কর্ম ভারে জড়িয়ে পড়া এবং পদ্মার পারের বিচিত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে তাঁদের যে দিনগুলি কাটতো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের বিষয়বস্তুগুলি সেখান থেকেই উঠে এসেছিল। গ্রাম বাংলার মানুষের সুখ দুঃখ আশা নিরাশা আলো আঁধারের চিত্ররূপময়তায় পূর্ণ  গল্পগুচ্ছের প্রথম দিকের গল্পগুলো। শিলাইদহে  প্রতিদিন বিকেলে যখন সবাই চা নিয়ে বসতো বিজ্ঞানীবন্ধু রবীন্দ্রনাথের কাছে  নতুন গল্প শুনতে চাইতেন। রবীন্দ্রনাথ দুপুরে গল্প গুলো লিখতেন আর বিকেলে বন্ধুকে পড়ে শোনাতেন। এইভাবে  গল্পগুচ্ছের গল্প রবীন্দ্রনাথ আর জগদীশচন্দ্র বসু এক সূত্রে গাথা হয়ে রয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্য বলয়ে। 
রবীন্দ্রনাথ তাঁর "খেয়া" কাব্যগ্রন্থ  জগদীশচন্দ্র কে উৎসর্গ করেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে শান্তিনিকেতনে যে সংবর্ধনা সভার আয়োজন হয়েছিল জগদীশচন্দ্র বসু তার সভাপতিত্ব করেন এবং যে লজ্জাবতী লতা দ্বারা তিনি গাছের প্রাণ আছে আবিষ্কার করেছিলেন সেই লজ্জাবতী লতার একটি গাছ রবীন্দ্রনাথকে সেদিন উপহার দেন। এইরকমই ছিল তাদের বন্ধুত্বের মিস্টি স্রোত। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলছেন তিনি ঠাকুরবাড়ির অন্দরে আঁধারে থেকে যেতেন যদি না জগদীশ চন্দ্রের মত এরকম উজ্জ্বল মানুষ তাকে বন্ধুত্ব দিতেন। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের বন্ধু হওয়া তো সোজা ব্যাপার নয়। রবীন্দ্রনাথ স্বীকার  করেছেন যে ঠাকুরবাড়ির বাইরে  জগদীশচন্দ্র বসুই তার প্রথম বন্ধু। তিনি বলছেন আমার নি:সঙ্গ  জীবনের কোণ থেকে তিনি আমাকে টেনে বের করেছিলেন যেমন করে শরতের শিশির স্নিগ্ধ সূর্যোদয়ের মহিমা চিরদিন আমাকে  ঘর থেকে ছুটিয়ে বাইরে এনেছে।

পদ্মার চরে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন জগদীশচন্দ্র। ইউরোপের এত সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখা সত্বেও তার মনে হতো পদ্মার চরের মত মনোরম স্বাস্থ্যকর জায়গা পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথেরও ছিল একই মত।
 দুজনেই পদ্মার চরে  ঘুরে বেড়াতেন,প্রকৃতির  সৌন্দর্য পান করতেন। বিজ্ঞানীর প্রিয় খাবার ছিল কচ্ছপের ডিম। বন্ধু পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র দুজনে মিলে বালির চর থেকে বালিতে ঢাকা কচ্ছপের ডিম খুঁজে নিয়ে আসতেন। হৈ হৈ করে সেসব রান্না হতো।এমন করেই  তিনি পারিবারিক বন্ধুও হয়ে গেছিলেন। এমনই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল যে রথীন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে জগদীশচন্দ্রের মতো বিজ্ঞানী হবেন।
রবীন্দ্রনাথ মনেপ্রাণে চাইতেন জগদীশচন্দ্র বসু ইংল্যান্ডেই থেকে যান। সেই সময়ে ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীরাও চেয়েছিল জগদীশচন্দ্র ইংল্যান্ডে থেকে গেলে তার গবেষণার কাজে সুবিধা হবে। রবীন্দ্রনাথ ও সেটাই চাইতেন। কিন্তু তারপরেও তিনি  আশা করতেন, বিজ্ঞানী এই পরাধীন ভারতে এসে বিজ্ঞানমনস্কতা জাগিয়ে তুলবেন যুবসমাজের মধ্যে। একটি চিঠিতে তিনি বন্ধুকে লিখছেন------ ভারতবর্ষের উন্নতির অশ্বমেধের  ঘোড়া তোমার হাতেই আছে ,তুমি ফিরে এলেই  আমাদের যজ্ঞ সমাধা হবে। জগদীশ চন্দ্রের গভীর জ্ঞানের উপর রবীন্দ্রনাথের প্রচন্ড আস্থা ছিল। শুধু উদ্ভিদবিদ্যা রসায়নবিদ্যা বা পদার্থবিদ্যা নয় মনোবিদ্যার চর্চা করতেও রবীন্দ্রনাথ তার বন্ধুকে অনুরোধ করতেন। তার বিশ্বাস ছিল মনোবিদ্যার চর্চায় জগদীশচন্দ্র নতুন দিশা দেখতে পারবেন।
শিলাইদহে তাদের সুন্দর দিনগুলো কাটতো। দিনের বেলা কবি ও বিজ্ঞানীর গল্পগুজব ও নানা বিষয়ে আলোচনায় কেটে যেত। রাতের দিকে জগদীশচন্দ্র বন্ধুকে অনুরোধ করতেন গান শোনাতে। কয়েকটি গান ছিল তার বিশেষ প্রিয়।  "এসো এসো ফিরে এসো বঁধূ হে ফিরে এসো"--এই গানটি বন্ধুর মনোরঞ্জনের জন্য রবীন্দ্রনাথ যে কতবার গেয়েছেন!
 আসলে জগদীশচন্দ্রের কোন অনুরোধই রবীন্দ্রনাথ ফেলতে  পারতেন না । একবার নিবেদিতার একটি গ্রন্থ The Web of Indian Life  এর মুখবন্ধ লেখার জন্য রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন । প্রথমে অরাজি হলেও শেষে বন্ধুর অনুরোধ তিনি রক্ষা করেন। বস্তুত: নিবেদিতা  আর রবীন্দ্রনাথের  মধ্যে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল জগদীশচন্দ্রের মাধ্যমেই।

🍂

ইংল্যান্ডে বিজ্ঞানী মহলে জগদীশচন্দ্রের বিপুল সাফল্যের ভুবনজয়ী খ্যাতিতে কবি আনন্দে আত্মহারা। বিজ্ঞানী কে কবি লিখলেন ------- বন্ধু ধন্যোহং,  কৃতকৃত্যোহং--  বন্ধু আমার পূজা গ্রহণ করো ,তোমার জয় হোক, তোমাতে আমাদের দেশ জয়ী হোক, নব্য ভারতের প্রথম ঋষি রূপে জ্ঞানের আলোক শিখায় নতুন হোমাগ্নি প্রজ্জ্বলিত কর। বন্ধুর সাফল্যে বন্ধুর এ উচ্ছ্বাস আমাদেরও অনুকরণীয়।
কবি ও বিজ্ঞানীর এই বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত ১৮৯৭ সালের এক বসন্তে। জগদীশচন্দ্র ইউরোপ সফর শেষে কলকাতায় ফিরেছেন । রবীন্দ্রনাথ দেখা করতে গেলেন তার বাড়িতে। বিজ্ঞানী বাড়িতে ছিলেন না টেবিলে ম্যাগনোলিয়া  ফুল রেখে আসেন কবি। পরে
তাঁদের আবার সাক্ষাৎ হয়। সেই ফুল দুজনের বন্ধুত্বের সুবাস ছড়িয়েছে আজীবন। জগদীশ চন্দ্র তার নিজের  ভাগনা অরবিন্দমোহন বসু কে পাঠান বন্ধুর শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। কবি কন্যা দের সঙ্গেও জগদীশ চন্দ্রের ছিল মধুর সখ্যতা। কবির প্রথম কন্যা বেলা কে মনে রেখে কবি লিখেছিলেন কাবুলিওয়ালার মিনি চরিত্রটি। জগদীশ বসু নিজেকে মনে করতেন কাবুলিওয়ালা। মিনি আর কাবুলিওয়ালার সখ্যতার একটি সুন্দর ছবি ধরা পড়ে ছোট্ট  বেলা আর মধ্যবয়সী বিজ্ঞানীর মধ্যে। শুধু বিজ্ঞানী নন, বিজ্ঞানী পত্নী অবলা বসুর সঙ্গেও ছিল মধুর সখ্যতা। কবি বিজ্ঞানী জায়াকে ডাকতেন" আর্যা" বলে.। কবি পত্নী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গেও বিজ্ঞানী দম্পতির ছিল হাস্যমধুর সম্পর্ক। অজস্র  চিঠিতে  তাঁদের মতবিনিময় স্বাস্থ্য সম্পর্কিত উদ্বেগ ধরা পড়েছে।
 তবে শুধু সুখের দিনেই  নয় এ বন্ধুত্ব গভীর ছিল তাদের দুঃখের দিনেও । জগদীশচন্দ্র বসু এবং অবলা বসু ছিলেন নিঃসন্তান। অবলা বসুর প্রথম  সন্তানটি জন্মের কিছুকাল পরেই মারা যায় এবং সেই দুঃসহ দিনগুলোয় বিজ্ঞানী ও তাঁর স্ত্রীর পাশে ছিলেন বন্ধু রবীন্দ্রনাথ । আবার রবীন্দ্রনাথের জীবনে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনার নিদারুণ সময় গুলোয় পাশে থেকেছেন জগদীশচন্দ্র বসু এবং অবলা বসু। শমীর মৃত্যু, বেলার মৃত্যু,রেনুকার মৃত্যু বা কবির  স্ত্রীর মৃত্যু -বিদীর্ণ করে দেওয়া এই সময়গুলোতে বন্ধু ও বন্ধু জায়া রবীন্দ্রনাথের পাশে থেকেছেন, বন্ধুত্বের  চামর দুলিয়ে স্নিগ্ধতা ছড়িয়েছেন কবির  তপ্ত হৃদয়ে।।।

Post a Comment

0 Comments