জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী /সপ্তদশ পর্ব

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
সপ্তদশ পর্ব

যাই হোক, দিন তো আর থেমে থাকেনা, বয়েই যায় ভালো বা মন্দে। জ্যাঠাইমা-জ্যাঠামশাই বুড়ো হয়ে পড়েন, বড়োদাদা পড়াশোনা শেষে কলকাতার খিদিরপুর ডক অফিসে ভালো কাজ পায়, সংসারের আর্থিক অবস্থা ফেরে। বৌদিদিও ক্রমে সংসারের দায়িত্ব নিতে শুরু করে।
মেজদাদা, ছোটদাদারও বিবাহ হয়; মেজবৌদিদি গ্রামেরই মেয়ে, বোকাসোকা,ভালোমানুষ।
ছোটবৌদিদি একটু দূরের গ্রামের, তার বাবা সেকালের পুলিশ;নুনের দারোগা:তাঁর নিজস্ব একটি ঘোড়াও ছিল;সময়ে সময়ে সেই ঘোড়া চেপেই মেয়েকে দেখতে আসতেন। মেয়েটি ছিল বাবা-মার একমাত্র সন্তান। তাই হয়তো খানিক অহঙ্কারী, আদুরেও। বয়সে ছোট বলে তাকে অবশ্য বিরজা বৌদিদি না বলে, ছোটবৌ বলেই ডাকতেন। 
বিয়ে হওয়ার পর থেকে প্রায়ই সে কলকাতাতে থাকতো, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বড়োবৌদিদি কখনও যা করেননি।
ছোটদাদা ততদিনে কলকাতার পোর্ট ট্রাস্টে একখানি চাকরি জোগাড় করে ফেলেছে। 
 চারটি ভাইপো, আটটি ভাইঝি পরপর এসেছে সংসারে, তাদের মায়েরা সংসার-কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে;আদর- আবদারের আশ্রয় পিসিমা। পিসিও সাধ্যমতো সে দায় সামলায়, ভরসা হয়ে ওঠে বাড়ির সবার। 
ইতিমধ্যে খবর আসে শ্বশুরবাড়ির তরফে, শ্বশুরমশাই নিরুদ্দেশ হওয়ার বারো বছর অতিবাহিত হওয়ায় কুল পুরোহিত তাঁর শ্রাদ্ধাদি আয়োজন করার অনুমতি দিয়েছেন। তাঁর পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য হিসেবে বধুমাতা যেন উপস্থিত থাকেন অবশ্যই। 
ততদিনে এগারো বছরের বিরজা তেইশের যুবতী। শারীরিক বিকাশের চাইতেও মনের প্রজ্ঞা বেড়েছে বেশি। খবর পাওয়া মাত্রই কেমন যেন কু ডাকলো মনে। বড় দাদাকে ডেকে এক সন্ধ্যায় বললে, 
-’দাদা গো! এবার সময় করে আমাকে শউরবাড়ি নিয়ে যাবে তুমি?’
দাদার চোখে ঘনায় ছায়া….বড্ডো ভালোবাসেন যে বোনটিকে, 
-’যেতে চাস সত্যিই!’
-’হ্যাঁ গো, ডেকেছেন যখন,একবার যাই।’
-’কিন্ত কেন?সেখানে গেলে মনখারাপই সার। তাছাড়া শুনেছি… ‘
-’তাই জন্যই তো বেশি করে যেতে চাইছি বড়দাদা। আর সেজন্যই জ্যাঠামশাই নয়, তুমি চলো সঙ্গে… ‘
খানিক তাকিয়ে রইলেন দাদা, বোনের দিকে। তারপরে সিদ্ধান্ত নিলেন, যাবেন, তিনিই নিয়ে যাবেন তাকে। 
এবং গেলেনও তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ে, যোগদানও করলেনকরলেন অনুষ্ঠানে। 
সন্ধ্যায় ফিরে আসার উপক্রম হতেই খুড়শ্বশুর বললেন দাদাকে, 
-’আমি ভেবেছিলাম বেয়াইমশাই নিজেই আসবেন। তা এলেন না যখন, তখন তোমাকেই বলি বাবা জীবন, দাদার পক্ষের সম্পত্তিতে না-দাবীটুকু লিখে বোনকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার ঘরে। আমরাও দায়মুক্ত হই’

 পৌঁছনো ইস্তক কুটুম বাড়িতে অভ্যর্থনা তো দূর অস্ত, বোনকে বিভিন্ন কটু কথায় যেভাবে উত্যক্ত করা হচ্ছিল, তা পছন্দ হয়নি বড়ো দাদার;তবু এতো খানিক হয়তো তিনিও আশা করেননি… খানিক চুপ থেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 
-’মানে?‘
-’মানে আবার কি? আমরা আর কোন ঝামেলায় থাকতে চাইছি না।‘
পাশ থেকে বলেছিলেন জামাই ঠাকুর, ননদিনী কাত্যায়নীর স্বামী। 

🍂

এসব শুনে চিরকালের ভালোমানুষ দাদার কি যে হলো, কে জানে, অদ্ভুত বলিষ্ঠ কন্ঠে বলে উঠেছিলেন, 
-’আপনারা চাইলেই তো আর সবকিছু আপনাদের মতো হবেনা। দেশে আইন-আদালত আছে, আমার বোনের প্রাপ্য সেখানেই ঠিক হবে।’
বলেই আর কোন কথা না বলে বোনের হাত ধরে বাড়ির পথ ধরেছিলেন। মনে আছে, সারা রাস্তা দুজনের কেউ কোন কথা বলেননি, অন্ধকার রাতে গরুর গাড়ির চাকার শব্দ বড়ো নিঃসঙ্গ লাগছিল। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে, বৌদিদিকে ডেকে দাদা বলেছিলেন, 
-’সারাদিন কিছু খায়নি, ওকে ভালো করে পেট ভরে ভাত খাওয়াও, আমাকেও ভাত দাও।’
 
তারপরে কতো ঝগড়া, কতো বিবাদ। মৌখিক, কাগুজে,আদালতে, মোকদ্দমায়। অবশেষে বিরজার স্বামীর সম্পত্তি ফিরে পাওয়া… সে এক তিক্ততর অধ্যায়। 
যদিও সে বিপুল সম্পত্তির কণামাত্রও কখনো বিরজা ব্যক্তিগত অথবা পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যবহার করেননি, তবু বোঝেন, অর্থ আত্মবিশ্বাসী করেছিল তাঁকে। 
জন্মমুহুর্তেই মাতৃহীনা, বাবা থেকেও নেই; খুব ভালো ঘর-বর পেয়েও সব হারিয়ে পিতৃগৃহে ফিরে আসা, অনতিশৈশবেই; নারীত্ব বা প্রত্যক্ষ মাতৃত্বের আস্বাদ অধরা, জীবনভ'র … তারমধ্যেও বেঁচেছেন আপন শর্তে, সৎসাহসে। ঘুরে বেড়িয়েছেন প্রায় সারা ভারত, একে ওকে টাকা ধার দিয়েছেন, প্রয়োজনে সুদের ব্যবসা করেছেন, হাঁস ফেলেছেন, সংসার করেছেন…  এবং হ্যাঁ, বই পড়েছেন। 
 জীবনের শেষবেলায় এসে অর্ধ-চেতনায় বৃদ্ধা ভাবলেন, জীবন খানা তাঁর সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি… (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments