জ্বলদর্চি

নীলষষ্ঠীর নীলব্রত /প্রসূন কাঞ্জিলাল

নীলষষ্ঠীর নীলব্রত

প্রসূন কাঞ্জিলাল

"মা -কে ডেকেই বললে সেদিন সাত বছরের বিলে
সত্যি বল, কোথা থেকে মা আমায় এনেছিলে?
মুচকি হেসেই মা বল্লেন, চড়ক-পুজোর দিনে 
নিউমার্কেট থেকেই তোকে এনেছিলাম কিনে!
বল্লে বিলে,চড়ক পুজোয়? ঠিক ধরেছি আমি, 
বুদ্ধি আমার আছে , যতই করি মা বাঁদরামি !
ছি-ছি, এতই কৃপণ তুমি , চৈত্রমাসের সেলে
সস্তা দামে রিডাক্শনেই আনলে কিনে ছেলে ?
তাই মা আমার আঙুলগুলো এমন ছোট -বড়, 
হাফ-দামেতে কিনলে জিনিস হবেই এমনতর!"
 .............ভবানীপ্রসাদ মজুমদার ।

আসলে নীলপুজো যে তিথিতেই হোক না কেন ওটাকে নীলষষ্ঠী বলে। আজ নীল পূজা ও নীলের উপবাস।

নীল পুজোর উপকরণ:----

গঙ্গামাটি বা শুদ্ধ মাটি, বেলপাতা, গঙ্গাজল, দুধ, দই, ঘি, মধু, কলা, বেল, বেলের কাটা ও শিবের পছন্দের ফুল, যেমন ধুতুরা, আকন্দ, অপরাজিতা।

নীল ব্রত পালনের নিয়ম:----

নীলষষ্ঠীর সারাদিন উপবাস করেন মায়েরা। সন্ধ্যাবেলা শিবের জলাভিষেকের রীতি প্রচলিত আছে। এর পর বেলপাতা, ফুল ও ফল অর্পণ করতে হয়। আকন্দ ও অপরাজিতার মালা পরিয়ে সন্তানের মঙ্গল কামনার জন্য মোমবাতি জ্বালতে হয়। পুজোর পর উপবাস ভঙ্গ করা উচিত। 

নীলষষ্ঠীর সঙ্গে প্রচলিত লোককথা:----

মহাদেবের অপর নাম নীলকণ্ঠ। অনেকে মনে করেন শিবের সঙ্গে নীলচণ্ডিকা বা নীলাবতী পরমেশ্বরীর বিবাহ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় এদিন। প্রচলিত রয়েছে, দক্ষযজ্ঞে দেহত্যাগ করেন সতী। এর পর পুনরায় নীলধ্বজ রাজার বিল্ববনে আবির্ভূত হন তিনি। মনে করা হয় রাজা তাঁকে কন্যার মতো বড় করে ফের মহাদেবের সঙ্গে বিয়ে দেন নীলাবতীর। বাসরঘরে নীলাবতী শিবকে মোহিত করেন। পরে মক্ষিপারূপ ধারণ ফুলের সঙ্গে জলে নিক্ষিপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুশোকে রাজা-রাণীও প্রাণ ত্যাগ করেন। অনেকের ধারণা শিব ও নীলাবতীর বিয়ে উপলক্ষে নীলপুজো। 

 আরো একটি প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, বহু কাল আগে এক ব্রাহ্মণ পরিবার বাস করত। কিন্তু তাঁদের কোনও সন্তান ছিল না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই মারা যেত অথবা খুব বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারত না সেই সন্তান।

সন্তান শোকে আহত ওই ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী তীর্থে বেড়িয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। নানান তীর্থ স্থান ঘুরতে ঘুরতে একদিন সরযূ নদীর তীরে এসে পৌঁছন তাঁরা। ব্রাহ্মণ সরযূ নদীতে ডুবে জীবন শেষ করার কথা বলেন ব্রাহ্মণীকে। বলেন,  ‘এই জলে ডুবেই আমাদের জীবন শেষ করি চলো। বংশ রক্ষার জন্য যখন একটি সন্তানও বেঁচে নেই, তখন আমরা বেঁচে থেকে কী করব? ’ 

ঠিক এমন সময় এক বৃদ্ধার রূপ ধরে সেখানে আবির্ভূত হন মা ষষ্ঠী। ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণীর উদ্দেশে বলেন, ‘বাছারা, তোমরা আর বেশি দূরে যেও না, না-হলে ডুবে মরবে।’ সেই বৃদ্ধাকে তখন নিজেদের সব দুঃখের কথা খুলে বলেন তাঁরা। সব শুনে ষষ্ঠী বলেন, ‘দোষ তো তোমাদেরই। সদ্যজাতের কান্না শুনে অহঙ্কারে মত্ত হয়ে তোমরা সব সময় আমাকে বলতে, বাবা! আপদ গেলেই বাঁচি। কিন্তু কখনও বলেছ কি, মা ষষ্ঠীর দাস বেঁচে থাক? সেই পাপেরই ফল ভোগ করছ তোমরা।’ ব্রাহ্মণী তখন সেই বৃদ্ধার পা ধরে বললেন, ‘কে তুমি, বল মা।’ বৃদ্ধা বললেন, ‘আমিই মা ষষ্ঠী। শোন, এই চৈত্র মাসে সন্ন্যাস করবি এবং সেই সঙ্গে শিবপুজো। সংক্রান্তির আগের দিন উপবাস করে নীলাবতীর পুজো করে নীলকন্ঠ শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে দিবি। আর তারপর আমাকে প্রণাম করে জল খাবি। একে বলে নীল ষষ্ঠী।’ 
এর পরই সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যান মা ষষ্ঠী।

নীলপূজা বা নীলষষ্ঠী হল বাংলার হিন্দুসমাজের এক লৌকিক উৎসব, যা মূলত শিব-দুর্গার বিবাহ বা শিবের বিয়ে নামে পরিচিত। সাধারণত চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক উৎসবের আগের দিন নীলপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। নীলসন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙেরা পূজার সময়ে নীলকে সুসজ্জিত করে গীতিবাদ্য সহযোগে বাড়ি বাড়ি ঘোরান এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। নীলের গানকে বলা হয় অষ্টক গান। ঐদিন সন্ধ্যাবেলায় সন্তানবতী হিন্দু রমণীরা সন্তানের কল্যাণার্থে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবপূজা করে সারাদিনের উপবাস ভঙ্গ করেন। নীলপূজা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, হাওড়া; বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, বরিশাল এবং ত্রিপুরায় বাঙালি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। নদিয়া জেলার নবদ্বীপের গাজন উৎসবের একটি অংশ হিসাবে বাসন্তী পুজোর দশমীর ভোরে শিবের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

নিম বা বেল কাঠ থেকে নীলের মূর্তি তৈরি হয়। চৈত্রসংক্রান্তির বেশ আগেই নীলকে মণ্ডপ থেকে নীচে নামানো হয়। নীলপূজার আগের দিন অধিবাস; অধিক রাত্রে হয় হাজরা পূজা অর্থাৎ বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা। হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে পোড়া শোল মাছের ভোগ দেওয়া হয়। পরদিন নীলপূজার সময় নীলকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন লালশালু কাপড় পরিয়ে অন্ততপক্ষে সাতটি বাড়িতে নীলকে ঘোরানো হয়।

🍂

নীলসন্ন্যাসীরা একইরকম লাল কাপড় পরে পাগড়ি মাথায়, গলায় রুদ্রাক্ষমালা ও হাতে ত্রিশূল নিয়ে নীলকে সঙ্গে করে এই মিছিল করেন। এদের দলপতিকে বলা হয় বালা। সাথে থাকে ঢাক-ঢোল, বাঁশী বাজনদারের দল এবং কাল্পনিক শিব-দুর্গার সাজে সঙেরা। গৃহস্থ মহিলারা উঠানে আল্পনা দিয়ে নীলকে আহ্বান করে বরাসনে বসিয়ে তার মাথায় তেলসিঁদুর পরিয়ে দেন। এরপর নীলের গান শুরু হয়:

"শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে
      কৈলাসেতে হবে অধিবাস।
(ও) তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা
       বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।"

"(ও) নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে।
আর একদিনেতে শূলপাণি, নারদকে বলেন বাণী
শুনো নারদ শুনো আমার সাধ,
আমি দুই পাশে দুই বালিশ দিয়ে, মধ্যিখানে থাকি শুয়ে
উশিপুসি করে কাটাই রাত।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে, দেখে এসেছি মেয়ে
শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন,
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
চলিলেন নারদ মুনি, চলিলেন নারদ ধনি
উপনীত গিরি পুরে যেয়ে।
কইলেন মেনকা রানী, আইলেন নারদ মুনি
দেখা পেয়ে এল মুনির ঠাঁই।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজা
জামাই তোমার হবে দিগম্বর।।"

বিয়ের ঘটক ভাগিনেয় নারদ মুনির কাছে শিব আর্তি জানান,

"ভাইগনা যদি উপকারী হও।
তবে বিয়া দিয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।।"

বিয়ের পর নীলের গানে থাকে সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরা প্রভৃতি এবং ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনি। গানের প্রথম অংশ দলপতি বালারা এবং পরবর্তী অংশ অন্য নীলসন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন। গানের শেষে গৃহস্থরা সন্ন্যাসীদের চাল-পয়সা, ফল প্রভৃতি ভিক্ষাস্বরূপ দেয়। ঐদিন সন্তানবতী হিন্দু নারীরা সারাদিন উপবাস রেখে সন্তানের আয়ু বৃদ্ধির কামনায় ‘নীল ষষ্ঠী’র ব্রত করে। নীলপূজার পর সন্ধ্যাবেলায় শিবমন্দিরে বাতি দিয়ে জলগ্রহণ করেন।

 এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ও প্রচলিত আরেকটি রীতি হলো, চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিবসে পালিত হয়। এ পূজার বিশেষ অঙ্গের নামই নীলপূজা।
চড়কপূজার আগের দিন নীলচণ্ডিকার পূজা হয় (যা মূলত নীলপূজা নামে পরিচিত), এদিন কয়েকজনের একটি দল সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দু'জন সখী। সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে দেল বা নীল পাগলের দল'ও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে। বিনিময়ে দান হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায় তা দিয়ে হয় পূজা। এদিন রাতে 'হাজরা পূজা' হয় এবং শিবের উদ্দেশ্যে খিচুড়ি ও শোলমাছ নিবেদিত হয়। মাঝরাতে শিবের আরাধনার সময়ে দু'একজন সন্ন্যাসী প্রবলবেগে মাথা ঘুরিয়ে মন্ত্র বলতে বলতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন; এই অবস্থাকে দেবতার 'ভর' বলা হয়। এসময় তারা দর্শকমণ্ডলীর প্রশ্নের যা যা উত্তর দেয় তা অভ্রান্ত বলে সাধারণ বিশ্বাস করে।

Post a Comment

1 Comments