জ্বলদর্চি

চার সখা সমাচার/ রবীন্দ্র বন্ধুত্ব---শেষ পর্ব/লোকেন পালিত/তনুশ্রী ভট্টাচার্য

চার সখা সমাচার  
রবীন্দ্র বন্ধুত্ব-শেষ পর্ব

লোকেন পালিত

তনুশ্রী ভট্টাচার্য 

শিলাইদহে জগদীশচন্দ্র বসু, প্রিয়নাথ সেনের 
 মতো লোকেন  পালিতও ছিলেন কবির  সংসারের নিয়মিত অতিথি। বিস্ময়কর ও বিরল এই চার বন্ধুর জীবন শুধু ব্যাপ্তিতে নয় বৈচিত্রেও অনন্যোপম। বৃত্তের কেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথ, পরিধিতে এই তিনজন। একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছেন সেই সব বছরগুলোতে। এদের বন্ধুত্ব রবীন্দ্র জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
লোকেন পালিতের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দরকার। কারণ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন মৃত্যুদিন পালনে আমরা যতটা আগ্রহী তাঁর দীর্ঘজীবনের বিভিন্ন ঘটনা মানুষ সম্পর্ক বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ বিদ্বেষ বিষাদ আনন্দ তুলনায় কম প্রাধান্য পায় কিন্তু সম্পূর্ণ মানুষকে, কবিকে জানতে গেলে সেটারও দরকার আছে।
লোকেন পালিত স্যার তারকনাথ পালিতের ছেলে। কে এই তারকনাথ পালিত? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি ক্যাম্পাস রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজ যাঁর অর্থানুকুল্যে(১৫ লক্ষ টাকাও সমস্ত সম্পত্তি দান) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় (সত্যি কি আমরা স্মরণ করি তাঁকে) তিনি ছিলেন বিলাতের ব্যারিস্টার। পুত্র লোকেন পালিত ছিলেন আই সি এস এবং ম্যাজিস্ট্রেট পদে চাকরি করতেন।
 লোকেন পালিত রবীন্দ্রনাথের থেকে তিন বছরের ছোট এবং মজার কথা  পিতা পুত্র দুজনেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। দুজনেই রবীন্দ্রনাথের ঘোর আর্থিক দুর্দিনে নিবিড়ভাবে পাশে থেকেছেন। রবীন্দ্রনাথকে দেনার দায় থেকে বারবার মুক্ত করেছেন এই পিতা এবং পুত্র । যদিও রবীন্দ্রনাথ সমস্ত দেনা শোধ করেছেন প্রিয়নাথ সেনের তত্ত্বাবধানে, সাংসারিক বুদ্ধিতে--- যে বুদ্ধিতে  রবীন্দ্রনাথ বারবার পিছিয়ে পড়তেন । মুশকিল আসান হতেন প্রিয় নাথ সেন। ১৮৯০ সালে দ্বিতীয়বার বিলাত যখন যান রবীন্দ্রনাথ লোকেন পালিতের সঙ্গেই গেছিলেন। লন্ডনে তারকনাথ পালিতের বাড়িতে বসে অনেক লেখাই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। ক্ষণিকা  কাব্যগ্রন্থটি এবং য়ূরোপের ডাইরী  লোকেন  পালিতকে উৎসর্গ করেছেন কবি। এই ডায়েরির বিস্তীর্ণ পরিসর জুড়ে লোকেনের আনাগোনা। সমুদ্রপথে জাহাজে দুই বন্ধুর আড্ডা কেমন জমে উঠতো, কি সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো তার একটা আভাস পাওয়া যায় এই কথাগুলোতে--" আমরা দুই যুবক গতকল্য রাত্রিদুটো পর্যন্ত কেবল ষট্ চক্র ভেদ চিত্তবৃত্তি নিরোধ ত্রিগুণাত্মিকা শক্তি সম্বন্ধে আলোচনা না করে সৌন্দর্য প্রেম এবং নারী জাতির পরম কমনীয়তা সম্বন্ধে পরস্পরের মতামত ব্যক্ত করেছিলুম"। এইই তো কমনীয় বন্ধুত্বের রমনীয় ছবি।

 লোকেনের বদলির চাকরি। যখন যেখানে যেতেন কবিকে ও বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যেতে হোত  কারণ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সংসর্গ  না হলে তাঁর চলেনা । তাঁদের কাব্য আলোচনা কতদিন কবির  ভাষায় "সন্ধ্যা তারার ক্ষণ থেকে শুরু হয়ে শুকতারার ক্ষণ পর্যন্ত গড়িয়েছে "। এই বন্ধুত্ব রবীন্দ্র জীবনীতে একটি দামি অধ্যায়। আর জীবন স্মৃতিতে এই মহার্ঘ বন্ধুত্ব কে স্বীকৃতী দিয়ে একটি অধ্যায়  রেখেছেন কবি--লোকেন পালিত। আবার লোকেন যখন যেখানে বেড়াতে যেতেন কবিকে তাঁর সঙ্গী হতেই হতো। কবি বলছেন "সাহিত্যে লোকেনের প্রবল আনন্দ আমার রচনার বেগকে পালের হাওয়ার মতো অগ্রসর করিয়াছে'। কবি স্বীকার করেছেন লোকেন একনিষ্ঠ শ্রোতা। রবীন্দ্রনাথ পড়ে যেতেন, তাঁর সৃষ্টি মন দিয়ে শুনতেন লোকেন। ইংরেজী ও বাংলায়  বন্ধুর অসাধারণ ব্যুৎপত্তির প্রতি কবির ছিল শ্রদ্ধা। লোকেন রবীন্দ্রনাথের নিষ্ফল কামনা ও তারকার মৃত্যু কবিতা দুটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
লোকেন ছিলেন বেশ তার্কিক । প্রায়ই এই দুই বন্ধুর মধ্যে এক একটা জোরালো তর্কের পরিবেশ তৈরি হতো। মতান্তর  থেকে মনান্তর। আবার দুজনেই দুজনের মন আর মতটা খুব ভালো করে জানতেন তাই এই তর্ক সুখ  সঙ্গ সুখে পরিণত হতে দেরি হতো না।

🍂

এই চারজনের মধ্যে যে চিঠি গুলি লেখালেখি হত সেগুলি পরপর মিলিয়ে পড়লে এই চারজনের বন্ধুত্বের গভীরতা প্রসারতা দুটোই বোঝা যায় আর আমাদের কবিকে আরো ভালো করে চিনে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। লোকেন পালিত অনেকদিন পর্যন্ত বিয়ে করবেন না বলতেন । বিয়ে নিয়ে এদের মধ্যে হাস্য আলোচনা  হতো । কিন্তু হঠাৎ  লন্ডনে মেবেল দত্তকে লোকেনের  বিয়ে করার খবরটি জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে জানান । সে বেশ পরিহাস মুখর চিঠি। অন্য এক চিঠিতে শিলাইদহ থেকে  রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে জগদীশচন্দ্রকে লিখছেন-- লোকেন যাত্রা করে বেরিয়ে পড়েছে। এতদিন সে তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করেছে তার প্রতি আমার ঈর্ষা হচ্ছে আমার ভারি ইচ্ছা করছে আমরা জন দুই তিনে মিলে তোমার ওখানে মাছের ঝোল খেয়ে আগুনের কাছে ঘরের কোণে ঘন্টা দুই দিনের জন্য জমিয়ে বসি।

তাম্রকূটঘনধূমবিলাসী----বলতেন রবীন্দ্রনাথ লোকেন পালিত কে তাঁর তীব্র সিগারেট প্রীতির জন্য। সরস প্রাণ খোলা আড্ডায় একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে চলতেন লোকেন । সেদিন শিলাইদহে আড্ডা প্রায় শেষ। গভীর রাত । শেষ মুহূর্তে লোকেন আরো একখানা সিগারেট ধরালেন। কিন্তু একটু পরেই আলোচনা শেষ হতে যে যার ঘরে শুতে গেলেন। হঠাৎই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঘর থেকে একটা ধোঁয়া গন্ধ পেলেন। কবি বুঝলেন কোথাও একটা আগুন লেগেছে, মনে পড়ল লোকেন শেষ সিগারেটটি না নিভিয়েই ঘরে শুতে গেছিল হয়তো সেখান থেকেই আগুন আর ধোঁয়ার গন্ধ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন লোকেন  শুয়ে আছে আর  তার মশারিতে আগুন লেগে গেছে রবীন্দ্রনাথ ঝাঁপিয়ে পড়েন আগুন নেভাতে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও দ্রুত তৎপরতায় কবি সেদিন বন্ধুর জীবন রক্ষা করেছেন।

১৯১৬ সালে লোকেন লোকান্তরিত হন । লোকেনের সঙ্গে কবির বন্ধুতার নিবিড়তার স্বাক্ষর রয়ে গেছে কত আবেগময় চিঠিতে, দিনপঞ্জির খাতায়, কবিতার পাতায়। 
অনেকদিন পর । তখন কবির  ৭৬ বছর বয়স। শান্তিনিকেতনে অন্নদাশঙ্কর রায় দেখা করতে গেছেন। কথা প্রসঙ্গে উঠলো এই ছড়াকারেরও কর্মক্ষেত্র ছিল রাজশাহী যেখানে লোকেন পালিত একসময় ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অন্নদাশঙ্করের কথা শুনতে শুনতে স্মৃতির পথ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন  স্মৃতিমেদুর সেই সব প্রসঙ্গে, সেইসব দিনগুলোয়------
         সকলি ফুরালো স্বপন প্রায় !
কোথা সে লুকালো কোথা সে হায়।।।

Few Relations In Earth Never Die-
বন্ধুত্ব তার মধ্যে একটি সম্পর্ক। আর তা যদি রবিকবির হয় তা আমাদের  ঋদ্ধ করে। নত করে। দীক্ষিত করে।

Post a Comment

0 Comments