জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে /একাদশ পর্ব /মলয় সরকার

ওয়াকুদানির  কালো ডিম

উদয়ের পথে
একাদশ পর্ব
মলয় সরকার

মাত্র ৫ কিমি রাস্তা ৫-৬ মিনিটের মধ্যেই আমরা আর এক রোপ ওয়ের পথে পেরিয়ে চলে এলাম তোগেন্দাই। এখানে সমস্ত যাত্রী এক জায়গায় জড়ো হচ্ছে। আর টিকিট কাটতে হচ্ছে নীচের লেকে জাহাজ চাপার জন্য। এখানে জানালা দিয়ে দেখলাম সুন্দর সুন্দর দুটি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে পুরানো দিনের পাইরেট শিপের মত , এর নামও দিয়েছে পাইরেট শিপ। অনেক মাস্তুল লাগানো, সোনালী রঙের, ডিজাইনটা দেখলেই এর প্রেমে পড়তে হয়। তার সঙ্গে এটি ভেসে যাচ্ছে ঘন নীল বিস্তৃত লেকের উপর দিয়ে , উপর থেকে দেখতে পাচ্ছি। দেখেই মনটা নেচে উঠল ছেলেবেলার মত- এমন সুন্দর একটা জাহাজে চাপব, ভাসব এই লেকের উপর দিয়ে– দারুণ উত্তেজনা। এত লোক রয়েছে, কিন্তু সবাই নিজের নিজের লাইনে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কোন ঠেলাঠেলি বা চেঁচামেচি নেই।সবাই দেখলাম, আমার মতই উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে নীচের নীল সবুজ লেকের দিকে।কখন সওয়ারী হবে ওই স্বপ্নযানের।
অসি লেকের নীল জলে ভেসে চলেছে পাইরেট শিপ

এক সময় অপেক্ষারও শেষ হয়।টিকিট কাটা হল। আমরা এগোলাম সেই সোনালী রঙের অতীত দিনের পাইরেট শিপের আদলে তৈরী স্বপ্নযানের দিকে। আর সবাইয়ের মতই গিয়ে উঠলাম নির্দিষ্ট জাহাজে। সেই সময়েই অন্য একটি জাহাজ আর একদল যাত্রী নিয়ে ফিরে এল।

আমাদের জাহাজ ছাড়ল।আমরা অবশ্যই ছাদে উঠে গেলাম, চারিদিক ভাল করে দেখে এই যাত্রাকে আরও উপভোগ্য করে নিতে।ছাদে সকলেই উঠেছে। সব থেকে বড় কথা,এখান থেকে দেখা যাচ্ছে দূর লেকের বিস্তৃত জলে রাজহংসীর মত ভেসে বেড়াচ্ছে নৌকো বা জাহাজ, পাশের ঘন সবুজ জঙ্গল,উঁচু পাহাড় আর তার সঙ্গে আদিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশ।সঙ্গে হাল্কা শীতের আমেজ অথচ ঝকঝকে রোদ।জাহাজের ছাদে রয়েছে পুরানো জাহাজের মতই একটি কামান। মনে হল ,সেই সত্যি পাইরেট জাহাজেরই যাত্রী আমরা, যেমনটি পুরানো ইংরাজী বইতে দেখি।
আমরা Togendai-Ko থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছালাম Hakone-machi-ko। সেখানে কিছু লোক নেমে গেল। আমরাও ভাবছিলাম , এখানেই নামব কি না।  পরে বুঝলাম, আমাদের গন্তব্য আরও এগিয়ে পরের স্টেশনে, যেটা এর যাত্রাপথের শেষ। 
এখানে এই যাত্রাপথের একটা জায়গা থেকে একটা সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়, তা হল, পিছনে ঝকঝকে মাউন্ট ফুজি ও জলে ডোবা হাকোনে জিঞ্জা শ্রাইনের টোরি গেট।
পাইরেট শিপ

আমরা নামলাম Moto Hakone Ko তে।জাহাজ এখানে খালি হয়ে গেল।এত তাড়াতাড়ি স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেল বলে খারাপ লাগছিল।অবশ্য দেখেছি, ভাল স্বপ্ন যেন কেমন স্বল্পস্থায়ীই হয়।

 ইতিমধ্যে বেলাও শেষ হয়ে এসেছে অনেক খানি।  জাহাজঘাটা থেকে বেরিয়ে সামনেই রাস্তার উপর দেখি রয়েছে বিশাল এক টোরি গেট। এরকম গেট রাস্তার মাঝে কোথাও থাকলেই বুঝতে হবে এখানে রয়েছে শিন্টো ধর্মের কোনো মন্দির। রাস্তা ঘাটে এমনিতে কোনো ভিড় নেই। 

🍂

একেবারে ঝকঝকে ছোটো গ্রাম্য ঢঙের কিন্তু ছোট্ট  পাহাড়ী শহরের মত। দোকানেরা অনেকেই বন্ধ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, যদিও আকাশে তখনও শেষ বেলা দেখা যাচ্ছে। আমরা ফিরে তাকালাম, লেকের দিকে পাহাড়ের পিছনে শেষ সূর্য অস্ত যাওয়ার পথে। এই রাস্তায় বেশ কিছুটা গেলে তবে আছে সেই শ্রাইন বা মন্দির। আমরা বেশ কিছুটা হেঁটেও, তার পরও দেখি জিপিএসে, আরও বেশ কিছুটা দূর যেতে হবে। এখানে কোন রিক্সা গোছের কিছুও চলতে দেখলাম না।পুরোটাই হেঁটে যেতে হবে। হয়ত সময়ও কুলোবে না।  তাই আর যাওয়ার ইচ্ছা হল না। বরং দূরে লেকের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রাইনের আরও এক জোড়া টোরি গেটের সৌন্দর্য্যের দিকে তাকালাম। জলের মাঝে এটিকে বেশ ভালই লাগছিল দেখতে। নীলের মাঝে গাঢ় কমলা রঙের ঊজ্বল টোরি গেট দুটি শ্রাইনের অবস্থান সূচিত করছে, যা এখান থেকে বেশ দূরে। 
 এখানে আর কিছু নেই। এটি আসলে একটি দ্বীপ। শান্ত এই দ্বীপে মানুষ আসেন একটু নিরবিলিতে এখানতার নির্জনতা ও প্রকৃতিকে উপভোগ করতে।তবে এখানে এলে সত্যি মন যে হারিয়ে যাবেই তা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়।

এবার তো ফেরার পালা।ভাবলাম, এই লেকের ধারে বসে আগে, একটু পা ছাড়িয়ে নেওয়া যাক, তার সঙ্গে এই ঠাণ্ডায় এক কাপ করে গরম কফি আর বিস্কুট নিয়ে বসা যাক। আশে পাশে সুন্দর সাজানো লন, সামনে লেকে, ধারে বেঞ্চি পাতা রয়েছে আর রয়েছে চেরী গাছের সারি। তাতে ফুটে আছে অবিন্যস্ত ভাবে চেরী ফুলের দল।লেকের দিকে তাকিয়ে দেখি ফিরে যাচ্ছে দিনের শেষ তরণী। বড় সুন্দর সে ছবি, যেন চিত্রকরের তুলিতে আঁকা।এখানে প্রকৃতি যেন অপার সৌন্দর্য্য অবহেলায় ছড়িয়ে রেখেছেন রসপিপাসুর নিজের হাতে কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য।

 যাওয়ার সময় আর জাহাজে যাওয়া যাবে না।তখন জাহাজ ঘাটা সব ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে বাসের লাইনই ভরসা। যদিও বাসের সার্ভিস ভাল, কিন্তু কোন কারণে বাস না আসায় যাত্রীর লাইন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সাপের মত বহুদূর গিয়ে লেকের ধারে পৌঁছে গেছে।আমার মনে হল সাপ এবার লেকে ডুবতে যাচ্ছে। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শরীর ক্লান্ত, খিদেতে পেট কান্নাকাটি করছে। সঙ্গের খাবার শেষ। কাছাকাছি উপযুক্ত কোন দোকানও খোলা নেই।সঙ্গে ঠাণ্ডা হাওয়াও দিচ্ছে। লুকাবো তার জায়গাও নেই। এদিকে কখন বাস আসবে জানি না। সবাই উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে। অনেক পরে পরে এক আধটা বাস আসছে, তারা যে আমাদের লাইনের নয় বুঝছি। অন্য যাত্রীদের তুলে চলে যাচ্ছে। সেখানে বাসে ওঠার মুখে আবার একজন দাঁড়িয়ে আছেন, লাইন করে একজন একজন করে টিকিট দেখে তবে ছাড়ছেন। আমরা মনে মনে নিজেদের ভাগ্যকে দোষ দিয়ে ওদের ভাগ্যকে হিংসা করতে লাগলাম, আর মনে মনে বলতে লাগলাম, হেই বাবা বুদ্ধ, উদ্ধার কর আমাদের ।

অনেক পরে বাস এল আমাদের। উঠলাম গাদাগাদি করেই। সিট তো পেলাম না কেউই। আসলে তরুণ দলের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া এত ভিড়ে সে দাবীই বা করি কি করে। যাক, বাস ছাড়ল। ফিরলাম পাহাড়ী পাকদণ্ডী পথে ঘুরতে ঘুরতে। এই রাস্তায় তো যাই নি। ভাবছিলাম, দিনের বেলায় গেলে জমত ভাল।তবে আমাদের সামনে একটি বাচ্চা মেয়ে বসে ছিল সিটে। সে কিন্তু বুলবুলকে দেখেই বুঝল, ওর কষ্ট হচ্ছে, দাঁড়াতে। সে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বুলবুলকে বলল, আপনি বসুন , কষ্ট হচ্ছে। জাপানী মেয়েদের ব্যবহার এখানে অনেক জায়গায় এত সহমর্মী পেয়েছি ,ভোলার নয়। সবার কথা হয়ত বলতে পারব না, কিন্তু ওরা যে সাধারণভাবে ভীষণ পরোপকারী, মানবিক, এবং নরম মনের এটা না বললে অন্যায় হবে।

যাক, পৌঁছানো গেল একসময় হাকোনে তে। এবার ভাবলাম, খেয়েই একেবারে বাড়ি যাব।মেয়ে খুঁজতে লাগল হোটেল। সমস্যা হচ্ছে, কোন হোটেলে যাব, বুঝতে পারি না।বাইরে মেনু টাঙানো রয়েছে অনেকেরই। দেখে বুঝতে পারি না, সেখানে কি পাওয়া যাবে, গরু না শুয়োর, উট, সাপ না ব্যাং। গুগল বাবার শরণাপন্ন হতে হয়। সে অনেক সময় ঠিক ঠাক বলে না। তবে তারই সাহায্যে আন্দাজে কয়েকটা হোটেলে গেলাম, যেখানেই যাই বলে জায়গা নেই । অনেক দেরী হবে।
মোটো হাকোনে কো-র টোরি গেট ও রাস্তা

শেষে যখন পরিশ্রান্ত এবং বিরক্ত হয়ে ভাবছি ,কি করি, রাস্তা থেকে যাহোক কিছু কিনে খেয়ে রাত কাটাব, এমন সময় একটি ঘটনা ঘটল। একটি হোটেলে, জিজ্ঞাসা করায় আগে বলেছিল, জায়গা নেই হবে না। তার ওয়েট্রেস মেয়েটি আমাদের বোধ হয় মুখ দেখে কিছু বুঝে ছিল। আমরা তখন দূরে দাঁড়িয়ে জল্পনা কল্পনা করছি , কি করব, এমন সময় সেই মেয়েটি দেবদূতের মত বাইরে এসে বলল, আপনারা আসুন, আমরা জায়গা করে দিচ্ছি। আদর করে নিয়ে গিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা করে আপ্যায়ণ করতে আরম্ভ করল।
আমরা তখন মনে মনে কাকে ধন্যবাদ দেব বুঝলাম না, ( সেটা অবশ্য খিদের জ্বালায়) বুদ্ধ, না আমাদের ভগবান না মেয়েটিকে।

তবে বুঝলাম, বুদ্ধের সিদ্ধি লাভের আগের অবস্থাটা। যখন প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত, তখনই এসেছিলেন সুজাতা পায়েস নিয়ে। ভাবছিলাম, এই মেয়েটিই কি আমাদের সুজাতা?

চলুন এগোব সামনের দিকে- সঙ্গে থাকুন আগামী দিনেও-
ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments