জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ১০/স্বপন কুমার দে

 চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ১০

স্বপন কুমার দে

সম্পূরক আর রূপসা আজ বেশ হাসিখুশি।দুজনেই বেশ মিলিয়ে এক রঙের পোশাক পরে এসেছে। অফিসেও আজ একটা অন্য কারণে উদ্দীপনা ও কৌতূহল। নতুন অ্যাডিশনাল ম্যানেজারের পোষ্টে জয়েন করবেন নতুন অফিসার। সকলেই তাই খুব কৌতূহলী। নতুন অ্যাডিশনাল ম্যানেজার কেমন হবে? কড়া ধাতের না গরম, এইসব চাপা আলোচনাও চলছে।

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল দশটা। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, কোর্ট টাই যে অফিসারটি সোজা ম্যানেজারের রুমে ঢুকলেন,  তাকে দেখতে খুব স্মার্ট, হ্যান্ডসাম বলেই মনে হল।
সকলের মধ্যে একটা গুঞ্জন তৈরি হল।
একটু পরেই ম্যানেজার সাহেব আগন্তুক অপরিচিত ভদ্রলোকটিকে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। একটু ভূমিকা করেই বললেন, " লেডিজ্ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, আমাদের অফিসে অ্যাডিশনাল ম্যানেজার হিসাবে মিস্টার অসীম রায় এইমাত্র জয়েন করলেন। আমি আশা করি আমরা সকলেই তার সান্নিধ্য, কর্মপরিচালনা ও আন্তরিকতার সঙ্গে উপভোগ করবো।" তারপর অসীমবাবুর উদ্দেশ্যে বলেন, " অসীমবাবু প্লিজ..."
রূপসা হাঁ হয়ে গিয়েছিল নতুন অফিসারকে দেখে। মুখ থেকে অস্ফুটে একটা শব্দ বেরিয়ে এল, ' অসীম!"

অসীমবাবু সকলের উদ্দেশ্যে নমস্কার জানিয়ে শুরু করলেন, " এই ডিপার্টমেন্টে আমার প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। এই ক্ষুদ্র কর্মজীবনে আমি বহু মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি, পরামর্শ নিয়েছি, অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। সেই হিসেবে এই পরিবেশ নতুন হলেও আপনাদের সাহচর্যে ঠিকই সফল হবো। তবে এই পরিবেশ আপনাদের অনেকে আমার কাছে নতুন হলেও একজন আমার অনেক দিনের পুরানো। ইনি আমার খুব কাছের মানুষ, আমার পুরানো বান্ধবী রূপসা, রূপসা চক্রবর্তী। মাঝখানে অনেকগুলো বছর কোনও যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু ও আর আমি ছোটোবেলাকার বন্ধু ছিলাম, এখনও আছি।"
সকলে হাততালি দিল, একে একে হ্যান্ডশেক করল।

অসীমবাবু সংযোজন করলেন," আজ এখানে আমার প্রথম দিন। তাই আজ একসঙ্গেই সকলে টিফিন করবো।আমি সামান্য কিছু ব্যবস্থা করতে চাই। যদি কেউ দায়িত্ব নেন তো ভালো হয়।"
অফিসের পিয়ন জয়দেব দায়িত্ব নিল।

টিফিন টাইমে সবাই একসঙ্গে চিকেন বিরিয়ানি আর মাটন কষা বেশ মজা করে খেল। সেখানে অনেকে অনেক রকম প্রশ্নের জবাব দিলেন অসীমবাবু। রূপসা অসীমকে 'তুই' বলতে গিয়েও থমকে গেল। অফিসের সৌজন্যতা বজায় রাখতে গেলে বসকে কখনই 'তুই' বলা যায় না।তবে অফিস ছুটির শেষে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই বলল," তুই যে এখানে আসবি, জানা ছিল না তো।"
" তুইও যে এখানে চাকরি করিস, জানতাম না। তবে এবার থেকে তোকে সব জানাবো। আর ভুল হবে না। চল্ আমার গাড়িতে।তোকে তোর বাড়িতে নামিয়ে দেবো।"
" আরে না না। আমি নিজেই যেতে পারবো। তাছাড়া ..." বলেই সম্পূরকের দিকে চাইল।
" আরে সব সময় কলিগদের কথা ভাবলে চলবে না। নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছাগুলোও তো দেখতে হবে। তাছাড়া সম্পূরকবাবুর জন্যও কেউ হয়তো অপেক্ষা করছে। না কি সম্পূরকবাবু?"
সম্পূরক 'হ্যাঁ' বা 'না' কিছুই বলতে পারল না। আমতা আমতা করে বলল," না, আসলে আমরা..."
সম্পূরকের কথায় আমলই দিল না অসীম, রূপসার হাতটা ধরে বলে," কতদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা। কোনও একটা কফিশপে কফি খেয়ে, গল্প করে তারপর বাড়ি যাবো।"
" সম্পূরকও চলুক না।অন্যান্য দিন আমরা একসঙ্গেই যাই।"
" ওসব কার্ট সি পরে দেখালেও হবে। এখন চল্ তো।" বলে একপ্রকার জোর করে রূপসাকে গাড়িতে তুলল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।

🍂

সম্পূরকের চোখের সামনেই চকিতে ব্যাপারটা ঘটে গেল। সে আর কিছু বলতে পারল না। ভেবেছিল, আজ অফিস থেকে বেরিয়ে সিনেমা হলে ইভনিঃ শো দেখবে। অ্যাডভান্স টিকিটও কেটে রেখেছিল,রূপসাকে বলেনি সারপ্রাইজ দেবে বলে।

রাগে দুঃখে মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। রাগ হলো অসীমের ওপর। কোথাকার কে, এতদিন কোনও খোঁজ খবর ছিল না। আজ হঠাৎ রূপসাকে পেয়ে বগলদাবা করে নিয়ে চলে গেল। রাগ হলো রূপসার ওপর। কেন সে মুখের উপর 'না' বলে দিতে পারল না। একটা আশঙ্কা তার মনে জমা হতে লাগল। আবার কখনও কখনও নিজেকে বোকা বোকা লাগল, সামান্য ঘটনাকে সে বড় করে দেখছে বলে।

বাড়িতে এসে শুনলো, মন্টিকে সন্ধ্যাবেলায় ম্যাথটা দেখিয়ে দিতে হবে। মন্টির টিউটর পড়ানো বন্ধ করে দিয়েছে। যতদিন না ভালো টিউশন পাওয়া যাচ্ছে ততদিন সে কাকুর কাছেই পড়বে। মন্টি সন্ধ্যা হতেই অপেক্ষা করে বসে আছে, কখন কাকু আসবে। ভাইঝিকে পড়াতে গিয়ে কাকু মাঝেমাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল দুঃখ, রাগ,হতাশা, অভিমান তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। ঘন্টাখানেক পড়িয়েই উঠে গেল।

রূপসার উপর অসীমের এতখানি জোর খাটানোর সঙ্গে তাদের অতীত ইতিহাস জড়িত। রূপসা এবং অসীম ছোটবেলা থেকেই একে অপরকে চেনে।রূপসাদের বাড়ি যে পাড়ায়, সেই পাড়াতেই ভাড়ায় থাকত অসীমদের ফ্যামিলি। অসীমের বাবার ছিল বদলির চাকরি। চাকরি ক্ষেত্রে স্থান বদলের সাথে সাথে স্থান বদল ঘটত গোটা পরিবারের। অসীমকেও স্কুল চেঞ্জ করতে হত। রূপসাদের পাড়ায় অসীমরা অনেকদিন ছিল। দু'জন একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত।দুই পরিবারের মধ্যেও সখ্য ছিল। অসীমের মা আর রূপসার মা, দু'জন বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলেন।দুই পরিবারের লোকেদের মধ্যে পারস্পরিক যাতায়াত ছিল। তবে রূপসা- অসীমের মধ্যে স্বাভাবিক বন্ধুত্বের বেশি কিছু নয়। তাদের কখনও কখনও ঝগড়া হত আবার মিলমিশ হয়ে যেত। অসীমের মা রূপসাকে বলতেন," স্কুলে অসীম যদি কোনও রকম বদমায়েশি করে তাহলে তুই আমাদের বলবি।" রূপসার ক্ষমতা বেড়ে গেল অসীমও তাই রূপসাকে একটু তোয়াজ করে চলত। ইস্কুলের দুষ্টুমির খবর যাতে বাড়িতে না পৌঁছায় সেজন্য মাঝে মাঝে চকোলেট ঘুষ চলত।অবশ্য কখনও কখনও অসীম শাসানি দিত," যদি মাকে বলিস,তাহলে তোর পিঠে এটা পড়বে।" বলেই একটা ঘুষি দেখাত। রূপসাও ছাড়বার পাত্রী নয়।মুখটা বাঁকিয়ে বলত," ঠিক আছে মারিস তো মারবি। আমি কিন্তু কাকিমাকে বলবই।"
এবার রূপসার হাত ধরে ফেলত অসীম। অনুনয়ের সুরে বলতো," রাগ করছিস কেন রূপসা? আমি আর সত্যি সত্যিই তোকে মারছি নাকি? তুই তো আমার বন্ধু, না কি? দয়া করে মাকে বলিস না।" অসীমের এই করুণ অবস্থাটা রূপসা বেশ উপভোগ করতো।

এইভাবে চলতে চলতে একই সঙ্গে একই স্কুল থেকে দু'জনে মাধ্যমিক পাশ করলো।বয়স বাড়ল, কিন্তু সম্পর্কের নিবিড়তা অনেকটা কমে গেল। হাওয়াটা জোরে বইবার কথা ছিল, কিন্তু উল্টো হল। এই সময় থেকেই ভালোবাসার অনুভূতিগুলো জোরালো হয়। মনে ও শরীরে তার প্রতিফলন ঘটে। দু'বাড়ির লোক লক্ষ্য করল, অসীম আর রূপসা যেন অকারণ নিজেদের মধ্যে বেশি সময় কাটাতে চাইছে। রূপসার বাবা মা'র সেটা পছন্দ নয়। রূপসা তাদের একমাত্র মেয়ে। তাকে ঘিরে বাবা মায়ের অনেক উচ্চাশা আছে। এই বয়সে ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা ছেলেমেয়েদের থাকে না। অকাল আবেগে ভেসে যায়, হারিয়ে যায়। দেখা গেল মাধ্যমিক পাশের পর অসীম একই স্কুলে ভর্তি হল আর রূপসা ভর্তি হল অন্য একটি গার্লস স্কুলে।টিউশনগুলো আলাদা আলাদা।দেখা হত মাঝে মাঝে অসীমের মাও আসতেন রূপসার মায়ের কাছে কিন্তু অসীমের মা বুঝতে পারলেন যে, আগের মতো বন্ধুত্বের সেই টান আর নেই। আসা যাওয়াটা কমতে কমতে প্রায় বন্ধই হয়ে গেল।

এইচ, এস্ পরীক্ষার এক মাস আগে অসীমের বাবা বদলি হয়ে অন্য জায়গায়। পরীক্ষার শেষে ওদের বাড়ির সবাই সেখান থেকে চলে গেলেন।যাবার আগের দিন অসীমেরা সপরিবার রূপসাদের বাড়ি এসেছিলেন। দুই মায়ের এতদিনের বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন হল। দু'জনেই কথা বলতে বলতে চোখের জল ফেললেন। বিদায়ের মুহূর্তে দুই পক্ষই দুঃখে অধীর হল।

Post a Comment

0 Comments