জ্বলদর্চি

বাংলা নববর্ষের লোকাচার /ভাস্করব্রত পতি

বাংলা নববর্ষের লোকাচার
ভাস্করব্রত পতি

বাংলা নববর্ষের প্রতি বাঙালির আলাদা টান। আলাদা আবেগ। বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই সংস্কৃতিবান বাঙালি মেতে ওঠে নানা ধরনের আঞ্চলিক লোকাচারে। এই নববর্ষের মধ্যে বাঙালি খুঁজে পায় তাঁর চিরন্তন আবেগ এবং বাঙালিয়ানাকে। 
ঋতুবৈচিত্র্যে বৈশাখ মাসটি অন্নদাতার সূচনা মাস। চাসবাস ও শষ্য রোপন করাই যাঁদের জীবিকা তাঁদের কাছে নববর্ষটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পৌষমাস যেমন ফসল শেষ করে গোলায় ভরার মাস, তেমনি বৈশাখ হোলো শুরুর মাস। গনেশ পূজার প্রচলন সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। আস্তে আস্তে অবাঙালি এই সংস্কৃতিকে বাঙালিরা আত্মীকরণ করে নিয়েছে হালখাতার সাথে সাথেই। আমরা বাঙ্গালিরা নববর্ষ পালন করি পয়লা বৈশাখের দিন! যদিও একসময় তা পালিত হতো অগ্রহায়ণ মাসে। 'অগ্র' অর্থাৎ প্রথম এবং 'হায়ণ' হলো বছর! 
তবে সবাই বছরের প্রথম দিন হিসেবে বৈশাখকে ধরেনা। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষজনের কাছে পয়লা মাঘ হোলো 'মাগসিম' উৎসব বা নববর্ষ। বিদেশিদের মতো পয়লা জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপন করে মিজোরাম, নাগাল্যান্ড সহ ত্রিপুরার লুসি ও টুকাই উপজাতীয় লোকজন। তামিলদের 'পুটুবর্ষ পিরাপ্পু' পালিত হয় 'চিহিরাই' মাস এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে। তেমনি ১৪ ই এপ্রিল মালয়লাম নববর্ষ 'বিশু' পালিত হয় কেরলে। যদিও এখানে সেপ্টেম্বর মাসে তথা ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমীতে আরও একটা নববর্ষ 'ওনাম' পালিত হয়। রামনবমীর দিন নববর্ষ হয় রাজস্থানীদের। চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে নববর্ষ উদযাপন করা হয় অন্ধ্রপ্রদেশে। পয়লা চৈত্রতে নববর্ষ 'যুগাদি' পালন হয় কর্ণাটকে। তেমনি পয়লা অগ্রহায়ণে গুজরাটিরা নববর্ষ উদযাপন করে সবরমতী নদীর জলে প্রদীপ ভাসিয়ে। তবে বাঙালিদের মতোই পয়লা বৈশাখ নববর্ষ উদযাপন করে অসমীয়া এবং পাঞ্জাবিরা।
উত্তর ভারতে 'বিক্রম সংবত' তথা নববর্ষ হয় চৈত্রের শুক্লা প্রতিপদে। ওড়িশাতে চালু ছিল 'বিলায়তি' এবং 'আমলি' অব্দ। এই 'আমলি' শুরু হোতো ভাদ্র মাসের শুক্লা দ্বাদশীতে এবং 'বিলায়তি' হোতো আশ্বিন থেকে। দক্ষিণ কেরলে 'কোল্লাম' শুরু হয় ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা নবমীতে। দক্ষিণ ভারতের 'বার্হস্পত্য' শুরু হয় বৈশাখের কৃষ্ণা তিথি থেকে। বাংলা নববর্ষ উৎসব পালনের মূলে সম্রাট আকবর প্রতিষ্ঠিত 'নওরোজ' উৎসবের কথা অনেকেই বলেন। এটি পারস্যের বসন্ত উৎসব। 
নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ এই নববর্ষের নাম দিয়েছিলেন 'পুণ্যাহ'। আসলে রাজস্ব আদায় করে জমিদারদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য ছিলো তাঁর। তেমনি জমিদাররাও পয়লা বৈশাখ না করে অন্য কোনও দিন 'পুণ্যাহ' পালন করে খাজনা আদায় করতো প্রজাদের কাছ থেকে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র 'পুণ্যাহ' করতেন অগ্রহায়ণের প্রথমে। কিন্তু নববর্ষ উদযাপন করতেন পয়লা বৈশাখ দিনটিতেই। 
বাংলা নববর্ষ তথা বৈশাখের প্রথম দিন পালিত হয় 'আইখান উৎসব'। কেউ বলেন 'আইখন', কেউবা 'অয়ক্ষণ' বা 'আইক্ষণ'। 'এখ্যান'ও বলেন কেউ কেউ।অক্ষ অয়ণ > এখ্খান > আইখান > আখান
আইখান দিনে গোয়ালারা কোথাও কোথাও উনুন পূজা করে। একে বলে 'বানি পূজা'। আসলে এটি নারায়ণ পূজা। বাংলাদেশের যশোহর জেলায় মাসের প্রথম দিনকে বলে 'অখ্যান' দিন। যাইহোক মূলতঃ বাংলা বছরের প্রথমদিনে সারা বছর ভালো কাটানোর বাসনাকে সামনে রেখে পুরোনো বছরের দুঃখ দূর করার রীতি পালনের উদ্দেশ্যেই এতদঞ্চলে পালিত হয় 'আইখান দিন'।
পয়লা বৈশাখ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসি মুখে পালিত হয় এই আখ্যান পরব। এদিন বসতবাটির আশপাশ থেকে ঝাঁটা দিয়ে জড়ো করা হয় শুকনো ঝরা পাতা। এরপর তা বাড়ির বিভিন্ন স্থানে স্তূপাকার করে জ্বালানো হয়। সেই আগুনে বাড়ির আঁশবঁটিকে গরম করা হয়। তারপর ঐ গরম করা আঁশবঁটির ছ্যাঁকা দেওয়া হয় বাড়ির লোকজনের বাম পায়ে। বিশেষ করে ছোট ছেলে মেয়েদের দেওয়া হয়। তবে লক্ষ্য রাখা হয় যাতে কোনো ভাবেই পায়ে ফোস্কা না পড়ে। শুধু বাড়ির লোকজন নয়, গবাদি পশু তথা গরু ছাগলের পায়ের খুরেও আঁশবঁটির ছ্যাঁকা দেওয়া হয়। এরপর গরু বাছুরকে স্নান করিয়ে নিজেরাও স্নান করে আসে।
এদিন বাড়ি সংলগ্ন বাঁশের ঝাড়ে বা বিভিন্ন গাছের গোড়ায় কোদাল দিয়ে মাটি চাপানো হয়। নতুন বছরের শুরুতেই গাছের গোড়ায় মাটি দেওয়ার রীতি। কোথাও কোথাও দৈর্ঘ্য প্রস্থ এবং গভীরতায় বিঘৎখানেক গর্ত করে সেই গর্তে ঘুঁটে জ্বালিয়ে ধান কাটা কাস্তে গরম করে তা সকলের নাভির তলদেশে ছ্যাঁকা লাগানো হয়। হঠাৎ এই ছ্যাঁকা লাগানোর ফলে চমকে ওঠে সেই ব্যক্তি। সজাগ হয়ে ওঠে তাঁর স্নায়ূ। ফলে পুরোনো বছরের যাবতীয় অসাড়তা দূর হয়ে যায় তৎক্ষণাৎ। আবার নতুন করে শুরু হয় কর্মজীবনের তৎপরতা। কোনো কঠিন রোগ আক্রমণ করতে পারে না তাঁকে।
যাতে কোনো রোগব্যাধি আক্রমণ করতে না পারে তার জন্য এই ছ্যাঁকা দেওয়ার রীতি চালু রয়েছে। শুকনো পাতার আগুনে পুড়ে মারা যায় নানা বিষাক্ত কীটপতঙ্গ। আর জঙ ধরা বা মরচে পড়া বঁটিটিকে আগুনে পুড়িয়ে তার বিষভাব নষ্ট করা হয়। বাড়ির আশপাশে জমে থাকা ময়লা আবর্জনা, শুকনো পাতা পুড়িয়ে এলাকা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। সেইসাথে ধান জমিতে হলকর্ষণ করে গোবরসার দেওয়া হয়। নাপিতের দেওয়া চকচকে কাঁসার বাসনে মুখ দ্যাখে বাড়ির সকলেই। শুকনো পাতা জড়ো করে যে আগুন জ্বালা হয়, তা আসলে গেরস্থের ভাষায় "শত্রুর মুখে ছাই দেওয়া"!
এরপর বাড়ির সামনে থাকা তুলসী মঞ্চে একটি ছিদ্রযুক্ত মাটির ভাঁড় ঝোলানো হয়। ঐ ছিদ্রে এক গোছা দূর্বাঘাস বা খড়ের টুকরো লাগানো হয়। দুপাশে দুটো এবং মাঝে আড়াআড়ি একটা লাঠির সাহায্যে ঝোলানো হয় ভাঁড়টিকে। ভাঁড়টির ছিদ্র অংশ থাকে ঠিক তুলসি গাছের ওপরে। সেই ভাঁড়ে বাড়ির লোকজন জল ঢালে সকালে। ভাঁড়ের ছিদ্র দিয়ে টুপটুপ করে জল পড়ে তুলসীমঞ্চের ওপর। একে বলে 'বসনঝারা'। ঝিরিঝিরি জলের ফোঁটা পড়ে বলেই এহেন নামকরণ বলে অভিমত। আসলে তা 'বসুন্ধরা'। পৃথিবীকে শীতল করার পদ্ধতি। শুধু তুলসী গাছ নয়, এই ধরনের ভাঁড় ঝুলিয়ে দেওয়ার রীতি অনুসৃত হয় শিবঠাকুর, নারায়ণ এবং বেল, বট, অশ্বত্থ, ফনিমনসা গাছের ক্ষেত্রেও। সারা বৈশাখ মাস জুড়ে চলে এই পদ্ধতি। সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক ভাবনা রয়েছে এই প্রথায়। আসলে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে যাতে গাছ না মরে যায়, তার জন্য এইভাবে জল দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বসনঝারার মাধ্যমে।
এইদিন মুড়ির ছাতু খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। কোথাও কোথাও যব গুঁড়োর ছাতুও খাওয়া হয়। উল্লেখ্য, ঠিক আগের দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তিতে পালিত হয় 'ছাতু সংক্রান্তি'। অনেক বাড়িতে আইখান দিন থেকে বাড়ির গৃহদেবতাকে দেওয়া হয় বেলের সরবত এবং ছানার পানা। তাতে থাকে ছানা, নানারকম ফল, মিস্টি ইত্যাদি। একে বলে 'শীতল দেওয়া'। মূলতঃ এই ভোগ বিতরণ 'বাল্য ভোগ' নামে পরিচিত। সারা বৈশাখ মাস জুড়ে 'শীতল দেওয়া' চলে দেবতাকে।
এদিন সকালে স্নানপর্ব সেরে কোনো একজন ব্রাম্ভণকে ডেকে তাঁকে সাধ্যমতো দান করেন গেরস্থ। দেওয়া হয় সিঁদুর, শাড়ি। তখন ব্রাম্ভণ ঐ গেরস্থের মাথায় নতুন পঞ্জিকা বা পাঁজি ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করেন। যাতে নতুন বছর তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের শুভ হয়। আয়ু বৃদ্ধি হয়। আর নববর্ষে তথা আইখান দিনে 'হালখাতা' তো অতি জনপ্রিয় প্রথা।
তবে পয়লা বৈশাখ নয়, পয়লা মাঘে নতুন বছর পালন করে কুড়মিরা। তাঁদের কাছে এদিন 'কুড়মালি নববর্ষ'। নাম দেওয়া হয়েছে ‘এখ্যান যাত্রা’ বা 'আইখান যাত্রা'। সীমান্ত বঙ্গে মাঘের প্রথম দিনেই 'এখ্য়ান যাত্রা' বা 'আইখান যাত্রা' পালিত হয়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি লিখেছেন, "ষোলশত বৎসর পূর্বে পৌষ সংক্রান্তির দিন উত্তরায়ণ দিন আরম্ভ হইত। পরদিন ১ লা মাঘ নূতন বৎসর আরম্ভ হইত।" যে কোনও শুভ কাজের জন্য ভালো বলে মনে করা হয় এই দিন। কুড়মি নববর্ষে কুড়মি কৃষকেরা জমিতে তিনবার লাঙল চালিয়ে প্রতীকী 'হালচার' করে। গ্রামের ‘গরাম থান' তথা গ্রামদেবতার স্থানে পশু বলিরও চল আছে এইদিন।
রাঢ় অঞ্চলের তপশীলি সম্প্রদায়ের লোকজন পয়লা মাঘকে বলে 'আইখান দিন'। এদিন তাঁদের কাছে মহা উৎসবের দিন। তখন ছাগ, মেষ, শূকর বলি দেওয়া হয়। বাদ্যি বাজনা হয়। খাওয়া দাওয়া হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মকরের পরের দিন তথা পয়লা মাঘ হয় 'আখান'। এদিন ভোরে কাস্তে গরম করে 'চিড়ুদাগ' দেওয়া হয়। বাইটা দিয়ে দড়ি তৈরি করা হয়। সারা বাড়িতে গোবর দিয়ে লাতা দেওয়ার পর স্নান সেরে সেই ভিজে কাপড়েই গরু বা মহিষকে (এঁদের পা ধুইয়ে সিঙে তেল মাখিয়ে বরণ করে বাড়ির বউ) লাঙ্গলে জুড়ে জমিতে আড়াই পাক লাঙ্গল করে বাড়িতে ফিরে আসে। এই প্রথা হল 'হালচার' বা 'হালপুইন্যা'। এভাবেই 'আখান' দিনে কৃষিকাজের আরম্ভ করে কুড়মি সম্রদায়ের মানুষজন। 

বাংলার কৃষি মানচিত্রেও নববর্ষের সংযোগ দেখতে পাই। খনার বচনে আছে "খনা বলে শুন কৃষকগণ / হাল লয়ে মাঠে যাবে যখন / শুভক্ষন দেখে করিবে যাত্রা / পথে যেন না হয় অশুভ বার্তা / আগে গিয়ে করো দিক নিরূপণ / পূর্বদিক হতে কর হল চালন / তাহা হলে তোর সমস্ত আশয় / হইবে সফল নাহিক সংশয়"। অর্থাৎ নববর্ষের শুভক্ষণ দেখে চাষ শুরু করতে হয়। কোনোরকম অশুভ দর্শন এক্ষেত্রে ক্ষতিকর হতে পারে। তখন ফিরে আসা উচিত। আর মাঠের পূর্ব দিক থেকে হাল করা উচিত । তবেই কৃষিতে সাফল্য আসবে। চাষিরা এই বচন মেনে চলেন আজও।
এখন আর সেই জমিদারগিরি নেই। আস্তে আস্তে নববর্ষ উৎসবটা চলে গিয়েছে ব্যবসায়ীদের হাতে। তবুও বাঙালি জাতি এইদিনে তাঁদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে চাইছেনা স্রেফ সংস্কৃতিমনস্ক মনটাকে বিসর্জন দিতে চায়না বলেই। যতই কোরোনা ভাইরাস চোখ রাঙাক, নববর্ষ বাঙালির কাছে আলাদা আবেগ, আলাদা ঐতিহ্য, আলাদা ভালোবাসা। এর মৃত্যু হয় না।
নববর্ষ মানেই পুরানো কালিমা আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। যাবতীয় দুর্দশার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার নামই নববর্ষ! এখানে থাকবে না কোনো দ্বেষ, লোভ, ক্ষোভ আর হিংসার বিষাক্ত ধোঁয়াশা! সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালি কোনভাবেই তাঁর সংস্কৃতিকে ভুলতে চায়না। যুগ পরিবর্তনের পাশাপাশি আজকের কঠিন পরিস্থিতিতেও বাঙালি জাতি তাঁর চিরন্তন ধারাকে যথাসম্ভব এগিয়ে নিয়ে চলবে আপন গতিতেই। হয়তো অনেকেই সরে যাচ্ছে নানা সংস্কার সংস্কৃতির ঘেরাটোপ থেকে। কিন্তু বাংলা নববর্ষের কৌলীন্যের ধারা বজায় থাকবে আপামর বাঙালির মননে, চিন্তনে এবং স্মরণে। নববর্ষেই শপথ নিতে হয় আগামী দিনগুলোতে ঠিক কিভাবে পরিচালিত করবো নিজেকে! নববর্ষ মানেই বছরভর ভালো থাকার বর প্রার্থনা করা! "মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা / অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা"!

🍂

Post a Comment

0 Comments