দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে
আজ ৫ই এপ্রিল 'জাতীয় সমতা দিবস'।এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় সমতা কি?
সমতা অর্থাৎ সমানতা, মানুষের মৌলিক অধিকারের এবং গনতান্ত্রিক সমাজের।জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার থাকবে। বলা যেতে পারে, সমতা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অংশ।
জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ বাবু জগজীবন রামের জন্মবার্ষিকীর দিনটি সমতা ( ৫ই এপ্রিল) দিবস হিসেবে পালন করা হয়।১৯০৮ সালের ৫ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন চাঁদোয়ায় একটি হরিজন পরিবারে। পরবর্তী কালে একজন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর জন্মদিনটি কে কেন্দ্র করে (৫ই এপ্রিল) 'জাতীয় সমতা দিবস' পালিত হয়, কারণ সমাজের সকলের মধ্যে সমতা আনয়নের জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন। এই দিনটি সমাজের সকল ক্ষেত্রে সমতা আনার উপর জোর দেয়। বহু স্তর বিশিষ্ট সমাজের প্রাধান্য থাকায়, সমাজের কঠোর নিয়মের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, অস্পৃশ্যদের দুর্দশা দেখে তিনি খুব ব্যাথিত হয়েছিলেন এবং এই সমাজের বিলুপ্তির চেষ্টা চালিয়ে যান।
তিনি স্কুল জীবন থেকে, দেখে আসছিলেন সমাজে উঁচু-নিচু ভেদাভেদ, তাঁর মনের এই যন্ত্রণা কার্যক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছিল, একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে।
তিনি ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুক্ত ছিলেন এবং প্রায় ৩৬ বছর লোকসভার সদস্যও ছিলেন। জগজীবন রাম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত বিভিন্ন পোর্টফোলিওতে ছিলেন।
তিনি একটি জাতি, ধর্ম, বর্ণহীন গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সমাজের রূপান্তর এবং দুর্বল অংশের উন্নতির জন্য লবি গ্রুপে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি সম্প্রদায়িক কক্ষপথের বিরুদ্ধে ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় তপশিলি জাতিদের সংঘটিত করেন এবং বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সম্মেলনের আয়োজন করেন।
তিনি মানুষের মর্যাদা এবং একজন ব্যক্তি যে স্বাধীনতা ভোগ করবেন, তাতে বিশ্বাস করতেন। যে মানুষেরা অন্যদের নিপীড়ন করতেন তাদের তিনি মন থেকে ঘৃণা করতেন। এই সকল কারণে ভারতে প্রতিবছর তাঁর জন্মদিনের দিন (৫ই এপ্রিল) সমতা দিবস পালিত হয়।
তিনি ১৯৭৯ সালে ভারতের উপ প্রধানমন্ত্রী হন। প্রায় ৫০ বছরের সংসদীয় কর্মজীবনে জাতির প্রতি জগজীবন রামের নিবেদন ও আনুগত্য তুলনাহীন। তাঁর সমগ্র জীবন, রাজনৈতিক-সামাজিক সক্রিয়তা এবং বিশেষ অর্জনে পরিপূর্ণ। যুগের পর যুগ ধরে দলিত, নিপীড়িত, শোষিত এবং শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য জগজীবন রাম যে আইন বিধান করেছিলেন, তা ঐতিহাসিক। তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি এবং সব সময় দলিতদের জন্য লড়াই করেছিলেন।
🍂
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বৃটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যায়, তখন তাদের প্রচেষ্টা ছিল, ভারতকে আরো টুকরো, টুকরো করার। সিমলায় ক্যাবিনেট মিশনের সামনে বাবুজি(জগজীবন রাম)দলিত ও অন্যান্য ভারতীয় দের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির ব্রিটিশ প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করেন। অন্তর্বর্তী সরকার লর্ড ওয়াভেলের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার জন্য যখন ১২ জন ভারতীয়র কে ডাকা হয়েছিল তখন বাবুজি জগজীবন রামও ছিলেন তাদের মধ্যে। তাকে শ্রম বিভাগ দেওয়া হয়। এই সময় তিনি এমন সব আইন প্রণয়ন করেন, যা ভারতের ইতিহাসে সাধারণ মানুষ, দলিত, শ্রমিক ও নিপীড়িত শ্রেণীর কল্যাণে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি ন্যূনতম মজুরি আইন, শিল্প বিরোধ আইন, এবং ট্রেড ইউনিয়ন আইন তৈরি করেছিলেন যা এখনো শ্রমিকদের স্বার্থে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হিসেবে পরিচিত। তিনি কর্মচারী রাজ্য বিমা আইন এবং ভবিষ্যৎ তহবিলআইনও তৈরি করেছিলেন।
তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই সময় যখন ব্রিটিশরা সর্বশক্তি দিয়ে চিরতরে স্বাধীনতার স্বপ্নকে চূর্ণ করতে চেয়েছিল। ব্রিটিশরা তাদের কূটনৈতিক বুদ্ধি প্রয়োগ করে মুসলিম লীগের কমান্ড জিন্নাহকে তাদের হাতের পুতুলে পরিণত করেছিল। গান্ধীজি টের পেয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' পলিসি ব্যবহার করে স্বাধীনতা আন্দোলন দুর্বল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। হিন্দু- মুসলিম বিভাজন সৃষ্টি করে দলিত এবং উচ্চবর্ণের মধ্যে একটি ব্যবধান তৈরি করতে শুরু করে, যাতে তারা সফল হয় এবং দলিতদের জন্য ইলেক্টোরাল কলেজ ধর্মান্তর এবং তার অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা হয়। গান্ধীজি এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি বুঝতে পেরে আমরণ অনশনে বসেছিলেন। এটি একটি জাতীয় সংকটের সময় ছিল। এ সময় জাতীয়তাবাদী বাবুজি আলোর স্তম্ভ হিসেবে আবির্ভূত হন।
১৯৪৬ সালের মধ্যে জগজীবন রাম গান্ধীজীর হৃদয়ে প্রবেশ করেছিলেন। সেই সময় একজন ছাত্র হিসেবে তিনি কলকাতার মিল শ্রমিকদের ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন। শ্রম মন্ত্রী হিসেবে বাবুজি শ্রমিকদের জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় উন্নতি এবং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য সুনির্দিষ্ট আইনি বিধান করেছিলেন যা আজও আমাদের দেশের সমনীতির ভিত্তি।
বর্তমানে বাবু জগজীবন রাম ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন কর্তৃক রাজহাটের বিপরীতে, সমতা স্থলে তাঁর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সর্বধর্ম প্রার্থনা সভারও আয়োজন করা হয়, যেখানে সকল ধর্মের মানুষ উপস্থিত থাকেন। শুধু তাই নয়, এই দিনটি বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে উদযাপিত হয়, যেমন দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং বার্তা দেওয়া হয়, সমাজের সর্বক্ষেত্রে মধ্যে সমতা বজায় রাখার জন্য। মূলত সমতা দিবসের মাধ্যমে প্রয়াত নেতাকে শ্রদ্ধা জানানো হয় তাঁর জন্মদিন ৫ই এপ্রিলে।
0 Comments