জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৮ / সালেহা খাতুন

স্যার আছেন সৃষ্টির মধ্যে

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৮ / সালেহা খাতুন 

আর ভারতীয় অলংকার শাস্ত্র পড়াতেন অধ্যাপক দুর্গাশঙ্কর মুখোপাধ্যায়। স্যার পরতেন ধুতি পাঞ্জাবী। শুধু দুর্গাশঙ্করবাবুই নন বিমলবাবু, সুখেন্দুসুন্দর গঙ্গোপাধ্যায়, মণিলাল খান, প্রদ্যোত সেনগুপ্ত, রামেশ্বর শ’ এঁরা সবাই ধুতি পাঞ্জাবী পরতেন। সময়ের সাথে সাথে এখন অবশ্য পোশাক নিয়ে মানুষের ভাবনা চিন্তা বদলেছে। মনে আছে আমার ছোট্ট ভাইটি যখন ক্লাস এইটে উঠলো মা ওকে একটি সাফারি কিনে দেওয়ায় বাবার সে কী আক্রোশ! কেননা তিনি চান ভাই তাঁর মতো ধুতি পাঞ্জাবীই পরুক। অথচ বাবা দু’হাজার চার সালে হজ্ব করার পর ধুতি ছেড়ে পাজামায় চলে এলেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি মানুষ যখন কোনো কথা বলেন বা কাজ করেন তিনি নিজের দিকটা খেয়াল করেন না। আসলে নিজের দোষের ঝুলি সব সময় পেছনে থাকে। অন্যেরটাই চোখে পড়ে।

মানুষ তো চলে যায় কিন্তু তাঁর কথা এবং সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে মনে রাখে। ফিরে আসি দুর্গাশঙ্করবাবুর কথায়। তিনিও অত্যন্ত যত্ন নিয়ে আমাদের পড়াতেন। তাঁর “কাব্যতত্ত্ব বিচার”, “নাট্যতত্ত্ব বিচার”, “বাংলা নাট্যমঞ্চের রূপরেখা”, “রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যতত্ত্ব বিচার”, “অ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব সমীক্ষা”, “মোহিতলালের কাব্য ও কবি মানস”বিভিন্ন বইগুলি এখনও পাঠকের শ্রদ্ধা আদায় করে। 

একেবারে গ্রাম্য একটি মেয়ে রূপে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কারোর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কোনো কৌতূহলই আমার কোনোদিন ছিল না। তবে সম্ভবত দু’হাজার দশ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রিফ্রেশার্স কোর্সে সুশোভনদার সাথে আলাপ হয়। কথায় কথায় জানতে পারি সুশোভনদা দুর্গাশঙ্করবাবুর ছেলে। সেই রিফ্রেশার্স কোর্সে সাহিত্যতত্ত্বের ক্লাস নিচ্ছিলেন এমন একজন রিসোর্স পার্শন যাঁর বক্তব্য পছন্দ হয় নি বলে আমি তেরো নম্বর রুম থেকে বেরিয়ে আশুতোষ বিল্ডিং আর দ্বারভাঙা বিল্ডিংয়ের সংযোগ স্থলের সিঁড়িতে চলে আসি। সেখানেই সুশোভনদার সঙ্গে আলাপ। আমি যখন বলি যে দুর্গাশঙ্করবাবুর ক্লাস যাঁরা করেছেন তাঁরা এই আলোচনা নিতে পারবেন না, তখন খুশি মনে সুশোভনদা জানান তিনি দুর্গাশঙ্করবাবুর পুত্র। ঐ একদিনই কথা হয়। দুঃখের বিষয় করোনাকালে সুশোভনদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর ছাত্রদের কাছে তিনিও অত্যন্ত প্রিয় অধ্যাপক ছিলেন বলে শুনেছি।

🍂

 এই যে চলে যাওয়া, হারিয়ে ফেলা তা কিন্তু শুধু মৃত্যুজনিত কারণেই হয় না। অনেক কাছের মানুষ, প্রিয় মানুষদের সঙ্গে বিচ্ছেদ যন্ত্রণা আমরা অন্তরে অন্তরে লালন করি বিভিন্ন কারণে। আমাদের বন্ধু টুনু একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়ে আমাদের চুরানব্বই-ছিয়ানব্বই ব্যাচের অনেককে এক জায়গায় জড়ো করেছে। তবুও এর বাইরে রয়ে গেছে আরো অনেকে। বিশেষ করে সুমনা মজুমদার, সোমা এবং নিবেদিতা গাঙ্গুলীর কোনো খোঁজ এখন আর পাই না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিন এদের ছাড়া ভাবা কঠিন। 

সুমনা ইউ জিতে ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশোনা করেছে। পড়াশোনার বাইরে আমরা যে রান্নাবান্না সাংসারিক কাজকর্মে পারদর্শী ছিলাম তা সুমনাকে অনুপ্রাণিত করতো। ফুলবাগানে ওদের একান্নবর্তি পরিবারে মা কাকিমারাই সব কাজ সামলাতেন ফলে ওরা কিছু শিখতে পারে নি বলে আফশোস করতো। পরে যখন রুটি বেলা শেখে, তিন বোনে মিলে মা কাকিমার অনুপস্থিতিতে সংসার সামলায় আমাকে চিঠি লিখে জানায়। ওর বিয়ে হয় দমদমের দিকে। কী ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ওর ফুলবাগানের বাড়িতে একদিন গিয়েছিলাম আমি নিবেদিতা আর সোমা। বাড়ির ছাদ থেকে দেখা যাচ্ছিল যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন। তিনতলা বাড়ির একতলায় রান্নাঘর এবং খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা, দোতলায় বড়োদের থাকার জায়গা, তিনতলায় ড্রইং রুম, স্টাডিরুম, গেস্টরুম এবং ওদের তিনবোনের থাকার জায়গা। সুমনা মা-বাবার একমাত্র সন্তান। অথচ বোঝার উপায় নেই ওর বোনেরা ওর তুতো বোন। সবথেকে ছোটো বোনটি  “এ কালে কালে আঁখে” গানটিতে সুন্দর নাচ করেছিল আমরা যেদিন ওদের বাড়িতে যাই। সুমনার বাবা ডিফেন্সে ছিলেন। বাড়িতে এবং জীবনে ডিসিপ্লিন মেনে চলার শিক্ষা তিনি দিতেন।
সুমনার কাছে শুনেছিলাম ওদের প্রতিবেশীর দেহদানের প্রসঙ্গে। যে প্রতিবেশীদের বাইরে থেকে বিরক্তিকর মনে হতো অথচ তাঁদের ভাবনা কত মহৎ। এ কথা বারবার বলতো। ও একটু গম্ভীর প্রকৃতির ছিল। আমার বিয়েতে ওকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম এবং ও আমার জন্য উপহার হিসেবে অনেক বই কিনে বিয়ের দিন হাওড়া স্টেশন থেকে ফিরে যায়। ঠিকঠাক রাস্তা চিনতে না পারায়। বারবার চিঠি লিখে জানাতো তোমার বইগুলো আলমারিতে বন্দি হয়ে আছে। কবে মিট করবো? আমাদের দেখা এখনো হয় নি। সমাজ মাধ্যমে ওকে খুঁজে বেড়াই এখন।
সুশোভনদা, দুর্গাশঙ্করবাবুর পুত্র

আর সোমার বারুইপুরের বাড়িতে আমাকে আর সুমনাকে ডেকে সোমা এক বিরাট চমক দেয়। ওর বিয়ের কার্ড ধরায়। এম.এ. পড়তে পড়তেই ও বিয়ে করে। আনন্দবাজারে পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে অনেক রকম চাহিদা আমরা দেখতাম। সুন্নী মুসলিম পাত্রী চাই দেখলে ওখানে নিজেকে বসিয়ে যোগ্যতা বিচার করতাম। আমাদের সোমার একমাত্র চাহিদা ছিল পাত্রকে ওর চেয়ে দু ইঞ্চি হলেও লম্বা হতে হবে। কেননা সোমা খুবই লম্বা। আমাদের বন্ধু গার্গী, সুতপা ওরাও খুব লম্বা। জিওলজিস্টের সঙ্গে সোমার বিয়ে হয়। বরের পার্কস্ট্রিটে অফিস।  সোমা কিন্তু ডিটারমাইন্ড ছিল ও কোনো প্রকার চাকরি করবে না। কেননা ওর মা স্কুলের দিদিমণি হওয়ায় ছোটোবেলায় ওকে খুব অন্যরকম ভাবে বড়ো হতে হয়। আমাকে নিয়ে একদিন ট্যাংরায় ওর বড়োমার কাছে দেখা করাতে নিয়ে যায়। বড়োমাই ওকে শৈশবে দেখভাল করেছেন। সোমাও খুব ভালো গান গাইতো। বারুইপুরে সেদিন সোমা এবং সুমনার গান শুনে আমি বলি একজন সুচিত্রা মিত্র আর একজন সুমিত্রা সেন। একজন আত্মদৃপ্ত অন্যজন আত্মমগ্ন। শ্রোতারূপে আমার মূল্যায়ন ওদের কিছুটা লজ্জা দিলেও ওরা প্রীত হয়। ওকেও এখন খুঁজেই বেড়াচ্ছি।

আর নিবেদিতা ছিল জলপাইগুড়ির মেয়ে। ওর বাবা চা বাগানের ম্যানেজার। ওর জন্যই বিবেকানন্দ রোডে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে যাওয়ার সুযোগ পাই। নিবেদিতাও বেশ মজার মজার গল্প বলতো। বিয়ের অনুষ্ঠানে ওদের ওখানে নাকি চল আছে বরের পা কনের চুল দিয়ে মুছে দিতে হয়। ওর যেহেতু ছোটো চুল তার উপর কোঁচকানো ফলে কী আর করা যাবে? পাপোশের মতো করেই ব্যবহার করতে হবে। …

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments