ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি (প্রথম পর্ব)
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
"গানের পাখি গেছে উড়ে শূন্য নীড়
কণ্ঠে আমার নাই সে আগের কথার ভিড়
আলেয়ার এ আলোতে আর আসবে না কেউ কুল ভুলি।।
ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি ."।
বিদ্রোহী কবি নজরুল বোধহয় চিকিৎসকদের আগেই জানতেন নিজে একদিন চিরতরে নীরব হয়ে যাবেন। তাই বুঝি অনুভবী কবি সে মর্মান্তিক ভবিষ্যতের সম্ভাবনা করে কোনযুগে লিখে রেখে ছিলেন সে গভীর মর্মস্পর্শী হৃদয় বিদারক বেদনার কথা । যে নজরুল সুগঠিত দেহ অপরিমেয় স্বাস্থ্য ও প্রাণখোলা হাসি ও সোচ্চার কণ্ঠের অধিকারী এক দিলখোলা মানুষ ছিলেন-- ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে মারাত্মকভাবে স্নায়বিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লে আকস্মিকভাবে তাঁর কর্ম জীবনের সকল সক্রিয়তার অবসান ঘটলো। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখি মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে বাংলা কাব্য সাহিত্যে তাঁর অনন্য সৃষ্টির সম্ভারে যে প্রাচুর্যতা এনেছেন তা অতুলনীয়। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। তবু ও তিনি পরিচিত ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় এক বাঙালি কবি হয়ে। ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে আজন্ম কাটালেও তাঁর জীবন সায়াহ্নের শেষ কয়েক বছর কেটেছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র স্বাধীন বাংলা দেশের জাতীয় কবির সম্মানে ।
কবি নজরুলেরর জন্মস্থান :--
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমবর্ধমানের আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (ইংরাজীর (১৮৯৯ সালের ২৫ মে ) কবি কাজী নজরুল ইসলাম পিতা কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুনের ঘরে আঁধার রাতের রাজা '' দুখু মিয়া জন্মনিলেন। তিনি '' এলেন যেন সমগ্র তমসাবৃত জাতির প্রতিনিধি হয়ে এক স্বর্ণোজ্জ্বল আলোর বর্তীকা হাতে নিয়ে। সেদিনের সেই শিশুটি মাটির সাথে মিশে প্রকৃতির মাঝে মাতৃক্রোরে তাঁর প্রকাশ। জীবনের শুরু অত্যন্ত সাধারণ পরিবেশে থেকে। এখন আর তিনি মাঠেঘাটে ,বনবাদাড়ে ধুলো কাদা মাটি মেখে খেলে বেড়ানো ছোট্ট দুখুমিয়া টি নন।
শৈশব থেকেই কবির সমগ্র জীবনের চলার পথটি ছিল কণ্টকাকীর্ণ। বেঁচে থাকা,টিকে থাকার লড়াইয়ের কঠিন সংগ্রামে রুক্ষ বন্ধুর পথপরিক্রমায় বালক নজরুল বারংবার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তবুও এক বিরল কবি প্রতিভার অধিকারী হয়ে ধরার ধূলিতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালাতে তাঁর আগমন অবিস্মরণীয়।
বালক কবির লেখা প্রথম কবিতাটির ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ, বেশ মজার ঘটনা। তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র নজরুল লিখেছেন এক পূর্ণাঙ্গ কবিতা। তার সহপাঠী বন্ধুরা শিক্ষক কে সে কথা জানালে " গুরুজির মনে প্রবল সন্দেহ ও অবিশ্বাস। তিনি বাঁকা চোখে চশমার ফাঁক দিয়ে নজরুলের দিকে তাকিয়ে বলেছিল "কবি সাহেব তাহলে আপনি আমাকে একটা কবিতা শুনানতো দেখি কেমন লেখেন ?, কাজী নজরুল তখন ভয়ে ভয়ে তার লেখা প্রথম কবিতাটি আবৃতি করে শুনালো --
প্রভাতী
ভোর হলো দোর খোল
খুকুমণি ওঠো রে
ঐ ডাকে জুঁই শাঁখে
ফুল খুকি ছোট রে।
খুলি হাল তুলি পাল
ঐ তরী চলল
এইবার এইবার
খুকু চোখ খুলল।
গুরুজি অভিভূত হয়ে অধিক স্নেহে নজরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ভবিষৎ বাণী করেছিলেন "তুই একদিন অনেক বড় কবি হবি"। গুরুজির সেদিনের আশীর্বাদ বাণী বহু শত বাধা বিঘ্ন সঙ্কট সত্ত্বেও অক্ষরে অক্ষরে পরিপূর্ন রূপে ফলপ্রসূ হয়েছিল সেদিনের সেই বালক কবির জীবনে।
🍂
জৈষ্ঠ্যের প্রখর তপন তাপে রৌদ্রদীপ্তি সম বাংলা কাব্য সাহিত্যের আকাশে আবির্ভুত হলেন কবি নজরুল। রবীন্দ্র প্রভাবিত বাংলা সাহিত্যে অগ্নিহোত্রী কবি প্রলয় মূর্তিতে গর্জে উঠলেন অন্যায় অবিচারের অন্ধকুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তাঁর আত্মপ্রকাশ এক প্রবল অগ্নিদহনে অসহায় দুর্বলের ওপর দুর্নীতির অত্যাচার কে সমূলে উৎপাটিত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। এবং প্রবল প্রতিবাদি ভূমিকার জন্য শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাচরণের ফলে তাঁর সমগ্র ভাবনাতেই ছিল অনির্বাণ বিদ্রোহের জ্বালা।
নজরুলের বিদ্রোহী স্বরূপ প্রকৃত পক্ষে তাঁর প্রেম ব্যথিত লাঞ্ছনা পীড়িত মনের ভাবনার জমাটবাঁধা প্রতিবাদ। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের ভিত থেকে শুরু করে একের পর এক বাস্তবের ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে কঠিন সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে স্বনাম ধন্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠার নেপথ্যে যে রোমহর্ষক সংগ্রাম লুকিয়ে আছে আজ এই অবকাশে তারই কাহিনি ও সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করেছি ।---
বাংলা কাব্য সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি নামে আলোকিত কবি একাধারে গীতিকার ,সুরকার হিসাবে গীতিকাব্যে ও সাহিত্যে অতুলনীয় দান রেখে গেলেন। তিনি বারবার গর্জে উঠলেন শ্রমজীবী, সাধারণ মানুষের উপর নিপীড়নের প্রতিবাদে। দেশের স্বাধীনতার দাবি ও বিদেশি শাসনের প্রতি বিদ্রোহ প্রকাশ -- তীব্র ভাষায় ব্যক্ত করতে তিনি ছিলেন একম এবং অদ্বিতীয়ম। ভাবতে ঘোর বিস্ময় লাগে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে সেই কবি একেবারে নীরব! স্থবির। কিন্তু আজ ও তার কাব্যিক স্পর্শ , তাঁর লেখনীর ঐতিহ্য জনমানসে উজ্জ্বল হয়ে প্রগতি সাধনে কর্মের অনুপ্রেরণা দেবার জন্য সর্বাধিক পরিচিত।
পরাধীনতার নাগপাশের শৃঙ্খলে জর্জরিত দেশমাতৃকার মুক্তির দাবিতে ,অন্যায় অবিচারের বিরোধিতা করে বলিষ্ঠ্য ভাষায় প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠে সেযুগে ব্রিটিশ সরকারের ত্রাসের কারণ হয়ে উঠলেন। আজ তাঁর ১২৬তম জন্মবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে সেই নির্বাক স্তব্ধ কবির কীর্তি কে স্মরণ করি।
কবির ছাত্র জীবনে :---
১৯১০ সালে তিনি প্রথমে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুল এবং পরে মাথরুন উচ্চইংরেজি স্কুলে ( পরে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন) ভর্তি হয়েছিলেন। শেষোক্ত স্কুলের হেড-মাস্টার ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক; নজরুল তাঁর বিশেষ স্নেহধন্য হয়ে নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলেন।
সংসারে প্রবল আর্থিক অনটনে দুর্ভাগ্যক্রমে ষষ্ঠ শ্রেনীতে মাথরুন স্কুল ছেড়ে তিনি প্রথমে বাসুদেবের কবিদলে,পরে এক খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা পদে এবং শেষে আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নিয়েছিলেন কিশোর শ্রমিক নজরুল।এবং বাল্যকাল থেকেই গ্রাসাচ্ছদনের জন্য বাধ্য হয়ে তাঁর দিনযাপনে কঠিন লড়াই চলেছিল।
জীবনের এই সময় ঘরের বাঁধন ছেড়ে যাযাবরের মত কিশোর কবি মকতব, মাযার ও মসজিদে কাটানোর পর রাঢ় বাংলায় (পশ্চিম বাংলার বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চল) কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক লোকনাট্য লেটোদলে যোগদান করায় তাঁর কবি ও শিল্পী জীবনের শুরু হলো ঐ লেটোদল থেকে।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি ও চরিত্রের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় গড়ে উঠলো। লোকনাট্যের দলে তিনি একই সঙ্গে পালাগান রচয়িতা ও বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় শিখে ছিলেন। তাৎক্ষণিক ভাবে কবিতা ও গান রচনার কৌশল ও লেটো বা কবিগানের দলেই রপ্ত করেছিলেন। কিশোর কবি নজরুল চাষার গান শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের গান ,দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ,কবি কালিদাস, বুদ্ধু ভূতুম, রাজপুত্রের গান , বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদ বধ ইত্যাদি কাব্যের লেটোদের দলের চরিত্র অনুযায়ী গান বাঁধতেন।এবং প্রয়োজন অনুসারে চরিত্রে অভিনয় ও করতেন।
কিশোর নজরুল সেই সময় রুটির দোকানে চাকরি নিয়েছিলেন এবং আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হওয়ায় তিনি ১৯১৪ সালে অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে কবিকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এক বছর পর কবি পুনরায় স্বগ্রামে ফিরে গিয়ে ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন।এবং অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লে ও প্রিটেস্ট পরীক্ষার আগে ১৯১৭ সালের শেষদিকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।
এই সময়ে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারায় নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যে হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্যচর্চায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ''এই চারজন শিক্ষক,দ্বারা বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। অসামান্য তাঁর কবি প্রতিভা ছাই চাপা আগুনের মত ধিকিধিকি জ্বলে খুব দ্রুতই মশাল হয়ে জ্বলে উঠলো। বঙ্গভূমির তমসাবৃত চেতনার আকাশে আলোর প্লাবন বয়ে গেল দিকে দিকে।
জীবনের সকল ঘাত প্রতিঘাত জয় করে বাংলাকাব্য সাহিত্যের আকাশে তিনি দেখা দিলেন ধ্রুবতারা সম। সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’, রবীন্দ্র অনুকরণ মুক্ত । তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টির পথ সহজ হয়েছিল বলে গবেষকরা মনে করেন।
নজরুলের সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রতিমুহূর্তে তাঁর সৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ।
কবির রচনায় একাধারে দেখি যেমন প্রতিবাদ বিদ্রোহ সোচ্চার, তেমনি দেশপ্রেম প্রকৃতির প্রতি নিবিড় ভালবাসা, সমাজ ও রাজনীতি, এবং ধর্মের সম্পর্কিত বহু কবিতা রচনা করলেন। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তুলে ধরলেন অনাবিল সহজ ছন্দে কবিতার ভাষায়। এমন কি বাংলা কাব্য সাহিত্যের এক দুর্লভ সম্পদ নজরুলের শিশুদের জন্য রচিত অবাধ কাব্য সাহিত্যের ভান্ডার
শিশু সাহিত্যে নজরুল ---
শিশুদের জন্য কবিতা, গান গল্পে এবং বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য রচনায় বাংলা কাব্য সাহিত্যের ভান্ডার কে পরিপূর্ণ করে তুলেছেন। তাঁর শিশু সাহিত্য সহজ, সরল, এবং আনন্দদায়ক, যা শিশুদের মনে নানা ভাবনা জাগিয়ে তোলে এবং তাদের কল্পনা বিলাসী মনকে সুদূর প্রসারিত করে দেয়। শিশুদের জন্য এমন একটি জগৎ তৈরি করতে চেয়েছিলেন যেখানে তারা আনন্দ,সাগরে তরী ভাসিয়ে ' আলোর স্রোতে পাল তুলে'' ভাসবে অকুল দরিয়ায়। কবি नজরুলের শিশু সাহিত্যে জ্ঞান বিতরণ বা উপদেশের ঘনঘটা নেই, বরং শিশুদের কল্পনাবিলাসের প্রতি ও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর লেখা কবিতা ও গল্প শিশুদের মধ্যে আনন্দ ও উৎসাহ তৈরি করে, যা তাদের মনকে উদ্বেলিত করে প্রেরণা যোগায়।
শিশু কাব্য রচনায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি তাঁর অতিমাত্রায় খেয়ালি, স্বপ্নময় ও কল্পনাপ্রবণ শিশু মনের সঙ্গে পরিপূর্ণ একাত্ম হয়ে , শিশু-ভাবে ভাবিত হয়ে বসলেন মজাদার ছড়া ও কবিতা সৃষ্টিতে। এবং যে গল্পের মালা গাঁথলেন তার অসাধারণ সাফল্য অনস্বীকার্য। আজো ঘরে ঘরে উঁকিমারলে চোখে পড়বে শিশুদের ভোরের ঘুম ভাঙাতে অভিভাবকের মুখে আবৃত্তি প্রভাত সূর্যোদয় তথা প্রকৃতির র সাথে শিশুর পরিচয় নিবিড় করে জীবনকে কে গড়ে তুলে শিশু কে জাগিয়ে তোলেন। কর্ম জীবনে এগিয়ে যাবার প্রেরণায় আলোর আহ্বানে।
‘ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠরে!
ঐ ডাকে যুঁই শাখে ফুল-খুকী ছোটরে।'’
এই 'কবিতায় কবি প্রভাতের যে অপরূপ সুন্দর অনবদ্য এক চিত্র আঁকলেন তা অপরূপ মনোমুগ্ধকর এবং যেন এক উৎসবমুখর ঝর্ণাধারার মতো কবিতাটির গতি ও অবারিত।
শিশুদের চঞ্চল খেয়ালি মন কখন কী চায় তার একটি পরিষ্কার ছবি বিদ্যমান কবির প্রতিটি কবিতায়। কাব্যিক শব্দের বিন্যাসে অপরূপ শৈলীতে সাজানো খোকার মন চায় সকাল বেলায় জাগবে ভোরের পাখি হয়ে জাগবে।
কিন্তু সেখানে তার মা রাজী নয় । খোকাকে বারণ করে বলে এখনো ভোর হয়নি ঘুমিয়ে থাকো। রাগ করে মাকে বলে আলসে মেয়ে এবং মাকে বোঝায় সে জাগলেই যে সকাল আসবে। এই কবিতায় কবি যেন সমগ্র ঘুমে অচেতন জাতি কেই জাগাতে চেয়েছেন। তাই কবি লিখেছেন :------
আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে উঠব আমি ডাকি।
সূয্যিমামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,
‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’ মা বলবেন রেগে।
বলব আমি, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল-তাই বলে কি সকাল হবে না 'ক ?
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’
কল্পনা বিলাসী কিশোর মনে নানা কিছু অসম্ভব সাধনের ভাবনা আসে। নানা ভাবের উদ্রেক হয়। শিশুদের অদম্য ইচ্ছাকে সুন্দররূপে ফুটিয়ে তুলেছেন সংকল্প কবিতায়।দুনিয়াকে দেখার, সৃষ্টি জগতের কোথায় কী আছে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য কবি ছোটোদেরকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। লিখেছেন '-----:
থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে ছুটছে তারা কেমন করে,
কীসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
কীসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণাকে।
সূর্য যেমন আঁধার ঠেলে শুভ সকালের সূচনা করে, তেমনি ছোটোরাও খারাপ কিছু না করে ভালো কাজ করবে। ছোটোদের এ কাজ দেখে অনেকেই তাকে বাহাবা দেবে, প্রশংসা করবে কিন্তু কাজ পাগল ছেলেরা তখন বলবে- এখন ব্যস্ত, কথা বলার সময় নেই। ভালো কাজের সন্ধানে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়বে- পাহাড়-পর্বত, নদী সাগর সবই তাদের পদানত হবে।
আর এ সব করতে গিয়ে অনেক বিপদ-আপদের সম্মুখীন হতে হবে। এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি ও দাঁড়াতে হতে পারে তবু ও তারা সাহসে ভর করে বুকে বল নিয়ে নির্ভয়ে এগিয়ে যাবে।
কবি লিখলেন -
‘বজ্র আলোকে মৃত্যুর সাথে হবে পরিচয়
জয় জীবনের জয়
শক্তিহীনের বক্ষে জাগাব শক্তির পরিচয়।
জয় জীবনের জয়।
তাঁর রচিত ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থে সম্পূর্ণ শিশুদের উপযোগী মোট ১৩টি কবিতা রয়েছে। 'খুকী ও কাঠবিড়ালি ’, ‘মা’, ‘খাঁদু-দাদু’, ‘খোকার বুদ্ধি’, ‘খোকার গল্প বলা’, ‘চিঠি’, ‘লিচু চোর’, ‘ঠ্যাংফুলী ও পিলে-পটকা’, ‘হোঁদল-কুঁৎকুতের বিজ্ঞাপন’, ইত্যাদি ছোটদের জন্য লেখা একের পর এক মর্মস্পর্শী কবিতা তাঁর অনন্য সৃষ্টি ।
শিশুসাহিত্যের অনন্য অবদান নজরুলের আর একটি কাব্যগ্রন্থ ‘সঞ্চয়ন’। এতে আছে ২৬টি কবিতা ও একটি নাটক। তার মধ্যে ‘প্রার্থনা’, ‘মা এসেছে’, ‘জননী জাগো’, ‘কোথায় ছিলাম আমি’, ‘মোরা দুই সহোদর ভাই’, ‘প্রজাপতি’, ‘বগ দেখেছো?’, ‘আগুনের ফুলকি ছোটে’ ও ‘মায়া মুকুরের মত ’কবিতাগুলো বিশেষ ভাবে উল্লেখ যোগ্য।
‘কিশোরের স্বপ্ন’ কবিতায় কবি ছোটোদেরকে সকল প্রকার বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
‘ ‘মা! আমারে সাজিয়ে দে গো বাইরে যাওয়ার বেশে,
রইবো না আর আঁচল-ঢাকা গাড়ি-আঁকা দেশে। (কিশোরের স্বপ্ন)
এ কবিতায় বাঙালি মায়ের শাশ্বত চিত্র তুলে ধরেছেন কবি। বাঙালি মায়েরা তাদের সন্তানকে ছোটো ভেবে তাঁর নিশ্চিন্ত আঁচল তলে রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু কবি এর ঘোর বিরোধী। তিনি চান ছোটোরাও মায়ের আঁচল থেকে বেরিয়ে আসুক। তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক। চোখ মেলে দেখুক বিধাতার সৃষ্টি সম্ভারকে, প্রকৃতির আলো বাতাস গাছপালা সামগ্রিক সৌন্দর্য নিদর্শন সমূহকে।
ঐ একই কবিতায় কবি বলেছেন-
‘ম্যালেরিয়ায় ভুগব না মা,
মরব না তোর কোলে,
ডাকতে তোরে দেব না মা,
চাকরের মা বলে।’
বাঙালি মায়েরা যেন পুত্র সন্তানকে নয়নের মণি করে রেখে বেশি আদর দিয়ে নষ্ট না করে ফেলেন । ছোট ছোট নিষেধের ডোরে বেঁধে না রাখেন ভালো ছেলে করে। এমনকি ঐ অতিরিক্ত আদরের ফলে সন্তান আলস্যের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের বোঝায় যেন না পরিণত হয়।
জিজ্ঞাসা’ কবিতায় কবি লিখেছেন-
‘রব না চক্ষু বুজি
আমি ভাই দেখব খুঁজি
লুকানো কোথায় কুঁজি
দুনিয়ার আজব খানায়।’
দুনিয়াকে দেখার, জগতের কোথায় কী আছে তার খোঁজ নেওয়ার জন্য কবি ছোটোদেরকে বিশেষভাবে উৎসাহ দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। উদার আকাশের দিকে তাকিয়ে গ্রহ তারা মণ্ডল ও আকাশের উদারতায় মনকে জাগাতে বলেছেন।
কত যে মধুমাখা নাম মা’ ,কত যে মধুমাখা শব্দ মা '' কবি তাঁর'' মা ''কবিতায় সে কথার নানা ভাবে নানারূপে বিশ্লেষণ করেছেন। মায়ের মমতা চলার পথের পাথেয়। শৈশবে গভীর মমতায় মা শিশুটিকে লালন করেতার অঞ্চল ছায়ায় স্নেহের চাদরে আগলে রেখে কঠিন বাস্তবের সাথে পরিচয় করায়। মা এমন সুমধুর ডাক পৃথিবীতে আর একটিও নেই। স্নেহ-সুধায় ভরা মমতা মাখা মায়ের মুখটি যার অকৃত্রিম স্নেহচ্ছায়ায় প্রাণ জুড়ায়। শৈশব ঘিরে মা।সারাজীবন মায়ের স্বার্থত্যাগ অসীম। সন্তানের দুঃখে দুখী মা সুখে সাফল্যে সর্বাপেক্ষা সুখী ।
মা কবিতা টি তে লিখলেন --
হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান
মায়ের শীতল কোলে সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
তাঁর লিচুচোর কবিতায় সুন্দর এক অন্তর্নিহিত গল্প রয়েছে। গ্রাম্য পরিবেশে লিচু চুরির মজার চিত্র কবিতার মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে।পুকুর পাড়ের লিচু গাছে কাস্তে হাতে কিশোর টি গাছে উঠলেও হঠাৎ ডাল ভেঙে পড়ে যাওয়ায় চুরি করা হলো না । ছেলেটির লিচু চুরির ইচ্ছাশক্তি ও ব্যর্থতা এই কবিতার মূল বার্তা শিশু মনকে সচেতন করে।
খাঁদু দাদু" কবিতায় হাসি-খুশি ও অদ্ভুত স্বভাবের দাদুর নাকের বিভিন্ন রূপ এবং তাঁর বিভিন্ন কাজকর্মের কথা উল্লেখ করে দাদুর বাঁকা নাক,দাঁত এবং চাল চলন নিয়ে বিশেষভাবে মজাদার এক হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন। হালকা ছন্দে শব্দের ব্যঞ্জনায় দাদুর প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন।
যেমন – "নাকের কাঁখে গজাল ঠুকে দেছেন, ভেঙে বাঁকা নাকের কাঁখ?"
‘ঝিঙেফুল’ কবিতাটিও ভারী মিষ্টি মনের মাঝে শব্দ ও ছন্দের অনুরণন তোলে —
‘ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল
সবুজপাতার দেশে ফিরোজিয়া
ঝিঙেফুল ঝিঙেফুল!’
‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’ কবিতায় খুকুর উক্তির মধ্যে শিশু হৃদয়ের কল্পনাবিলাস ও জীবজন্তুর জীবন সম্পর্কে তার অসীম কৌতূহল ও আত্মীয়তাবোধ প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার ভাষা ও ছন্দে শিশুসুলভ চপলতা লক্ষণীয়—
‘কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও?
বাতাবি-নেবু? লাউ?
বেড়াল-বাচ্চা কুকুর ছানা? তাও?’
প্রজাপতি ছড়া টিতে নজরুল শিশুর কাছে প্রজাপতির বিচিত্র সুন্দর রূপ ও তার মুক্ত জীবনের আকর্ষণকে সার্থকভাবে রূপায়িত করেছেন।
‘প্রজাপতি!
তুমি নিয়ে যাও সাথী করে তোমার সাথে।
তুমি হাওয়ায় নেচে নেচে যাও,
আজ তোমার মত মোরে আনন্দ দাও।’
এ ছাড়া বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘পুতুলের বিয়ে’, ‘ঘুম জাগানো পাখি’, ‘ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি’ ইত্যাদি এবং কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘শেষ সওগাত’, ‘ঝড়’ ইত্যাদি, যা চিরকাল শিশুমন জয় করে সবার হৃদয়হরণ করেছে এবং করবে। এ ছাড়া ও ছড়া, কবিতা-গানে তাঁর রয়েছে অসামান্য অবদান।
শিশুকাব্যে নজরুলের বিচরণ তাই অপরিমিত। বঙ্গভূমির মুগ্ধ শিশুরা চিরকালএই অদ্বিতীয় কালজয়ী কবি কে আপন আনন্দে ভক্তিভরে স্মরণ করবে।মনে বড়ো বিস্ময় জাগে যে কবি দৃঢ় চিত্ত বজ্রের মত সুকঠিন ,এবং বিদ্রোহী হয়ে বীরবিক্রমে সদর্পে লাথি মেরে পাষাণকারা ভাঙেন , কুসংস্কারের অচলায়তন নিমেষে গুড়িয়ে দেবার জন্য অহর্নিশ প্রতিবাদের ঝড় তোলেন , সে কবির কলম দিয়েই শিশুদের জন্য এমন মরমী স্পর্শ এমন মজার কবিতায় বাৎসল্য ও স্নেহ কোমল রসের প্রস্রবণ বয়ে যায়। ক্রমশঃ
0 Comments