জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫১/বিজন সাহা

ত্রইৎস্কি সাবর

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫১

বিজন সাহা 

সারাতভ ও ইউরি গাগারিন 


সারাতভ থেকে আমরা যাচ্ছি ভোলগাগ্রাদের দিকে। কিন্তু মন পড়ে আছে সারাতভে। আমাদের শেষ তিনটি যাত্রা বিরতি ছিল উলিয়ানভ, সামারা আর সারাতভে। এ সবই ভোলগা তীরের গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল শহর যারা রাশিয়ার ইতিহাসে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। যদি উলিয়ানভ এখন লেনিনের স্মৃতি সমৃদ্ধ তবে সারাতভ গাগারিনের স্মৃতি বিজড়িত। তাই এখানে এসে গাগারিনের মিউজিয়াম না দেখে যাওয়াটা আমাদের সারাতভ ভ্রমণে কেমন যেন শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। তবে এর পেছনে কিছু অবজেক্টিভ কারণ ছিল। দেমিদের সাথে কথা হয়েছিল দুই সপ্তাহের জন্য। তাই ও কিছুটা হলেও অসন্তোষ প্রকাশ করছিল। অন্য দিকে দিলীপ মস্কোয় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সাথে এক বৈঠকের আয়োজন করেছিল। তাই সেদিক থেকেও তাড়াহুড়ো ছিল। 

দিলীপ সারাতভে আসার পর থেকেই বেশ কয়েকবার ইউরি গাগারিন সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছে। দেশে আমরা গ্যাগারিন নামে অভ্যস্ত, তবে রুশে নামটা হবে গাগারিন। তাই আমি সেভাবেই লিখব। আসলে কোন কোন জায়গার সাথে কোন কোন ব্যক্তির নাম অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে থাকে। সাঙ্কত পিতেরবুরগের সাথে যেমন পিওতরের নাম, শান্তি নিকেতনের সাথে রবীন্দ্রনাথের নাম, তেমনি উলিয়ানভের সাথে লেনিনের বা সারাতভের সাথে গাগারিনের নাম। যদিও ভিন্ন ভিন্ন কারণে। পিতর বা রবীন্দ্রনাথ ছিলেন  সাঙ্কত পিতেরবুরগ ও শান্তিনিকেতনের স্থপতি, লেনিন উলিয়ানভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আর গাগারিন সারাতভে ছাত্রজীবন কাটিয়েছিলেন। কিন্তু এরা সবাই নিজ নিজ কাজে এতটাই মহিমান্বিত যে তাদের স্মৃতি বিজড়িত বলে এসব স্থান নিজেরাই গর্ব বোধ করে।  

সারাতভে ইউরি গাগারিন

ইউরি গাগারিন ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ রাশিয়ার স্মলেনস্ক প্রদেশের গঝাতস্কি, যা বর্তমানে গাগারিন নামে পরিচিত, থানার ক্লুশিনো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা-মা ছিলেন সাধারণ কৃষক। ১৯৫১ সালে মস্কো প্রদেশের লিউবেরেৎস্ক থেকে তেকনিকুম বা কারিগরি কলেজ শেষ করেন। সেখানে তিনি শৈল্পিক ঢালাই কাজের সার্টিফিকেট পান। তাঁর কাজ ছিল ভাস্কর্য, অলংকার ইত্যাদির জন্য ছাঁচ তৈরি করা। সোভিয়েত আমলে পেশাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শেষ করার পর সরকার থেকে এদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হত। সরকার থেকেই ঠিক করা হত কে কোথায় কাজ করবে। এটা একদিকে বেকার সমস্যার সমাধান করত আর সরকার আগে থেকে পরিকল্পনা করে নির্দিষ্ট ফিল্ডে প্রয়োজনীয় পরিমাণ বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে পারত। যদি সাধারণ ছাত্রদের জন্য এটা ছিল ভালো পদ্ধতি, তবে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে যারা ভিন্ন পরিস্থিতিতে অনেক ভালো করতে পারত, সরকারের কঠিন নিয়ন্ত্রণের কারণে ঠিকমত নিজেদের বিকাশ করতে পারত না। কলেজ শেষ করার পর গাগারিনকে সারাতভের ইন্ডাস্ট্রিয়াল কলেজে পাঠানো হয় লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য। ১৮৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানের ছিল সমৃদ্ধ ইতিহাস।  প্রথম দিকে এই প্রতিষ্ঠানে সেলাই, চামড়ার কাজ ও বাইন্ডিং শেখানো হত। পরে এখানে অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষা দেয়া শুরু হয়। এমনকি ঢালাই কাজের উপর এখানে পড়ানো শুরু হয়। আর এর ফলেই গাগারিন সারাতভে পড়তে আসে। আর এভাবেই সারাতভের নাম মহাকাশ বিজয়ের সাথে যুক্ত হয়। ইউরা (ইউরির অন্য নাম) সেখানে একা আসেনি, এসেছে বন্ধুদের সাথে। সারাতভের গরম তাদের স্বাগত জানায়। ইউরা লেখে “সারাতভ আমাদের ভালো লেগেছে। আমরা এসেছি আগস্ট মাসে। ২১ মিচুরিন স্ট্রিটের হোস্টেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। জিনিসপত্র রেখেই আমরা ছুটে যাই ভোলগায়।” তখনও সেখানে বাঁধানো নদী তীর ছিল না। পরে এর নামকরণ করা হবে কসমানাফত বা নভোচারীদের নদী তীর। মিচুরিনস্কি থেকে ইউরা ও তার বন্ধুরা গেল রাদিশেভ রাস্তায়। তাদের সামনে ভোলগার খাঁড়া তীর। নীচে বিশাল ভোলগা। তারা সেখান থেকে যাবে সবুজ দ্বীপে। তীব্র স্রোত। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। ইউরা লিখবে “এই দৃশ্য আমাদের মুডের সাথে ছিল একই সুরে বাঁধা। আমরা এক নতুন, অজানা জীবনে প্রবেশ করছিলাম, আমরা ছাত্রত্ব বরণ করছিলাম।” উল্লেখ করা যেতে পারে যে রাশিয়ায় ইউনিভার্সিটি বা ইনস্টিটিউটে যারা পড়াশুনা করে তারা ছাত্র বা স্টুডেন্ট, স্কুল ও তেকনিকুমের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার্থী নামে পরিচিত। 

🍂

সারাতভে পড়াশুনার সময়ে ইউরা ও তার বন্ধুরা বিভিন্ন ধরণের মেটালিক গ্রিল ঢালাই করে যা সারাতভের পার্কে দেখা যায়। ইউরা লেখে “স্কুল ও তেকনিকুমের তুলনায় এখানে পরিবেশ অনেক বেশি সিরিয়াস। শিক্ষকগণ ছিলেন বেশ কড়া। শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল খুব ভালো – ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরী, বিভিন্ন বিষয়ের উপর স্পেশাল ক্যাবিনেট।” ইউরা বেশ সিরিয়ালি লেখাপড়া করতে থাকে যদিও মার্কের পেছনে দৌড়ানর অভ্যেস তার ছিল না। তার চেষ্টা ছিল যত বেশি সম্ভব জানার। ইউরা লিখবে “তেকনিকুম আমার জন্য শুধু জ্ঞানার্জনের স্কুল ছিল না, এটা ছিল আমার জীবনের স্কুল।” চার বছরের শিক্ষা জীবনে ইউরা ৩২ টি পরীক্ষা দেয়। এর মধ্যে ৩১ টি পরীক্ষায় আক্সিলেন্ট বা পাঁচ, মানে সর্বোচ্চ নম্বর পায় আর সাইকোলজিতে পায় চার। তবে মহাকাশ বিজয়ের পর ইউরি গাগারিন লেবেদেভের সাথে “সাইকোলজি ও কসমস” নামে এক বই লিখলে তার নম্বর বাড়িয়ে ৫ করা হয়। সারাতভে শিক্ষা কালে ইউরার এরোপ্লেনের প্রতি ঝোঁক দেখা দেয়। আসলে সেই সময় প্রায় সব তরুণদের মধ্যেই বিমান চালক হবার আগ্রহ ছিল। ইউরা লেখে “তেকনিকুমে পড়াশুনা নিজের গতিতে চলতে থাকে। কিন্তু যখনই প্লেনের শব্দ কানে আসত বা শহরে বৈমানিকের দেখা পেতাম, মনের ভেতরটা যেন গরম হয়ে উঠত। এটা ছিল মহাশূন্যের প্রতি এক অবচেতন মনের আকর্ষণ।” ১৯৫৪ সালের ২৬ অক্টোবর ইউরা পাইলট বিভাগে সারাতভ ফ্লাইং ক্লাবে নথিভুক্ত হয়। এখনও সেই স্থাপনা সংরক্ষিত আছে। বিপ্লবের আগে এটা ছিল জার্মান কনস্যুলেট। আগে সেখানে যারা তেকনিকুম শেষ করেছে শুধু তাদেরই ভর্তি করা হত, কিন্তু সেবার চতুর্থ বর্ষের ছাত্রকেও সুযোগ দেয়া হয়েছিল। গাগারিন লেখে “সারাতভ  ফ্লাইং ক্লাবে নতুন জীবনের শুরু করতে পেরে আমি যারপর নাই আনন্দিত, সুখী। দক্ষ ও যত্নশীল শিক্ষকেরা আমার মধ্যে বিমান চালনার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাঁরা আমাকে সত্যিকারের পেশা খুঁজে পেতে সাহায্য করেছেন।” সারাতভে তাঁর জীবন কাহিনী ইউরি গাগারিন লিখেছেন “রোড টু কসমস” বা “মহাকাশের পথ” নামক আত্মজীবনী মুলক গ্রন্থে।     

সারাতভ

দুবকি এয়ার ফিল্ডে এপ্রিলে প্রি-ফ্লাইট প্রস্তুতি শুরু হয়। ঘুম থেকে উঠতে হত ভোর ৪ টায়, এরপর ব্যায়াম, দৌড়, আর সবশেষে মার্চ করে বিমান পার্কে যাওয়া। তার প্রথম একক ফ্লাইট ছিল ইয়াক-১৮ বিমানে। ছাত্রদের মধ্যে এক ধরণের রীতি চালু ছিল। প্রথম একক ফ্লাইটের পর সবার জন্য সিগারেট “কাজবেক” কেনা ও যারা ধুমপানে আগ্রহী তাদের মধ্যে সিগারেট বিলানো। এখানে গাগারিন সব পরীক্ষায় এক্সিলেন্ট রেজাল্ট করে আর এর উপর ভিত্তি করেই ১৯৫৫ সালের হেমন্তে অরেনবুরগ এভিয়েশন স্কুলে ভর্তি হয়। এভাবেই ঢালাই কর্মীর পরিবর্তে ইউরি হন যুদ্ধ বিমানের পাইলট। বিখ্যাত বিমান যাত্রার বা রকেট যাত্রার আগে গাগারিন আবারও এখানে ফিরে আসবে। কসমানাফত বা নভোচারীদের নিবিড় প্যারাসুট প্রশিক্ষণ নিতে হয়। একটা সময় পরে তাদের রকেট ত্যাগ করে নিজের প্যারাসুটে নীচে নামার শিক্ষা নিতে হত। কসমস বিজয়ের ঠিক এক বছর আগে ১৯৬০ সালের ১৩ এপ্রিল সব নভোচারীরা মস্কো থেকে সারাতভের উপকণ্ঠে এঙ্গেলস শহরে চলে আসেন। ভোলগার বাম তীরের এই শহরের শুরু হয় তাদের প্যারাসুট প্রশিক্ষণ। বিভিন্ন পরিস্থিতে বিভিন্ন উচ্চতা থেকে প্রায় শ খানেক বার তাদের লাফাতে হয়েছিল। এক বছর পরে ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল সকাল ১০ টা ৫৫ মিনিটে পৃথিবীর প্রথম নভোচারী এঙ্গেলস এলাকার লেনিনের পথ নামে কালখোজের ফসলী জমিতে অবতরণ করেন। গাগারিন পরে লিখবেন “এ যেন এক হ্যাপি এন্ডিং উপন্যাস। কসমস জয় করে আমি সেখানেই ফিরে এলাম যেখানে প্রথম উড়তে শিখেছিলাম।” ইউরি গাগারিন ভোলগার বুকে ভেসে যাওয়া বিশাল বরফের টুকরোয় নামতে পারতেন। কিন্তু দীর্ঘ প্যারাসুট প্রশিক্ষণ তাঁর সাহায্যে আসে। প্যারাসুটের দড়ি ব্যবহার করে তিনি ভোলগার বুকে ভেসে যাওয়া বরফের টুকরো থেকে দূরে সরে যান এবং নদী তীর থেকে ১,৫ - ২ কিলোমিটার গভীরে উজমোরিয়ে  গ্রাম থেকে ৩ – ৪ কিলোমিটার দূরে ভূমিতে অবতরণ করেন। এভাবেই সারাতভ গাগারিনের জীবন আমুল পরিবর্তন করে নিজের নামও কসমসের সাথে লিখে রাখতে।     

গাড়ি চলছে ভোলগোগ্রাদের পথে। পেছনে রয়ে যাবে গাগারিনের স্মৃতি – যে স্মৃতি আমাদের দেখা হবে না, জানতে হবে বই পড়ে।

Post a Comment

0 Comments