জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী


‘পিসিমা! ও পিসিমা! দেখুন,দেখুন,বাইরে কি সুন্দর রোদ উঠেছে।এবার একটু উঠুন! এই যে আপনার জন্য আদা দিয়ে চা করে এনেছি,ভালোবাসেন আপনি।মুখ ধুইয়ে চাটুকু খাইয়ে দিই আপনাকে,দেখবেন কি ভালো লাগবে!’
অনেক দূর থেকে কে যেন আদরমাখা গলায় এমন করে ডাকছে কাকে! কে ডাকছে, কাকে ডাকছে,কেন ডাকছে, ঠিক ঠাহর হচ্ছে না বিরজার। ইদানীং মানুষের চাইতে গাছপালা, পশুপাখির কথা যেন বেশি বুঝতে পারেন তিনি,চোখের সামনে কেমন যেন পুতুল পুতুল সব ছায়া ভাসে দিনরাত।  
এখনও ঘোলাটে চোখে আবছা দৃষ্টি ফেলে দেখলেন,অ্যন্টেনায় ঠিকমতো ছবি না আসা টিভির পর্দায় লাফালাফি করা রঙহীন ঝিলমিলের মতো কে যেন একটি কম বয়সী মেয়ে সামনে বসে তাঁর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কি যেন বলছে… কিছু কানে আসছে,কিছু আসছে না।কি যে হয়েছে আজকাল, শরীর বা চেতনা কখনো সঙ্গ দেয়,কখনো দেয় না,বাঁচা-মরার মাঝামাঝি কোন একখানে যেন তাঁর অবস্থান।

সকাল থেকেই বেশ সুন্দর দখিনা বাতা বইছে,রোদের তাপমাত্রা দুপুরের দিকে চড়া।ফাল্গুন শেষ হয়ে এলো।
হঠাৎ দরজা দিয়ে বাইরের টাটকা একবলক ডাকাতিয়া সোঁদাগন্ধী হাওয়া ঢুকে পড়লো রোগিনীর ঘরে। বেশ কয়েকদিন বিছানাতেই কাটছে দিন। বৌমায়েরা পালা করে সঙ্গ দেয়, ভাইপোরা ওষুধ, ডাক্তার, সেবার সর্বোত্তম ব্যবস্থাও করেছে। জ‍্যাঠাইমা বলতেন,দেওয়ার দেওয়া জমা থাকে।সত‍্যিই বলতেন হয়তো।
তা নইলে,যে যুগে আপন বাপ-মায়েরই জায়গা হয়না ছেলের ঘরে,সেখানে পিসিমার জন্য…
ভাবতে ভাবতেই মুখে স্নিগ্ধ ছোঁওয়া… 'জ‍্যাঠাইমা এলে?এতোদিনে মনে পড়লো তোমার আমার কথা!'
অভিমানে ঠোঁট উল্টে জানতে চায় বিরজা। 
উত্তরে ঝরঝর ঝর্ণার মতো খিলখিল হাসি… , 
-'কি বিড়বিড় করছেন পিসিমা!আমি তো আপনার বৌমা,আপনার জ‍্যাঠাইমা কোথা থেকে আসবেন এতোদিন পরে!' 
পঞ্চ ব্যঞ্জনের সুগন্ধি ঝঙ্কার উঠলো যেন স্বাদ হারিয়ে যাওয়া অন্ধকার মলিন ঘরটিতে। হঠাৎ এক আঁজলা আলো পড়লো চোখে,চেতন ফিরে এলো, বুঝতে পারলেন,কথা বলতে বলতেই নতুন বৌমা পেছনে বালিস দিয়ে বসিয়ে দিলে,মুখ মুছিয়ে চামচে করে চা খাইয়ে দিলে,পেটে গরম কিছু যেতে যেন আরও খানিক জীবনে ফিরে এলেন বৃদ্ধা,কিছু বলতে চাইলেন,গলা দিয়ে স্বর বেরোলো না,হাত তুলে আশীর্বাদ করতে চাইলেন অনুজাকে;হাতও উঠলো না।
তবে ভালোবাসার তো এক মধুগন্ধী সৌরভ আছে, এমনিতেই ছড়িয়ে পড়ে,বলা বা ছোঁওয়ার তোয়াক্কা না করেই।
সেই গন্ধই যেন নাকে এলো নবীনার;স্মিতহাস‍্যে তাকালে প্রবীণার দিকে। পাশে বসে খানিক লজ্জায় মুখ নামিয়ে বললে কানে কানে,
-'ও পিসিমা!আপনি যে আবার ঠাকুমা হতে চলেছেন,তাড়াতাড়ি সেরে উঠুন,আপনি ছাড়া সেরে উঠুন…আপনি ছাড়া আমাদের এই অবস্থায় আদর করবে কে!'
আলতো করে মাথা নামিয়ে রাখলে তাঁর কোলে; মেয়েটির মনে পড়লো আপন মায়ের কথা,কতদিন যাওয়া হয়নি বাবার বাড়ি, দেখা হয়নি মায়ের সাথে. .. 
সত্যিই,ধন‍্য এ নারীজীবন!সৃষ্টির কী বিষম ব‍্যথা! জন্মদান কী আঘাতসহ!একমাত্র মেয়েরাই হয়তো এটি পারে।

🍂

বড়ো আতুরতায় পিসিমাকে আঁকড়ে ধরে ভাবলে মেয়ে,একে তো নিজের শরীরের এমন অবস্থা, সবসময়েই গা গোলাচ্ছে, বমি পাচ্ছে,মাথা ঘুরছে, অসুস্থ লাগছে,শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনখারাপও হচ্ছে; আরও খারাপ লাগছে এই ভেবে যে,পিসিমার এমন অবস্থায় এমন সুখবরটি  তাঁকে দিতে পর্যন্ত পারছে না সে…
অনেকেই বলছেন,এমন অবস্থায় খুশি থাকতে হয়,ভালো ভালো বই পড়তে হয়… কিন্তু বাড়ির বাচ্চাগুলো পর্যন্ত যেখানে বিষন্নপ্রায়, সেখানে আনন্দের আয়োজন যে বৃথা।
এমনকি,এ অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবাও অন‍্যায়,বিশেষত বিয়ের পর থেকেই পিসিমা যেভাবে তাকে আগলে রেখেছেন,তাঁর এই অবস্থায় তাঁকে ফেলে যেতে যে মনও চায়না মেয়েটির…

বাইরের উঠোনে তখন ঢালা রোদে বকবকম পায়রার ভীড়;পিসিমা প্রতিদিন কাজকর্মের ফাঁকে সকালবেলা ওদের খেতে দিতেন,রেশন দোকান থেকে গম আনার ব‍্যবস্হা আছে মাসকাবারি ওদের জন‍্যই।পিসিমা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ওই খেতে দেয় তাদের,নিয়মমতোই…. কেমন যেন একটা মায়া পড়ে যাচ্ছে এ বাড়ির ওপরে; যারা কয়েকদিন আগেও ছিল নেহাতই অচেনা,তারা কেমন করে যে আপনার হয়ে যায় ক্রমে ক্রমে,ভাবতে ভাবতে গায়ে হাত বুলোয় পিসিমার,নারীজীবন কি এমনই!বহতা নদীর মতোই!...

বাইরে তখন নববসন্তের উতল হাওয়া আগামী ঋতুচক্রের আবাহনে উত্তাল,পুরনো যা কিছু,ঝরাপাতার মতো ঝরে যাবে এই হাওয়ায় হাওয়ায়,বৈশাখের রুদ্রদাহে সেসব পুড়ে যাবে,নববর্ষা আগমনে নতুন প্রাণোদ্গমের আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবে আবার প্রকৃতি; বছরের পর বছর,যুগের পরে যুগ,জীবনের পরে জীবন…এভাবেই তো কালচক্র ঘুরবে,এক প্রজন্মের পেরিয়ে পরের প্রজন্মের দিকে এগোবে চিরায়ত জীবনগান।
মানুষ তো কুশীলব মাত্র,জীবনভর তাকে তার ভুমিকায় শুধুমাত্র অভিনয়ই করে যেতে হয়, আমরা ভাগ‍্য,ভবিতব‍্য,কর্মফল ইত‍্যাদি ইত্যাদি নামে হয়তো তাদের ডাকি,কিন্তু আদপে তা অভিনয়ই…
হঠাৎ গোঙানির আওয়াজ পেয়ে বাস্তবে ফিরে এলেন নবীনা,পিসিমা কি যেন বলতে চাইছেন!তার ভাবনার
অস্ফুটে স্বীকৃতিই কি দিচ্ছেন মাতৃসমা মানুষটি!বড়ো নিবিড় সঙ্গ সন্ধানে অগ্রজার সংলগ্ন হয়ে রইলেন নবীনা,ফুল-পাতা-ফল যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন,আমাদের আশ্রয় প্রেরণা তো মূলেই…খাতা-পেন কাছে নেই,তবু মনে মনে গুণগুণিয়ে উঠছে কয়টি কথা,কেমন যেন এক ব্যাকুলতা.. 

রোদের বিষন্ন চোখে জমে আছে একাকী বিষাদ
ইমনের আলাপের ছলে ‘ঋ’-কে ছোঁয় কোমল নিষাদ
            অশ্রুবাস্পে থিরবিজুরি কই! 
এমন নিদাঘবেলা, কবেকার সৃজনের তৃষিত নির্জনে,
শ্যামলাঙ্গ মেঘ, অপরুপ সুখ হয়ে ঝরে যদি আনমনে, 
                 সুসময় প্রতীক্ষায় রই! 

(ক্রমশঃ)

Post a Comment

0 Comments