জ্বলদর্চি

সময়, স্থান আর মহাবিশ্ব – স্টিফেন হকিং এর চোখে/ সুমনদীপ পাণ্ডে


সময়, স্থান আর মহাবিশ্ব – স্টিফেন হকিং এর চোখে
                           
সুমনদীপ পাণ্ডে

আজ আমরা বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিং এর লেখা A Brief History of Time: From the Big Bang to Black Holes  (1988) এই বইটির মূল বক্তব্যটি বোঝার  চেষ্টা করবো । তাহলে চল শুরু করা যাক ।       

 
বইটির উদ্দেশ্য

স্টিফেন হকিং এই বইটি লিখেছিলেন একটি বিশেষ কারণে—তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি বই তৈরি করতে, যেখানে জটিল জিনিস যেমন সময়, স্থান, ব্ল্যাক হোল, মহাবিশ্বের শুরু এবং ভবিষ্যৎ, এসব বিষয় সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। বিজ্ঞান যেন শুধু পরীক্ষাগার বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে আটকে না থাকে—তাই তিনি আমাদের মতো কৌতূহলী মনের মানুষদের জন্য এই বইটি লেখেন।

অধ্যায়ভিত্তিক সহজ ব্যাখ্যা

অধ্যায় ১: মহাবিশ্বের ধারণা – কোথা থেকে এল সবকিছু?
স্টিফেন বলেছিলেন, "আমরা যদি বুঝতে পারি মহাবিশ্ব কীভাবে কাজ করে, তাহলে আমরা জানতেও পারব কেন আমরা এখানে আছি।"
প্রাচীনকালে মানুষ ভাবতো পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্র। তারপর এল কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন—তাঁরা প্রমাণ করলেন সূর্য আসলে মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয়, বরং আমরা একটি গ্যালাক্সির অংশ। স্টিফেন দেখালেন, বিগ ব্যাং নামে এক বিশাল বিস্ফোরণ দিয়ে শুরু হয়েছিল সময় ও স্থান—এর আগে কিছুই ছিল না।

অধ্যায় ২: সময় ও স্থান – কি করে এটা সম্ভব?
আমরা ভাবি সময় একটা সরল রেখার মতো—একটা মুহূর্তের পর আরেকটা। কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন দেখালেন সময় আর স্থান একসাথে জড়িত—এই মিশ্র জগৎকে বলে স্পেস-টাইম (space-time)। আর এই স্পেস-টাইম বেঁকে যেতে পারে মহাকর্ষ বা গ্র্যাভিটির কারণে।
স্টিফেন বলেন, সময় শুধু ঘড়ির কাঁটার হিসাব নয়। এটা একটা মাত্রা (dimension), যেভাবে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা থাকে। যেমনটা সিনেমায় টাইম ট্রাভেল দেখায়, বাস্তবেও সময়কে নিয়ে নানা মজার বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন রয়েছে।
অধ্যায় ৩: মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ – বেলুনের মতো ফেঁপে ওঠা
স্টিফেন ব্যাখ্যা করেন, মহাবিশ্ব এখনও বড় হচ্ছে। আমরা এখন যেখানে বসে আছি, সেটাও আসলে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে, কারণ বিগ ব্যাং-এর পর থেকে মহাবিশ্ব থেমে থাকেনি—এখনও প্রসারিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখনো জানার চেষ্টা করছেন, একসময় কি এটা আবার সংকুচিত হয়ে যাবে?

অধ্যায় ৪: ব্ল্যাক হোল – আলোর ফাঁদ
সবচেয়ে রহস্যময় অংশগুলোর একটি হলো ব্ল্যাক হোল। যখন কোনো বিশাল নক্ষত্র মারা যায়, তখন তার ভেতরের মাধ্যাকর্ষণ এত শক্তিশালী হয় যে সে নিজেকে ধ্বংস করে একটি অতিবৃহৎ সংকুচিত বিন্দুতে পরিণত হয়। এই বিন্দুকে ব্ল্যাক হোল বলে।
ব্ল্যাক হোল এতটাই শক্তিশালী হয় যে, আলোও এখান থেকে বের হতে পারে না। আগে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন ব্ল্যাক হোল সবকিছু চুষে নেয়, কিছু ফেরত দেয় না। কিন্তু স্টিফেন দেখালেন, ব্ল্যাক হোল ধীরে ধীরে তাপ বিকিরণ (radiation) করে এবং এক সময় নিজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। একে বলে Hawking Radiation।

অধ্যায় ৫: কোয়ান্টাম ও মহাকর্ষ – দুটি বড় শক্তি
দুইটি বড় তত্ত্ব রয়েছে মহাবিশ্ব বোঝার জন্য:
General Relativity (বিশাল জিনিস যেমন গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি বোঝার জন্য)
Quantum Mechanics (আণবিক ও ক্ষুদ্র কণাগুলোর আচরণ বোঝার জন্য)
কিন্তু এই দুই তত্ত্ব একসাথে কাজ করে না! স্টিফেন চেয়েছিলেন এমন একটি "Theory of Everything" তৈরি করতে, যা দিয়ে সবকিছু একসাথে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়।

অধ্যায় ৬: ভবিষ্যতের দিকে তাকানো – আমরা কোথায় যাচ্ছি?
স্টিফেন মনে করতেন, মানুষ একসময় সময়ের শুরু এবং শেষ, সবকিছু জানতে পারবে।
 তিনি বলেন, একদিন মানুষ হয়তো টাইম ট্রাভেল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), এমনকি  ভবিষ্যৎ মহাবিশ্বের ভবিষ্যদ্বাণী করতেও সক্ষম হবে।

কিন্তু তার জন্য সবচেয়ে দরকার:
প্রশ্ন করা
উত্তর খোঁজা
কখনো হাল না ছাড়া

স্টিফেন হকিং – অদম্য প্রতিভার প্রতীক
স্টিফেন যখন ২১ বছর বয়সে Amyotrophic Lateral Sclerosis (ALS)  নামের এক বিরল রোগে আক্রান্ত হন, ডাক্তাররা বলেছিলেন তিনি মাত্র কয়েক বছর বাঁচবেন। কিন্তু তিনি হার মানেননি। কম্পিউটারের সাহায্যে কথা বলতেন, হুইলচেয়ারে বসে গবেষণা করতেন এবং পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীতে পরিণত হন। তাঁর জীবন বলে—শরীর নয়, মনই সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র।

বইটি থেকে কী শিখলাম?
মহাবিশ্বের ইতিহাস শুধু বড়দের জন্য নয়—তরুণদের জন্যও।
বিজ্ঞান মানে প্রশ্ন করা, উত্তর খোঁজা, ও ভুল থেকে শেখা।
মহাবিশ্ব বিশাল, কিন্তু আমাদের চিন্তা তার চেয়েও বড় হতে পারে।
জটিল জিনিসও সহজভাবে বোঝানো যায়—যদি ইচ্ছা থাকে।
স্টিফেন হকিং আমাদের দেখিয়েছেন: কোনো সীমাবদ্ধতাই সাফল্য থামাতে পারে না।

উপসংহার
A Brief History of Time শুধু একটি বই নয়—এটি একটি দরজা, যা আমাদের নিয়ে যায় অসীম কল্পনার মহাবিশ্বে। তুমি যদি কৌতূহলী হও, যদি প্রশ্ন করতে ভালোবাসো—তবে স্টিফেন হকিং -এর পথেই তুমি হেঁটে চলেছো।
মহাবিশ্ব এখনও অনেক রহস্য ধরে রেখেছে। সেই রহস্যভেদের দায়িত্ব হয়তো একদিন তোমারই হবে।
 
তথ্যসূত্র- A Brief History of Time: From the Big Bang to Black Holes  (1988) by Stephen William Hawking
🍂
ad


Post a Comment

0 Comments