জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা ১৮৩ তম সংখ্যা

ছোটোবেলা ১৮৩ তম সংখ্যা
সম্পাদক -মৌসুমী ঘোষ
চিত্রগ্রাহক - রাকেশ সিংহ দেব

জীবন 
 ভানুপ্রিয়া মাহাত
দ্বাদশ শ্রেণি
জওহর নবোদয় বিদ্যালয়
পশ্চিম মেদিনীপুর


" জীবন " শব্দটা বড়ই কঠিন 
কী জানি এর কোন মানেটা সঠিক।

দাদা বলে , জীবন মানে অ্যাডভেঞ্চার 
করতে হবে অনেক নতুন এনকাউন্টার 
কতই রঙ্গ দেখবি এই দুনিয়ার 
পাবি গতি এই সমাজে পথচলার। 

দাদা আমার গ্রেজুএট , ইংলিশ অনার্স 
কিন্ত আমি এই তো সবে পার করলাম ফোর ক্লাস 
না জানি অ্যাডভেঞ্চার, আর না জানি এনকাউন্টার 
 জীবন মানেটা তাই আমার, হল না স্পষ্ট আর ।

মা বলে জীবন হল তিন স ( 3স)
স্বামী , সন্তান, সংসার 
আবার দিদার মতে জীবন মানে 
নাতিনাতনির খুশি পরিবার 

দাদু ও আমার একমত
 তার গিন্নীর বক্তব্যে 
আয় দেখি মা, বাবা আমায় 
ডাকল সবার শেষে ।

তাই তো রে মা , শব্দটা আনলি বড়ই শক্ত 
আসলে এই জীবন হল আদি থেকে অন্ত
জন্ম থেকে মৃত্যু , শৈশব থেকে বার্ধক্য, 
শক্ত দীর্ঘ এক পথ মোহমায়া আচ্ছন্ন। ।
ইশিকা ভট্টাচার্য
গ্রেড সিক্স, হিল্ক্রেস্ট মুডিল স্কুল ট্রামবুল ইউ এস এ


 কিশোর উপন্যাস-                                                 
ছাতাদাদুর অদ্ভুত  কেরামতি
                   
দিলীপকুমার মিস্ত্রী 
                                                           

মহুলডিহি একটি ছোট্ট  পিছিয়ে পড়া গ্রাম। গ্রামের মধ্যে গোটা তিরিশ ঘর বাদ দিলে, বাকী প্রায় সকলের অবস্থা এককথায় অসচ্ছ্বল।  গ্রামে  কাজকর্মের সুযোগ তেমন নেই। কাজ বলতে তো চাষবাস। তাও  চাষের জমি সকলের কাছে নেই। অনেকে পরের জমি  ভাগে নিয়ে চাষ করে। আবার কেউ কেউ অন‍্যের জমিতে মুনিষ খাটে ভাতুয়া হিসেবে। অর্থাৎ বাবুদের জমি-বাড়িতে সারা বছর কাজ করার বিনিময়ে তাদের একরকম বছরভর  ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা। এখানকার চাষের জমির বেশির ভাগটাই বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। ইতি-উতি ছোট ছোট পাহাড়,জঙ্গল। আর সমতল মানেই বেশিরভাগ অনুর্বর পাথুরে  জমি‌। এমন চাষের অনুপযুক্ত জমিকে স্থানীয় মানুষ বলে বাইদ জমি। আর চাষের জন্য উপযুক্ত জমিকে বলে বহাল। সেচের ব‍্যবস্থা নেই বললেই চলে। তাই প্রতি বছর চাষ-আবাদ তেমন ভাল হয় না। এক বছর ঘরে ভালো ফসল উঠলে গ্রামের লোকজন ভয়ে ভয়ে থাকে এই কথা ভেবে যে পরের বার কপালে নির্ঘাৎ দুর্ভোগ আসছে। এ’কারণে,গ্রামের অনেকেই দূর গাঁয়ে চলে যায় কাজের খোঁজে। তাও তেমন কাজ পাওয়া যায় না।  তাই এই গাঁয়ের একটি বড় অংশের মানুষ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হয়। 
🍂
ad

         এরমধ্যে মহুলডিহি গ্রামের মাঝিপাড়ার অবস্থাটা সবচাইতে খারাপ। এদের কা’রও নিজের জমিজমা বলতে কিচ্ছু নেই। গ্রামের শেষ প্রান্তে,বাঘা পাহাড়ের পাদদেশে এদের ঘর-দোর। ঘর-দোরের অবস্থাও তেমনতর। ঝিটে-বেড়ার দেয়াল আর উপরে চাল বলতে কাশবন,ঝোপঝাড় কেটে চাপান দেওয়া। সহজ ভাষায় তাকে কোনরকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই বলাই ভালো। জঙ্গলের শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে,ঝাটি এ’গ্রামে ও’গ্রামে মানুষের দোরে দোরে ঘুরে বেচে তাদের কারও কারও সামান্য দু-চার টাকা আয় হয়। আর চাষের মরশুমে,গ্রামে বাবুদের জমিতে মজুর হিসেবে কাজ করে এদের সবাই। এভাবে দিনান্তে একবেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় তাদের কাছে অনেক পাওয়া। অমাবস্যা,পূর্ণিমা বা একাদশী উপলক্ষে নয়,মাঝেমধ্যে উপোষ থাকা তাদের কাছে যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
           তবু চারদিকে মহুলডিহি গাঁয়ের খুব নামডাক আছে শুধুমাত্র ওই মাঝিপাড়ার জন্য। কারণ ওই পাড়ার একজন মানুষও লেখাপড়া জানেনা। অতিকষ্টে শুধুমাত্র নিজের নামটুকু লিখতে পারবে,এমন একজনও  ও-পাড়ায় নেই। ছোট থেকে বড়,সবাই নীরক্ষর। অথচ মহুলডিহি  গ্রামে  ইসকুল আছে। গ্রামের অন্য সব পাড়ার  ছেলেমেয়েরা সেই  ইসকুলে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। কিন্তু মাঝিপাড়ার কেউ সেখানে পড়তে যায় না।   পঞ্চায়েতের লোকজন ওদের ঘরে ঘরে গিয়ে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে,শিশুদের ইসকুলে পাঠাতে।  কিন্তু ওদের সব চেষ্টাই বিফলে গেছে। মাঝিপাড়ার কোনো বাবা-মা তাদের বাচ্চাদের ইসকুলে পড়তে পাঠাতে চায় না।  কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,দুপুরে মিড-ডে-মিল খাওয়ার সময় মাঝিপাড়ার সমস্ত বাচ্চারা   যথারীতি ইসকুলে চলে যায়। দুপুরবেলা অভুক্ত বাচ্চাদের কীভাবে খাবার খেতে না দিয়ে ফিরিয়ে দিতে পারে মাষ্টারমশাই, দিদিমণিরা ? তাই যেভাবেই হোক,তাঁদের সে ব্যবস্থা করতে হয় নিজেদেরই চেষ্টায়। বাচ্চাগুলোকে দেখলে,তাঁদের সত্যিই খুব দুঃখ হয়,কষ্ট হয়।
         সম্প্রতি হীরাবিল  ব্লকের নতুন বিডিও হয়ে এসেছেন একজন মহিলা। তাঁর বয়সটা খুব কম,অবিবাহিতা। কিন্তু তাঁর আচার-ব‍্যবহারে,অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ব্লকের সমস্ত মানুষের কাছে ভীষণ আপনজন হয় উঠেছেন। সবাই তাদের ব্লকের বিডিও দিদিমণি বলতে অজ্ঞান। দিদিমণিও শুধু অফিসে বসে দায়িত্ব পালন করেন না। দিনরাত ব্লকের গ্রামে-গ্রামে,দোরে-দোরে ঘুরে বেড়ান। সকলের দুঃখ-কষ্টের কথা মন দিয়ে শুনে, সাধ‍্যমতো সাহায্য করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তবে অন্য গ্রামের তুলনায় তাঁর একটু  বেশি যাতায়াত মহুলডিহি গ্রামে। আর মহুলডিহি গেলে,মাজিপাড়া তো তারমধ্যে থাকেই। মাঝিপাড়ার কচিকাঁচাদের প্রতি তাঁর টান যেন একটু বেশি। ওরাও দিদিমণিকে খুব ভালোবাসে অন্তর থেকে। সবাই যে তাঁকে আপনজন মনে করে। 
                                                                     ।। দুই ।।
         ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি। না শীত,না গরম। এককথায়,খুব মনোরম পরিবেশ। চারপাশে এখন পলাশ ফুলের উৎসব শুরু হয়েছে। অপরূপ সাজে সেজেছে রুখাশুখা গ্রামের প্রকৃতি। আর তাকে নিয়েই আনন্দে মেতে রয়েছে গ্রামের মানুষগুলো। এসময় তাদের পেটে খিদে থাকলেও, সকাল সন্ধে মুখে চওড়া হাসি। 
      এক রোববারের বিকেল। আজ সরকারি অফিস ছুটি। অফিসের সবাই যে যার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত।  কিন্তু  বিডিও দিদিমণির  ছুটি নেই। তিনি হঠাৎ এসে হাজির হলেন মহুলডিহি গ্রামের কুমোরপাড়ায়। এই  কুমোরপাড়ার পাশেই রয়েছে মহুলডিহি গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। বিডিও দিদিমণি সেখানে এসে ইসকুল মাঠের একপ্রান্তে থাকা শান বাঁধানো প্রকাণ্ড বটগাছের তলায় বসে পড়লেন সঙ্গীদের নিয়ে। তাঁর সঙ্গে এসেছেন অফিসের দুই প্রবীণ সহকর্মী,তরুণ পাণ্ডে আর বিমলা সর্দার। আর তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত তরুণ গাড়ির চালক অভয়চরণ মাহাত। দিদিমণি সেখানে বসে অভয়চরণ মারফত খবর পাঠালেন,একটি বাদে গ্রামের সাতটি পাড়ার মোড়লদের কাছে। খবর পেয়ে তারাও পা চালিয়ে এসে হাজির হল তাদের প্রিয় দিদিমণির সামনে।
            দিদিমণি  গ্রামের  সাতটি পাড়ার মোড়লদের নিয়ে বসলেন গল্প করতে।  শুধুমাত্র মাঝিপাড়ার মোড়ল নেই। উপস্থিত সবাই এমনটা দেখে একটু অবাক হল। কিন্তু তারা কেউ দিদিমণির কাছে সেকথা প্রকাশ করল না। সাহসের অভাব বলেই হয়তো তারা দিদিমণির কাছে এ’বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতে পারল না।  অথচ  দিদিমণি সবাইকে অবাক করে গল্পে গল্পে তুললেন ওই মাঝিপাড়ার ছেলেমেয়েদের কথা। সবাইকে বোঝালেন, ওই পাড়ার  ছেলেমেয়েদের জন্য  ভবিষ্যতে মহুলডিহি গ্রামের এই সাতটি পাড়ায় কি কি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এখানকার ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তার বিষয়গুলো কেমন ধরনের হতে পারে,এসব সম্পর্কে নানান কথা।  অনেক আলোচনার পর দিদিমণি সকলের উদ্দেশ্যে  বললেন,
        মাঝিপাড়ার ছেলেমেয়েদের যেভাবেই হোক একটু আধটু লেখাপড়া শেখাতে হবে। নিদেনপক্ষে, ওদের স্বাক্ষর করে তোলার জন্য এই সাতটি গ্রামের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে,কিছুটা দায়িত্ব নিতে হবে।
   দিদিমণির মুখে এমন কথা শুনে সবাই চুপটি করে বসে রইল। কারও মুখে একটিও রা নেই।  সবাই যেন এই মুহূর্তে এক-একটি পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছে। দিদিমণি সবাইকে এভাবে দেখে একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। এমন সময়,বামুনপাড়ার মোড়ল রূপচাঁদ মুখুজ‍্যে আমতা আমতা করে বলতে শুরু করল।
     দিদিমণি,ই কাজড অত সহজ লয় গ,বড় কঠিন কাজ বট্যে। মাঝিপাড়া আমদের গেরামের এগবারে শেষ‍্যে বাঘা পাহাড়ের গায়‍্যে। অরা গেরামের কারঅ সঙ্গে তেমন ম‍্যালাম‍্যাশা করে লায়। গেরামের মানুষঅ অদের ঘরকে কখনঅ যায় নায়। অরা জঙ্গলিদের মত থাক‍্যে। উআদের ল‍্যাখাপড়া শ‍্যাখানর কাজডা আমদের দি হবেক নায় গ। সরকার ত কত রকমভাবে চ‍্যাষ্টা করে যাচ্ছ‍্যে দশ-বিশ বছর ধর‍্যে। কিছু কি হচ্ছ‍্যে বল? উ জঙ্গলিদের কিছুতেই মানুষ করা যাবেক লায়। আর এগডা কথা তুমাকে আমার বলবার আছ‍্যে,সব্বার লেখাপড়াটি শ‍্যাখার এমন কী দরকারটি পড়ল বট্যে? সবাই লেখাপড়া শিখ‍্যে পণ্ডিত হবেক, ত গেরামে মজুরডা, বাগালডা কে খাটবেক বট্যে? এ্যরপর গেরামে আর ভাতুয়া লকটি খুঁজে পাওয়া যাবেক? তখন আমদের চাষবাসের কী হব‍্যে গ?’
      রূপচাঁদ মুখুজ‍্যে লেখাপড়া জানা মানুষ। আর্থিকভাবেও গ্রামের মধ্যে তার অবস্থা সবার চেয়ে ভালো। বিস্তর জমিজমা,দু-তিনটি পুকুর,ফলের বাগান আছে তার। পাশাপাশি যজমানিও করে। তাই গ্রামের মানুষের কাছে তার একটা আলাদা সম্মানের জায়গা রয়েছে। তাছাড়া,গ্রামের মানুষজন এমনিতেই বামুনদের একটু বেশি খাতির করে। 
     মুখুজ‍্যে বামুনের মুখে এমন কথা শুনে বিডিও দিদিমণি খুব হতাশ হয়ে পড়লেন। তিনি আর কা’কে কী জিঙ্গেস করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন,তাহলে, অযথা এখানে বসে সময় নষ্ট করে কাজ নেই। এদিকে সন্ধেও তো গড়িয়েছে। দিদিমণি উঠতে যাচ্ছেন, এমন সময় কুমোরপাড়ার মোড়লের সঙ্গে আসা একজন বুড়োলোক উঠে দাঁড়াল। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই হলে কী হবে,বুড়ো এখনও অনেক যুবকের চেয়ে চনমনে। তার মনে সবসময় ফুর্তি ঘুরছে ফিরছে। আট গ্রামের ছোটদের কাছে সে  ছাতাদাদু নামে পরিচিত। বড়দের কাছে সে হল ছাতাবুড়ো। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা,তার প্রধান সঙ্গী একটি লম্বা-ডাঁটের ছাতা। তাই তাকে সবাই এই নামেই চেনে। তার আসল নাম গুণধর পাল। ছোট থেকে বড়ো,সবাই তাকে খুব  ভালোবাসে। সে  একগাল হেসে, দিদিমণির মুখে তাকিয়ে বলল, 
          ই কাজড আর কত কঠিন কাজড হব‍্যে গ!  দিদিমণি, তুমি আজ নিশ্চিন্তে ঘরকে ফিরে যেত‍্যে পার। অদের নিজের নামটুকু ল‍্যাখা শ‍্যাখান, উ আমি ঠিক পারব। তবে হঁ,অ্যার  বেশি মাষ্টারীটি কিন্তু আমাক দিয়ে হবেক লায়। কথাটি  তমাকে এখ‍্যনই বল‍্যে দিলম।
              বুড়োর মুখে এমন কথা শুনে বিডিও দিদিমণি যারপরনাই খুশি। সে নিজের আসন থেকে উঠে,এগিয়ে গিয়ে বুড়োর হাত দুটো ধরে, ছলছল চোখে বলল, 
           হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ, আপনি পারবেন। আমার মন বলছে,আপনি আরও অনেক কিছু করতে পারবেন। শুধু মহুলডিহির এই আটটি পাড়া নয়,আপনার জন্য একদিন হীরাবিল ব্লকের সঙ্গে গোটা দেশের মানুষ গর্ববোধ করবে। আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করা উচিত হবে না। আপনার পা ছুঁয়ে আমার প্রণাম করা উচিত।
                 এই বলে, বিডিও দিদিমণি নীচু হয়ে ছাতাদাদুর পায়ে হাত দিতে উদ্দ‍্যত হল। বুড়ো তাঁকে কোনভাবেই নিরস্ত করতে পারল না। অবশেষে বুড়ো দিদিমণির  মাথায় তার ডান হাতটি রেখে বলল,
          মা গ, আম‍্যার মা’টি মর‍্যে গ‍্যাল ছুটুবেলায়। তার কথ‍্যাটি তুমাক দেখ‍্যে আজ বড় মনে পড়ছ‍্যে ! মিত্যুর আগ-দিন পযন্ত‍্য আমি তমার সঙ্গে সব কাজ‍্যে লড়াই করে যাব‍্য। তুমি কন বিডিও লয় গ,তুমি আমদের মহুলডিহি গেরামের স্বয়ং মা লক্ষীটি হএ এসেছ‍্য। আমদের ঘরের লক্ষ্ণীটি বট্যে।
         ছাতাবুড়োর মুখে এমন কথা শুনে বামুনপাড়ার মোড়ল রূপচাঁদ মুখুজ‍্যে তো হতবাক। উপস্থিত অন‍্যান‍্য পাড়ার মোড়লরাও এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তারা এমন একটি দৃশ্য স্বচোক্ষে দেখবে,তা কখন স্বপ্নেও ভাবেনি। সকলে খুশি হয়ে হাতজোড় করে। তারপর,সেই হাত নিজেদের কপালে ঠেকিয়ে ছাতাবুড়ো এবং বিডিও দিদিমণিকে নমস্কার করে। এমন পরিস্থিতিতে,মুখুজ‍্যে মোড়লও তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারল না। 
     
                               ।। তিন ।।
         ছাতাদাদুর ঘর মহুলডিহি গ্রামের একেবারে মাঝখানে কুমোরপাড়ায়। লেখাপড়া সে তেমন বিশেষ কিছু জানেনা। তবে ছেলেবেলায়,পাঠশালায় গিয়ে আদর্শলিপি ও ধারাপাত বই দু’টি শেষ করেছিল।  সে আগে খুব ভালো ঠাকুর গড়তে পারত। এখন বয়সের কারণে সেসব কাজ তার ছেলে-ছেলে-বৌ, নাতিরা করে। ঠাকুর গড়ার কাজটা অবশ্য ছাতাদাদুর পরিবারে সাত-পুরুষ ধরে চলে আসছে। কিন্তু আট গ্রামে তার জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণটি অন্য। দাদু সদাই মিষ্টভাষী, রসিক এবং মহা-গল্পবাজ মানুষ। গ্রামের ছোটদের সঙ্গে তার খুব ভাব,দেখলে মনে হবে,দাদু যেন তাদের সকলের গোল্লাছুটের বন্ধু। আসলে, ছাতাদাদু রোজই গ্রামের পথে ঘুরে ঘুরে তাদের সঙ্গে বসে মজার মজার গল্প করে। আর শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, ছাতা ছাড়া সে একপাও নড়ে না। ছাতা যেন তার সর্বক্ষণের সাথী। তাই সবাই তাকে চেনে-ডাকে, ছাতাদাদু নামে। ছাতাদাদু হচ্ছে আট পাড়ার ছোটদের প্রধান বন্ধু। ছাতাদাদুকে তারা মনেপ্রাণে ভালোবাসে। 
          পরদিন দুপুর গড়াতে না গড়াতেই ছাতাদাদু সটান মাঝিপাড়ায় গিয়ে হাজির হল। তারপর সব বাচ্চাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে সে গল্প করতে বসল একটা বড় শিমুল গাছের তলায়। কিছুক্ষণ গল্প হল,মানুষের জীবনে গাছের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। সামনে দোল উৎসব, সেসব নিয়েও অনেক কথা হল।  তারপর সে মুখ চেপে, খুব আস্তে আস্তে ছোট্ট বন্ধুদের বলল,
           আজগে আমি তমাদের আমার মনের এগটা গপন কথা বইলব‍্য। মন দিয়ে তমাদের সব্বাইকে কথাটি  শুনতে হবেক। আমি তমাদের মাটির জিনিস,মানে পুতুল বানাঅ শ‍্যাখাতে চাই। কে কে শিখতে চাঅ, আমকে হাত তুলে দেখাঅ ত এগবারডি।
            একটুও দেরী না করে,বন্ধুরা সবাই একসাথে তাদের দু’হাত উপরে তুলে ধরল। সেই সঙ্গে তারা  বড়-গলায় বলল, 
           আমরা সব্বাই শিখতে চাই,আমরা সব্বাই তুমার কথায় রাজী আছ‍্যি গ দাদু।
        বাচ্চাদের আগ্রহ দেখে ছাতাদাদু খুব খুশি হল। সে উৎসাহের সঙ্গে আরও বলল, 
           তাহলে আর দেরী করা ক‍্যান। কাল থেক‍্যেই শুরু হয়ে যাগ আমদের শুভযাত্রাডি। আমি কাল সক্কালে,ঠিক ন’টার সমায় এখ‍্যানে চল‍্যে আসব। তমরা সব্বাই চল‍্যে আসবে। সকালের দিগে বললাম ক‍্যান জান ?  মাটি ঘাঁটাঘাঁটি ত; তাই। ঘরে গিয়ে সবাই চানডি করে লিলেই, সব সাফ-সুতর। কী, ঠিক বলছি ত বট‍্যে ?
          সবাই আবার ঘাড় নেড়ে তাদের সম্মতির কথা জানিয়ে দিল প্রিয় ছাতাদাদুকে। 
         পরদিন সকাল ঠিক ন’টায় ছাতাদাদুর ছোট্ট বন্ধুরা সবাই চলে এল শিমুলতলায়। দাদু হাজির তারও একটু আগে। তার কথা মতো সবাই সঙ্গে করে এনেছে ছোটো কোদাল, বালতি, মগ ইত্যাদি। তুমুল উৎসাহে শুরু হয়ে গেল মাটির জিনিস গড়ার প্রাথমিক কাজ। অর্থাৎ মাটি খুঁড়ে, তাকে জলে ভিজিয়ে কাদা তৈরির কাজ। 
       দাদু নিজে হাত লাগিয়ে তাদের  শেখাল,পুতুল গড়ার জন্য কীভাবে মাটি তৈরি  করতে হয় তেমন কৌশল। মাটি তৈরি হয়েও গেল কিছু সময়ের মধ্যে। এরপর দাদুর পরামর্শ মতো এক-একজন এক-একটি জিনিস গড়তে শুরু করল। দেখতে দেখতে,প্রথম দিনেই তারা গড়ে ফেলল কয়েকটি মাটির জিনিস। 
              তিলকা গড়ল একটি ক্রিকেট খেলার বল। মালতি গড়ল একটি আম। লছমন গড়ল একটি আপেল। পলাশ গড়ল একটি পেঁপে। মনসা গড়ল একটি সুন্দর বিড়ালের মুখ। আর পুষ্পা গড়ে ফেলল একটা আস্ত প‍্যাঁচা। অন্য বন্ধুরা সবাই তাদের পাশে বসে দেখল,প্রয়োজনে কিছু সাহায্যও করল। শেষে দাদু যখন হাসি-হাসি মুখ করে বলল, 
        সবগুলা পুতুলই খুব  সুন্দর হয়‍্যেছে, যাক্কে বল‍্যে চমৎকার।
         দাদুর মুখে এমন কথা শুনে কারিগরদের চোখে-মুখে যেন খুশির ফোয়ারা নেমে এল।
           এবার ছাতাদাদু্র ছোট্ট বন্ধুদের ঘরে ফেরার পালা। যাবার সময় দাদু তাদের জনে জনে বলে দিল,
            অ্যাগুলাকে খুব সাবধানে যে-যার ঘরকে লিয়ে যাঅ। দু-চারদিন রোদ খাঅয়াতে হব‍্যে ইগুলাকে, শুখাতে হবেক ত। তারপর,আমরা আব্বার অ্যাখানে বসে অ্যাগুলাকে রং করব। ভাবছ,সেটা কি করে হব‍্যে,তাইনা বট‍্যে ?  অটা লিয়ে অত চিন্তার কিছু নাই। খুব সহজ কাজডি বট‍্যে ত। অ আমি তমাদের শিখাই দিব ছু-মন্তর যাদুটির সাহায‍্য লিয়ে। তখন দ‍্যাইখবে,পুতুলগুলাকে আরঅ কত সুন্দর লাইগছে বটে।
          এভাবেই মাজিপাড়ার শিমুলতলায় বসে ছোটরা মাটির নানান রকমের জিনিস তৈরি করতে শিখে গেল মাস কয়েকের মধ্যেই। তারমধ্যে আম আপেল বাঘ হাতি হাঁড়ি কলসি কড়াই ঘর উট পাখি রথ হরিণ পেঁচা বর-বউ-  তাদের কাছে খুব পছন্দসই হল। সকলের মনে হল,তারা আরও অনেক কিছু গড়তে পারবে, ছাতাদাদুর একটু সাহায্য পেলেই। 

                                                                    
।। চার ।।
 দেখতে দেখতে এসে গেল গ্রামে রথের মেলা। আর বারো দিন পর প্রথম রথ। প্রথম রথযাত্রা থেকে ফিরতি,অর্থাৎ উল্টো রথযাত্রা পর্যন্ত মহুলডিহি গ্রামে রথের মেলা বসে ইসকুল মাঠে। ছোটখাটো মেলা। কিন্তু তাতে কি হয়েছে,পাশাপাশি গ্রাম চৈতন‍্যডিহি,পলাশডাঙা,বৈকন্ঠপুর,কিষ্টপুর,গৌরাঙ্গডি,রাজডাঙা তালবেড়‍্যা থেকেও অনেক লোকজন আসে এই মেলায়। বহু বছরের পুরোনো মেলা। এই মেলার একটা ঐতিহ্য আছে বৈকি! একদিন দাদু তার ছোট্ট বন্ধুদের সবাইকে ডেকে বলল, 
             ‘ভাইবছ‍্যি,তমাদের নিজেদের হাতে গড়া পুতুলগুলা অ্যাবার রথের মেলায় লিয়ে গিয়ে বিকরি করার চ্যাপ্টা করা যায়। তমরাই মেলার এগডা জায়গায় চট পেত‍্যে, পুতুল লিয়ে বইসব‍্যে। কী,সব্বাই অবাক হয়‍্যে আমার মুখে কী খুঁইছ‍্য ? অত কিছু ভাইবতে যাবার দরকার নাই। অযথ‍্যা এত‍্যসব লিয়ে ক‍্যান বেশি  চিন্তাটি করতে যাইচ্ছ‍্য? আরে বাব্বা,আমি ত থাগছি তমাদের সঙ্গে। আর পুতুল বিকরি করার পর হাতে যা আইসবেক, সেই পয়সায় তমাদের নাগরদলা চড়া, সার্কাস দেখা,আর পাপড় ভাজা,জিলাপি খাবাটাও হয়‍্যে যাবেক ভালভাবে।
            দাদুর কথা শুনে সবাই আহ্লাদে আটখানা। সবাই তাদের মুষ্ঠিবদ্ধ এক হাত উপরে ছুড়ে দিয়ে একসাথে চিৎকার করে উঠল, 
               ইয়া হু। ইয়া ছাতাদাদু্,ইয়া মারান গুরু।
       এবারের রথের মেলায় মহুলডিহি গ্রামের মাঝিপাড়ার বাচ্চাদের নিজের হাতে তৈরি মাটির পুতুল ভালো বিক্রি-বাটা হল। সেই টাকা-পয়সায় সবাই মেলায় সাতদিন ধরে খুব আনন্দ করল। এত আনন্দ তারা জীবনে আগে কখনও করেনি। যে কারণে তাদের বাবা-মা’ও খুব খুশি। সবাই ছাতাবুড়োর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই খবর দ্রুত পৌঁছে গেল বিডিও দিদিমণির কাছে। শুধু দিদিমণি কেন,খবর ঝড়ের বেগে  ছড়িয়ে পড়ল মহুলডিহি ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর গ্রামে গঞ্জে শহরে,সরকারের নানান দপ্তরে। 
             রথের মেলার ক’দিন পর বৈকন্ঠপুর গ্রামে বসবে ঝুলন মেলা। দাদু তার জন্য বন্ধুদের সবাইকে নিয়ে জোরদার প্রস্তুতি শুরু করে দিল। এবার সে ছোট্ট বন্ধুদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল,
           অ্যাবার আমদের কাজগুলা আরঅ সুন্দর করে  করতে হব‍্যে। সেই সঙ্গে চ‍্যাষ্টা করতে হব‍্যে,মেলার খরচ থেকে কিছু পয়সা বাঁচিয়ে রাখার জন্য। সেই পয়সায় সক্কলের জন্য এগডি করে শীতের সয়েটার কিনতে  হব‍্যে। শুধু ঝুলন মেলা থেকে বাচান সামান্য পয়সায় ত তা হব‍্যে লায়।  তব‍্যে আমরা আবার পূজার সমায় যে মেলাগুলা হব‍্যে,সেখান থেকেঅ কিছ‍্যুটা জগাড় করে লিতে পারব।
              দাদুর এমন পরামর্শ শুনে বন্ধুরা সবাই আজ  ভীষণ ভীষণ খুশি। খুশিতে তাদের চোখ মুখ হঠাৎ করে রঙিন হয়ে উঠল। ছাতাদাদু্ও আজ তার ছোট্ট বন্ধুদের মুখগুলো দেখে আনন্দে আত্মহারা।
          বৈকন্ঠপুর  ঝুলনের মেলায় ছাতাদাদু্র বন্ধুদের হাতে গড়া পুতুল বিক্রি হল ঝপাঝপ। এবার দামও একটু বেশি পাওয়া গেল। কারণ এবারের পুতুলগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়েছে। মেলায় হাত-খরচ করার পরও কিছু বাড়তি টাকা বন্ধুদের জন্য দাদুর হাতে রয়ে গেল। তাই সবার মধ্যে পুতুল তৈরির উৎসাহ আগের চেয়ে দ্বিগুণ মাত্রায় বেড়ে গেল। ছাতাদাদুরও খুশি রাখার জায়গা বেড়ে গেছে অনেকখানি।  সে মনে মনে বিডিও দিদিমণির কাছে ঋণ স্বীকার করে,তাঁকে অন্তর থেকে অনেক শ্রদ্ধা আর  ভালোবাসা জানাল। 
                                    
 ।। পাঁচ ।। 
এদিকে বেশ কয়েক মাস পেরিয়ে যাবার পরেও মাঝিপাড়ার ছেলেমেয়েরা ইসকুলে পড়তে যাচ্ছে না। কিন্তু দুপুরবেলা খাওয়ার সময় ওরা সবাই দলবেঁধে স্কুলে চলে যায়,আবার খাওয়া শেষ হলেই স্কুল ছেড়ে দ্রুত হাওয়া। এ’নিয়ে সকলেই চিন্তিত। একটু বেশি চিন্তিত জেলার শিক্ষা দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা। একদিন দুপুরের পর,জেলা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের এক কর্তা হঠাৎ এসে হাজির হলেন হীরাবিল বিডিও অফিসে। তিনি সরাসরি বিডিও দিদিমণির ঘরে ঢুকে কুশল বিনিময়ের পর মহুলডিহি মাঝিপাড়ার  ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া সম্পর্কে খোঁজ খবর জানতে চাইলেন। 
     দিদিমণি তাঁকে নানাভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন বটে,কিন্তু তিনি কিছুতেই দিদিমণির কথায় ভরসা রাখতে পারলেন না। তিনি দিদিমণিকে বারবার অন্য কিছু ভাবতে অনুরোধ করলেন। একসময়,তিনি একটু বিরক্তিমাখা মুখে বিডিও দিদিমণিকে বললেন,আপনার ঐ কি যেন ছাতাবুড়ো না ছাতাদাদু, ওসব লোককে দিয়ে এমন কঠিন কাজ শেষ করা কোনদিনই সম্ভবপর হবে না। আপনি অযথা সময় অপচয় করছেন। তারচেয়ে আপনি বরং অন্য কাউকে এই দায়িত্ব দিয়ে দেখুন কিছু করা যায় কিনা ! আসলে সামনের বছর, মাঝামাঝি সময়ে আমার চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার কথা। তার আগে এই কাজটা শেষ করা আমার কাছে একটা বিরাট চ‍্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আর এক্সটেনশন নিতে চাইছি না। কিন্তু সরকার থেকে আরও দু’বছর এক্সটেনশন দিতে চাইছে। না,আমি আর এতো চাপ নিতে পারছি না। প্লিজ,আপনি--!’
       উপস্থিত শিক্ষা কর্তার মুখে এমন কথা শুনে বিডিও দিদিমণি খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। কিন্তু সেটা উপস্থিত অতিথিকে বুঝতে না দিয়ে,মৃদু হেসে বললেন,
        অন‍্য কাউকে দায়িত্ব তো যখন খুশি দেওয়া যায়। কিন্তু তিনিও যে সঠিকভাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন,তার কী কোনো  নিশ্চয়তা আছে? প্রায় বিশ বছর ধরে আপনারা সবাই তো অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চেষ্টা করলেন। অনেককেই তো এই কাজে লাগালেন। কিন্তু তাঁদের একজনও কাজের কাজ কিছু করে দেখাতে পেরেছেন কী ? এককথায়,সবাই ব‍্যর্থ। এখন মাত্র ছ’টা মাস যাওয়ার আগেই আপনি কেন এতোটা হতাশ হয়ে পড়লেন? একটু ধৈর্য্য ধরুন, আমার উপর আর একটু আস্থা-বিশ্বাস রাখুন;আমি বলছি, আপনার মুখরক্ষা হবে। ও,আর একটা কথা,আপনি ছাতাদাদুকে কোনদিন নিজের চোখে দেখেছেন? না,দেখেননি। একটু বসুন। আমি তাকে আনতে লোক পাঠিয়েছি। চা আসছে। আপনার চা খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই সে এসে পড়বে। মানুষটাকে একবার স্বচোক্ষে দেখে যান। আমার মন বলছে, ভবিষ‍্যতের জন্য ভালোই হবে।
    শিক্ষা কর্তার চা খাওয়া শেষ হতে না হতেই,বিডিও দিদিমণির ঘরে এসে ঢুকল ছাতাদাদু। হাতে তার সেই লম্বা ডাঁটের ছাতা। তাকে একপলক দেখেই দিদিমণির মন যেন আনন্দে একেবারে নেচে উঠল। তিনি একগাল হেসে সবিনয়ে বললেন,আসুন আসুন। বসুন ঐ চেয়ারটায়। বৃদ্ধ মানুষ আপনি,আমার পিতৃতুল্য। এই ভরদুপুরে, হঠাৎ লোক পাঠিয়ে আপনাকে অসময়ে এখানে ডেকে পাঠানোর জন্য আমি সত্যিই খুব দুঃখিত,লজ্জিত। কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। ইনি হলেন অলোকরঞ্জনবাবু, অলোকরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। আমাদের জেলার শিক্ষা দপ্তরের বড়ো-কর্তা। হঠাৎই এসে পড়েছেন এখানে। তাই আমি ভাবলাম,আপনার সঙ্গে ওঁনার যদি একবার সরাসরি দেখা হয়,কথা হয়,তো ভালোই হয়। তাই আপনাকে একটু কষ্ট দিলাম।
    এরমধ্যেই ছাতাদাদু্র জন্য চা এসে গিয়েছে। দাদু চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে উপস্থিত শিক্ষা-কর্তাকে বারবার আড়চোখে দেখছে। কর্তাও ছাতাবুড়োকে ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর,সরাসরি ছাতাবুড়োকে প্রশ্ন করলেন,কোন স্কুল থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন,কত সালে মনে আছে?
     কর্তার প্রশ্ন শুনে ছাতাবুড়ো তো অবাক। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সে দু’চোখ কপালে তুলে ভাবতে লাগল,এখন কীভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়। অনেক ভেবে সে সরল মনে উত্তর দিল, 
         সে ত অনেক বছ‍্যর হয়‍্যে গেল বট‍্যে। পেরায় ষাট বছর ত হব‍্যেই হবেক। 
     ছাতাবুড়োর মুখে এমন উত্তর শুনে,শিক্ষা-অধিকর্তা নিজের দু’চোখে যেন সরষেফুল দেখতে লাগলেন। তিনি বড় বড় চোখ করে, বিডিও দিদিমণির মুখে তাকিয়ে রয়েছেন। দিদিমণি নিজের মুখে হাত চেপে ধরে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কিছুতেই হাসি আটকে রাখতে পারছেন না। এরপর, দিদিমণি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলতে শুরু করলেন। 
    অলোকরঞ্জনবাবু,হ‍্যাঁ,উনি ঠিকই বলেছেন। আসলে উনি প্রাইমারি স্কুল অবধি লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারপর তো স্কুল জীবন থেকে ওনার একপ্রকার অবসরই বলা যায়। আর হ‍্যাঁ, উনি কখনও কোনো স্কুলে শিক্ষকতা করেননি। তাই অবসর ওই স্কুল ছাড়ার দিন থেকেই। আপনি ভেবে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন,তাহলে এমন একজন মানুষের উপর আমি কোন সাহসে এতো বড়ো কঠিন একটি কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারলাম। কারণ,আমার বিশ্বাস,উনি এই কাজটা করতে পারবেন এবং এই কারণে,সত্যি সত্যিই আমাদের সবাইকে ভীষণ অবাক হতে হবে একদিন। প্রকৃত অর্থে,একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়া খুব কঠিন কাজ। সেটা সবার দ্বারা হয়না। অনেক ডিগ্রি অর্জন করলেও সবাই হতে পারেন না। আমার বিশ্বাস,উনি সেই শিক্ষককতার  কাজটা খেলার ছলে,নিষ্ঠার সঙ্গে শেষ করবেন। আমরা সবাই আর কিছুদিন অপেক্ষা করতেই পারি এরজন্য।
     শিক্ষা-অধিকর্তা জীবনে কখনও এমন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি। তিনি ছাতাবুড়োর চোখে চোখ রেখে আবার প্রশ্ন করলেন, 
          আপনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশি লেখাপড়া শেখেননি,কোনো ইসকুলে কখনও মাষ্টারী করেননি; তবু আপনি কোন সাহসে জঙ্গলি মাঝিপাড়ার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন?  
     ছাতাবুড়ো তার হাতের লম্বা হাতলওয়ালা ছাতাটি চেয়ারে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখল। তারপর,তার কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে আসা ব‍্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটি একটি করে মাটির পুতুলগুলো বের করতে লাগল। সবগুলোই কাগজে মুড়ে ঢেকে রাখা ছিল। সবগুলোই তার ছোট্ট বন্ধুদের হাতে গড়া পুতুল। তারমধ্যে রয়েছে কেউটে সাপ, পেঁচা,ইঁদুর,কাঠবিড়ালি,পাখি,বর-বউ,বাঘ,হরিণ; আরও কতকী। 
        ছাতাবুড়ো প্রথমেই মাটির কেউটে সাপটি মোড়ক খুলে শিক্ষাকর্তার সামনে এগিয়ে ধরল। বুড়োর হাতে কেউটে সাপ দেখে কর্তা ভয়ে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, 
       একী ছেলেমানুষী করছেন? আপনি সাপ ধরে বেড়ান? আপনি সাপুড়ে,ওঝা; না মাষ্টার? কেউটে সাপ সঙ্গে নিয়ে আপনি সরকারি অফিসে এসেছেন? জানেন,এ’জন্য আপনার কী কঠিন শাস্তি হতে পারে?
           ছাতাবুড়ো হাসতে হাসতে বলতে লাগল, 
        অত ডর কইরছেন কেনে বাবু ? ইটা মাটির পুতুলডি বট‍্যে। আমি সাপ লিয়ে ঘুরতে যাব ক‍্যানে,আমি কী অঝা? সাপ আমাকে কাইটব‍্যে লায়? বসেন বসেন,ভয়ের কিছ‍্যু লাই।
         কর্তা আবার চেয়ারে বসে পড়লেন। এরপর ছাতাবুড়ো একটি একটি করে মোড়ক খুলে পুতুলগুলো শিক্ষা-কর্তার হাতে তুলে দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলল, 
       সাহেব,যারা মাতর ছ’মাসের মধ্যে অমন সুন্দর সুন্দর মাটির পুতুল গইড়তে পার‍্যে,তারা কনদিন লিজের নামডি লিখত‍্যে পাইরবেক লায়,তাই কখনঅ হয় বট‍্যে? আপনি আর কয়েগডা মাস সমায় আমাকে দ‍্যান,আমি অদের মধ্যে থেক‍্যে নীরক্ষরতা দূর কইরবই করব। উয়াদের সব্বাইকে আমি লিজের নামডি লিখতে শেখাবই শেখাব। আপনি দ‍্যাখবেন,এগদিন উয়ারা সব্বাই ব‍্যাগটি পিঠে চাপিয়ে ইসকুল যাচ্ছ‍্যে বট‍্যে। তখ‍্যন আপনেদের আর কিছ‍্যুডি বলতে হব‍্যে লায় উয়াদেরকে। আপনে নিশ্চিন্ত‍্যে থাকতে পারেন সাহেব। আর এগডা কথা,আমি ত দিদিমণিকে পথম দিনই বল‍্যেছি,অদের ল‍্যাখাপড়া আমি শেখাতে লাইরব। সে মুরোদ আমার লাই গ,আর হব্বেকঅ লাই কদনিন।
    ছাতাবুড়োর কথা শেষ হতেই শিক্ষা-কর্তা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর,হাতজোড় করে ছাতাবুড়োকে নমস্কার জানালেন। যাবার মুখে,সবশেষে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন, 
        আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনি সত্যি সত্যিই একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার মতো যোগ্য মানুষ। আমি আপনাকে চিনতে ভুল করেছি। দয়া করে আমাকে মাফ করে দিন। আর আপনাদের প্রিয় দিদিমণি সম্পর্কে আমার আর কিছুই বলার নেই। আমি আমার চাকরির একেবারে শেষ জীবনে ওঁনার মতো একজন আদর্শ এবং দূরদৃষ্টি-সম্পন্ন অফিসারের সংস্পর্শে এসে ধন‍্য হলাম। ধন্য হয়েছে আমার কর্মজীবন। 
                                   
।। ছয় ।।

        আর দু’মাস পর আসছে দুর্গাপূজা, মাসে শারদ উৎসব। একমাস ধরে বিভিন্ন গ্রামে, এখানে ওখানে বসবে অনেক মেলা।  ছাতাদাদু তাই বন্ধুদের নিয়ে এখন খুবই ব‍্যস্ত। এবার গড়া হবে নতুন ভাবনায় কিছু পুতুল। পুলিশ, দোতলা-ঘর, ঘাড়-নড়া-বুড়ো,রুইমাছ, সৈনিক,খরগোশ, কাৎলামাছ,কোলা-ব‍্যঙ তার মধ্যে অন‍্যতম। কয়েকটি পুতুল এমনভাবে তৈরি করা হবে যেগুলোর ভেতরটা থাকবে ফাঁকা। যাতে পয়সা জমিয়ে রাখা যায়। এককথায়,নতুন ভাবনায় তৈরি পয়সা জমানোর ভাড় বা ঘট। 
      ঝুলনের পরপর, একদিন দাদু তার ছোট্ট বন্ধুদের বলল, 
    এ্যবার আমাদের গেরামের মেলা ছাড়াও লক্ষীপূজার সমায় গৌরাঙ্গডি গেরামের মেলা,কালীপূজার সমায় বৈকন্ঠপুর গেরামের মেলা,আর রাসের সমায় রাজডাঙা গেরামের মেলায় আমরা পুতুল বিকরি করতে যাব‍্য। তাই আমাদের অনেক অনেক পুতুল গইড়তে হব‍্যে। তমাদের সব্বাইকে অনেক সমায় কাজ করতে হব‍্যে। সব্বাই খুব পরিশম্ করতে পারবে ত? এ্যখন সব্বাইকে একটু কষ্ট করতে হব্ব‍্যেই। তব্যেই শেষ‍্যে মজাটা হব‍্যে! কী,তমরা পারবে ত?
    সবাই একসাথে উত্তর দিল,হঁ হাঁ পারব,খুব পারব বট্যে। আমদের কন কষ্ট হবেক লায়। এ্যতে ত আমদের আনন্দই হব‍্যে। আমদের কন কষ্ট হবেক লায় গ দাদু।
    ছাতাদাদু খুশিতে টগবগ করে যেন ফুটছে। সে বন্ধুদের বলল, 
        শন দুটা দরকারি কথা,চুপিচুপি তুমাদের বইলছি। পথম কথাটি হল,আমরা এ্যখন রজ কাজ করব অনেক সমায় ধর‍্যে। নাহ’লে কাজগুলা শেষ করা যাব‍্যে লায়। এবারের মেলাগুলা থেকে পুতুল বিকরি করে যে টাকা পাওয়া যাব‍্যে,সিখান থেক‍্যে পূজাতে কিছ‍্যু হাতখ‍রচ করা হব‍্যে। বাকী টাকা রেখ‍্যে দেওয়া হব‍্যে আগের কথা মত, তমাদের সেই শীতের গরম পশাক ক‍্যানার জন্য। 
     দ্বিতীয় কথাটি হল,এখন থেক‍্যে রোজ দু’বেলা তমাদের জন্য খাবার পাঠাবেন বিডিঅ দিদিমণি। যাত‍্যে তমাদের কাজের কন ক্ষতিটি না হয়। দুফারে খাবার খেত‍্যে তমাদের আর ইসকুলে যেত‍্যে হবেক লায়। ইখানেই দিদিমণি তমাদের জন্য ভাল ভাল খাবার পাঠ‍্যাবেন। আর তমাদেরকে পূজায় নতুন জামাঅ দিদিমণি কিন‍্যে দিবেন বল‍্যেছেন। কী,তমরা সব্বাই খুশি ত? 
    ছোট্ট বন্ধুরা এসব কথা শুনে আনন্দে তাদের মুখের কথা যেন হারিয়ে ফেলেছে। তাই সবাই ঘাড় নেড়ে তাদের সম্মতির কথা জানিয়ে দিল ছাতাদাদুকে।  
     এরপর ছাতাদাদু বন্ধুদের আবার বলল, 
          এ্যবার আমদের গেরামের ঠাকুর দেখতে দিদিমণি মন্ডপে আসবেন ষষ্ঠী পূজার দিন। আসবেন তমাদের পুতুল কিনতেঅ। সেখানেই উনি তমাদের হাতে নতুন জামা তুলে দিবেন নিজের হাত‍্যে। আরঅ ভাল খবর আছ‍্যে গ। দিদিমণি আমাকে বলেছেন,তমাদের সব্বাইকে উনি পাঁপড় ভাজা আর জিলিপি খাবার জন্ন পয়সা দিবেন। কিন্তু এই কথাটি তমরা এ্যখন কারঅ কাছে বলবেক লায়,ক‍্যামন! এ্যখন আমরা সব্বাই মুখটি বন্ধ কর‍্যে রাইখব বট‍্যে,ঠিক ত?
       এরপর দাদু একটু সময় চুপটি করে বসে কী যেন ভাবল। তারপর সেই হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলতে শুরু করল, 
      এ্যবার আমরা আমাদের গেরামের মেলায় ষষ্ঠী,সপ্তমী আর অষ্টমী,এই তিনদিন পুতুল বিকরি করব। অ্যারপর আমি তমাদের সব্বাইকে লিয়ে যাব পাশের বৈকন্ঠপুর,তালবেড়‍্যা, চৈতন‍্যডিহি,পলাশডাঙা, গৌরাঙ্গডি,কিষ্টপুর,রাজডাঙা গেরামে ঠাকুর দেইখতে। চৈতন‍্যডিহি, কিষ্টপুর, রাজডাঙায় ত খুব সুন্দর সুন্দর প‍্যান্ডেল, ঠাকুর, লাইটিং হয়। তমরা কখনঅ সেখ‍্যানে গিয়েছ?
       ছোট্ট বন্ধুরা সবাই ঘাড় নেড়ে, মৃদুস্বরে বলল, 
      না,কখনঅ যাঅয়া হয় নাই দাদু।
      দাদু বলল, 
     মনে আর কন দুঃখ থাকবে লায়। অ্যাবার আমি নিজে তমাদের সঙ্গে লিয়ে যাব অই সব গেরামে। নবমী আর দশমী,এই দু’দিন আমদের হাতে রইল অইসব জায়গায় গিয়ে ঠাকুর দেখা আর অ্যাটা-অটা মুখরোচক খাবার কিনে খাবার জন্ন। পয়সা ত তমাদের দিদিমণি দিবেনই বলেছেন। এবার আমদের পুতুল বিকরি থেকে এগটা পয়সাঅ খরচ করতে হবেক লায়। খুব ভাল হল। 
        দাদুর মুখের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে ছোট্ট পুষ্পা বলতে লাগল, 
       অ্যাবার আমাদের অনেক অনেক টাকা জইমব‍্যে। আর দিদিমণির দিয়া নতুন জামা পরে আমরা সব্বাই দাদুর হাত ধরে অনেক দূরে দূরে ঠাকুর দেইখতে যাব‍্য লাইচতে লাইচতে। কী আনন্দ,কী আনন্দ। সব্বাই হাততালি দাঅ,জরে জরে। 
        পুষ্পার কথা শুনে খুশিতে সবাই তালি বাজাতে লাগল। সেই তালি শুনে ছাতাদাদু্র মনে হল,তার ছোট্ট বন্ধুদের এই হাততালির শব্দ বুঝি আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। সে মনে মনে গর্ববোধ অনুভব করল। 
                                
।। সাত ।। 
দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। এবার প্রথম পুজো শুরু হচ্ছে আশ্বিন মাসের একেবারে শেষ দিন,একত্রিশে আশ্বিন, ইংরেজি মাসের আঠারো অক্টোবর। অর্থাৎ এবারের দুর্গা পূজা শরতে শুরু হলেও সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমী, সব পড়েছে হেমন্তে। তাই এখন সূর্যের তেজ অপেক্ষাকৃত অনেকটা কম। এককথায় খুব সুন্দর,মনোরম প্রকৃতি। নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে রাশিরাশি তুলো-মেঘের ভেলা। ভোরবেলা ঘাসের মাথায় বসছে বিন্দু বিন্দু শিশিরের মেলা। আবার ভোরে মৃদুমন্দ হিমেল বাতাসের খেলা;সত্যি মন ভালো করা,আনন্দে মেতে ওঠার সময়। দিনভর ঝলমলে মিষ্টি রোদ। শারদীয় উৎসব এবার বুঝি একটু অন‍্যরূপে, অন‍্যসাজে সেজেগুজে হাজির হয়েছে। বর্ষার জো’ও এবার খুব ভালো গিয়েছে। তাই গ্রামে গ্রামে সবুজ মাঠে হাওয়ায় নেচে বেড়াচ্ছে ধানের খেত। মানুষের মন এবছর তাই খুশিতে ভরপুর। সেই আঁচ লেগেছে গ্রামে গ্রামে পুজোর আয়োজনেও। এবার যেন একটু বেশি জাঁকজমকের ছাপ সব পুজোর আয়োজনেই। 
          ষষ্ঠী পুজোর দিন, বিকেল থাকতে থাকতেই বিডিও দিদিমণি মহুলডিহি গ্রামে এসে হাজির। সঙ্গে এসেছেন তাঁর দপ্তরের সেই দুই প্রবীণ সহকর্মী অরুণ পাণ্ডে এবং বিমলা সর্দার। আর তাঁর গাড়ির চালক অভয়চরণ মাহাতকে তো আসতেই হয়েছে। এই খবর পেয়েই ছুটে এসেছে আট পাড়ার মোড়লরা। এসেছে আরও অনেক মানুষ। তাদের সবাইকে দেখে, দিদিমণি আজ খুব খুশি। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রথমে পাড়ার পুজো মন্ডপে গিয়ে প্রতিমা দর্শন করলেন। বললেন,
          আহা,কী সুন্দর হয়েছে প্রতিমার মুখখানি,অপূর্ব ! প্রতিমাটি কে গড়েছেন গো ? তার নামটি একটি কাগজে লিখে মন্ডপের এক জায়গায় টাঙিয়ে দিলে ভালো হয় না?  শিল্পীর নামটিও তো সকলের জানা দরকার। শিল্পীকে এভাবে একটু সম্মান জানানো আমাদের প্রত‍্যেকের উচিত,কর্তব্য। মূর্তি তৈরির জন্য টাকা দিলেই সব হয়না। টাকা তো তার পারিশ্রমিক হিসেবে প্রাপ‍্য। কিন্তু তার শিল্পকর্মের মূল্য,সেটা আমরা কীভাবে দেবো? তাছাড়া, শিল্পীর সৃষ্টিকে কখনও অর্থের বিনিময়ে কেনা যায় না,ওভাবে শিল্পীকে কখনো যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করাও যায় না। তাই এই মন্ডপে তার নামটি তুলে ধরে তাকে আমরা নূন্যতম সম্মান জানাতেই পারি।
          এরপর দিদিমণি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ছাতাদাদু্র ছোট্ট বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করলেন। তাদের কাছ থেকে অনেক পুতুল কিনলেন। তাঁর দেখাদেখি,বামুনপাড়ার মোড়ল রূপচাঁদ মুখুজ‍্যে সহ আরও কয়েকজন একটি-দু’টি করে পুতুল কিনল। 
       এরপর দিদিমণি হাতের ইশারায় তাঁর গাড়ির চালক অভয়চরণকে কিছু একটা নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দিলেন। অভয়চরণ সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নামিয়ে,কাঁধে তুলে নিয়ে এল এক বিরাট বস্তা। সেই বস্তা থেকে বের করা হল অনেক নতুন নতুন জামা। দিদিমণি মোড়লদের হাত দিয়ে সেই সমস্ত নতুন জামা তুলে দিলেন ছাতাদাদু্র প্রিয় মাঝিপাড়ার ছোট্ট বন্ধুদের হাতে হাতে। নতুন জামা হাতে পেয়ে তারা যেমন খুশি,তেমনই খুশি পাড়ার মোড়লরা। কারণ এরআগে এভাবে তাদের কেউ সম্মানিত করেনি। 
      করগাপাড়ার মোড়ল দিদিমণির মুখে তাকিয়ে,তাঁকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু দিদিমণি যেন অন্তরযামী। তিনি একমুখ হাসি নিয়ে মোড়লদের উদ্দেশ্যে বললেন,
         আপনাদের পাড়ার যে সব বাচ্চাদের পুজোয় নতুন জামা হয়নি,তাদের জন্যও আমি নতুন জামা এনেছি। আপনারা অভয়চরণের সঙ্গে যান। ও গাড়ি থেকে ওগুলো নামিয়ে আপনাদের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু যার যার পাড়ায়, ওগুলো বিতরণের দায়িত্ব আপনাদেরকেই নিতে হবে।
      দিদিমণির কথা শুনে মোড়লরা সবাই ভীষণ খুশি। তারা গাড়ির চালক অভয়চরণের সঙ্গে একটু এগিয়ে,গাড়ি থেকে সাতটি নতুন জামার বস্তা নামিয়ে নিয়ে এল। তারপর দিদিমণির সামনে এসে,বস্তাগুলো তাঁর নামিয়ে রেখে,সবাই একসাথে হাতজোড় করে তাঁকে নমস্কার করল। দিদিমণির কোনো আপত্তি তারা শুনল না। সবশেষে,রূপচাঁদ মুখুজ‍্যে আবেগ মাখানো গলায় বলল, 
         দিদিমণি গ,আমরা পতিমা পূজা করব পাঁচদিন ধর‍্যে। কিন্তু তবু কী তাঁর দেখ‍্যা কেউ পাব গ? না,আগেঅ কখন পাইনি,ভবিষ্যতেঅ পাবনা। কিন্তু সত্যি বলছি গ দিদিমণি, একেবারে অন্তর থেক‍্যে আমি রূপচাঁদ মুখুজ‍্যে বামুনের ছা বলছি,আপনিই আমার চখ‍্যে দেখ্যা পকিত দেবী। মন্ডপে অই সুন্দর পতিমার মধ্যে আমি যেন আপনাকেই দেখতে পাচ্ছি। শুধু আমি ক‍্যান,আমার মন বলছে,অ্যাদের সকলের মনের কথাঅ আমার থেকে এগটুঅ আলাদা লয়।
          মুখুজ‍্যে মোড়লের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে,আর সবাই সমবেতভাবে উচ্চকন্ঠে বলে উঠল,
        ঠিক ঠিক,অ্যাগ‍্যেবারেই ঠিক বইছ্যে ঠাকুরমশাই। আপনিই আমদের চখে সাক্ষাৎ দেবী,মা দুগ্গা।‘ 
                                          
।। আট ।। 

ছাতাদাদু্র ছোট্ট বন্ধুদের চোখের সামনে দিয়ে গড়গড় করে গড়িয়ে চলে গেল ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী পুজো। নবমীর দিন সকাল সাড়ে দশটা-টশটা হবে,বন্ধুরা সবাই স্নান সেরে নতুন জামাকাপড় পরে,দাদুর কথামতো তাদের পাড়ার সেই শিমুলতলায় হাজির। সবাই আশ্চর্য চোখে দেখল,দাদু তাদের আগেই এসে বসে রয়েছে। দাদু যেন তাদের জন‍্যই অপেক্ষা করছে। তার সামনে রয়েছে অনেকগুলো প‍্যাকেট। দাদু তাদের সকলের হাতে একটি করে প‍্যাকেট তুলে দিয়ে বলল, 
        আগে পেট-পূজ‍্যাটি সেরে লাঅ। অ্যাগুলা দিদিমণি তমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। আমার জন‍্যও অ্যাগটা প‍্যাকেট পাঠিয়েছেন। তবে আর দেরী ক‍্যানে,শুরু কর‍্যে দাঅ। খেয়‍্যে দেয়‍্যে বৈকন্ঠপুর থেক‍্যে ঠাকুর দেখা শুরু করা হব‍্যে। সব শেষ‍্যে যাব‍্য রাজডাঙা। ক‍্যাননা,অদের লাইটিং খুব ভাল হয় বটে। স‍্যাটা সব্বাইক‍্যে দ‍্যাখতে হবেক লায় ?’ 
      খাওয়ার পাট চুকল। কিন্তু সবাই প‍্যাকেট নেওয়ার পরেও তিনটি প‍্যাকেট অতিরিক্ত হয়ে গেল। দাদু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
       প‍্যাকেট তিনটা তমরা তিনজনের ব‍্যাগে ঢুক‍্যিয়ে লাঅ। আবার যখন খিদ‍্যাটি পাবেক,তখ্খন সব্বাই ভাগাভাগি কর‍্যে খেয়ে ল‍্যিবে।
      সবাই দাদুর কথামতো সঙ্গে করে জলের বোতল নিয়ে এসেছিল। সুতরাং কোনোরকম  সমস্যা নেই। হাঁটা শুরু হয়ে গেল। দাদু মাথা গুণে দেখল,ছেলেমেয়ে মিলে দলে মোট বন্ধুর সংখ্যা বাইশ জন। দাদু মজা করে বলল, 
      এখ‍্যন আমদের মধ্যে হয়‍্যেছে দুটা ফুটবল টিম। ফুটবল না হয়‍্যে ক্রিকেট টিমঅ হত‍্যে পারে। আমি এগমাত্র রেফারি,অব্বার আম্পায়ারঅ বলতে পার তমরা। চল,খেল‍্যাটা শুরু হয়‍্যে যাক তব‍্যে।
       দাদুর কথা শুনে বন্ধুরা ‘হো হো’ করে হেসে উঠল। 
      হাঁটা শুরু হল। আজকের গন্তব্য মহুলডিহির উত্তর দিকে। প্রথম গ্রাম বৈকন্ঠপুর। এখান থেকে খুব বেশি দূরের পথ নয়,সোয়া-মাইল খানেক হতে পারে। কিন্তু এই পথটুকুই তো নয়। আজ দাদু এবং তার বন্ধুদের হাঁটতে হবে কম করে সাত-আট মাইল পথ। এই পথে তিন থেকে চারটি গ্রামের ঠাকুর দেখা হবে। বাকীগুলো আবার পরের দিন একইভাবে দেখা হবে। দাদুর চিন্তা সবচাইতে ছোট্ট দুই বন্ধু চম্পা আর পবনের জন্য। ওরা সত্যি খুবই ছোট্ট বন্ধু। চপ্পার বয়স মাত্র সাত বছর,আর পবন এখনও ছ’য়ে পা দেয়নি। কিন্তু এরা দু’জনেই যেমন চটপটে,তেমনি মাথায় বুদ্ধি ধরে। কী সুন্দর সুন্দর পুতুল গড়তে শিখে গিয়েছে ওরা এরমধ্যেই। তাই দাদু ওদের দু’জনকে একটু বেশি ভালোবাসে। ওদের ভালোবাসে সব দাদা-দিদিরাও। এমনকি  বিডিও দিদিমণি পর্যন্ত। 
       বৈকন্ঠপুর তালবেড়‍্যা গৌরাঙ্গডি,সবশেষে রাজডাঙা গ্রামের ঠাকুর দেখা হল। প্রতিটি গ্রামের প‍্যান্ডেল,প্রতিমা সত্যিই দেখার মতো হয়েছে। আর সেই সঙ্গে রাজডাঙা গ্রামের প‍্যান্ডেলে লাইটিং দেখে ছাতাদাদু্র বন্ধুদের মনভরে গেল। এমন লাইটিং তারা জীবনে এই প্রথমবার দেখল। তাই এখানেই অনেক সময় চলে গেল। দেখতে দেখতে সন্ধে গড়িয়েছে ঘন্টা খানেকেরও আগে। দাদু সবাইকে এবার একটু তাড়া দিয়ে বলল, 
      অ্যাখন খর খর পায়ে যেত‍্যে হব‍্যে আমদের। সব্বাই জিলাপি খেত‍্যে খেত‍্যে ফুর্তিতে পা চালাঅ। বাকী তিনটা গেরামের ঠাকুর আমরা কাল দেখ‍্যে লিব। চম্পা আয়,আমার হাতটি ধর কেনে দিদি। সনাতন,তুমি পবনের হাতটি ধরে আগ‍্যে আগ‍্যে চল। আমি সব্বার প‍্যাছনে যাচ্ছি। 
      সকলকে তাদের ঘরে পৌঁছে দিয়ে ছাতাবুড়োর ঘরে ফিরতে একটু রাত হল বৈকি। কিন্তু তাতে তার মধ্যে কোনো কষ্টের ছাপ নেই। বরং সে আবার কাল সকালে বন্ধুদের নিয়ে ঠাকুর দেখতে যাবার জন্য পরিকল্পনাটা ভেবে নিল মনে মনে। বন্ধুদের যে বলা আছে সকাল ঠিক সাড়ে দশটায় শিমুলতলায় হাজির হতে। তার একটু আগে তো তাকে যেতেই হবে,যে করেই হোক। 
       পরের দিন যথারীতি দিদিমণির পাঠানো খাবার খেয়ে বন্ধুরা তাদের দাদুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল ঠাকুর দেখতে। আজ তাদের যাত্রা পথ মহুলডিহির দক্ষিণে। প্রথমে তারা গেল চৈতন‍্যডিহি গ্রামে। এই গ্রামটা মহুলডিহির খুব কাছে। এখানের প্রতিমা দেখার সময়,ছোট্টবন্ধুদের দারুণ নজর কাড়ল সিংহ আর মহিষাসুর। সিংহটাকে দেখে সবার মনে হল,সত্যি সে যেন বন থেকে বেরিয়ে এসে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সবুজ রঙে,বার্ণিশ করা ভয়ংকর অসুরকে দেখে সবাই একটু অবাকই হয়েছে। ছোটদের চোখে মুখে তো ভয়ের ছবি পরিস্কার ফুটে উঠেছে। 
      এরপর তারা গিয়ে পৌঁছল পলাশডাঙা। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। সবাই এখানে একটুখানি বসে জিরিয়ে নিল। এই প‍্যান্ডেলে ছোট্ট বন্ধুদের নজর কাড়ল কার্তিক আর গণেশের মূর্তি। ময়ূরটাকে দেখে তাদের মনে হল সত‍্যিকারের জ‍্যান্ত ময়ূর বটে। এখানের প‍্যান্ডেলটাও তাদের সকলের খুব ভালো লাগল। ছোট-বড়,নানান রকমের বাঁশকাঠির ঝুড়ি দিয়ে প‍্যান্ডেলের ভেতরটা সাজানো হয়েছে ভারী চমৎকারভাবে। 
        এবার ছাতাদাদু সবাইকে আজকের শেষ প‍্যান্ডেল কিষ্টপুরে নিয়ে গেল। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধে নামু নামু। এখানেও প্রতিমা,লাইটিং মোটামুটি ভালোই লাগল সকলের। ঘন্টা খানেক ঘুরে ঘুরে দেখার পর দাদু তাদের সবাইকে চিনেবাদাম ভাজা কিনে দিল। তারপর বলল, 
          সব্বাই আগে জলটি খেয়‍্যে লাও। তারপর, বাদামভাজা খেত‍্যে খেত‍্যে ঘরকে চল। পবনকে আজ আগ‍্যে আগ‍্যে রমেশ সামলাবেক। চম্পাকে ত তুমরা কেঅ সামলাত‍্যে পারবে লায়। উ আমার সাথেই পেছনে যাব‍্যে। চম্পা আয় আমার কাছ‍্যে। সব্বাই চল, চল গ।
                                    
 ।। নয় ।।

        পরদিন, অর্থাৎ বিজয়ার পরের দিন সকালে,ছাতাদাদুর সব বন্ধুরা হঠাৎ ছাতাদাদু্র ঘরে এসে উপস্থিত। মাঝিপাড়ার বাচ্চারা ছাতাদাদু্র ঘরে কেন,আজ পর্যন্ত তারা গ্রামের কোনো ঘরের ত্রিসীমানায় পা রাখেনি। এটাও ঠিক,গ্রামের লোকজন তাদের ঘরে ওদের আসা-যাওয়া মোটেও পছন্দ করেনা। কিন্তু ছাতাদাদু তার বন্ধুদের দেখে আনন্দে আটখানা। সে ভীষণ খুশি হল। ঘরের দাওয়ায় তাদের বসার জন্য খান তিনেক মাদুর পেতে দিল। বন্ধুরা মাদুরে বসার আগে লাইন করে এসে দাদুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। 
      দাদু ঘর থেকে এনে সবার হাতে একটি করে মন্ডা তুলে দিয়ে বিজয়ার মিষ্টিমুখ করাল। তারপর বড় বড় পাঁচটি জামবাটিতে করে ওদের মুড়ি আর ভেলিগুড় খেতে দিল। সবাই খুব আনন্দ করে খেতে লাগল। খবর পেয়ে,মাঝিপাড়ার বাচ্চাদের দেখতে এসেছে গ্রামের গাদা লোক। কয়েকজন মোড়লও এসেছে। তারা এমন দৃশ্য দেখে, সবাই সত্যিই খুব খুশি। 
        ছাতাদাদু তার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে সকলের সামনে বলল, 
         তমরা এগডা জিনিস লখ‍্য করেছ‍্য,আমদের গেরামের পতিমা শিল্পীর নামটি কুথাঅ লেখ‍্যা ছিল না বল‍্যে,দিদিমণি স‍্যাটা ঠিক লয় বল‍্যেছিল। আব্বার আমরা যখ‍্যন বৈকন্ঠপুর তালবেড়‍্যা চৈতন‍্যডিহি পলাশডাঙা গৌরাঙ্গডি কিষ্টপুর রাজডাঙায় গেলম,অখানে কি দেখলম? অখানে কিন্তুক সব পতিমা শিল্পীর নামটি লেখ‍্যা ছিল প‍্যান্ডেলে। 
    আচ্ছা,এ্যবার তমরা যে পুতুলগুলা তৈরি করছ‍্য,অতে তুমাদের নিজের নিজের নামটি যদি লেখ‍্যা হয়, ক‍্যামন হবেক বলত ?
           হাতে-তোলা মুড়ি মুখের কাছ থেকে ফিরিয়ে এনে,তা জামবাটিতে রেখে সনাতন একগাল হাসি মুখে নিয়ে বলল, 
         দাদু,দারুণ হবেক বট‍্যে। আমার পুতুলগুলায় আমার নামটি লেখ‍্যা থাইকবে,দাদু,জব্বর হব‍্যে গ। কত লক জাইনবেক অই পুতুলটি সনাতনের,আমার হাত‍্যে গড়া বটে। 
       সনাতনের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে সবাই চিৎকার করে বলে উঠল, 
        হঁ হঁ,দারুণ হব‍্যে বট‍্যে দাদু।
       বন্ধুদের মুখে এমন কথা শুনে ছাতাদাদু আজ ভীষণ ভীষণ খুশি। কিন্তু উপস্থিত অন‍্যান‍্যদের চোখে মুখে কেমন যেন অবাক হওয়ার দৃশ্য ফুটে উঠেছে। ছাতাদাদু সেদিকে নজর করেনি। সে তার ছোট্ট বন্ধুদের আবার বলল, 
        তাহলে তমাদের এ্যবার নিজের নামটি লিখ‍্যা শিখা করত‍্যে হব‍্যে। খুব কঠিন কন কাজটি লয় গ। উ আমি তমাদের শিখাই দিব দুই দিনে। বল, তমরা সব্বাই রাজী আছ কি না? 
     বন্ধুরা আবার সবাই একসাথে একটি হাত উপরে তুলে, উচ্চস্বরে একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করল,রাজী।                               
                             
।। দশ ।।
          
হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর রাজডাঙা গ্রামে রাস উৎসব উপলক্ষ্যে বসবে বিশাল মেলা। সেখানে কোনো জিনিস নিয়ে বসে বিক্রি করতে গেলে মেলা কমিটির তৈরি করে দেওয়া স্টলেই বসতে হয়। তার ভাড়াও অনেক। সেটা দেওয়া ছাতাদাদুর পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। এই কথা সে বিডিও দিদিমণিকে জানাতেই,নিমেষেই মুশকিল আসান হয়ে গেল। ব‍্যবস্থা হয়ে গেল খুব ভালো জায়গায় একটি স্টলের। আর মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দিদিমণি তো থাকছেন প্রধান অতিথি হিসেবে। সুতরাং, ছাতাদাদুর মাথা থেকে যাবতীয় দুঃশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল নিমেষে। 
       রাজডাঙা রাস মেলার জন্য মাটির পুতুল গড়ার কাজ শেষ হয়েছে। চলছে রংয়ের কাজ। দাদু সবাইকে তাদের নাম, নিজেরর পাড়া ও গ্রামের নাম লেখা আগেই শিখিয়ে ফেলেছে খুব সহজে। দাদু বন্ধুদের সকলের মাথায় ঢুকিয়েছে একটি সহজ কথা,তাতেই কাজ হয়ে গেছে মন্ত্রের মতো। দাদু তাদের শুরুতেই বলেছে, 
      ইটা কন লিখাপড়ার বিষয় লয়। ইটা পুতুল রঙ করা,তার চখ আকার মত সজা কাজ। চ‍্যাষ্টা কর‍্যে দ‍্যাখ, ধনুক লয়,তীরের মত সজ‍্যাটি বট‍্যে গ।
         এবার সকলের পুতুলের পিছনে লেখা হয়েছে কারিগরের নাম। জায়গা পাওয়া গেলে লেখা হয়েছে তার পাড়া ও গ্রামের নাম। এবারে রাস মেলা উপলক্ষে দুটি স্পেশাল পুতুল তৈরি করা হয়েছে। একটি ভূত এবং পেত্নি। মদনা ছোড়া দারুণ গড়েছে পুতুল দুটি। সব বন্ধুদের খুব পছন্দ হয়েছে। সবচেয়ে খুশি তাদের ছাতাদাদু। 
          রাজডাঙা রাস মেলায় উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এসে বিডিও দিদিমণি তাঁর দলবল নিয়ে দেখতে এলেন ছাতাদাদুর বন্ধুদের স্টল। সুন্দর সুন্দর পুতুলগুলা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে গিয়ে তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, সব পুতুলগুলোর পিছনে শিল্পীর নাম লেখা রয়েছে। কোনটিতে নামের নিচে মাঝিপাড়া,মহুলডিহি- কথাগুলোও লেখা রয়েছে। তিনি দাদুর মুখে সমস্ত বিষয় জানার পর,আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। মেলা কমিটির উদ‍্যোক্তাদের জানিয়ে আবার উদ্বোধন মঞ্চে উঠলেন। তারপর মাইকের মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে আবেগ মথিত কন্ঠে ঘোষণা করলেন। 
            এই মেলার শেষ দিনে আমি আবার এখানে আসবো। আমি নিজে,সেদিন আসার জন্য অনুরোধ জানাবো জেলাশাসক,জেলা শিক্ষা-অধিকর্তা সহ কয়েকজন বিশিষ্ট ব‍্যক্তিকে। আসতে অনুরোধ জানাবো হীরাবিল ব্লকের সমস্ত জনপ্রতিনিধি এবং বিশিষ্ট ব‍্যক্তিদের। ঐদিন আমাদের সকলের প্রিয় ছাতাদাদু এবং তার শিল্পী-বন্ধুদের সংবর্ধনা জানানো হবে আমার দপ্তরের তরফ থেকে। আর আজ আমি আনন্দের সঙ্গে এই মঞ্চ থেকে ঘোষণা করছি, মহুলডিহি গ্রামের মাঝিপাড়ার সকল ছোট্ট-বন্ধুরা স্কুলে না গিয়েও স্বাক্ষরতা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে সাফল্য অর্জন করেছে। এ’জন্য আমি তাদের সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা,অভিনন্দন ও অশেষ ভালোবাসা জানাচ্ছি। আর দাদুকে জানাই শুধু প্রণাম প্রণাম আর প্রণাম।
                                    
।। এগারো ।। 

আজ রোববার। রাজডাঙা রাসমেলার শেষ দিন। বিকেল গড়াতেই হাল্কা কুয়াশায় ঢেকেছে মেলা প্রাঙ্গণ। একটু ঠাণ্ডাও লাগছে গায়ে। কিন্তু মেলায় এতো মানুষের সমাগম ঘটেছে যে সেই ঠাণ্ডা কেউ অনুভব করতে পারছে না। আজকের মতো এতো মানুষ এরআগে এই মেলায় কখনও দেখা যায়নি। মানুষের ভীড় আর তাদের খুশি-ভরা মুখ দেখে মেলা কতৃপক্ষ, বিডিও দিদিমণি,ছাতাদাদু্ এবং তাঁর বন্ধুরা একটু বেশি খুশি। 
         সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের আগে মঞ্চে ছোট্ট একটি অনুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে। মঞ্চে অতিথি হিসেবে আসন অলংকৃত করছেন, জেলাশাসক মহাশয়,জেলার পুলিশ সুপার,জেলার শিক্ষা অধিকর্তা,হীরাবিল ব্লকের বিডিও দিদিমণি,সমস্ত পঞ্চায়েতের কর্তাব্যক্তিগণ,মেলা কমিটির সভাপতি,সম্পাদক এবং প্রিয় ছাতাবুড়ো। মঞ্চের সামনে এতো মানুষ যে তিল ধারণের জায়গা নেই। অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য সঞ্চালনার দায় কাঁধে নিয়ে মঞ্চে উঠলেন মেলা কমিটির সম্পাদক মহাশয় নিজে।  
        অনুষ্ঠানের শুরুতেই মঞ্চে উপস্থিত অতিথিদের হাতে পুষ্পস্তবক তুলে দিয়ে তাঁদের সম্মান জানালো রাজডাঙা গ্রামের কচিকাঁচার দল। তারপর সংক্ষিপ্ত স্বাগত ভাষণ রাখলেন মেলা উদযাপন কমিটির মাননীয় সভাপতি তথা প্রাক্তন শিক্ষক মাননীয় মলয়কুমার বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। এরপরই আজকের আয়োজিত এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে বক্তব্য রাখার জন্য হীরাবিল ব্লকের সকল মানুষের প্রিয় বিডিও দিদিমণি অর্পিতা সরকারকে অনুরোধ করা হল। এই ঘোষণা হওয়া মাত্র মেলা প্রাঙ্গণ উপস্থিত মানুষের করতালিতে ভাসতে যেন লাগল। দিদিমণির চোখ,মায় সারা শরীর থেকে যেন খুশির জোয়ার আছড়ে পড়ছে মেলার পরতে পরতে। তিনি মাইক্রোফোন হাতে ধরে মঞ্চে একটু সামনে এগিয়ে এস দাঁড়ালেন। নিজের ডান হাতটি একবার উপরে তুলে নেড়ে সবাইকে অভিনন্দন,ভালোবাসা জানালেন। তারপর বলতে শুরু করলেন। আজ অত্যন্ত আনন্দের আবেগে-মাখা তাঁর কন্ঠখানি। 
       প্রথমেই আমি মঞ্চে উপস্থিত শ্রদ্ধেয় জেলাশাসক, জেলাপুলিশ সুপার, জেলা শিক্ষা-অধিকর্তা, অন‍্যান‍্য অতিথিবৃন্দকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই কারণে যে, এমন একটি ছোট্ট সাধারণ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁরা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে,তাঁদের অমূল্য সময় নষ্ট করে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। আর সকলের প্রিয় ছাতাদাদুকে আমার প্রণাম,ভালোবাসা জানানাই,এইকথা বলা ছাড়া আর কিছুই বলার নেই। 
       আজকে আমি সত্যিই খুব আনন্দিত,গর্বিত এই কারণে যে এই ব্লকের একটিমাত্র গ্রাম মহুলডিহির  মাঝিপাড়ার একজনও এতদিন নিজেদের নামটুকুও লিখতে পারতো না। কিন্তু আজ ওই পাড়ার প্রায় প্রতিটি ছেলেমেয়েরা তাদের নিজেদের নামের সঙ্গে সঙ্গে নিজের পাড়া,গ্রামের নামটি পর্যন্ত অনেকেই লিখতে শিখে গিয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়,এরজন্য ওদের স্কুলে যেতে হয়নি,ওদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ করতে হয়নি আমাদের। এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি এককথায় বলতে গেলে,প্রায় খেলাচ্ছ্বলে শেষ করেছেন ওদের সকলের প্রিয় ছাতাদাদু,আপনাদের পরিচিত মহুলডিহির ছাতাবুড়ো। আর একটি কথা না বললে সত্যিই খুব অপরাধ করা হবে,তা হল,এরজন্য ছাতাদাদুকে আমাদের কোনো প্রকার পারিশ্রমিক বা টাকা-পয়সা দিতে হয়নি। তাই আজ এই মঞ্চে আমরা তাঁকে আপনাদের সকলের সামনে তুলে ধরে একটু সম্মান জানাতে চাই। আমি আসলে বলতে চাই,এভাবে আমরাই সম্মানিত হতে চাই। 
          আমি সকলের প্রিয় ছাতাদাদু,শ্রদ্ধেয় গুণধর পাল মহাশয়কে চেয়ার থেকে উঠে আমার পাশে আসার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। তাঁর অতি আদরের ছোট্ট বন্ধুদেরও আমি মঞ্চে উঠে,দাদুর পিছনে দাঁড়াতে আহ্বান জানাচ্ছি।
          দিদিমণির ঘোষণা শেষ হওয়ার সাথে সাথে,ছাতাবুড়ো বিডিও দিদিমণির ডানপাশে এসে,লাজুক মুখে চুপটি করে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপরই দাদুর একদল বন্ধু হুড়মুড়িয়ে মঞ্চে উঠে, দাদুর পিছনে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের প্রত‍্যেকের মুখে চওড়া হাসি। খুশিতে চোখের কোণ চিকচিক করছে। এরপরই দিদিমণির ঘোষণা মতো ছাতাদাদুকে সম্মান জানাতে শাল,ফুলের মালা,একহাঁড়ি মিষ্টি এবং একটি ছাতা তাঁর হাতে তুলে দিতে এক-এক করে এগিয়ে এলেন মাননীয় জেলাশাসক, জেলাপুলিশ সুপার,জেলা শিক্ষা-অধিকর্তা এবং মেলা কমিটির সভাপতি মহাশয়। করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ। 
         এবার ছোটদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবার পালা। দিদিমণি ঘোষণা করলেন,প্রথমে তাদের হাতে একটি করে গরম পোশাক তুলে দেবেন তাদের প্রিয় ছাতাদাদু। ঘোষণা মতোই পুরস্কার বিতরণ চলছে। জনসাধারণের স্বতঃস্ফুর্তভাবে  হাততালির শব্দে কানে তালা রাগার মতো অবস্থা। এরপর জেলার শিক্ষা-অধিকর্তা তাদের সকলের হাতে তুলে দিলেন একটি করে ব‍্যাগ। ছেলেদের ব‍্যাগের মধ্যে রয়েছে ঘুড়ি লাটাই সুতো আর নানান রকমের একগাদা লজেন্স। মেয়েদের ব‍্যাগের মধ্যে রয়েছে একটি করে লাফদড়ি,খুব সুন্দর চুল-বাঁধার ফিতে আর ছেলেদের মতোই গুচ্ছের লজেন্স। এবার তাদের হাতে একটি করে নতুন জামা তুলে দিলেন জেলাশাসক মহাশয়। 
        তাদের পাওয়া যেন শেষ হচ্ছে না। এবার তাদের হাতে হাতে তুলে দেওয়া হল একটি করে মিষ্টির ভাড়। তুলে দিলেন জেলাপুলিশ সুপার মহাশয়। সবশেষে,হাতের মাইক্রোফোনটি টেবিলের উপর রেখে সকলের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন তাদের সবচাইতে প্রিয় দিদিমণি। 
         পুরস্কার তুলে দেবার কাজ শেষ হয়েছে। দিদিমণি আবার মাইক্রোফোন হাতে তুলে নিয়ে,ছোট্ট বন্ধুদের অতিপ্রিয় ছাতাদাদুকে দু-চার কথা বলবার জন্য অনুরোধ জানালেন। ছাতাদাদু কিছুতেই রাজী নয়। কিন্তু তাঁর প্রিয় মেয়ের আব্দারে তাঁকে শেষ পর্যন্ত রাজী হতেই হল। সে বলতে লাগল। 
          আমি জীবনে কনদিন মাইকের সামনে কথ‍্যাটা বলি নাই। কি বইলব‍্য আমি? আমি শুধু আমার বন্ধুদের কাছ‍্যে বলছি,তমরা নিজের নামটা লিখা শিখ‍্যেই এ্যাতকিছু পুরসকার প‍্যায়‍্যে গ‍্যালে। তব‍্যে ইসকুলে গিয়ে ঠিকমত লিখ‍্যাপড়াটি শিখল‍্যে তমরা আরঅ কতকিছ‍্যু পেত‍্যে পার বলত ! তমরা কি কাল থেক‍্যে আমার কথ্থামত‍্য ইসকুলে যাব‍্যে?
       ছাতাদাদুর কথা শুনে তার সকল বন্ধুরা একসঙ্গে চিৎকার করে বলল, 
        হঁ হঁ দাদু,আমরা তমার সব কথ‍্যাটি শুইনব। তুমি আমাদের দেবতা গ। তুমি যা বইলব‍্যে আমরা সিটাই কইরব‍্য। 
        বাচ্চাদের মুখে এমন কথা শুনে,তাদের কয়েকজনের বাবা;মা আনন্দে মঞ্চে উঠে পড়েছে। তারাও উচ্চস্বরে বলতে শুরু করেছে,
        হঁ হঁ,ছ‍্যেলাগুলা ইসকুলটায় পরতে যাবেক নায় কেনে? যাব‍্যে যাব‍্যে,রজ যাব‍্যে। উআদের ইবার মানষের মত‍্য মানষট হত‍্যে হব‍্যেক। দিদিমণির মত‍্য মানষট হব‍্যেক বট‍্যে।   
-সমাপ্ত 
         

অগ্নিযুগের গল্প
তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

আজ তোমরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ বীরের কাহিনী জানবে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে বাংলা মায়ের অকুতোভয় এক কিশোর সন্তান ১৯০৮ সালের মে মাসের ২ তারিখে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা না দিয়ে নিজহাতে চালানো গুলিতে ভারতের প্রথম শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সেই অদম্য সাহসের ও মর্মান্তিক মৃত্যুর কাহিনি শুনলে তোমরা সবাই নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে দেশপ্রেমের মর্ম বাণী। 

সময়টা ১৯০৭ সালের শেষের দিক। ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে যে সময়টি চিহ্নিত হয়ে আছে ‘অগ্নিযুগ’ হিসেবে। ‘নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি’ অবিশ্বাস দেখা দেয় তৎকালীন তরুণ সমাজের একটি অংশের মধ্যে। ক্রমশঃ তাঁদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা গড়ে ওঠে যে ‘অস্ত্রশক্তি’ ব্যতীত ‘রাজনৈতিক মুক্তি’ সম্ভব নয়। অর্থাৎ মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের একমাত্র পথ হলো ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’। কিন্তু সুপ্রশিক্ষিত ইংরেজ সেনাদের বিরুদ্ধে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মতো শক্তি ছিল না তাঁদের। তাই তাঁরা বেছে নেন ‘রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা’র পথ। ‘সিক্সবোর রিভলবার’ আর ‘দেশীয় হাতবোমা’ দিয়ে, রাইফেল আর মেশিনগান সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর মোকাবেলা করা অসম্ভব হওয়ায় তাঁরা বেছে নেন ‘গুপ্তহত্যা’র মাধ্যমে ব্রিটিশদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার পদ্ধতি যাতে তাঁরা দ্রুত পালায় ভারত ছেড়ে। আন্দোলন পরিচালনার জন্য গড়ে ওঠে ‘যুগান্তর’ আর ‘অনুশীলন’ নামের দুটি গুপ্ত সমিতি। ‘সুবোধ মল্লিক’, ‘হেমচন্দ্র’, ‘চারুদত্ত’, ‘বারীন ঘোষ’, ‘ঋষি অরবিন্দ’ এঁরাই ছিলেন নেতৃত্বে। এঁদের নির্দেশেই কাজ করতেন অন্যরা। সে এক উত্তাল সময়। সারা ভারতে শুরু হয় ‘ব্রিটিশ শাসক আর সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের সংঘর্ষ’, ধরপাকড় আর নির্যাতন। বিপ্লবীরা সুযোগ বুঝে গুম করে দেয় ব্রিটিশ শকুনদের। স্বাধীনতাকামী বিপ্লববাদী দলগুলোকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী মরিয়া হয়ে উঠে। একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা’ রুজু করে তাঁদের উপর চালানো হত শারীরিক নির্যাতন। আর তাঁদেরকে ‘আন্দামান জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’ দিয়ে পাঠানো হতো ‘দীপান্তরে

    বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়াজেলার
ভাসুবিহার গ্রাম’ ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ প্রফুল্ল চাকীর জন্মভূমি। প্রফুল্ল চাকীর জন্ম – ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ২৭শে অগ্রহায়ণ, ইংরেজি ১০ই ডিসেম্বর ১৮৮৮ সাল। 
 তাঁর বাবার নাম রাজনারায়ণ চাকী, মায়ের নাম স্বর্ণময়ী দেবী। তিনি প্রথমে একটি ইংরেজীমাধ্যম স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করে রংপুরজেলা স্কুলে ভর্তি হন। মাত্র নবম শ্রেণীতে পড়তে তিনি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ফলস্বরূপ স্কুল থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়।তারপর তিনি রংপুরের কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেই স্কুলে  পড়ার সময় কিছু মানুষের সংস্পর্শে এসে তাঁর মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ বোনা হয়। এখানেই তিনি ঘোড়ায় চড়া, সাঁতার কাটা, কুস্তি, লাঠিখেলায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।এই রংপুর জাতীয় বিদ্যালয় বাংলার প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়। ১৯০৫ সালে বিপ্লবী বারীন ঘোষ রংপুর আসেন এবং তখন ই প্রফুল্ল চাকীর সাথে তাঁর পরিচয় হয়।  প্রফুল্ল চাকী ‘রংপুরের কুস্তির আখড়ার পরিচালক’ ছিলেন। এ সম্পর্কে প্রফুল্ল চাকীর বৈপ্লবিক সাধনার সহযোদ্ধা ‘শ্রীযুক্ত সুরেশ চক্রবর্তী’ লিখেছিলেন, ‘‘রংপুরে আমাদের একটি বৈপ্লবিক দল ছিল। আমরা তিনজনেই (প্রফুল্ল চক্রবর্তী, সুরেশ চক্রবর্তী ও প্রফুল্ল চাকী) অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। এই দলে প্রবেশের অনুষ্ঠান ছিল-বুক কেটে সেই রক্ত দিয়ে কয়েকটি প্রতিজ্ঞা সম্বলিত একখানি কাগজে স্বাক্ষর করা। এই প্রতিজ্ঞাগুলোর একটি ছিল- প্রয়োজন হলে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করবো। এ থেকেই তোমরা নিশ্চয়ই আরও স্পষ্ট করে তাঁদের দেশভক্তির কথা বুঝতে পারছো।

১৯০৫ সালের পর থেকে বাংলার বিপ্লবীদের প্রতি প্রচন্ডরকম অত্যাচার শুরু করেন কোলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস হিউম কিংসফোর্ড।

     গুপ্ত সমিতির শীর্ষ স্থানীয় নেতারা স্থির করলেন, এই বিচারক কিংসফোর্ডকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হোক।
বিপ্লবী বারীন ঘোষের উপর ভার পড়ল, এই দুঃসাহসিক কার্যে কাকে পাঠানো হবে তা নির্ধারণ করার।
 ১৯০৮ এর মার্চ মাসে কিংসফোর্ডকে জেলা জজ হিসেবে প্রেরণ করা হল মজঃফরপুরে। এপ্রিলমাসে সুশীল সেন ও প্রফুল্ল চাকী মজঃফরপুরে উপস্থিত হলেন ছদ্মনাম নিয়ে যথাক্রমে দুর্গাদাস সেন ও দীনেশ চন্দ্র রায়। তারা উভয়ে কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতায় ফিরে আসেন কিংসফোর্ডের খবর নিয়ে এবং এক চরম আঘাত করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই মুহূর্তে সুশীল সেন সিলেটে চলে গেলেন তাঁর মুমূর্ষু পিতার সাথে শেষ বারের মত দেখা করতে। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ আর অপেক্ষা করতে না পেরে সুশীল সেনের জায়গায় আরেকটি যুবককে খোঁজ করতে লাগলেন । মেদিনীপুরের হেমচন্দ্র তাঁর জেলা থেকে আরেকটি অসীমসাহসী এক সদ্যযুবককে নিয়ে এলেন কলকাতায়।তাঁর নাম ক্ষুদিরাম বসু। ক্ষুদিরাম বসুও এর আগে বিভিন্ন বিপ্লবী কার্যকলাপে তাঁর দক্ষতা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। সুতরাং, শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাঁকে সহজেই নির্বাচন করে ফেললেন। প্রফুল্ল চাকীর নাম থাকলো দীনেশচন্দ্র রায় আর ক্ষুদিরাম বসুর নাম হল দুর্গাদাস সেন। সেই রাত্রেই তাঁরা মজঃফরপুরে রওনা দিলেন। 
পরবর্তী পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী কিংসফোর্ড কে হত্যার অভিযান চালান কিন্তু তারা ব্যার্থ হন। কিংসফোর্ডের পরিবর্তে অন্য ইংরেজ মহিলার প্রাণহানি ঘটে।
 

    এই দুর্ঘটনার পর দুই যুবক তৎক্ষণাৎ সেই জায়গা ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। দুই জনে খালি পায়ে  খিদে তেষ্টায় কাতর অবস্থায় দুই দিকে চলে যান। ক্ষুদিরাম বসু যান সমস্তিপুরের দিকে। প্রফুল্ল চাকী কোন দিকে গিয়েছিল আজও অজানা।

       বোমা নিক্ষেপের পরবর্তী ঘটনা বিভীষিকাময়। তোলপাড় করে তল্লাশি চলে বাঙালিদের ঘরে ঘরে। ক্ষুদিরাম বসু বন্দী হলেও প্রফুল্ল তখনও ফেরার। প্রফুল্ল পরের দিন দুপুরে  ত্রিগুণাচরণ ঘোষ নামে এক বাঙালির ঘরে পৌঁছন। সেখানেই চান খাওয়া সারেন। ত্রিগুণাচরণ ঘোষ সন্দেহ করেন যে গতকাল রাত্রের ঘটনার দুই পলাতক যুবকের মধ্যে এই যুবক একজন। তিনি প্রফুল্লকে নতুন জামা কাপড় কিনে দেন। সিংভূমের এস.আই নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছুটি কাটিয়ে মোকামা ফিরছিলেন। তিনি নতুন পোশাক পরিহিত এক যুবককে দেখে তার সন্দেহ হয় এবং তিনি এগিয়ে গিয়ে সেই যুবকের সাথে পরিচয় করেন। স্টেশনে দুজনের কথায় কথায় গতকালের কথা ওঠে। গতকালের দুর্ঘটনায় দুই মহিলার গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনার  শুনে প্রফুল্ল চাকী অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তাছাড়া তাঁর কথায় পূর্ববঙ্গের টান দেখে নন্দলাল স্থির করে ফেলেন, এই সেই দুই যুবকের একজন। তিনি স্টেশন থেকে তার দাদামশাই প্রখ্যাত উকিল শিবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দ্রুত টেলিগ্রাম করে বলেন, পুলিশ সুপারকে সমস্ত ঘটনা জানাতে এবং সেই যুবককে গ্রেফতার করার অনুমতি চাইতে। এরপর ট্রেনে উঠে তিনি প্রফুল্লর সাথে আরো ভাব জমান। পরদিন তাঁকে সিমারিয়া ঘাটে নেমে প্রাতঃরাশ খাওয়ানোর কথা বলেন। এরপর সিমারিয়া ঘাটে দুজনে প্রাতঃরাশ সেরে স্টিমারে করে মোকামা স্টেশনে আসেন। স্টেশনে এসে প্রফুল্ল চাকী কলকাতা গামী ট্রেনের টিকিট কাটেন। নন্দলাল জিআরপিতে খবর নিতে যান, টেলিগ্রামের কোন উত্তর এসেছে কিনা। তখন তিনি উত্তর পান, 'Arrest and bring the man here'. 

   এরপর নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এস .আই রামাধার শর্মা ও কনস্টেবল শিবশঙ্কর সিংকে নিয়ে যুবককে গ্রেফতার করতে ছোটেন। এই দৃশ্য দেখে প্রফুল্ল পশ্চিম দিকে ছুটতে শুরু করেন। শিবশঙ্কর তাঁকে ধরে ফেলেন এবং শর্মা তার মোটা লাঠি দিয়ে প্রফুল্লর কাঁধে  তীব্র আঘাত করেন। এই তিনজন পরবর্তীতে বয়ান দেন যে, এরপর প্রফুল্ল পরপর দুটি গুলি করেন এবং তাই তারা এই যুবককে মেরে ফেলতে বাধ্য হন।  কিন্তু উল্লেখ্য বিষয়, প্রফুল্লকে নিয়ে আলাদা তদন্ত বা বিচার কিছু হয় নি। এরপর দু দুবার প্রফুল্লর মৃতদেহের ছবি তোলা হয় এবং তাঁর মরদেহ আনা হয় ক্ষুদিরাম বসুর কাছে। ক্ষুদিরাম তাঁর দেহ সনাক্ত করে বলেন, 
"The body lying here is that of Dinesh Chandra Roy. I know him by general appearance not by any special marks."

    কিন্তু কে এই দীনেশ চন্দ্র রায়? ক্ষুদিরাম বসু যা জানতেন,তাই জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও তাদের সন্দেহ প্রশমিত হল না। তাই সেই মৃত যুবকের দেহের শিরোচ্ছেদ করা হল এবং টিনের বাক্সে স্পিরিটের মধ্যে সেটা রাখা হল। সেই বিচ্ছিন্ন মাথা নিয়ে ডেপুটি সুপার বাচ্চু নারায়ণ লাল কলকাতায় এলেন। উদ্দেশ্য, অপরাপর বিপ্লবীদের থেকে তার পরিচয় জানা। তবে শোনা যায়, মির্জা গালিব স্ট্রিটের সংলগ্ন জৈনেক ইন্সপেক্টর পি.সি.লাহিড়ীর বাগানবাড়িতে প্রফুল্লর বিচ্ছিন্ন মাথা পুঁতে রাখা হয়। এই কাজটি সম্পন্ন করেন তার ভাই এস.আই হেমচন্দ্র লাহিড়ী। দেশের স্বাধীনতার পর সেই করোটিটি তুলে পরিষ্কার করে সেটি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের হেফাজতে সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু প্রফুল্লর ধরের কি হল জানা যায় না। হয়তো তা নাকি গড়ের মাঠে ফেলে দেওয়া হয়েছিল শেয়াল কুকুরের খাওয়ার  জন্য। না জেল, না দ্বীপান্তর , না ফাঁসি - এক বীর বিপ্লবীর মৃত্যু হল চরম অসম্মানিত অবস্থায়।  

    প্রফুল্লর মৃত্যুর পর তাঁর কাটা মাথার  ফটো গেল তাঁর বগুড়ার বাড়িতে। তাঁর দুই বড় ভাই তাঁকে শনাক্ত করেন। তাঁর মা তখনো বেঁচে আছেন। প্রফুল্লর মা তাঁর কাটা মাথার ফটো দেখে বলেন, " এ আমারই ছেলে প্রফুল্ল। আজ আমি ধন্য।"

    উল্লেখ্য ,তাঁর মরদেহের কোন অংশ তারা পান নি। কিন্তু তারা শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করলেন। তাঁর শ্রাদ্ধে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন তাঁর মা। নিয়মানুষ্ঠান করার জন্য তাঁরা পণ্ডিতমন্ডলীর পরামর্শ নিলেন। স্থির হল, করতোয়া নদীর তীরে প্রফুল্লর  কুশপূত্তলিকা দাহ করে অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। শাস্ত্রবিহিত শ্রাদ্ধের দিনে মাতা স্বর্ণময়ী সর্বক্ষণ শ্রাদ্ধ বাসরে উপস্থিত থেকে তার বীর পুত্রকে সম্মান জানালেন।

     তাঁর আবক্ষ ও পূর্নাবয়ব মূর্তি নির্মিত, হয়েছে কিছু স্থানে। তবু তাঁকে কি আমরা যথার্থ সম্মান দিতে পেরেছি ! অধিকাংশ ভারতবাসী এই শহীদের নাম শোনেনই নি। তোমরা সবাই মিলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করে তাঁর নীরব আত্মবলিদান কে সার্থক করো।

   " আজি তোমারে ভুলিতে পারিনি 
               বীর প্রফুল্ল চাকী।
      তব পবিত্র সুকঠোর দেহ 
    স্পর্শিতে কভু পারে নাই কেহ
    নিজ হাতে দিলে পরাণ আহুতি
           বন্ধন লাজ ঢাকি। 
(রচনাকার: অজ্ঞাত)


নির্মল স্যারের ক্লাস (২)

কে কোথায় খাবার পাবে 

 ধ্রুবজ্যোতি দে

শনিবার পঞ্চম শ্রেণীতে নির্মল স্যারের ক্লাস থাকে মিড-ডে মিল-এর পর। তারপর ছুটি হয়ে যায়। আজ ক্লাসে এসে দেখলেন ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে জোরে জোরে কথা বলছে। কয়েকজন বেশ উত্তেজিত, কী নিয়ে যেন তর্ক করছে অন্যদের সঙ্গে। “কী হল রে তোদের?”- নির্মলবাবু জানতে চাইলেন। সদা তৎপর সুবল দাঁড়িয়ে বলে, “স্যার মাছ নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে”। ঘটনা হল, আজ মিড-ডে মিল-এ ডিমের ঝোল ভাত দেওয়ার কথা। কিন্তু ডিম কিছু কম থাকায় সমস্যা হচ্ছিল। এদিকে আজ স্কুলের কাছে বসাকবাবুদের পুকুরে বড় জাল ফেলে অনেক মাছ ধরা হয়েছে। হেডমাস্টারমশাইয়ের অনুরোধে বসাকবাবু কয়েকটি মাছ স্কুলকে দেন। মৃগেল, রুই, সিলভার কার্প এইসব। ঠিক হয় উঁচু ক্লাসে মাছ দিয়ে ছোটদের ডিম দেওয়া হবে, যাতে ছোটদের কাঁটা বাছতে অসুবিধা না হয়। মিড-ডে মিলের কমলাদি যখন মাছ নিয়ে বসেছেন তখন এরা মাছগুলো দেখেছে, কেউ কেউ হাতও দিয়েছে।  

      নির্মল স্যার বলেন, “কেন তোরা সকলেই তো ডিম পেয়েছিস। তাহলে আবার ঝগড়া কেন।” মালতী বলে, “আমি বোলেচি মাছেদের মুখগুলা আলাদা আলাদা রকম, উরা মানচে নাই”। নির্মলবাবু – “কেন? নানারকম মাছের মাথা আলাদা আলাদা দেখতে, এতো সবাই জানে”। মালতী - “তা না স্যার, মুখগুলা কারও উপরদিকে, কারও নিচে, কারও সোজা থাকে”। এই বলে মালতী তার ঠোঁট দুটো জড়ো করে একবার ওপর একবার নিচে করে দেখায়। রতন বলে ওঠে, “সে তখন মাছগুলো খাবি খাচ্ছিল, তাই ওরাম দেখাচ্ছিল”। মালতীর মুখ দেখে নির্মলবাবুর হাসি পেয়ে যায়। সেটা চেপে তিনি বলেন, “ নারে, মালতীই ঠিক। সব মাছ পুকুরের সব জায়গা থেকে খাবার খায় না। যে যেখান থেকে খাবার খায় তার মুখ সেইরকম হয়ে যায়। মৃগেল খায় পুকুরের নিচের দিক থেকে, তাই ওদের ঠোঁট নামানো। রুই খাবার যোগাড় করে পুকুরের গভীরে মাঝখান থেকে, তাই ওদের ঠোঁট সোজা। আবার কাতলা, সিলভার কার্প খায় জলের ওপরে ভেসে থাকা খাবার, তাই ওদের ঠোঁট ওপরের দিকে বাঁকানো।” মালতী রতনকে হেসে বলে, “দেখলি”।     

      আজ নির্মল স্যারের পড়ানোর কথা ছিল ‘জীববৈচিত্র্য’, উপএকক ‘উদ্ভিদ ও প্রাণী’। আগের দিন আলো দেওয়া গাছের গল্প বলতে গিয়ে বিষয়টি ভালো পড়ানো হয়নি। তবে নির্মলবাবু মনে করেন শুধু বই দেখে বলে যাওয়া আর লেখা করালেই পড়ানো হয় না। এইসময় সুবল জানতে চায়, “কোন মাছ কী খায় স্যার?” নির্মলবাবু বলেন মাছেরা উদ্ভিদ, প্রাণী দু’রকমই খায়। শ্যাওলা, পোকামাকড়, ছোট মাছ, জলের ওপরে নিচে যারা যেখানে যেমন পায় সেটাই খায়”। স্বপ্না বলে, “আমরাও তো দু’রকমই খাই। মাছ, গাছ, দুইই খাই”। নির্মলবাবু বলেন, “ঠিক, তাই আমরা হলাম উভভোজী। কিন্তু অনেক প্রাণী আছে যারা একরকমই খায়, কেবল উদ্ভিদ বা কেবল প্রাণী। বলতো এরকম প্রাণীদের নাম”। ক্লাস সুদ্ধ বলতে থাকে, ‘গরু, ছাগল, হাতি - শুধু উদ্ভিদ খায়; বাঘ, সিংহ, সাপ - শুধু প্রাণী খায়’। নির্মল স্যার বলেন, “প্রথম দল হল তৃণভোজী, দ্বিতীয় দল মাংসাশী”। এবার জিজ্ঞাসা করেন, “তাহলে গাছেরা কী খায়?” কয়েকজন বলে ওঠে, ‘জল, সার’। নির্মল স্যারের প্রশ্ন, “শুধু জল, সার দিয়ে একটা গাছকে এই ঘরে বন্ধ করে রাখলে বাঁচবে?” এবার সবাই বলে, “না স্যার, রোদ্দুর দরকার লাগবে”। 

     নির্মল স্যার বলেন, “ঠিক। গাছের পাতার সবুজকণা সূর্যের আলো দিয়ে জল আর বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস, যা আমরা, সব জীবেরা, নিঃশ্বাসের সঙ্গে বাতাসে ছেড়ে দিই, তাই জুড়ে ওদের খাবার তৈরি করে। তৃণভোজীরা, আমরা, যখন গাছ পাতা খাই তখন এই খাবারই খাই। মাছ মাংস খেলে ঐ খাবারই খানিক পাল্টে গিয়ে মাংসাশীদের, আমাদের শরীরে আসে। তাহলে দেখা যাচ্ছে সব খাবারেরই উৎস হল গাছ।” তপন বলে ওঠে, “তাহলে স্যার গাছেদের পাতা হল রান্নাঘর, সবুজকণা হল উনুন, আর রোদ্দুর হল আগুন।” নির্মল স্যার বললেন, “অনেকটা ঠিক বলেছিস। ” সুবল জানতে চায়, “স্যার, গাছের পাতা সবুজ হয় কেন?” নির্মলবাবু প্রশ্ন করেন, “তোরা রামধনু দেখেছিস?” সবাই একসাথে বলে, “হ্যাঁ, বৃষ্টি হলে দেখা যায়।” 

     এবার নির্মলবাবু স্বপ্নাকে অফিস ঘর থেকে কাঁচের গ্লাসে খানিকটা জল নিয়ে আসতে বলেন। স্বপ্না জল নিয়ে এলে ক্লাসের যে জানালা দিয়ে রোদ আসছে সেখানে গ্লাসটা এমনভাবে রাখলেন যাতে রোদ গ্লাসে এসে পড়ে। তারপর একটা সাদা পাতা গ্লাসের এদিক ওদিক পাশে নিচে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ধরতে তাইতে রামধনুর আবছা সাত রঙ দেখা গেল। নির্মল স্যার বললেন, “তাহলে দ্যাখ সবসময়েই সূর্যের আলোতে সাত রঙ থাকে। এর মধ্যে সবুজ রঙটাই কম কাজে লাগে। তাই পাতারা সেটা নেয় না। আর তাই আমরা পাতাগুলো সবুজ দেখি। সেইজন্য রোদ্দুর না পেলে পাতা আর সবুজ থাকে না, হলুদ হয়ে যায়। কারণ সবুজকণাগুলো অকেজো হয়ে যায়।” স্বপ্না মন্তব্য করে, “স্যার, গ্যাস না কিনতে পারলে যেমন উজালা উনুন বন্ধ থাকে”।           

     এইসময় নির্মলবাবুর মনে পড়ে মানিকের কথা। মানিক শান্ত ছেলে, কথা কম বলে। কিন্তু চুপিচুপি এটা ওটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে ওর জুড়ি নেই। আর সে যা করে তা নিয়ে, বাবা মাকে না বললেও, নির্মল স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করতে কখনও ভোলে না। কিছুদিন আগে পুরসভা থেকে প্রচার দিয়েছিল ঘরে যেন বেশিদিন জল জমিয়ে রাখা না হয়, কারণ ওতে মশা জন্মায়। কীভাবে মশা জন্মায় দেখবে বলে মানিক লুকিয়ে একটা পাত্রে জল জমিয়েছিল। সেই জলে মশার লার্ভা আর কমার মত দেখতে পিউপা জন্মালে সেগুলো কী জানতে সে শিশিতে ভরে নির্মল স্যারকে দেখাতে এনেছিল। তারপর যখন জানল যথাসময়ে পিউপার পিঠ থেকে মশার বাচ্চা বেরবে তা দেখার জন্য রাত জেগে ওত পেতে বসেছিল। তাইতে সে মায়ের কাছে ধরা পড়ে যায়। ‘ঘরে মশার চাষ করছে’ বলে তিনি সেই জল পুকুরে ফেলে দেন। 

     কয়েকদিন আগে মানিকের একটা পড়ার বইয়ের কোনা ইঁদুরে কেটে দেয়। মানিকের বাবা বড় মিস্ত্রী, কাঠের কাজ করেন। দরজা, জানালা, আসবাব এইসব তৈরি করেন। বাবার অনুপস্থিতিতে তাঁর যন্ত্রপাতি নিয়ে মানিক একটা ইঁদুর ধরা ফাঁদ তৈরির চেষ্টা করছিল। কীভাবে স্প্রিং দরজা করা যায় জানতে চেয়েছিল নির্মলবাবুর কাছে। শেষে যন্ত্রপাতি খারাপ করে দেবে অথবা হাত পা কাটবে, এইরকম কিছু ভেবে ওর বাবা সেগুলো বাক্সবন্দী করে তালা দিয়ে দিয়েছেন। তবে মানিকের যে টবে ছোট ছোট গাছ করার শখ আছে তাতে বাবা মা বাদ সাধেননি। নির্মলবাবু মানিককে কিছু কালো কাগজের টুকরো আর জেমস ক্লিপ দিয়েছিলেন একটি ছোট গাছের কয়েকটি পাতার কিছু অংশ কালো কাগজ দিয়ে মুড়ে গাছটিকে কয়েকদিন রোদে রাখার জন্য। আজ কথা ছিল সে ঐ গাছটা স্কুলে নিয়ে আসবে। ইচ্ছা ছিল রোদ না পেলে পাতা কেমন হলুদ হয়ে যায় দেখাবেন। কিন্তু আজ কেন সে এল না ! ছেলেমেয়েদের পড়ার বইয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীদের খাদ্য বিষয়ের ছক ভরতে দিয়ে বসে বসে ভাবছিলেন নির্মলবাবু।    

    মানিকের পাড়াতেই মিঠু থাকে। নির্মলবাবু মিঠুকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন মানিককে মনে করিয়ে দিতে। কিন্তু মিঠুও আজ আসেনি। মিতা মিঠুর সঙ্গে আসে। সে খবর দিল, মিঠুর মা অসুস্থ, তাই ও বাড়ির কাজ সামলাচ্ছে। ঠিক এইসময়ে মিঠু ছুটতে ছুটতে দারোয়ানের সঙ্গে ক্লাসে এসে জানালো মানিককে বাড়িতে সাপে কামড়েছে। সাপটা এখনও সেখানে রয়েছে। নির্মলবাবু সঙ্গে সঙ্গে হেডমাস্টারমশাইকে বলে ক্লাস ছুটি দিয়ে দিলেন। তারপর মিঠুকে সাইকেলের কেরিয়ারে চাপিয়ে মানিকের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। যাবার সময় স্কুলের শৌচালয় ঢালাইয়ের জন্য যে শিক রাখা ছিল তার একটার মুখ বেঁকিয়ে হুকের মতো করে মিঠুকে ধরতে দিয়েছিলেন। প্রাণপণে সাইকেল চালাতে চালাতে নির্মলবাবু বলেন, “আমি সাপ চিনি, কিন্তু ধরিনি কখনও। দ্যাখা যাক কী হয়”। 

    মাথার ওপর জ্বলন্ত রোদ। স্তব্ধ দুপুরে দূরে কোনও গাছে একা একটা হাঁড়িচাঁচা ডাকছে। নির্মলবাবু কেবল ভাবছেন সাপটা যেন বিষধর না হয়। কেননা অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ফোন করে জেনেছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিষ প্রতিষেধক ‘অ্যান্টিভেনম সিরাম’ আছে। মানিকের বাড়ি পৌঁছে নির্মলবাবু শুনলেন মানিককে তার দাদু মদন ওঝার কাছে নিয়ে গেছে। নির্মলবাবু মানিকের বাবা অজয়বাবুকে জোর করে মানিককে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য মদন ওঝার বাড়ি পাঠালেন। এদিকে সাপ মহাশয় মানিককে কামড়ের পর অজয়বাবু যেখানে বাতিল কাঠপত্র রাখেন তার মধ্যে ঢুকে বসে আছেন। গায়ের ছাপ দেখে বোঝা গেল সেটি নির্বিষ দাঁড়াস সাপ। বেশ বড়, প্রায় চার ফুট হবে। এঁরা ইঁদুর খেতে খুব পছন্দ করেন। মানিকের বাড়িতে খাওয়া সেরে তিনি আরামে শুয়েছিলেন। মানিক কাঠ সরিয়ে দেখতে গিয়েছিল। উনি ভয় পেয়ে কামড়েছেন। 

    নির্মলবাবু হুক নিয়ে সাপের কাছে গেলেন ও ধীরে ধীরে সেটিকে বের করলেন। মানিকের মায়ের থেকে একটা বস্তা নিয়ে তাইতে ভরে কাছের জঙ্গলে ছেড়ে দিলেন। এরপর মানিকের মাকে বাড়ি ইঁদুর মুক্ত রাখার পরামর্শ দিয়ে সাইকেলে পাড়ার একটি ছেলেকে তুলে নির্মলবাবু মদন ওঝার বাড়ি গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন অনেক লোকের ভিড়। মদন ওঝা মানিককে না ছেড়ে শুইয়ে রেখে হ্রিং ব্রিং মন্ত্র পড়ছেন ও বলছেন ‘যা বিষ নেমে যা, মা মনসার আইজ্ঞা’। আর অজয়বাবু হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। নির্মলবাবু রেগে গিয়ে চিৎকার করলেন, “বন্ধ করুন এসব। বিষধর সাপ হলে তো ছেলেটা এতক্ষণে মরেই যেত। ওকে সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল”।

     মদন ওঝা একসময় নির্মল স্যারের স্কুলে পাঁচ ক্লাস অবধি পড়েছেন। তারপর এটা সেটা করে এখন ওঝাগিরি করে পেট চালান। মদন ওঝা হাত জোড় করে বলেন, “মাস্টারমশাই, মানিকের হাতে দুটো দাগ দেখে ভাবনু জাত সাপ। কেউতো সাপটা মারি এনে দেখায়নি।” নির্মলবাবু উত্তর দেন, “মারবে কেন, সাপ না থাকলে তো ইঁদুরে ভরে যেত দেশটা, দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। দাঁড়াস সাপ, ভাল কামড়াতে পারেনি, তাই দুটো দাগ”। এবার ভয়ে নেতিয়ে পড়া মানিককে ধরে বসালেন। তারপর তাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানোর জন্য অজয়বাবুর বাইকের পিছনে বসিয়ে তার পিছনে মদন ওঝাকে তুলে দিলেন। কারণ ওর অ্যান্টি-টিটেনাস ও ওষুধপত্র লাগতে পারে। নিজে সাইকেলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র যাওয়ার পথে খাবারের দোকান থেকে মানিক ও মিঠুর জন্য খাবার কেনেন, কেননা সাপের চক্করে দুজনেরই খাওয়া হয়নি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে মানিককে খাইয়ে অজয়বাবুর হাতে মিঠুর খাবার দিয়ে দিলেন।            

    দু’দিন পরে ক্লাসে এসে মানিক জানালো অজয়বাবু ইঁদুর কল এনে ধরে ধরে ইঁদুর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন, মানিকের আপত্তিতে মারেননি। আর বলে, সে সাপ চেনা, সাপ ধরা, শিখবে। সাপ ধরে যেখানে ইঁদুর ছাড়া হয়েছে সে ওখানে তাদের ছেড়ে দেবে। তাহলে তারা খেতে পাবে। নির্মল স্যার হেসে ফেলেন, যেন তারা সবাই এক জায়গায় বসে থাকবে ! তবে তিনি সাপ চেনাতে রাজি হয়েছেন। সবাইকে নিয়ে পরে একদিন ‘স্নেক পার্কে’ও যাবেন বলেছেন। কিন্তু মানিককে বলে দিয়েছেন সাপ ধরতে হলে তাকে বড় হয়ে সাপ নিয়ে পড়াশোনা করে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।     

Post a Comment

0 Comments