জ্বলদর্চি

রসিক রবীন্দ্রনাথ/ তনুশ্রী ভট্টাচার্য

রসিক রবীন্দ্রনাথ 

তনুশ্রী ভট্টাচার্য 

আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের অনেক পরিচয়। সহজ পাঠের রবীন্দ্রনাথ, কাব্য ছন্দের রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রনাথ, জীবন স্মৃতির রবীন্দ্রনাথ, নোবেল জয় ও নাইট উপাধি ত্যাগের রবীন্দ্রনাথ, মানবতার জয়গানকারী রবীন্দ্রনাথ, সভ্যতার সংকটে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ, প্রকৃতিপূজারী রবীন্দ্রনাথ, জীবন প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ।নৃত্যশিল্পী চিত্রশিল্পী কী নয়! কিন্তু তবুও তার সম্পূর্ণ পরিচয় কি পেয়েছি আমরা? উত্তরটা দ্বিধা মিশ্রিত । কবি নিজেই বলে গেছেন "তুমি মোর পাও নাই পাও নাই  পরিচয়"। তার সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়ার মত জ্ঞান বা বোধ আমাদের কুলিয়ে ওঠে না। তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ কি কেবল পূজা প্রেম প্রকৃতি স্বদেশ পর্যায়ের ভারি ভারি অর্থযুক্ত সুর- তাল- লয়ের সংমিশ্রণ ? তিনি কি শুধুই গাম্ভীর্য বহন করে চলেছেন সারা জীবন? একটুও কি হাসাহাসি ঠাট্টা তামাশা চুটকি সরস কৌতুকে কখনো মেতে ওঠেননি ? সব কিছু পরিচয়ের  উর্ধ্বে তিনি তো জীবন রসিক। জীবনের সব রস নিংড়ে নিয়েই তো তিনি বিশ্বকবি। তাহলে তিনি রসপ্রিয় কেন হবেন না? জীবনকে সরস ভঙ্গিতে না দেখলে তো এমন অতি সুন্দর কাব্য  আসে না! অন্তরে একটা সরস মন অবশ্যই খেলা করত। তিনি তখন রসিক রবীন্দ্রনাথ । জীবনে যেকোনো কঠিন মুহূর্তে হাস্যরস তৈরি করতে  তিনি ছিলেন অদ্বিতীয় এমন উদাহরণ আমরা ভালই পাই।
ক্ষিতিমোহন সেন --নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের দাদু রবীন্দ্রনাথের প্রিয়তম সখা, অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী, শান্তিনিকেতনের স্তম্ভ স্বরূপ। এবং সুরসিকও বটে ।কবির  সঙ্গে তার প্রায়ই চলত সরস আলাপ। রবি-র হাস্যরসের ধারায় নিজেকে পরিস্নাত করতেন তিনি। একবার হয়েছে কি এক কালবৈশাখীর ঝড় বৃষ্টিতে সপসপে ভিজে ক্ষিতিমোহন দাঁড়ালেন  কবির সামনে। রঙ্গ প্রিয় রবীন্দ্রনাথ সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আবৃত্তি করে উঠলেন-- ওই আসে অতি ভৈরব হরষে জলসিঞ্চিত  ক্ষিতি  সৌরভ রভসে। বলা বাহুল্য, সেই ভেজা অবস্থাতেও কবির এই রসিকতায় ক্ষিতিমোহন  অট্টহাস্য করে উঠলেন।

🍂

রবীন্দ্রনাথের সর্ব ক্ষণের সঙ্গী সেক্রেটারি অনিল চন্দ। তার স্ত্রী রানী চন্দ ছিলেন কবির  খুব কাছের মানুষ। কবি তখন একেবারে শয্যাশায়ী। হাঁটাচলা করতে পারেন না। বিছানায় আধশোয়া  করিয়ে মুখমন্ডল পরিষ্কার করিয়ে দেওয়া হয়। সেই প্রশান্ত সৌম্য উজ্জ্বল মুখমণ্ডলে যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠেছে কবি নিজেও তা ভালোই জানেন। এইরকম এক সকালে অনিল চন্দ ঘরে ঢুকলেন । কবিকে প্রণাম করলেন ।কবির মুখের দিকে তাকালেন খুব গম্ভীর ভাবে ।কবি ততোধিক গম্ভীর ভাবে অনিলকে বললেন --এখনকার রবীন্দ্র রচনাবলীর মুখ্য সংস্করণের খবর কি? অনিল চন্দ সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্র রচনাবলীর প্রকাশের বৃত্তান্ত গড়গড় করে বলতে শুরু করলেন। কবি সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিলেন-- তুমি সেই সিলেটি বাঙালই  রয়ে গেলে দেখছি। আমি বলতে চাই আজ আমার মুখের অবস্থা কি রকম দেখছো? কবির  এই রসিকতায় রাশ ভারি অনিল বাবু জোরে হেসে ফেললেন। নিজের শারীরিক যন্ত্রণাকে হাস্যরসে জারিয়ে নিতেও দ্বিধা নেই রসিক মানুষটির।

   রানী চন্দর  উপর ভার ছিল কবির চোখে রোজ ড্রপ দেওয়ার। চোখে ড্রপ দিলে স্বাভাবিকভাবেই চোখ দিয়ে জল পড়ে ।কবি রসিকতা করে বললেন-- কিগো চক্ষু ধাত্রী --তুমি তো ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে- যে কেউ একজন রবীন্দ্রনাথকে প্রতিদিন চোখের জল ফেলিয়েছে। এই বলেই নিজেও রানীচন্দের সঙ্গে হেসে উঠলেন। 

মুকুল দে বিখ্যাত চিত্রকর ও কবির স্নেহভাজন। কিন্তু বেরসিক । মুকুল বিয়ে করলেন কিন্তু কবি বিয়েতে যেতে পারলেন না কোন কারণবশত। মুকুল রেগে চলে গেলেন। বউকে নিয়ে কবির আশীর্বাদ নিতে গেলেন না। কবি ব্যাপারটা বুঝলেন। তাই একদিন সময় করে নিজেই নব দম্পতিকে আশীর্বাদ করতে গেলেন। মুকুলের রাগ পড়ল ।বধূটি কবিকে প্রণাম করলেন ।কবি নাম জিজ্ঞাসা করলেন। বধূটি বলল --বীণা। কবি মুকুল কে বলে উঠলেন-- বীণা  নিয়ে তুই কি করবি বীণা  লাগবে আমার আমি কবি -- জগৎ জুড়ে বীণা  বাজানোই আমার কাজ। উপস্থিত সকলে হেসে উঠলো। বধূর  চোখেও সলজ্জ হাসি। শুধু বেরসিক মুকুল মুখ ভার করে রইল। খানিক পরে ব্যাপারটা বুঝে সে হাসিতে যোগ দিলো।

দীর্ঘকায় লোকেদের কোমরে ব্যথা প্রায় এক স্বত:সিদ্ধ অসুখ। তরুণ বয়সেই রবীন্দ্রনাথের কোমরে ব্যথা হতো মাঝে মাঝে। একবার পাহাড়ে বেড়াতে গেছেন। কিন্তু তখন কোমর ব্যথা। ভাইঝি ইন্দিরাকে সে ব্যথার কথা জানিয়ে চিঠি লিখছেন -- হৃদয় ভেঙ্গে গেলে লোকের সান্ত্বনা লাভের জন্য পাহাড়ে বেড়াতে আসে কিন্তু কোমর ভেঙে গেলে! নিজের কষ্টকে নিয়ে রসিকতা করছেন --এই কোমরের কথা যাকে বলি সেই ই হাসে, কারোর করুণা আকর্ষণ করে না। কোমর ভাঙ্গা যেন হৃদয় ভাঙ্গা অপেক্ষা কোন অংশে কম!! তাই কাউকে বলতে চাই না।চাই না কোমরের জন্য করুণা। লিখছেন --

আমার কোমর আমারই কোমর 
বেচি নি তো তাহা কাহারো কাছে 
ভাঙাচোরা হোক যাহোক তা হোক 
আমার কোমর আমারই আছে।

সুহৃদ শ্রীশ চন্দ্র মজুমদার কে চিঠিতে লিখছেন-- আমার কোমর ছাড়া পৃথিবীতে আর সমস্ত মঙ্গল। যে   রবীন্দ্রনাথ সভ্যতার সংকটে উদ্বিগ্ন হন সে রবীন্দ্রনাথ নিজের শারীরিক সংকটে রসিক হয়ে ওঠেন।

একবার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এল  কে এক পাঁচকড়ির  কথা। সে নাকি রবীন্দ্রনাথের নামে উল্টো পাল্টা রটিয়ে বেড়াচ্ছে। আশুতোষ বাবু উদ্বিগ্ন  হয়ে বললেন-- রবিবাবু পাঁচ কড়ির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা না করলে আর চলছে না। কবি শান্ত স্বরে বললেন --আহা এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কি আছে ?ওর বাবা মা ই ওকে পাঁচটি কড়ির  বেশি মূল্য দেয়নি। আপনি ওকে এত মূল্য দিতে যাচ্ছেন কেন?

এই রসবোধ ‌বা নিজেকে নিয়ে এই হালকা চালে কথাবার্তা একটা জীবনশৈলী। এই রসিকতা বোধ হয়তো সকলের থাকে না কিন্তু রবীন্দ্রজীবনচরিত পড়ার মুহূর্তে এইসব গল্পে নিজেদেরকে তো খুঁজে নিতে পারি।পারি ত রসের ভান্ড না হোক পেয়ালা ভরে নিতে---। এই পঁচিশে বৈশাখে সেই রসিক রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালন করি না কেন!!!!!!

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

1 Comments