জ্বলদর্চি

রাতের তিন তারাই আছে রবির আলোর গভীরে /সুবর্ণা নাগ


রাতের তিন তারাই আছে রবির আলোর গভীরে

সুবর্ণা নাগ


I seem to have loved you in numberless forms, numberless times...
In life after life, in age after age, forever.
My spellbound heart has made and remade the necklace of songs,
That you take as a gift, wear round your neck in your many forms,
In life after life, in age after age, forever. ..... 
     
    (*Unending Love* , By Rabindranath Tagore) 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপামর বাঙালির চিন্তন, মনন, সাহিত্য ও জীবনবোধের এক অভিধান, অভিভাবকও তিনি। মনের রসদের তিনি দাতা, আমরা গ্রহীতা , এ সম্পর্ক চিরন্তন। তিনি জীবনদেবতার পূজারী। রবিঠাকুরের সৃষ্টি সুধায় সিক্ত হয়ে আমরা সুখের উৎযাপনে বা দুঃখের বিলাসিতায় সমান স্রোতে ভেসে গেছি। কবিগুরুর দীক্ষায় দেহের সীমানা ছাড়িয়ে অন্তর স্পর্শ করাই প্রকৃত প্রেম, সমর্পণই উৎসব আর আত্মার উৎসর্গেই তৃপ্তি।
   এইরকম এক সৃজনশীল প্রতিভা তায় অসাধারণ সুপুরুষ, কাজেই তাঁর জীবনে নারী প্রসঙ্গটি নিয়ে আজও পাঠকের মনে কৌতূহলের শেষ নেই। এ বিষয়ে বিভিন্ন রবিজীবনীর সহায়তায় আমরা কিছু তথ্যের সন্ধান করতে পারি। সেক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ভালোলাগা বা ভালবাসা তাঁর জীবনেও এসেছে স্বাভাবিক ছন্দেই। ঠাকুরবাড়ির উদার মুক্ত সারস্বত পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার ফলে নিতান্ত অল্প বয়সেই তাঁর অধিক মানসিক পরিণতি ঘটেছিল। বয়সে বড় নারীরাই তাঁর প্রথম জীবনে সৃষ্টির প্রেরণা।
    *রবীন্দ্রনাথের তখন সতেরো বছর, আনা তড়খড় তেইশ*

অন্নপূর্ণা পান্ডুরঙ তড়খড় ওরফে আনা তড়খড় ছিলেন তৎকালীন বোম্বাইয়ের শেরিফ  ও 'প্রার্থনা সমাজের' প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার আত্মারাম পাণ্ডুরঙ তড়খড় এর দ্বিতীয় কন্যা।  রবীন্দ্রনাথ নিজে আনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে দিলীপকুমার রায়ের কাছে আনাকে ‘মারাঠী ষোড়শী’ বলে উল্লেখ করেছেন। মজার ব্যাপার হল এই উল্লেখ থেকে মনে হতে পারে আলাপের সময় তখন সতেরো বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথের থেকে ‘ষোড়শী আনা’ যেন এক বছরের ছোট। বাস্তবে অবশ্য আনা রবীন্দ্রনাথের থেকে ছ বছরের বড় ছিলেন। তার তথ্য, প্রমানও রয়েছে বিস্তর। 

আনা ১৮৭৬ সালে ইংলণ্ডে গেছিলেন। ১৮৭৮ সালে ২৩ বছর বয়সে ইংলণ্ড থেকে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়। রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বোম্বাই থেকেই ইংলণ্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন কবি। বোম্বাই বাস পর্বে তাঁর সঙ্গে আনার প্রথম আলাপ হয়।
বিলেত যাবার আগে কলকাতা থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে গিয়েছিলেন আমেদাবাদে তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। সত্যেন্দ্রনাথ তখন আমেদাবাদে সেশন জাজ এবং উল্লেখ্য ব্রিটিশ অধীন ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস।তাঁর আগ্রহেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর  রাজি হন রবীন্দ্রনাথকে ব্যারিস্টার হবার জন্য বিলেতে পড়তে পাঠাতে। আমেদাবাদ এ কিছুদিন থাকার পর রবীন্দ্রনাথকে সত্যেন্দ্রনাথ পাঠিয়ে দেন বোম্বাই-এর এক পরিবারের কাছে, গৃহবিদ্যার্থীরূপে। ডাক্তার আত্মারাম পাণ্ডুরঙ এর অতীব সুন্দরী,মেধাবী ও বিদূষী কন্যা আনা তখন সদ্য বিলেত থেকে ফিরেছেন, তিনি নানা ইউরোপীয় ভাষা ও আদব কায়দা জানেন। পাণ্ডুরঙ পরিবারে মাস দুয়েক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সময়টায় আনা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষয়িত্রী হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথকে বিলিতি আদবকায়দা ও ইংরেজী শেখাবার ভার পরে তাঁর ওপর। 'ছেলেবেলা'তে পরুবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “মেজদাদা মনে করলেন, বিদেশকে যারা দেশের রস দিতে পারে সেই রকম মেয়েদের সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে দিতে পারলে হয়তো ঘরছাড়া মন আরাম পাবে। ইংরাজী ভাষা শেখবারও সেই হবে সহজ উপায়।” তবে এই সম্পর্ক ছাত্র শিক্ষিকার সম্পর্কেই কেবল আবদ্ধ থাকে নি।
    এই প্রসঙ্গে কবিমানসী গ্রন্থে অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য আমাদের জানিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব ও কাব্যপ্রতিভায় আনা অনুরক্ত হন। “সম্পর্ক বদল হল। বিদ্যার্থী বসলেন গুরুর আসনে, আর শিক্ষয়িত্রী হলেন নবীন কবির কাব্য সংগীত সৌন্দর্যমুগ্ধ অনুরাগময়ী প্রিয়শিষ্যা।” সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের কবিকাহিনী ভারতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তার অনুবাদ আনাকে শোনাতেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু শুধু অনুবাদে আনার মন ভরে নি। প্রিয়-কবির কাব্যরস আস্বাদনের জন্য তিনি বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ বিলেতে থাকার সময় কবিকাহিনী গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং তা পাঠানো হয় আনার কাছে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এটি পাঠিয়েছিলেন এবং আনা এজন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে যে জবাবী চিঠি পাঠান, সজনীকান্ত দাস সেটি আবিষ্কার করেন। আগ্রহী পাঠক জগদীশ ভট্টাচার্যের কবিমানসীর প্রথম খণ্ডের ১০৪ – ১০৫ নং পাতায় আনার লেখা সম্পূর্ণ চিঠিটি পাবেন।
   রবির প্রতি আনার ভাবাবেগ এতটাই প্রবল ছিল যে, তাঁর চিঠির পংক্তিতে উঠে আসে, 
“Poet, I think that even if I were on my death-bed your songs would call me back to life” . রবীন্দ্রনাথের ওমন তেজদীপ্ত মুখশ্রীর প্রতি অনুরাগী আনার আবদার ছিল “ You must never wear a beard, donot let anything hide the outline of your face” . 
সেই সব দিনের কথা মনে করে আশি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ”Everyone knows that I have not followed that advice. But she herself did not live to see my disobedience proclaimed upon my face”.

রবীন্দ্রনাথ বিলেত চলে যাবার পর আত্মারাম পাণ্ডুরঙ তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে কোলকাতায় এসেছিলেন এবং আত্মারাম ফিরে যাবার পরেও আনা ও তাঁর দিদি বেশ কিছুদিন কোলকাতায় থেকে গিয়েছিলেন। ঠাকুর
পরিবারের সঙ্গে যে সকন্যা আত্মারাম পাণ্ডুরঙের এই পর্বে যথেষ্ট যোগাযোগ হয়েছিল, রবিজীবনীকার শুধু সেই অনুমানই করেন নি, আনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রণয়ের সূত্রে কিছু নির্দিষ্ট প্রস্তাবও তিনি রবীন্দ্রনাথের অভিভাবকদের দিয়েছিলেন – এমন কথাও ভাবতে চেয়েছেন।
 “রবি অনুরাগিণী আনার হৃদয় দৌর্বল্য দেখে কন্যাবৎসল ডাঃ পাণ্ডুরঙ হয়তো সেই অনুরাগকে সার্থক করার জন্য বিশেষ কোনও প্রস্তাব নিয়েই কলকাতায় এসেছিলেন”। অবশ্য এটি যে নিছক অনুমান, নির্দিষ্ট কোনও প্রমাণ যে নেই এরকম ভাবনার, তাও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

যদি এরকম কোনও প্রস্তাব থেকেও থাকে তা যে আর এগোয় নি কোনও বন্ধনের দিকে তা আমরা সবাই জানি। এর কয়েক মাস পরে ১৮৭৯ সালের ১১ নভেম্বর বরোদা কলেজের উপাধ্যক্ষ হ্যারল্ড লিটলডেলের সঙ্গে আনার বিবাহ হয়। এই বিবাহও কিন্তু অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ ছিল না, লাভ ম্যারেজই ছিল। আনা তড়খড়ের মৃত্যুর পর বামাবধিনী পত্রিকায় ১৮৯১ সালে যে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, সেখানে লেখা হয়েছিল, “ডবলিন নগরে বরদা কলেজের অধ্যাপক লিটলডেলের সহিত তাঁহার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এই সাক্ষাৎই প্রণয়ের মূল। এই প্রণয়ই পরিণামে পরিণয়ে পরিণত হয়”। সময়পর্ব অনুসরণ করে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আনা তড়খড়ের সম্পর্ক তাহলে আনা ও লিটলডেলের সঙ্গে প্রণয় ও পরিণয়ের মধ্যবর্তী পর্বের ব্যাপারই ছিল।

বিবাহের পরেও আনা রবীন্দ্রনাথকে ভুলে যান নি। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া আদরের ডাক নাম 'নলিনী'কে তিনি মনের মধ্যে রেখেছিলেন; দেশি ও বিলিতি সংবাদপত্রতে নানা প্রবন্ধ, গদ্য ও পদ্য লেখার সময় 'আনাবাই নলিনী' নামটি ব্যবহার করতেন। তাঁর এক ভাইয়ের ছেলের নাম রাখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ।
নলিনী নামটি রবীন্দ্রনাথের নানা রচনাতেও ঘুরে ফিরে এসেছে। জগদীশ ভট্টাচার্য তাঁর কবিমানসীর দুই খণ্ডে এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। শৈশব সংগীতের প্রভাতী, গোলাপবালা প্রভৃতি কবিতায় আনার সঙ্গে সম্পর্ক সূত্রটির আভাস রয়েছে। তার গানের রূপটি আবার ধরা আছে ‘রবিচ্ছায়া’তে। কবিকাহিনী তো রচিতই হচ্ছিল আনার সঙ্গে সময় কাটানোর সমকালে। ফলে তার মধ্যে আনা রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের ছাপ খুঁজে পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এরপর নলিনী আবার ফিরে এসেছেন ‘ভগ্নহৃদয়’ নাট্যকাব্যে। এরপর ১৮৮৪ তে (১২৯১ বঙ্গাব্দে) নলিনী নামে একটি গদ্যনাট্য লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য প্রথম প্রকাশের পর থেকে বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলীর অচলিত সংগ্রহের প্রথম খণ্ডে পুনর্মুদ্রণের আগে অবধি এই বই আর প্রকাশিত হয় নি। ‘নলিনী’র সংশোধিত গীতিনাট্যরূপ হল ‘মায়ার খেলা’। অনেক পরে লেখা হয় ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘ক্ষণিকা’ ও ‘কিশোর প্রেম’ নামের দুটি বিখ্যাত কবিতা।১৮৭৯ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতিতে  লিখেছেন-
"
শুন     নলিনী, খোলো গো আঁখি--
       ঘুম      এখনো ভাঙিল না কি!
       দেখো, তোমারি দুয়ার-'পরে
       সখী,    এসেছে তোমারি রবি॥
       শুনি    প্রভাতের গাথা মোর
       দেখো ভেঙেছে ঘুমের ঘোর,
    জগত উঠেছে নয়ন মেলিয়া নূতন জীবন লভি।
তবে    তুমি কি সজনী জাগিবে নাকো,
   আমি যে তোমারি কবি॥..."

১৮৯১ সালে ৫ জুলাই মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান আনা। রোগের নাম যক্ষ্মা। মৃত্যুর আগেই বিয়ে ভেঙ্গে গিয়েছিল আনার। তার দুইটি মেয়ে সন্তান ছিল।

আনা বহুগুণে যে গুণান্বিতা ছিলেন তা তাঁর মৃত্যুর পরে বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত অজ্ঞাতনামা রচনাকারের লেখাটিতে উল্লিখিত হয়েছে। “গীতবাদ্যে তিনি সুনিপুণা ছিলেন। মাতৃভাষা মহারাষ্ট্রীয় ব্যতীত তিনি ইংরাজী, ফরাসী, জর্ম্মণ ও পর্ত্তুগীজ ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। এই সকল ভাষায় কথোপকথন করিতে পারিতেন। তিনি সংস্কৃতও কিছু কিছু জানিতেন। তাঁহার রীতি নীতি চাল চলন এত ভাল ছিল, তিনি এরূপ সদালাপিনী ছিলেন, যে একবার যিনি তাঁহার সহিত বাক্যালাপ করিয়াছেন, তিনিই তাঁহার হৃদয়গ্রাহিতার প্রশংসাবাদ না করিয়া থাকিতে পারিবেন না।”
   'নলিনী' যে তাঁর হৃদয়ের ওপর আঁচড় কেটেছিলেন, সে কথা কেবল গান আর নাটকের ভাষায় নয়, বন্ধুদের কাছেও পরে কবি সে গল্প করেছেন। এমনই এক অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় ধূর্জটিপ্রসাদ আর অতুলপ্রসাদ সেনের কাছে আনা আর তার সম্পর্ক কীভাবে কতোটা গড়ে উঠেছিলো, তা বলেছিলেন আনাকে শেষবার দেখার ঊনপঞ্চাশ বছর পরে, পয়লা জানুয়ারি,১৯২৭-এ, 
"আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই না ঘুরত আমার আনাচে কানাচে। আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিত সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে। এ কথা আমি মানব যে আমি টের পেতাম ঘটবার মতন একটা কিছু ঘটেছে, কিন্তু হায় রে, সে হওয়াটাকে উস্কে দেওয়ার দিকে আমার না ছিল কোনো রকম তৎপরতা, না কোনো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। ... একদিন সন্ধ্যাবেলা, ... সে আচমকা এসে হাজির আমার ঘরে। চাঁদনি রাত। চারদিকে সে যে কী অপরূপ আলো হাওয়া! কিন্তু আমি কেবলি ভাবছি বাড়ির কথা। ভালো লাগছে না কিছু। ... সে বলে বসল আহা কী ভাবো আকাশপাতাল। তার ধরনধারণ জানা সত্ত্বেও আমার একটু কেমন কেমন লাগল। কারণ সে প্রশ্ন করতে না করতে একেবারে আমার শোবার খাটের উপরেই এসে বসল। ... আচ্ছা আমার হাত ধরে টানো তো, টাগ অব ওয়ারে দেখি কে জেতে। ... শেষে একদিন বলল তেমনি আচমকা : জানো কোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার? বলে খানিক বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল নিদ্রাবেশে। ঘুম ভাঙতেই সে চাইল তার দস্তানার দিকে। একটিও কেউ চুরি করেনি।"[প্রশান্ত পালের 'রবিজীবনী', দ্বিতীয় খণ্ডে উদ্ধৃত]
   কবিগুরুর কাছে প্রেম আদতে পূজারই অন্য রূপ,
দৈহিক চাহিদার ঊর্ধ্বে হৃদয়ের সমর্পণ। 
  আনা তড়খড়ের পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যোগাযোগ রেখেছিলেন। আনার ছোটবোন মানকে অনেক পরে ১৯১৮ সালে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ১৭ বছর বয়সে আনাদের গৃহে দিন যাপনের মধুর স্মৃতি স্মরণ করেছেন, সময় সুযোগ মতো আবার সেখানে যেতে চেয়েছেন।

অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন যে “পূরবী’র ‘ক্ষণিকা’ কবিতাটি আনার উদ্দেশ্যে কবির শ্রেষ্ঠ কাব্যতর্পণ। 

"খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা—
খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা।
কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগান্তরে
গোধূলিবেলার পান্থ জনশূন্য এ মোর প্রান্তরে
            লয়ে তার ভীরু দীপশিখা।
দিগন্তের কোন্‌ পারে চলে গেল আমার ক্ষণিকা।

ভেবেছিনু গেছি ভুলে; ভেবেছিনু পদচিহ্নগুলি
পদে পদে মুছে নিল সর্বনাশী অবিশ্বাসী ধূলি।
আজ দেখি সেদিনের সেই ক্ষীণ পদধ্বনি তার
আমার গানের ছন্দ গোপনে করেছে অধিকার;
      দেখি তারি অদৃশ্য অঙ্গুলি
স্বপ্নে অশ্রুসরোবরে ক্ষণে ক্ষণে দেয় ঢেউ তুলি।...."
    
*রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রথম বিদেশিনী : লুসি স্কট*

 আঠারো বছর বয়সে যৌবনের প্রথম অন্তরঙ্গতার এই শিহরণ নিয়েই কবি বিলাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন শুক্রবার ১৮৭৮ সালে ‘পুনা’ স্টিমারযোগে। আলেকজান্দ্রিয়া, ব্রিন্দিষি, প্যারিস ঘুরে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের সাসেক্স কাউন্টির সমুদ্র তীরবর্তী শহর ব্রাইটনে মেজ বউঠান জ্ঞানদা নন্দিনীর বাসায় এসে পৌঁছলেন ১০ই অক্টোবর নাগাদ ব্রাইটন আর হোভ-এরগা-লাগাও ‘মেদিনা ভিলা’র বাড়িগুলোর একটিতে। এখানে ভাইঝি ও ভাইপো বিবি সুরণের বিচিত্র উৎপাতে কবির দিন কাটতে লাগলো বেশ। 
তিনি মোটেই ভালো লাগাতে পারেননি নিয়ম আর পাঠক্রম অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শেখার পদ্ধতিকে। ভালো লাগতো কেবল ইংরেজির অধ্যাপক হেনরি মর্লির সাহিত্যের পাঠ। ভর্তি হয়ে তিনি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন কলেজের সামনের দিকের রাস্তায়, রিজেন্টস স্ট্রিটে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে অতিথি হিসেবে বাস করতে আরম্ভ করলেন ডাক্তার জন স্কটের বাড়িতে। ছোট শহর ব্রাইটেনের ইঙ্গ সমাজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়ে গেল অচিরে। সুদর্শন রবীন্দ্রনাথ তখন আঠারো বছরের তরুণ। বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে হৃদয়ের লেনদেন হয় স্কট কন্যা লুসির সঙ্গে। লন্ডনে স্কট পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু দিন ছিলেন। স্কট পরিবারে ছিল চার মেয়ে। লুসি স্কট সবার ছোট। সেজো ও ছোট দুজনেই একসাথে অনুরক্ত হয়ে পড়লেন সুদর্শন কবি রবীন্দ্রনাথের। 
তিনি ‘ইউরোপ-প্রবাসীর পত্রে’ এ পরিবারের পরিচয় দিয়েছেন।  সে বাড়িতে সার্জন জন স্কট ছাড়া আরও ছিলেন তার স্ত্রী, মেরী, তাদের তিরিশোর্ধ্ব কন্যা, সাতাশ বছর বয়সী মেয়ে ফ্যানি, আর পঁচিশ বছরের কন্যা লুসি। গৃহভৃত্য ছিলো দু'জন। স্কট পরিবারে একটি পুত্রও ছিলো রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিন বছরের বড়ো। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিলো পরিবারের ছোট দুই মেয়ে ফ্যানি আর লুসির, পূর্বেই যা উল্লিখিত। রবীন্দ্রনাথেরও একটু পক্ষপাত ছিলো তাঁর চেয়ে ছয় বছরের বড়ো লুসির প্রতি। রবির জীবনে তিনিই প্রথম বিদেশিনী অনুরাগিণী। 
   লুসি তাঁর কাছে বাঙলা শিখতে চান। রবীন্দ্রনাথও শেখাতে রাজি ছিলেন। তাঁকে তিনি আশ্বাস দেন যে, বাঙলা ভাষা ইংরেজির চেয়ে শেখা সহজ, কারণ বাঙলা বানান এবং উচ্চারণের মধ্যে পার্থক্য নেই ইংরেজির মতো। কিন্তু সাধারণ 'কখন'-এর মতো শব্দ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখলেন, এর উচ্চারণ 'ক খ ন' নয়, বরঙ এর উচ্চারণ হলো : 'কখোন্', অথচ তিনটি অক্ষরই লেখা হয়েছে অ-কারান্ত বর্ণ দিয়ে। তখনই রবীন্দ্রনাথ প্রথম সচেতন হলেন বাঙলা ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে। বছর পাঁচেক পরে তিনি বাঙলা ভাষার প্রথম বর্ণনামূলক ব্যাকরণের সূচনা করেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পত্রিকায়। শেষ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একেবারে নতুন ধরনের বই প্রকাশিত হয় 'শব্দতত্ত্ব' (১৯০৮/৯)। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে লুসির পরোক্ষ অবদান আজও রয়ে গেছে বাঙলা ভাষাতত্ত্বে। তিনিই রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখালেন, বাঙলা বানান আর উচ্চারণ মেলে না। 

লুসির আরেকটা অবদান তিনি রবীন্দ্রনাথকে বেশকিছু ইংরেজি, আইরিশ আর স্কটিশ গান শিখিয়েছিলেন।
লুসি বেশ ভালো পিয়ানো বাজাতে পারতেন। তাদের মধুময় সেই দিনগুলোতে লুসি পিয়ানো বাজাতেন আর রবি গান গাইতেন। কখনো কখনো একসাথে গেয়ে উঠতেন দুজনে..

"Ye Banks And Braes o bonne doon
How can ye bloom sae fresh and fair
How can ye chant ye little birds
And I sae weary fu o' care?
Thou'll break my heart thou'll warblin bird
That wantons thro the flowering thorn
Ye minds me o' departed joys
Departed never to return..."
পরবর্তী কালে যার সুরের আদলে সুরারোপিত হয় 
'ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদু বায়'.. গানটিতে। 
    উল্লেখ্য এগুলোর প্রভাবেই দেশে ফিরে তিনি এসব গানের অনুকরণে বেশকিছু গান রচনা করেছিলেন। অপেরা দেখে এসে দেশে ফিরেই 'বাল্মীকি প্রতিভা' [১৮৮০] আর কয়েক বছর পরে 'মায়ার খেলা' [১৮৮৮] লিখেছিলেন। 
সেই সময় পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রেনাথের চিঠি এসে হাজির- বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়া বন্ধ করে দেশে ফিরে এসো। হঠাৎ এমন তলব কেন? তবে কি কানাঘুষায় রবীন্দ্রনাথের এই বন্ধুত্বের কথা তাঁর কাছেও পৌঁছেছিল? জ্ঞানদা নন্দিনী দেবী কি শ্বশুর মশাইকে কিছু জানিয়েছিলেন দেবরের মতিগতি সম্পর্কে? 
 রবীন্দ্রনাথের সাথে লুসির সম্পর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, তবু লুসি তার পরের জীবনে আর কোন দিন বিয়ে করেননি। তবে তাদের সেই সুরেলা সন্ধ্যা যাপন আদতে স্পষ্ট ছাপ রেখে গেছে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গানের সুরে, লুসি স্কটের থেকে শোনা ইংরেজি বা অন্যান্য
ভাষার গানগুলির সুরের মূর্ছনার রেশ রয়ে গেছে নানা রবীন্দ্র সঙ্গীতে। 
প্রেমের এই ভাঙা গড়া খেলায় প্রবাসী প্রেমিকাকে নিয়ে কবির রচনা করতে হয় বিচ্ছেদের পঙ্ক্তিমালা-
‘কিন্তু আহা, দু’দিনের তরে হেথা এনু,
একটি কোমল প্রাণ ভেঙ্গে রেখে গেনু।’
   বিলেতে সেইসময় আরো কিছু নারীর সাথে সখ্যতা তৈরি হয়েছিল রবির। লুসির সাথে লং, মুল কিংবা ভিভিয়ান সেইসময়ের বিলেতের নারীদের কাউকেই কোনোদিন ভোলেননি কবি।
    এই পরিবার আর লুসির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার দুটি তথ্য পাওয়া যায়। একবার যখন এই পরিবারের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ বিদায় নিলেন, বছরখানেক থাকার পর। অন্যটা, যখন ১৮৯০ সালে, ১২ বছর পর যখন তিনি দ্বিতীয়বার বিলেত গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে সেই পুরনো বাড়িতে ফিরে গেলেন। 

১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় ফ্রান্স হয়ে সত্যেন্দ্রনাথ এবং তার পরিবারের সঙ্গে তিনি অক্সাস জাহাজে করে দেশে ফিরে আসেন। স্কট পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সেই পরিবার এবং তিনি নিজে বিশেষ বিষন্ন হয়েছিলেন এ কথা তিনি নিজেই লিখেছেন। তিনি জীবনস্মৃতিতে স্কট পরিবারের সঙ্গে তার সম্পর্কের বর্ণনা দিয়েছেন।
স্কট-কন্যারা কী বলে বিদায় দিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সে কথা জীবনস্মৃতিতে লেখেননি, কিন্তু এই কন্যারা নিজেরা কেঁদেছেন, কবিকেও কাঁদিয়েছেন। কবিতায় এর স্বীকৃতি দেখতে পাই নিচের পঙক্তিগুলোতে।

"ফুরালো দুদিন
কেহ নাহি জানে এই দুইটি দিবসে
কি বিপ্লব বাধিয়াছে একটি হৃদয়ে।
দুইটি দিবস চিরজীবনের স্রোত দিয়াছে ফিরায়ে
এই দুই দিবসের পদচিহ্নগুলি
শত বরষের শিরে রহিবে অঙ্কিত
যত অশ্রু বরষেছি এই দুই দিন
যত হাসি হাসিয়াছি এই দুই দিন
এই দুই দিবসের হাসি অশ্রু মিলি
হৃদয়ে স্থাপিবে দিবে চির হাসি অশ্রু।" (বসন্ত বরষা)

🍂

তিনি দ্বিতীয়বার বিলেতে যান ১৮৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। সেবারে তিনি লিখেছিলেন ডায়েরি। তা থেকে জানা যায়, ১১ সেপ্টেম্বর তিনি যান তাঁর বহু স্মৃতিবিজড়িত ডক্টর জন স্কটের বাড়িতে। সেখানে গিয়ে শুনলেন, স্কট পরিবার সেখানে আর থাকে না। তারা চলে গেছেন দক্ষিণ লন্ডনের উপকণ্ঠে। কবি তাঁর তখনকার মনের অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-

"ভারী নিরাশ হৃদয়ে আমার সেই পরিচিত বাড়ি থেকে বেরলুম। মনে কল্পনা উদয় হলো, মৃত্যুর বহুকাল পরে আবার যেন পৃথিবীতে ফিরে এসেছি। আমাদের সেই বাড়ির কাছে এসে দ্বারীকে জিজ্ঞাসা করলুম আমার সেই অমুক এখানে আছে তো? দ্বারী উত্তর করলো, না সে অনেক দিন হলো চলে গেছে! আমি মনে করেছিলুম কেবল আমিই চলে গিয়েছিলুম, পৃথিবীসুদ্ধ আর সবাই আছে। আমি চলে যাওয়ার পরেও সকলেই আপন আপন সময় অনুসারে চলে গেছে। তবে তো সেই সমস্ত জানা লোকেরা কেহ কারও ঠিকানা খুঁজে পাবে না। জগতের কোথাও তাদের আর নির্দিষ্ট মিলনের জায়গা রইলো না।"... [প্রশান্ত পালের রবিজীবনী, তৃতীয় খণ্ডে উদ্ধৃত। পৃ. ১৫৫]।

স্কট পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে দেশে ফিরে আসার আগ মুহূর্তে বিষন্ন হয়েছিলেন,১৯২৪ সালের ১৯ নভেম্বর তেষট্টি বছর বয়সে কিশোরবেলার সেই নারীদের স্মরণ করেছেন কবি তার ‘কিশোর প্রেম’ কবিতায়।..

‘এই জীবনে সেই তো আমার প্রথম ফাগুন মাস
ফুটলো না তার মুকুলগুলি
শুধু তারা হাওয়ায় দুলি
অবেলাতে ফেলে গেছে চরম দীর্ঘশ্বাস
আমার প্রথম ফাগুন মাস ।’

মৃত্যুর চার বছর আগে 'প্রান্তিক' নামে কবিতায় কিশোর বেলার সেই প্রেমের কথাগুলো আবারো বলেছেন কবি।
সত্তর বছর বয়সে লেখা ‘পশ্চিম যাত্রার ডায়রী’তে তিনি লুসি স্কটের কথা স্মরণ করেছেন। লুসির পুরো পরিবার রবীন্দ্রনাথের জীবনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।কিন্তু লন্ডনে লেখাপড়া করার ব্যাপারে তার যে আগ্রহ তেমন ছিলো না, আমরা আগেই তা লক্ষ্য করেছি।
  আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ শুনে লুসি নাকি অভিনন্দন জানিয়ে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে চিঠি লেখেন, যদিও ঠিকানার অঘটনে কবি সে চিঠি পাননি।
   
  উল্লেখ্য আরো একটি ঘটনা- ১৯২৯ সালে রবীন্দ্রনাথ তখন কানাডায়, বয়স ৭০। শান্তিনিকেতনে একটি চিঠি আসে রবীন্দ্রনাথের কাছে। চিঠিটি লিখেছেন ইংরেজ এক ভদ্রলোক যিনি লুসিকে তার পিসি বলে পরিচয় দিচ্ছেন এবং তিনি রবীন্দ্রনাথ আর লুসির সম্পর্কের কথা জানতেন বলে দাবি করছেন।
 তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন, পুরো জীবনে বিয়ে না করা লুসি এখন অসুস্থ বৃদ্ধা এবং দরিদ্র এবং তার শেষ শয্যায়ও তিনি রবিকে স্মরণ করছেন বারবার। কিছুু টাকা পয়সার সাহায্য প্রয়োজন, এই ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখেছেন তবে শর্ত দিয়েছেন বৃদ্ধা লুুসি স্কট যেন কোনভাবেই না জানে যে তিনি  রবীন্দ্রনাথের কাছে আর্থিক সাহায্য চাইছেন।
  রবীন্দ্রনাথ তাকে টাকা পাঠিয়েছিলেন কিনা তা জানা যায়না। তবে লুসিকে যে রবীন্দ্রনাথ মনে রেখেছিলেন সেটা জানা যায় তার বহু রচনার মধ্য দিয়ে।

*তোমিকো ওয়াদা কোরা- এক জাপানী হৃদয়ের গাথা*

১৯১৬ সালে জাপান গেলেন রবীন্দ্রনাথ। তখন তার বয়স ৫৫। কলেজ ছাত্রী তোমিকো ওয়াদা কোরার বয়স তখন মাত্র ২০। 'Song of offerings' পড়ে তখন বিশ্ব জুড়ে পাঠক হৃদয় উদ্বেলিত, তেমনি জাপানের তোমিকো  'Song of offerings'  এর মধ্য দিয়ে অদেখা কবির পাদপদ্মে যেন হৃদয় রেখে দিয়েছিলেন। আর কবিকে দর্শনের আকাঙ্ক্ষার অবসান হয়েছিল যেন দৈব কৃপায়। 
রবীন্দ্রনাথের আগমনবার্তায় জাপানে রটে গিয়েছিল যে ‘সেকেন্ড বুদ্ধ’ আসছেন তাই বন্দরে বন্দরে সর্বত্র হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। জাপানের ‘কোবে’ বন্দরে রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনার জন্য জাপানের বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাপানের সর্বশ্রেষ্ঠ আর্টিস্ট ইয়োকোহামা টাইকান, পেন্টার কাটসুকা এছাড়াও শান্তিনিকেতনের জুজুৎসু শিক্ষক কানো আর জাপানের প্রিন্ট কাওয়াগুচি।
সফরের কার্যক্রমে তোমির কলেজেই অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন কবি। প্রথম দেখাতেই যেন তোমির ঈশ্বর দর্শন। দেশ কাল পাত্র সব ভুলে আজীবনের এক অদৃশ্য বন্ধনে যেন বাধা পড়লেন তোমি।
     সেবারই কলেজ ছাত্রছাত্রীদের সাথে একটা সফরে যান কবি। সেই সফরে গভীর আন্তরিকতার সম্পর্ক তৈরি হয় তোমি ও রবীন্দ্রনাথের।তোমি যেহেতু ইংরেজি জানতেন। কবির ভাষণের অনুবাদের কাজটা করতেন তিনি। সাথে কবিকে দেখাশোনা, ঘর গোছানো সহ সকল কাজের দায়িত্ব ছিল তার উপর। সেবাই ছিল তোমিকোর কবি-উপাসনার পথ। কবির প্রতি তার মুগ্ধতা ছিল এতটাই যে তিনি বালিশে লেগে থাকা কবির চুল সংগ্রহ করে রাখতেন গোপনে।এভাবেই কবির স্নেহের পরশে ও তোমিকোর সেবায় কবির সেই বারের জাপানের সফর শেষ হলো অমর স্মৃতিলিপি নিয়ে। 
 জাপান থেকে ফেরার তিন বছর পরে ১৯১৯ সাল কবি  আমেরিকায় গিয়েছিলেন। কবির বয়স তখন ৫৮ আর তোমি ২৩। তোমি তখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কবি আমেরিকায় এসেছেন শুনে তার সাথে দেখা করতে এবার নিউইয়র্ক  গেলেন তোমি।জাপান থাকতে বালিশে লেগে থাকা মাথার যে চুল সযন্তে রেখে দিতেন তোমি, সেই চুল এবার সাথে করে নিয়ে গেছেন
আমেরিকায়। নিউইয়র্কে  দুজনের বন্ধন যেন আরো গাঢ় হয়। আবারো জাপানে যাবার আমন্ত্রণ জানায় তোমি। তোমির হাত ধরে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন কবিগুরু।
  পাঁচ বছর পর ১৯২৪ সালে আবার জাপান গিয়েছিলেন কবি, তখন তার বয়স ৬৩ বছর। উঠেছিলেন নাগাসাকিতে তোমির বাড়িতে। সে সময় তোমির আত্ম নিবেদন , কবি-
আরাধনা পূর্ণতা পায় যেন। 
 ১৯৩৪ সালে বিয়ে করেন তোমি। বিয়ের পরও রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অনুরাগ কমেনি এতটুকু। 
  ১৯৩৬ সালে তোমিকো শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন কবিকে দেখতে। তখন ভগ্ন শরীরে চিত্রাঙ্গদার মহড়া দিচ্ছিলেন ৭৫ বছরের রবীন্দ্রনাথ। দেখে মুগ্ধ ও বিহ্বল হয়েছিলেন তোমি।
কথা শেষে আবারো জাপানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কবিকে। কিন্তু সেই আমন্ত্রন আর রক্ষা করা হয়নি কবির। 
   ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাটম বোমা ফেলা হয় নাগাসাকিতে। কি নির্মম বিধ্বংসী সেই যুদ্ধ। তবু ভালো কবিকে দেখতে হয়নি তার প্রিয় বান্ধবীর শহর ধ্বংসের লীলাযজ্ঞ। তার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বিশ্বকবি।

রবির আলোর গভীরে এভাবেই কত শত তারা আজও জ্বাজল্যমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন, দর্শন ও সাহিত্য প্রভাবিত হয়েছে এইরকম আরও কতক বিদূষী নারীদের সংস্পর্শে। কবির জীবনে তাঁদের আগমন ও গমনও হয়েছে কালের নিয়মে কিন্তু কবি তাঁদের অমর করে গেছেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। 

"...বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
‘আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে-
কিছুই কি নেই বাকি?’

একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
‘রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।’
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, ‘থাক্, এখন যাও ও দিকে।’
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে।
আমি চললেম একা।"
       ('হঠাৎ দেখা' - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) 

 
তথ্য ঋণ:
১) 'কবিমানসী' - জগদীশ ভট্টাচার্য
২) 'রবিজীবনী'- প্রশান্ত পাল
৩) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন গান, কবিতা, পত্র ও প্রবন্ধ। 
৪)'রবীন্দ্রজীবনী'- প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়
৫)গুরুদেব- রানি চন্দ।
 ৬) ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য
৭) বিশেষ কৃতজ্ঞতা - শ্রীনিবাস অধিকারী

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

1 Comments

  1. রবির তিন তারা ---খুব সুন্দর

    ReplyDelete