জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে /ত্রয়োদশ পর্ব/মলয় সরকার

নিজো ক্যাশলের প্রধান দরজার উপরের কারুকাজ

উদয়ের পথে
ত্রয়োদশ পর্ব

মলয় সরকার

(ভ্রম সংশোধনঃ আন্তরিক দুঃখিত যে,  গত দ্বাদশ পর্বে টাইপ প্রমাদজনিত কারণে ওডাওরা থেকে কিয়োটো যাওয়ার ট্রেনের ভ্রমণ সময় বলা হয়েছিল ৪ ঘণ্টা ৪৮ মি, যা আসলে হবে ১ ঘণ্টা ৪৮ মি।এটি, পাঠকদের কাছে অনুরোধ , সংশোধন করে নেওয়ার জন্য।আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু শ্রী অঞ্জন বাগচী এই ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর প্রতি রইল আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা)

পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এখানে খুব ভাল। ইচ্ছা থাকলে বা সময় থাকলে গাড়ি না চেপে বাসেও ঘোরা যায় অনেক কম পয়সায়। 
অবশ্য এখানে দেখলাম, আমেরিকান বার্গার কিং, স্টার বাক্স,ম্যাকডোনাল্ডও ভালই বাজার জমিয়েছে।
আর একটা জিনিস দেখলাম, বাস ট্যাক্সি বা হোটেল কোথাও এখানে টিপস দেওয়ার কোন সিস্টেম নেই। টিপস দিলে সেটিকে এরা অপমান মনে করে।এটা খুব ভাল পদ্ধতি। টিপস আসলে মানুষকে লোভী করে তোলে ও চারিত্রিক অবনমন করে। একটা পরিশ্রমী জাতি কখনও টিপস নেয় না। এ ব্যবস্থা সেজন্য চীনেও দেখি নি। অথচ তাদেরই পাশের দেশ আমরা, কোথাও টিপস শুধু নয় , আমরা জেনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, মোটা রকমে ঘুষ না দিয়ে কোন কাজই হবে না, এমন কি শিক্ষা, চিকিৎসার মত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও।একটা দেশ কত নীচু না হলে এরকম হতে পারে না, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝছি। তাই আমি যে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই, এটাই দেখি যে, আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় কত নীচে।এই অপমান আর লজ্জা আমাকে কুরে কুরে খায়। অথচ কিছুই করতে পারি না।
নিজো ক্যাশল

রাত্রে উবেরে অর্ডার করে ঘরে বসেই খাওয়া হল সুশি সাসিমি, মেসো সুপ আর টেম্পুরা। খারাপ নয় খেতে।

পরদিনে সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর মেঘলা।এখানে বৃষ্টি প্রায়ই হয় ঝিরঝিরে, তাতেই শহর সমান তালে চলে।
আজ মা মেয়ের দুজনেরই গা ব্যথা, ক্লান্তি, মাথাব্যথা ইত্যদি। ঘরে একটু গড়িয়ে চলা সময়। কিন্তু আমাদের ফেরার সময় তো বাঁধা, তাই সময় তো বসে থাকবে না। যদিও ছেলে বলছে,এক কাজ কর, সময় কিছু বাড়িয়ে নাও, টিকিট পেছিয়ে দিচ্ছি।
সে তো তার মত বলল, কিন্তু আমাদের কাজের হিসাব তো এখানে বাঁধা হয়ে আছে। একদিনও পিছানো যাবে না। তা না হলে আমার ইচ্ছা ছিল জাপানে আরো অন্ততঃ ১৫ দিন থেকে ,আরও ভাল করে দেখে আসতে।সেটা হল না। যে দেশে এসে রবীন্দ্রনাথ তাদের শিল্প , রুচির প্রেমে পড়েছিলেন, যদিও একসময়, শাসকদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, তবু ভারত জাপান মৈত্রী যে তাঁরা হাত ধরেই শক্ত হয়েছিল, তাতে তো কোন দ্বিমত নেই।সেই দেশকে আরও ভাল করে চেনার ইচ্ছা ছিল।রাসবিহারী এসে এ দেশের মেয়ের প্রেমে বাঁধা পড়ে সারাজীবন এখানে থেকে গেলেন।
জনান্তিকে বলি, আমিও যে এদেশের মেয়ের সেবা যত্নের প্রেমে পড়ি নি তা কিন্তু নয়। সে গল্পটা এখন তোলা থাক। পরে শোনাব।
ক্যাশলের ভিতরের সযত্নে তৈরী জাপানী পদ্ধতির জলাশয়

তবে টোকিওতে অত ঘুরলেও কাছেই রেনকোজি মন্দিরে যেতে ইচ্ছা হয় নি। ওখানে নাকি আমাদের নেতাজীর চিন্তা ভাবনা আদর্শ, যা আমরা আজীবন লালন করেছি, তার জীবন্ত সমাধি দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপামর ভারতবাসী ,ভারতের শাসকবর্গ ও তাঁর আত্মীয় স্বজন, যাঁরা সরকারের সঙ্গে এ ব্যাপারে এক সুরে সুর মিলিয়েছেন, তাঁদের কোন দিনও ক্ষমা করে নি।
যাক, ও সব তর্কের বিষয়ে না গিয়ে বলি, ওখানে আমার যেতে ইচ্ছা হয় নি, তাই যাই নি।

খানিকটা পরে বৃষ্টি একটু ধরলে, মা মেয়ে দুজনেই বলল, চল, দিনটা নষ্ট না করে ঘুরেই আসি।উবের ডেকে এগোনো হল, নিজো জো ক্যাশলের দিকে,যাকে এক কথায় বলে নিজো ক্যাসল, বা ইম্পিরিয়াল প্যালেস।
যাওয়ার সময় একটা মজা হল, বলি সে কথা।উবের তো এল। যথারীতি সুবেশ স্যুটেড বুটেড ড্রাইভার। এখানকার নিয়ম অনুযায়ী, নিজেই ট্যাক্সির দরজা খুলে দিল। আমরা বসলাম। সেও কখনও ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজীতে , কখনও জাপানী গুগল দাদার হাত ধরে, এইসব করে গল্প করতে করতে চলল। তারপর অনেক দূর আসার পর জিজ্ঞাসা করল , আচ্ছা, আপনারা যাবেন কোথায়? আমরা তো আকাশ থেকে পড়লাম। উবেরে তো সব গন্তব্য ও তার রাস্তার বর্ণনা নির্দিষ্ট করা থাকে, তবে? ও কি বোঝে নি? আর যদি না বুঝেই থাকে ,যাচ্ছে কোথায় আমাদের নিয়ে? যাই হোক, ভাল মানুষের মত মুখ করে বললাম, গন্তব্য। 

🍂

ও শুনে, একগাল বোকার মত হেসে বলল, ও হো, সে তো অনেকক্ষণ ছেড়ে এসেছি।
ও, মা! সে কি! যাক, কি হবে? আমরা বললাম, তাহলে আমরা যাব কি করে? ও বলল, ঠিক আছে ছেড়ে দিচ্ছি , চলুন। আবার গাড়ী ঘুরল। আবার খানিকক্ষণ পরে ও বোকা বোকা মুখ করে বলে, আর একবার বলুন তো ঠিক কোথায় যাব? ওকে আবার দেখালাম। ও দেখে শুনে, ওর ট্রান্সলেটরে কি দেখল, কে জানে- আরও জোর হেসে বলল, ওখানে কি দেখতে যাচ্ছেন? ওখানে তো আছে একটা সেপ্টিক ট্যাংক। শুনে আমাদের আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। এ কিরে বাবা, একটা নয় দুটো রাজবংশের কয়েকশ’ বছরের রাজগরিমা এর হাতে পড়ে এক মুহুর্তে হয়ে গেল, নিছক একটা দুর্গন্ধময় সেপ্টিক ট্যাঙ্ক!!! হায় হায়–

আমরা আবার ওকে গাড়ি থামিয়ে গুগলের ছবি দেখালাম, যে কোথায় যাব। ও তখন, মাথাটা একবার চুলকে হেসে বলল, ইন জাপান, নো ইংলিশ, অনলি জাপানীজ।আন্দারস্ত্যান্দ? কি যে ‘আন্দারস্ত্যান্দ’ করলাম , সে আর বলে লাভ নেই।যাই হোক বলল, আমরা কাছেই আছি। দু মিনিটের মধ্যেই, এনে হাজির করল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে সৌভাগ্যের কথা, এই বেশি ঘোরার জন্য, ও একটা পয়সাও বেশি দাবী করে নি।
যাক,জাপান যে ইংরাজীকে মন থেকে কত দূরে সরিয়ে রেখেছে আর নিজের ভাষাকে কত ভালবাসে তার প্রমাণ হাতে হাতে নয়, হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। আর সেই সঙ্গে আমাদের, বিশেষ করে বাঙ্গালীর শাসক বর্গ থেকে শুরু করে আপামর বাঙ্গালীর মাতৃভাষাকে ভুলিয়ে দেওয়া বা ভুলে যাওয়ার যে প্রবণতা , তার গায়ে একজন সামান্য ট্যাক্সিওলা যে অপমানের জুতো ছুঁড়ে মারল, মাথা নীচু করে তাকে হজম করা ছাড়া আর আমার হাতে কিছু রইল না। ‘মজার কথাটা’ ভাবলেই আমার অন্তরটা নিজের প্রতি অপমানে রি রি করে ওঠে, কোন গোপন অন্ধকার খুঁজি লুকানোর জন্য। 
ক্যাশলের বাইরের মোট (Moat) বা পরিখা

যাই হোক, পৌঁছানো গেল নিজো ক্যাসলে।এ বার বলি এই ক্যাশলের কিছু কথা।

ক্যাশলগুলো সব দেশেই আজ এক দ্রষ্টব্য জায়গা। এগুলো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। এগুলো সব রাজারাই করতেন, নিজেদের সুরক্ষার জন্য। তাই যাঁর যা সুরক্ষার সম্বন্ধে ধারণা তাই দিয়েই এগুলো হত। তবে এগুলো প্রায়ই সব যুদ্ধকালীন দুর্গ নয়, এতে রাজারা নিজেরাও থাকতেন, অনেক সময়েই সপরিবারে, ফলে এগুলোতে থাকার বা আমোদ প্রমোদের প্রভূত ব্যবস্থাই থাকত। আসলে এগুলোই ছিল সুরক্ষিত রাজবাড়ি ।এই ক্যাসলগুলো অনেক ক্ষেত্রেই পরিখা দিয়ে ঘেরা থাকত।পাহারা বা প্রহরীর কথা বাদই দিলাম, সে ছাড়াও অনেক ধরণের বন্দোবস্ত থাকত নানা জায়গায়। 
এখানের ক্যাসলগুলো মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত থাকত। সেগুলি হল একেবারে বাইরের পরিখা বা মোট (Moat) , তার ভিতরের অংশ বা নিনোমারু(Ninomaru),এর পর আবার পরিখা বা মোট (Moat), তারপর থাকত ভিতরের অংশ বা হোনমারু (Honmaru)।এর মধ্যে নিনোমারু অংশেও একটি প্রাসাদ ও বাগান থাকত। আবার ভিতরের অংশ হোনমারুতেও একটি প্রাসাদ বা সঙ্গে একটি বাগান থাকত।স্বভাবতঃই বাইরের বাগানে জায়গা বেশি হওয়ার জন্য অনেক বড় হত। আর ভিতরের বাগান তুলনামূলক ভাবে ছোট হত।এই ক্যাসল টি ৫০০ মি লম্বা এবং ৪০০ মি চওড়া। এর বাইরের অংশ  থেকে ভিতরের অংশে যাওয়ার জন্য রয়েছে কাঠের ব্রিজ।ভিতরের আসল প্রাসাদটি পুড়ে যায় ১৭৮৮ খ্রী তে, তাই ১৮৪৭ সালে আবার এটি পুনর্নির্মিত হয়।পরবর্তী কালে এটি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে দর্শনীয় করার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।এখানে প্রিন্স কাতসুরার নামে একটি প্রাসাদ আছে, যেটি বিশেষ জাপানী বৈশিষ্ট্য বহন করে।

চলুন যাই পরের পর্বে- সঙ্গে থাকুন আরও দেখতে থাকব-

ক্রমশঃ-

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments