রাজীব শ্রাবণ
বাসুদেব সার্বভৌম শুধু চৈতন্যদেবের একজন বিশিষ্ট পরিকর ছিলেন না, তিনি চৈতন্যদেবের মহিমা প্রচারের উদ্দেশ্যে নিজের লেখনীও চালনা করেছিলেন। জয়ানন্দ তাঁর ‘চৈতন্যমঙ্গল’ গ্রন্থে জানিয়েছিলেন যে, বাসুদেব সার্বভৌমই প্রথম 'চৈতন্য-চরিত্র’ প্রচার করেছিলেন—
“সার্ব্বভৌম ভট্টাচার্য্য ব্যাস অরতার। চৈতন্য-চরিত্র আগে করিল প্রচার॥
চৈতন্য সহস্র নাম শ্লোক প্রবন্ধে। সার্ব্বভৌম রচিল কেবল প্রেমানন্দে॥”
অতীতের সমস্ত চৈতন্যচরিতগ্রন্থে তাঁকে — ‘সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য’ — নামে উল্লেখ করা হয়েছিল। অন্যদিকে সার্বভৌমের স্বরচিত ‘অদ্বৈতমকরন্দটীকা’ ও লোচনদাসের লেখা ‘চৈতন্যমঙ্গল’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, তাঁর সম্পূর্ণ নাম ছিল বাসুদেব সার্বভৌম। ‘অদ্বৈতমকরন্দটীকা’ গ্রন্থে তিনি তাঁর পিতার নাম ‘নরহরি বিশারদ’ বলে উল্লেখ করলেও, বৃন্দাবন দাসের লেখা ‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থে তাঁর পিতার নাম ‘মহেশ্বর বিশারদ’ বলা হয়েছিল বলে দেখা যায়। বলা বাহুল্য যে, এক্ষেত্রে সার্বভৌমের নিজের বক্তব্যই ঠিক ছিল।
এবারে ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যাক যে, সার্বভৌম কতদিন জীবিত ছিলেন। অতীতে দীনেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছিলেন —
“সার্বভৌমের জন্মাব্দ হয় অনুমান ১৪৩০-৩৫ সন মধ্যে।”
কিন্তু বর্তমান সময়ের গবেষকরা তাঁর এই মতকে স্বীকার করেন না। কারণ— কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থের মধ্যলীলার ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে দেখা যায়—
“সার্বভৌম কহে নীলাম্বর চক্রবর্তী। বিশারদের সমাধ্যায়ী এই তাঁর খ্যাতি॥
মিশ্রপুরন্দর তাঁর মান্য হেন জানি। পিতার সম্বন্ধে দোঁহা পূজ্য করি মানি॥”
এথেকে বোঝা যায় যে, সার্বভৌমের পিতা বিশারদ চৈতন্যদেবের মাতামহ নীলাম্বর চক্রবর্তীর সহপাঠী ছিলেন এবং চৈতন্যদেবের পিতা জগন্নাথ তাঁর কাছে ‘মান্য’ ছিলেন। কিন্তু নীলাম্বর ও জগন্নাথ— কারো জন্মসালই যেহেতু ১৪৩০ খৃষ্টাব্দের আগে নয়, সুতরাং বিশারদের জন্মাব্দও এর পূর্ববর্তী হওয়া সম্ভব নয়। অতএব বিশারদের পুত্র সার্বভৌম ১৪৫০ খৃষ্টাব্দের বেশি আগে জন্মগ্রহণ করেন নি। ১৫১০ খৃষ্টাব্দে নীলাচলে চৈতন্যদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করবার সময়ে তিনি একজন প্রবীণ পণ্ডিত ছিলেন। সুতরাং তাঁর জন্মসাল ১৪৫০ খৃষ্টাব্দের বেশি পরবর্তী হওয়ায় সম্ভব নয়।
জয়ানন্দ লিখেছিলেন যে, চৈতন্যদেবের জন্মের অব্যবহিত আগে বাংলার মুসলমান গৌড়েশ্বর নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদের উপরে অত্যাচার চালিয়েছিলেন। সেই সময়ে, অর্থাৎ— ১৪৮৪-৮৫ খৃষ্টাব্দে সার্বভৌম নবদ্বীপ ছেড়ে নীলাচলে চলে গিয়েছিলেন। অতীতে দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বিবেচনা না করে জয়ানন্দের এই উক্তিকেই ঐতিহাসিক সত্যি বলে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান সময়ের গবেষকদের মতে— জয়ানন্দের বর্ণনায় পরস্পরবিরোধী উক্তি থাকবার জন্য সেগুলিকে চোখবুজে সত্যি বলে গ্রহণ করা যায় না। জয়ানন্দ লিখেছিলেন —
“বিশারদসুত সার্বভৌম ভট্টাচার্য্য। সবংশে উৎকল গেল ছাড়ি গৌড় রাজ্য॥
উৎকলে প্রতাপরুদ্র ধনুৰ্ম্ময় রাজা। রত্নসিংহাসনে সাব্বভৌমের কৈল পূজা॥”
অথচ— প্রতাপরুদ্র কিন্তু চৈতন্যদেবের জন্মের ১১ বছর পরে, ১৪৯৭ খৃষ্টাব্দে উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। জয়ানন্দের উপরোক্ত বর্ণনার মধ্যে শুধু যেটুকু সত্যি রয়েছে, সেটা হল যে— সার্বভৌম প্রথমে নবদ্বীপে ছিলেন এবং পরে তিনি নীলাচলে চলে গিয়েছিলেন। চৈতন্যচরিতামৃতে বিশারদের সঙ্গে নীলাম্বর চক্রবর্তীর সহাধ্যায়ন প্রসঙ্গ ও ‘নদীয়া-সম্বন্ধে’র উল্লেখ থেকেও একথা বুঝতে পারা যায়। চৈতন্যদেবের জন্মের সময়ে সার্বভৌমের বয়স ৩৫/৩৬ বছরের বেশি ছিল না। অথচ তিনি পণ্ডিত হিসাবে লব্ধপ্রতিষ্ঠ হওয়ার পরে নীলাচলে গিয়েছিলেন বলেই প্রসিদ্ধি রয়েছে। সুতরাং— বর্তমান সময়ের গবেষকদের মতে, সার্বভৌম ১৫০০ খৃষ্টাব্দের মত সময়ে নীলাচলে গিয়েছিলেন বলে মনে করাই যুক্তিসঙ্গত।
১৫১০ খৃষ্টাব্দে নীলাচলে সার্বভৌমের সঙ্গে চৈতন্যদেবের দেখা হয়েছিল। সেখানে তিনি চৈতন্যদেবকে বেদান্তের মতে দীক্ষিত করবার চেষ্টা করেও শেষপর্যন্ত চৈতন্যদেবের কাছে নতিস্বীকার করে নিয়েছিলেন। মুরারি গুপ্ত, কবিকর্ণপুর ও বৃন্দাবন দাসের লেখা গ্রন্থগুলি খুঁটিয়ে পড়লে একথা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারা যায় যে, সার্বভৌম কিন্তু কখনোই চৈতন্যদেবের সঙ্গে তর্কে পরাজিত হননি, বরং চৈতন্যদেবের ব্যক্তিত্বে অভিভূত হয়েই তিনি তাঁর কাছে নতি স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
নীলাচলে অবস্থান করবার সময়েই সাবভৌম ‘অদ্বৈতমকরন্দটীকা’ নামক গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। গবেষকদের মতে, উক্ত গ্রন্থটি ১৫০৯ খৃষ্টাব্দের পরে লেখা হয়েছিল, কারণ— তাতে সার্বভৌম উড়িষ্যার তৎকালীন শাসক গজপতি প্রতাপরুদ্রকে — “কর্ণাটেশ্বরকৃষ্ণরায়নৃপতের্গব্বাগ্নিনির্ব্বাপক” — বলে উল্লেখ করেছিলেন। কর্ণাটরাজ কৃষ্ণদেব রায়া ১৫০৯ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন এবং তারপরেই তাঁর সাথে প্রতাপরুদ্রের যুদ্ধ হয়েছিল।
কবিকর্ণপুরের ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয়’ নাটক এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, চৈতন্যদেবের সঙ্গে মিলনের কয়েক বছর পরে সার্বভৌম কাশীতে গিয়েছিলেন। অতীতে দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য রামানন্দ বন রচিত ‘কাশীখণ্ডের’ টীকার সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন যে, সার্বভৌম তাঁর শেষ জীবনে কাশীতেই বাস করেছিলেন। কিন্তু ‘ভক্তিরত্নাকর’ গ্রন্থের মতে সার্বভৌম চৈতন্যদেবের তথাকথিত তিরোধানের পরেও নীলাচলে অবস্থান ছিলেন এবং শ্রীনিবাস আচার্য সেখানে গিয়ে তাঁর দর্শন লাভ করেছিলেন। সুতরাং— সার্বভৌম ১০০ বছরের বেশী সময় ধরে জীবিত ছিলেন বলে দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য যে অনুমান করেছিলেন, সেটার মূলে কোন ঐতিহাসিক যুক্তির সন্ধান পাওয়া যায় না।
গবেষকদের মতে, বাসুদেব সার্বভৌমকে মধ্যযুগের বাংলার সংস্কৃতির ‘জংশন স্টেশন’ বলা যেতে পারে। একদিকে তিনি যেমন সেকালের চৈতন্যসম্প্রদায়ের অন্যতম মুখপাত্র ছিলেন, অপরদিকে তিনি সেযুগের ন্যায় ও বেদান্তদর্শনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনাষী ছিলেন। এছাড়া অতীত থেকেই বাংলায় ব্যাপকভাবে একটা প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে যে— চৈতন্যদেব, নৈয়ায়িক রঘুনাথ, স্মার্ত রঘুনন্দন ও তন্ত্রাচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ — একইসঙ্গে সার্বভৌমের কাছে অধ্যয়ন করেছিলেন। অবশ্য সময়ের বিচারে এই প্রবাদ অমূলক বলেই প্রতিপন্ন হয়। ঐতিহাসিকদের মতে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ১৬০০ খৃষ্টাব্দের মত সময়ে বর্তমান ছিলেন। কারণ— তাঁর ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থের অধিকাংশ পুঁথিতে দেবনাথ তর্কপঞ্চাননের ‘তন্ত্রকৌমুদী’ গ্রন্থের, যেটির রচনাকাল ছিল— ১৫৬৪-৬৫ খৃষ্টাব্দ, উদ্ধৃতি পাওয়া যায়; এবং গৌরীকান্তের ‘সদযুক্তিমুক্তাবলী’ গ্রন্থে, যেটির প্রাচীনতম পুঁথির লিপিকাল হল ১৬৪২ খৃষ্টাব্দ, তন্ত্রসারের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। আগমবাগীশের অধস্তন সপ্তম পুরুষ রামতোষণ ১৮২০ খৃষ্টাব্দে ‘প্রাণতোষিণী’ নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। (এসম্বন্ধে আরো বিস্তৃত আলোচনার জন্য ১৩৬৩ বঙ্গাব্দের শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকার ১৩-১৬ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্যঃ।) তাই প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমের কাছে আগমবাগীশের পড়াশুনা করা তো দূরের কথা, সার্বভৌমের জীবদ্দশায় তাঁর জন্ম পর্যন্ত অসম্ভব বলেই মনে হয়।
স্মার্ত রঘুনন্দন তাঁর ‘জ্যোতিস্তত্ব’ গ্রন্থে ১৪৮৯ শকাব্দের (১৫৬৭-৬৮ খৃষ্টাব্দের) উল্লেখ করেছিলেন, সুতরাং— উক্ত গ্রন্থটি এর পরে সম্পূর্ণ হয়েছিল। তাঁর ‘মলমাসতত্ত্ব’ গ্রন্থে ‘জ্যোতিস্তত্ব’ সমেত ২৮টি ‘তত্ত্বের’ উল্লেখ পাওয়া গেলেও তীর্থযাত্রাতত্ত্ব, দ্বাদশযাত্রাতত্ত্ব, ত্রিপুষ্কর-শান্তিতত্ত্ব, গয়াশ্রাদ্ধপদ্ধতি, রাসযাত্রাপদ্ধতি প্রভৃতি গ্রন্থের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। এথেকে বোঝা যায় যে, তিনি জ্যোতিস্তত্বের পরে মলমাসতত্ত্ব এবং তারপরে শেষোক্ত গ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন। অতএব রঘুনন্দন অন্ততঃপক্ষে ১৫৮০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলেই মনে হয়। শ্রীনাথ আচার্যচূড়ামণি রঘুনন্দনের গুরু ছিলেন। অতীতে শ্রীনাথের আরেক শিষ্যের লেখা ১৪৩৪ শকাব্দ বা ১৫১২-১৩ খৃষ্টাব্দের পুঁথি পাওয়া গিয়েছিল। তাই ১৫০০ খৃষ্টাব্দের বেশি পরে জন্মগ্রহণ করলে শ্রীনাথের কাছে রঘুনন্দনের পড়াশুনা করা সম্ভব হয় না। অতএব রঘুনন্দনের আনুমানিক জীবৎকালকে ১৫০০-১৫৮০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ধরা যেতে পারে। এই হিসেবে বাসুদেব সার্বভৌমের কাছে রঘুনন্দনের পড়াশুনা করাটা একেবারে অসম্ভব বলে মনে হয় না, যদিও সে সম্বন্ধে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি; কিন্তু— রঘুনন্দনের পক্ষে চৈতন্যদেবের সহপাঠী হওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে চৈতন্যদেবও কোনদিন সার্বভৌমের কাছে পড়াশোনা করেছিলেন বলে মনে হয় না; কারণ— একটি জাল ‘অদ্বৈতপ্রকাশ’ গ্রন্থ ছাড়া অন্য কোন চরিতগ্রন্থে এবিষয়ে ঘুণাক্ষরেও কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায় না। এছাড়া ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থের বর্ণনা থেকে মনে হয় যে, নীলাচলে দেখা হওয়ার আগে সার্বভৌম চৈতন্যদেবকে আদৌ চিনতেনই না। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে দেখা যায় যে, চৈতন্যদেব বিনয় করে সার্বভৌমকে বলেছিলেন —
“আমি বালক সন্ন্যাসী ভাল মন্দ নাহি জানি।
তোমার আশ্রয় নিল গুরু করি মানি॥”
গবেষকদের মতে, সম্ভবতঃ এই উক্তিটির উপরে নির্ভর করেই পরবর্তী সময়ে সার্বভৌম ও চৈতন্যের মধ্যে গুরু-শিষ্য সম্পর্কের প্রবাদটি গড়ে উঠেছিল।
🍂
উপরোক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শুধুমাত্র রঘুনাথ শিরোমণিই সম্ভবতঃ সার্বভৌমের কাছে শিক্ষা নিয়েছিলেন। কারণ— রঘুনাথ বিদ্যালঙ্কার নামক জনৈক গ্রন্থকারের লেখা ‘অনুমানদীধিতিপ্রতিবিম্ব’ গ্রন্থে সর্বভৌমকে রঘুনাথ শিরোমণির গুরু বলা হয়েছিল বলে দেখা যায়। এখনও পর্যন্ত রঘুনাথ শিরোমণির সময় সম্বন্ধে যেটুকু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া গিয়েছে, সেসব থেকেও এই উক্তিটি সমর্থিত হয়। ১৫৭০ খৃষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে রচিত রঘুনন্দনের ‘মলমাসতত্ত্ব’ গ্রন্থে রঘুনাথ শিরোমণির ‘মলিমলুচবিবেকে’র উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, সুতরাং— রঘুনাথ শিরোমণি নিশ্চই তার আগেই বর্তমান ছিলেন। রঘুনাথের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘অনুমানদীধিতি’ নামক গ্রন্থের কয়েকটি টীকা খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রচিত হয়েছিল। সেই সময়ের মধ্যেই ‘দীধিতি’ গ্রন্থটির প্রাচীন পাঠ অনেকাংশে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং বিভিন্ন পাঠান্তরের সৃষ্টি হয়েছিল বলে ঐ সমস্ত টীকা থেকে জানতে পারা যায়। (আরো বিস্তারিত তথ্যের জন্য দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রণীত ‘বাঙ্গালীর সারস্বত অবদান’ গ্রন্থের ৯৮-৯৯ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্যঃ।) সুতরাং— ‘অনুমানদীধিতি’ গ্রন্থটি ১৫৩০ খৃষ্টাব্দ বা তার আগেই রচিত হয়েছিল। তবে ১৫২৫ খৃষ্টাব্দের আগে সেটি নিশ্চিতভাবে রচিত হয় নি, কারণ— ‘দীধিতি’ গ্রন্থে কাশীনাথ বিদ্যানিবাসের একটি ‘বিবক্ষা’ উদ্ধৃত করা হয়েছিল। (আরো বিস্তারিত তথ্যের জন্য দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রণীত ‘বাঙ্গালীর সারস্বত অবদান’ গ্রন্থের ১০১ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্যঃ।) কাশীনাথ বিদ্যানিবাস ১৫৫৮-৫৯ খৃষ্টাব্দে ‘সচ্চরিতমীমাংসা’ নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন; এছাড়া তিনি ১৫৮৩ খৃষ্টাব্দের একটি নির্ণয়পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন এবং ১৫৮৯ খৃষ্টাব্দে লক্ষ্মীধরের ‘কৃত্যকল্পতরু’ গ্রন্থটির পুঁথি নকল করিয়েছিলেন। (আরো বিস্তারিত তথ্যের জন্য দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রণীত ‘বাঙ্গালীর সারস্বত অবদান’ গ্রন্থের ৬৩-৭২ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্যঃ।) সুতরাং— তাঁর জন্মাব্দ ও গ্রন্থরচনাকাল যথাক্রমে ১৫০০ ও ১৫২০ খৃষ্টাব্দের আগে হওয়া কোন মতেই সম্ভব নয়।
অতএব রঘুনাথ শিরোমণি ১৪৭৫ খৃষ্টাব্দের মত সময়ে জন্মগ্রহণ করে প্রায় ৫৫ বছর বয়সে তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ — ‘অনুমানদীধিতি’ — রচনা করেছিলেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। অন্য একটি বিষয় থেকেও এই সময়নির্ধারণটি সমর্থিত হয়। ‘রূপসনাতন’ নামের জনৈক ঘটক গ্রন্থকারের মতে স্মার্ত গ্রন্থকার ‘সাহরী’ বংশীয় শূলপাণি রঘুনাথের মাতামহ ছিলেন। (আরো বিস্তারিত তথ্যের জন্য দীনেশচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রণীত ‘বাঙ্গালীর সারস্বত অবদান’ গ্রন্থের ৮৯ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্যঃ।) শূলপাণি মৈথিল গ্রন্থকার বাচস্পতি মিশ্রের (জীবৎকাল— আনুমানিক ১৪০০-১৪৭৫ খৃষ্টাব্দ) সমসাময়িক ছিলেন; কারণ— তাঁরা উভয়েই উভয়ের গ্রন্থে পরস্পরের মত উদ্ধৃত করেছিলেন বলে দেখা যায়। (Indian Historical Quarterly, 1941, р- 464) অতএব রঘুনাথের জন্মাসাল ১৪৭৫ খৃষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ধরাই যুক্তিযুক্ত হয়। সুতরাং— সময়ের হিসেবেও শুধুমাত্র তাঁর পক্ষেই বাসুদেব সার্বভৌমের ছাত্র হওয়া সম্পূর্ণভাবে সম্ভব বলে মনে হয়।
তবে সনাতন গোস্বামীও বাসুদেব সার্বভৌমের কাছে শিক্ষা নিয়েছিলেন। কারণ— সনাতন তাঁর ‘বৃহদ ভাগবতামৃত’ গ্রন্থে — সার্বভৌম ও তাঁর ভাই বিদ্যাবাচস্পতি — দু’জনকেই নিজের গুরু বলে বন্দনা করেছিলেন।
0 Comments