জ্বলদর্চি

বার্লিনের ডায়েরি --২৯ পর্ব। চিত্রা ভট্টাচার্য্য /প্রাগের শেষ পর্ব

প্রাগের স্থাপত্য

বার্লিনের ডায়েরি -২৯ পর্ব
চিত্রা ভট্টাচার্য্য              
          
প্রাগের শেষ পর্ব 

" যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন যা পাইনি বড়ো সেই নয় '' ডায়েরির পাতায় লাল স্কেচপেন দিয়ে মোটা করে লেখা কবিতার লাইনটি নিয়ে শ্রীময়ী ভাবনার  অতলে ডুব দিয়েছে। মলাট খসে পড়া ছেঁড়া ডায়েরিটি ওকে টেনে নিয়ে চলেছে 26th November -- 2015 প্রাগের রাজপথ জনপথের ঠিকানায়। ভাবনার ঘুড়ি স্মৃতির মহাআকাশ জুড়ে উড়ছে ।' প্রাগের বেড়ানোর কথা লিখতে বসে খোলা জানলা দিয়ে একমুঠো আকাশ টা হাসছে। মুছে যাওয়া সেই দিন গুলোর না বলা গল্পের পাতায় মন।  প্রাগের এপার্টমেন্টের নরম বিছানায় নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে কাটিয়ে দ্বিতীয় রাতটির ও ভোর হোলো। জানলার পর্দা সরিয়ে ভোরের আকাশের দিকে চোখ মেলে দেখে প্রাগের পৃথিবী তখন ও সুপ্ত শান্তির নীড়ে। মনে পড়লো আজই সন্ধ্যের  বাসে বার্লিনে ফেরা।

 গতকাল কিছুটা সময় চার্লস বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে ওরা অভিভূত হয়ে গিয়েছিল।তারপর প্রাগের বিখ্যাত  ড্যানসিংহাউজটির অসাধারন স্থাপত্য নক্সা দিয়ে সাজানো বাড়িটি কিম্বদন্তি নৃত্য শিল্পী ফ্রেড এস্টায়ার এবং জিঞ্জার রজার্স এর নামে প্রতিষ্ঠিত। প্রাগের ঐতিহাসিক স্থাপত্যর এতো প্রাচীনত্বের মাঝে হঠাৎ এমন অত্যাধুনিক অদ্ভুত আকারের খাপছাড়া এক স্থাপত্যের সৃস্টি মন কে আশ্চর্যান্বিত করেছিল। নৃত্যের তালে ছন্দে এই বিল্ডিং টি এঁকেবেঁকে দাঁড়িয়ে থেকে এক অন্য ধরণের শিল্পের পরিচয় বহন করে চলেছে। অন্বেষণ জানালো ক্রোয়েশিয়ান, চেক ও ক্যানাডিয়ান আমেরিকান শিল্পী দের যুগ্ম প্রচেষ্টায় এই অতি আধুনিক স্থাপত্য টি গড়ে উঠেছিল। যেহেতু বিল্ডিং টির নৃত্যের ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে প্রাগবাসী তাই ভালোবেসে এই ভবন টি কে ড্যানসিং হাউজ বলে ।প্রাগ ক্যাসেল

গতকাল বেলা শেষের বিদায়ী সূর্য পশ্চিম আকাশে বেশ খানিক আগে ঢলে পড়ে ছিল। শহরে বেড়িয়ে ঘরে ফেরার পথে সন্ধ্যে রাতের আলো ঝলমল প্রাগের অপরূপ মোহনীয় মায়াময় রূপ। ওরা ক্লান্ত শরীরে মুগ্ধ হয়ে বসে আপন খুশিতে বেহিসেবী অনেকটা সময় নির্বাক কাটিয়ে দিয়েছিল। চলতে চলতে একটি কালো উজ্জ্বল পাথরের প্রমান সাইজের বড় মূর্তি ,অন্বেষণ দেখিয়েছিল। ইনি হচ্ছেন "নাইটস অফ দি ক্রস স্কোয়ার। মাঝখানে প্রতিষ্ঠিত ছিল রাজা চার্লস এর বিশাল সেমি গথিক স্ট্যাচু। " প্রাগের বিখ্যাত রাজপথ পার হয়ে দিনের আলোয় ওল্ড স্কোয়ার থেকে প্রাগ ক্যাসেলে যাওয়ার পথে একটি নির্মিত মূর্তি দেখে অবাক হয়েছিল  যে  বিখ্যাত শিল্পটি  চার্লস ইউনিভার্সিটির ৫০০বছর পূর্তিতে , রাজা চার্লসকে সশ্রদ্ধ সম্মান জানিয়ে তৈরী হয়েছিল। গথিক ভাস্কর্য্যের স্টাইলে সাজানো স্কোয়ারের আশেপাশে অট্টলিকা গুলো আলোর মালায় অপরূপ সেজে উঠেছে । অসংখ্য সবুজের ছায়াঘেরা মেঘমুক্ত নীলাম্বরীর তলে প্রাসাদের প্রতিবিম্ব দুলছিল নদীর স্থির জলে। অবিস্মরণীয় শিল্প সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে শুধুই মোহিত হয়ে যেতে হয়। দূরে বহুদূরে তখন কোন চার্চে কালের মন্দিরা অনবরত বেজেই চলেছিল ।  

 তিতিরের প্রবল তাড়ায় সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই ওরা প্রাগ ক্যাসেল দেখতে বেরিয়ে পড়েছে।   শ্রী সরল উৎসাহে বলেছিল প্রাগের ক্যাসেল  শুনেছি বেশী দূরে নয় তাহলে হেঁটেই যাওয়া যাবে ! অদ্রিজার দিকে তাকিয়ে ঋষভের মুখে মৃদু হাসির ঝলক বয়ে গেল ,আসলে শ্রীর দ্বারা  এত পথ হাঁটা সম্ভব নয় । অন্বেষণ কোথা থেকে  এক তিন চাকার টেম্পো নিয়ে এসে সামনে দাঁড়া করিয়ে বলে উঠে পড়ো। ব্যাটারী চালিত টেম্পো চলতে লাগলো। অন্বেষণ বলে দেখ কেমন এক ঐতিহাসিক অজানা গল্পের  নতুন  অধ্যায় শুরু হলো। যেমন প্রাচীন প্রাগ তেমনি এই শহরের ক্যাসেল টি গিনেস বুক অফ রেকর্ডসের মতে  '' পাহাড়ের ওপর নবম শতকে নির্মিত এই ক্যাসেল টি হচ্ছে প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো দুর্গ গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বিশাল দুর্গ। গথিক রোমানিস্ক সব রকম স্থাপত্যের মিলনের নিদর্শন রয়েছে এখানে। প্রায় ছয় শত বছর লেগেছিল এই প্রাসাদ টি গড়ে তুলতে। রিপাব্লিকের প্রেসিডেন্টের অফিস ও বাসভবন এই ক্যাসেলের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় কড়া প্রহরার ব্যবস্থা রয়েছে।    
প্রাগ ক্যাসেল।

 পাহাড়ের পায়ের কাছে দুর্গের দোর গোড়ায় পৌঁছলে শ্রী ভাবে ঐ উঁচু পাহাড়ে উঠে দুর্গ দেখা সম্ভব ! পারবে তো ? পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে অসংখ্য ঢালাও সিঁড়ি।  সিঁড়ি বেয়ে উঁচুতে উঠতেই শ্ৰীময়ীর  শ্বাস কষ্ট হওয়ায় সামনেই সাইড রেলিঙে বসার জায়গায় বসলে পাশ দিয়ে তরতর করে হেঁটে ওপরে উঠে যায় ফর্সা ববকাট  চুলের ৭৫উর্দ্ধ বয়স্কা স্প্যানিশ মহিলা। শ্রীর দিকে তাকিয়ে ইংলিশে বলেন ''বসে থেকোনা,ইয়ং লেডি আমাকে দেখো কেমন এগিয়ে চলেছি ।'' অদ্রিজা হেসে বলে মা উনি  নিশ্চয়ই  কোনো ট্রেনার ছিলেন। অবশেষে দুর্গে দ্বারে পৌঁছে শ্রীর মনে হলো -- এক দুরূহ দুর্গম গিরি পথ পার  হওয়া  '' যেন পেরিয়ে এলেম অন্ত বিহীন পথ।'' 

ওরা দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করলো। একে একে ঐতিহাসিক দালান মিউজিয়াম ,গ্যালারি সব হাত ছানি দিয়ে ডাকতে লাগলো। অনবদ্য স্থাপত্য শিল্প অপূর্ব মন মুগ্ধ কর শোভা। দেখা যেন শেষ হতেই চায় না।  প্রায় হাজার বছরের পুরোনো এই দুর্গ টি  কালের যাত্রা পথের সাক্ষী হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাসেলটি ঘুরে ঘুরে দেখতে কত যে সময় কেটে গেল তার হিসেব ছিল না। চেক রিপাব্লিকের কড়া প্রহরার ব্যবস্থা রয়েছে কারণ প্রেসিডেন্টের অফিস ও বাসভবন এই ক্যাসেলের মধ্যে অবস্থিত। এই ক্যাসেলটির দৈর্ঘ্যে পাঁচশত সত্তর মিটার লম্বা এবং প্রস্থে একশত তিরিশ মিটার চওড়া। অন্বেষণ বলে দুর্গের কোনো এক গোপন স্থানে নাকি বোহেমিয়ান ক্রাউন জুয়েলস রক্ষিত আছে।রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে বোহেমিয়ান সম্রাটের ক্ষমতার প্রতীক ছিল এই অতি মূল্যবান ক্রাউনটি।  তিতিরের  ভারী উৎসাহ জানার  সেই সুরক্ষিত গোপন স্থান টি এই বিশাল ক্যাসেলটির কোন স্থানে আছে ? ঋষভ কে বলে ''তুমি ব্যোমকেশ হও আর আমি অজিত হয়ে ক্রাউন জুয়েলস খুঁজে বার করি। মা তখন নতুন করে লিখবে দুর্গরহস্য।বেশ একটু হাসি ঠাট্টার পরিবেশ তৈরী হলো। অন্বেষণ বলে এমা ! আমার তো ব্যোমকেশ বক্সী পড়াই হয়নি। আদ্রিজা বলে রহস্য উপন্যাস। ও  পড়ে দেখো খুব ভালো লাগবে।   

🍂

 শ্রী  স্তদ্ধ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বিশাল আয়তনের সুউচ্চ এই ক্যাসেল টি কে দেখেই চলেছে কী অপরূপ শিল্পকর্ম। ।ঋষভ হাতের ছোট্টো কোডাক ক্যামেরা টিকে ও সচল রেখেছে। সব দৃশ্য গুলো পরস্পর মনের গভীরে সাজিয়ে রেখে দিতে একমাত্র সহায় সম্বল এই ক্যামেরাটির জুড়ি নেই। রাজপ্রাসাদের শ্বেত শুভ্র মর্মর পাথরে দেওয়ালের গায়ে  নিভৃত প্রাসাদের কোণে অনাদি অতীত কথা বলে চলেছে। ওরা কান পেতে আছে কার অশরীরী পদধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরে ফিরছে প্রাচীরের গায়ে দেওয়ালে। গম্বুজে  ,   খিলানে।  সর্বত্র এক সোঁদা গন্ধ অব্যক্ত প্রাণের অনুরণন। অন্বেষণ বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে ছিল এই ক্যাসেলটির নির্মান কৌশল। ওরা তন্ময় হয়ে দেখছিল স্থাপত্য শিল্পের উৎকর্ষতা। সবথেকে দৃষ্টি নন্দন লেগেছিলো ক্যাসেলের ভিতরে সেন্ট ভিটাস ক্যাথিড্রালের জানলার ওপর রঙিন কারুকাৰ্য্য। স্টেইন্ডকাঁচ সূর্যের আলো পড়লে অপরূপ  শোভায়  উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ।   স্টেইন্ডকাঁচ গুলোর অপরূপ শোভা প্রভু যীশুর জন্মবৃত্তান্ত সূর্যের আলো পড়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে। শ্রী ভাবে এত দর্শক এখানে তবুও কত শৃংঙ্খলা ,কত নীরবতা একটু ও হৈ হুল্লোড় নেই।                                                                                                                  
  ক্যাসেল টির বিশাল কমপ্লেক্সে দাঁড়িয়ে সেন্ট ভিটাস ক্যাথেড্রালস এবং আরো বেশ কয়েকটি  আকর্ষণীয় স্থাপত্য শিল্প গুলোকে খুব কাছের থেকে দেখার ইচ্ছে থাকলে ও সব ঘুরে দেখা অসম্ভব। ওরা প্রায় ৬০০বছর আগে নির্মিত  ক্যাথিড্রাল চার্চের ভিতরে প্রবেশ করে। এটি চেক রিপাব্লিকের ,ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্র হিসাবে ইউরোপের সর্বাপেক্ষা স্বীকৃত একটি অন্যতম প্রধান আভিজাত্য পূর্ণ ক্যাথিড্রাল চার্চ। চতুর্দশ শতাব্দীর মোজাইক করা বিখ্যাত "শেষ বিচার " শিল্প কর্ম টি দেখে মুগ্ধ হয়ে  অদ্রিজার  মনে প্রশ্ন শেষ বিচার মানে Last Judgement  কেন ? শ্রী বলে খ্রিস্টধর্ম মনে করে যীশু র দ্বিতীয় আগমন কে ঈশ্বরের দ্বারা শেষ বিচারের জন্য যারা বেঁচে আছেন তাদের সকলের জন্য কিছু লোকের অনুমোদনের এবং বেশীর ভাগ জনসাধারণের অন্যায়ের শাস্তি পেতে হবে। এর শৈল্পিক সৌন্দর্য পরবর্তী কালে ইউপরোপীয় অনেক শিল্পধারায় প্রভাব বিস্তার করেছিল।    

 এর পর সেন্ট ওয়েন্সেসলাস ও চতুর্থ চার্লসের বিখ্যাত সমাধি দেখেছিল। নিশিরডাকের মত সম্মোহিত হয়ে শ্রী আবার ক্যাসেলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো। সবুজ পাইনের শ্যামলিমায় ছাওয়া পাহাড়ের ওপর গড়ে ওঠা এই দুর্গটির ঘন সন্নিবিষ্ট গম্বুজ টাওয়ার ও সারি দেওয়া রাজপ্রাসাদ গুলো যেন অলৌকিক কাহিনীর মত। ঐ পুরোনো দুর্গ শহর তার অবিস্মরণীয় স্মৃতি দিয়ে পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল। ক্যাসেলের ওপর থেকে দেখাযায় পাহাড়ের পায়ের কাছে কুলু কুলু রবে বয়ে চলেছে ভাল্টাভা নদীর স্রোত। দূরের শহরে ডলস'হাউসের মত সাজানো ঘরবাড়ি সূর্যের আলোয় ঝকঝকে ত্রিকোণ লাল মাথা তুলে উর্দ্ধে চেয়ে আছে। সব যেন অবাস্তব লাগে ,মনে হয় কোনো এক রূপকথা। সময় ঘড়িতে বাঁধা ওরা ইতিহাসের স্বপ্নালু জগৎ ছেড়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড় থেকে নামে। 

  পথের ধারে ম্যাকডোনাল্ডে  দুপুরের খাবারের কথা মনে করিয়ে দিল। লাঞ্চ পর্বে  ফ্রেঞ্চফ্রাই ,চিকেন বার্গার ক্রোসেন্ট,ব্রেডটোস্ট পাওয়া গেল। সাথে এক মগ কফি নিয়ে অন্বেষণ  কবি ফ্রানৎস কাফকার গল্প শোনায়।আড্ডা বেশ জমে উঠেছে।  ঋষভ বলে আগেই জেনেছিলাম এই দেশ যেন সারা পৃথিবীর শিল্প সংস্কৃতি সংগীত সাহিত্যের এক মধুর মিলন সভা। এখানে রয়েছে আরো বিভিন্ন শত শত রকমের শৈল্পিক কারু কাৰ্য্যের নানাবিধ নিদর্শন। অদ্রিজা বাইরে রোদের দিকে চেয়ে বলে আমাদের দুটো দিন যে বৃষ্টি ছাড়া এমন সুন্দর কাটবে ভাবতে ও পারিনি। পাহাড়ের ওপর  নীলাকাশের গায়ে হেলান দিয়ে স্বর্ণালী কারুকার্য্যে সজ্জিত কষ্টিপাথরের মত কালো চকচকে প্রাসাদ টি দ্বিপ্রাহরিক আলোয় প্রাগের স্বর্ণজ্জল সময়ের জ্বলন্ত স্বাক্ষর হয়ে স্বগর্বে পৃথিবীর ইতিহাসে কেমন  আবহমান কাল ধরে বিরাজিত  হয়ে আছে ।  শ্রী বলে এমন রোমান্টিক শহর তামাম দুনিয়াতে বোধহয় খুব কমই আছে।                                                 
টিকিট কেটে   ফ্রানৎস কাফকার মিউজিয়ামে যাবার সময় শ্রীময়ীর অঞ্জনার সাথে কলেজের দিন গুলো মনে পড়ে। ও ঋষভ ও অন্বেষণ কে বলে , সাহিত্যের প্রতি অমোঘ আকর্ষণে  বিদেশী সাহিত্যিক শেক্সপিয়র ,টলস্টয় ,মোপাঁসা, দস্তয়ভস্কি ,ম্যাক্সিম গোর্কির  সাথে ফ্রানৎস কাফকার রচনার  সঙ্গে  পরিচয় হয়েছিল। মনে আছে  সাহিত্য সৃস্টির অভিনবত্ব শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কলেজের কমন রুমে বা ক্যান্টিনে কত টেবিল চাপড়ানো এবং তর্কের ঝড় উঠতো। অঞ্জনা ও শ্ৰীময়ী সবসময় দুজনে এক সাথে চেঁচাতো । কাফকার অবিস্মরণীয় পত্রলিপি -গল্প লেখার মধ্য দিয়েই প্রাগ দেশটি কে তখন থেকে একটু ওরা জেনেছিল।    

   চার্লস ব্রিজের  কাছেই মিউজিয়াম টি মাঠের মত ফাঁকা জায়গায় বিশাল আকারের কালো পাথরের ভাস্কর্য এবং ফ্রানৎস কাফকার বেশ প্রমান মাপের কালো কষ্ঠি পাথরের ভাস্কর মূর্তি টির সাথে অতি উৎসাহী দর্শক ,ভ্রমণার্থীর দল  ছবি তুলতে ব্যস্ত।   ইংলিশের  C  অক্ষরের মত সাধারণ উচ্চতার এক  বিল্ডিং এবং নদীর ধারের দিক ঘেঁসে গ্যালারি সাজানো রয়েছে।  বিল্ডিঙের খোলা চত্বরের সামনে কাঁচের তৈরী দুটি পুরুষ মূর্তির নগ্ন চেহারার বিবস্ত্র অবস্থায়  মূত্র বিয়োগ রত দৃশ্যের  ভাস্কর্য্য মা মেয়েকে   অবাক করেছিল। একপাশে বিরাট আকারে K অক্ষর  বোধহয় কাফকার  নামের আদ্যক্ষর লেখা ছিল । 

অন্দরে প্রবেশের পর  কাঠের সিঁড়ি পার হয়ে একটি বড় কালো দেওয়াল জুড়ে কাফকার ছবির সাথে সংরক্ষিত আছে  তাঁর বাড়ির ছবি ,কর্ম জীবনের বৃত্তান্ত -,তাঁর বাবার  ও তাঁর  বিভিন্ন বয়সের ছবি বা আলোক চিত্র এবং বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের ছবি।  স্রষ্টার সব সৃষ্টির পাণ্ড লিপি। অনেকর মতে  ফ্রানৎস কাফকার জগৎ ভারী রহস্য ময়।  তিনি পত্র লিপি রচনা করতেন এবং চিঠি  লিখতেন পিতা ও  প্রেমিকা মিলেনা কে। সে সব চিঠির কিছু অংশ শোভা পাচ্ছে মিউজিয়ামের দেওয়ালে । অন্বেষণ বলেছিল -- কাফকা তাঁর প্রিয় বন্ধু ব্রডের হাতে সব পাণ্ড লিপি তুলে বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর সব যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়।  কিন্তু ব্রড তা শোনেননি  তাই  বিশ্ব সাহিত্য সম্ভারে কাফকা এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক রূপে  আজো  প্রাগের অনন্য লেখক। এই ক্ষণ জন্মা কথা শিল্পীর অনবদ্য সব চরিত্র সৃষ্ট ,লেখনীর মায়াজাল আজো পাঠক মনে গভীর বিস্ময় জাগায়।অন্বেষণ বলে কাফকার সবচেয়ে যুগান্তকারী লেখা  মেটামরফোসিস , ট্রায়াল বা ক্যাসেল  উপন্যাসের  চরিত্র গুলো যা আজো সমান ভাবে মন কে স্পর্শ করে যায়। 

   তাঁর আঁকা ছবি ,পাণ্ডলিপি এবং নানা রচনার সংস্করণ মিউজিয়ামের দেওয়ালে সাজানো ছিল। তাঁর ইচ্ছে  ছিল পূর্ন কালীন এক লেখক হবার। কলম কে তিনি শরীরের এক অঙ্গই  ভাবতেন।  কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্য কাল ব্যাধি রোগ ও অসুখী প্রেম তাঁকে জীবনের মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছিল।মাত্র ৪১ বছর বয়সে যক্ষা রোগে তাঁর অকাল প্রয়ানে লেখক হবার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে জীবৎকালে যা সৃষ্টি করেছিলেন তা ও  কেন পুড়িয়ে দিতে বলেছিলেন ,সে রহস্যের কোনও সমাধান জানা নেই। শ্রীর মুখ ভার।  অদ্রিজা কে বলে মিউজিয়াম টি দেখে হতাশ লাগলো।                              কাফকার মিউজিয়াম                    

   বার্লিনে ফেরার বাস একটু পরেই । অন্বেষণের কাছ থেকে ফোন নম্বর আদান প্রদান পর্ব সারা হলো এবং কলকাতায় এলে শ্রীর কাছে অবশ্যই আসবে জানালো। প্রাগের বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে চলেছে ।   চার্লস ব্রিজ , ভাল্টাভা নদীর পাড়ে গোধূলিতে আবির রাঙা প্রাগের আকাশ ,ক্যাসেল গথিক স্থাপত্য ক্যাথিড্রালের চূড়ায় পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রোদ্দুর , দূর্গ প্রাসাদ সবুজ প্রান্তর সব একে একে ছায়াছবির মত পিছনে ফেলে বাস এবার গতি নিয়ে চলতে শুরু করেছে।  কাঁচের বদ্ধ জানলার ভিতর  থেকে  মুখ বাড়িয়ে যত দূর দেখা যায় দেখি  খুব আপন সখার মত আমাদের বিদায়ী জানিয়ে একটি দীর্ঘ দেহীর ডান হাতের পাঁচটি আঙ্গুল সমেত পাঞ্জা সমানে নড়ে চলেছে। আবছা মেঘের আঁচল সরিয়ে আকাশে তখন এক ফালি আনমনা চাঁদের আলো.মনে হলো মেঘের বাসর থেকে দেখা দিল তারাদের মিছিলে হারিয়ে যাওয়া অঞ্জনার মধুর হাসি মুখখানি বলে আছিতো হারিয়ে যায়নি। 
প্রাগের বেড়ানোর দিন গুলোর কথা কোনো নির্জন দুপুরে বা জোৎস্না ভেজা রাত গভীরে যখন কোনও নিরালায় বসে  মনে পড়ে তখন সেই শীতলতম ঠান্ডায় ঐতিহাসিক অনবদ্য সৌন্দর্যের সাথে সেই পরিচিত দীর্ঘ দেহী অন্বেষণের ছবি মনের আয়নায় ভেসে ওঠে।তখন মনে হয় এই পৃথিবীর পান্থ শালায় অঞ্জনারা এমনি করে তার উত্তরাধিকারের মধ্য দিয়ে যুগে যুগে বেঁচে থাকে। হারানোর স্মৃতি শুধু বেদনার নয় সে যে কখোনো বড় সুখের মধুময় এক কবিতার পাতা হয়ে দেখা দেয় ।  

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousMay 27, 2024

    লেখার মাধুর্য ও বর্ণনার বিন্যাসে মন ভরে গেলো।

    ReplyDelete