মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১০৮
শ্রীকৃষ্ণকিঙ্কর (মধ্যযুগের কবি, কোলাঘাট)
ভাস্করব্রত পতি
"এই মত ধান্য যত জন্মে মর্ত্যধাম।
কৃষ্ণকিঙ্করে কহে কত লব নাম॥"
শ্রীকৃষ্ণকিঙ্কর মেদিনীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করা একজন বিস্মৃতপ্রায় কবি। কবির লেখা বহু পুঁথি বিভিন্ন জনের কাছে সংগৃহীত থাকলেও বিভিন্ন বন্যায় তা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে অনেক লেখা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কবির লেখা যেসব পুঁথির সন্ধান মিলেছে সেগুলি হল -- পঞ্চানন্দের গান, দেবী লক্ষ্মীর গীত, পীর পাঁচালী, কালু রায়ের পালা, দক্ষিণ রায়ের পালা, সত্যনারায়ণ পাঁচালী, শীতলামঙ্গল কাব্যের কয়েকটি পালা (বিবাহ, মগরাজার পূজা, লঙ্কা পূজা, জাগরণ), বিভাপালা, জন্মপালা, নিমাজগাতিপালা ইত্যাদি। কবির লেখা পুঁথির ভাষ্য অনুযায়ী সম্ভবত ১১৭০ বঙ্গাব্দ বা ১৭৬৩ খৃষ্টাব্দ সংলগ্ন সময়কালে কবি কাব্যরচনা করে গিয়েছেন।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কোলাঘাট থানার হাড়োয়াচক গ্রামে (তৎকালীন মানকুর পরগনা) জন্মগ্রহণ করেন কবি শ্রীকৃষ্ণকিঙ্কর। এখানকার এক মাহিষ্য পরিবারের সন্তান ছিলেন। সম্ভবত তখন আঠারো শতকের প্রথম দিক। যদিও পরবর্তীকালে কবি হাড়োয়াচক থেকে উঠে গিয়ে পার্শ্ববর্তী পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার ক্ষেপুত উত্তরবাড় গ্রামে (বর্তমান নাম কৃষ্ণবাটি) বসতি স্থাপন করেন। কবি তাঁর নিজের বাসস্থান সম্পর্কে এক পুঁথিতে উল্লেখ করেছেন --
"মণ্ডলঘাট পরগণে মানকুর অনুবন্দ।
বর্ধমান চাকলা নরেন্দ্র তিলকচন্দ্র।।
খেপুত ভাটরা তড়া গোপালনগর।
বন্দ স্থল শ্রীবরা সমাজ মনোহর।।
এই পঞ্চপাটে পঞ্চ ভট্টাচার্য বন্দি।
তবে ত করিল কবি কবিত্বের সন্ধি।।
রুক্মীনিকান্ত ভট্টাচার্য ভাটরা বসতি।
বেদে ব্রহ্মা বিধানে যেমন বৃহস্পতি।।
তার আজ্ঞা রঙ্গে ভাঙ্গ্যা সার্বভৌমবাহকে (?)।
রামায়ণ রচি পুরী দাহ সপুস্তকে।।
গঙ্গেশ্বর ভট্টাচার্য গোপালনগরবাসী।
সর্বশাস্ত্রযোগে যেন শুক্রাচার্য ঋষি।।
কৃপা করি তিনি মোরে দিলা দিব্যজ্ঞান।
তার আশীর্বাদে বাড়ে আমার কল্যাণ।।
রামকৃষ্ণ ভোলানাথ ভট্টাচার্য শ্যাম।
সিদ্ধ বিদ্যা বিদ্যান্ত শ্রীবরা মাঝে ধাম।।
প্রথম কবিত্বভাগে মোরে শুভ দিত।
শতদ্বিজে আশীর্বাদ সগোষ্ঠী সহিত।।
বাঞ্ছারাম বিদ্যাবাগীশ নিবাস ভাটড়া।
বিধি ব্যবস্থায় বুধ নাঞি যার বাড়া।।
নীলকণ্ঠনন্দন আদি পরম পণ্ডিত।
পিতাপুত্রে শিখাইল নানা শাস্ত্রগীত।।
রামগোপাল ন্যায় পঞ্চানন ভট্টাচার্য।
ক্ষেপতি কিষ্টবাটি বাটি পূজা রাজ্য (?)।।
একি গ্রামে বসবাস অপূর্ব চৌপাড়ি। ।
নানা শাস্ত্র তত্র নিত্য নিত্য শিখি পড়ি।।
সার্থকরাম তর্কভূষণ ভট্টাচার্য।
সর্বশাস্ত্রের সুবিদিত সর্বস্থানে পূজিত।।
সুকুদেব রায় মহাশয় সুপণ্ডিত।
যার মুখে সুধা কৃষ্ণকিঙ্কর কবিত্ব।।"
এখনও এখানে ক্ষেপুত, গোপালনগর, ভাটরা, তড়া, শ্রীবরা গ্রামগুলি কবির জন্মস্থান কৃষ্ণবাটির আশেপাশেই রয়েছে। এই ভাটরা বর্তমানে রূপনারায়ণ নদের পূর্ব পাড়ে হাওড়া জেলার আমতা থানার মধ্যে পড়ে। সেসময় ক্ষেপুত গ্রামের রামগোপাল ন্যায় পঞ্চানন ও সার্থকরাম তর্কভূষণ, ভাটরার জমিদার বাঞ্ছারাম চৌধুরী, তড়া গ্রামের রুক্মিনীকান্ত ভট্টাচার্য, গোপালনগরের গন্ধেশ্বর ভট্টাচার্য, শ্রীবরা গ্রামের ভোলানাথ ভট্টাচার্য ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানীগুণি বিদ্যানুরাগী ব্যক্তি। এ বর্ণনা কবির পুঁথির রচনা থেকেই মেলে।
আবার 'শীতলার বিভাপালা'তে কবি তাঁর আত্মপরিচয় দিয়েছেন এভাবে --
"সাকিম ক্ষেপুত পরগণা মানকুর।
তিলকচন্দ্ররাজ অধিকারে নিজপুর।।
শঙ্করসন্ততি লক্ষ্মীকান্ত সুবিখ্যাত।
শূলপানি তস্যপুত তস্য জগন্নাথ।।
তস্যপুত মুকুন্দ পিতা মাতা কাত্যায়নি।
খুল্লতাত আনন্দ শ্রীমতী পিসিরানি।।
দীনবন্ধু নিমাই আদি চারি সহোদর।
কনিষ্ঠ নারান কৃষ্ণা ভগিনী একেশ্বর।।
অর্জুন ভবানীশ্বর রামজয় দুর্গা।
গয়ারাম আদি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃসুত যজ্ঞা। ।
রাম বিজয় রাম দাতারাম মধ্যসুত।
কানাই বলাই লক্ষ্মী কনিষ্ঠ মজুত।। (?)
খুল্লতাতসুত বাসু সুতা ত্রিলোচনা।
বিষ্ণু হরি কৃষ্ণদেব যুগল ভাগিনা।।
শঙ্কর অঙ্গজ নিজ করিয়া সন্ততি। (?)
সত্যভামা রুক্মিণী কন্যা সুমিত্রা সুমতি।।"
কবি শ্রীকৃষ্ণকিঙ্কর বিভিন্ন পুঁথিতে 'কিঙ্কর', 'কৃষ্ণকিঙ্কর', 'শঙ্কর', 'চন্দ্রচূড়' ইত্যাদি নামের ভনিতা ব্যবহার করেছেন। ড. ত্রিপুরা বসু লিখেছেন, "বাংলা পুঁথিসাহিত্যে 'কিঙ্কর' ভণিতা অনেক থাকলেও আমাদের আলোচ্য কবি যে স্বতন্ত্র ব্যক্তি সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তাঁর বিভিন্ন পুঁথিতে আত্মপরিচয় অংশে যে সব বর্ণনা মেলে, তা থেকে জানা যায়, তাঁর পূর্বপুরুষ হলেন --
শঙ্কর> লক্ষ্মীকান্ত> শূলপানি> জগন্নাথ > মুকুন্দ
মুকুন্দের চারপুত্র - দীনবন্ধু, নিমাই, কিঙ্কর ও নারায়ণ।"
যোগেশচন্দ্র বসু তাঁর 'মেদিনীপুরের ইতিহাস' বইতে উল্লেখ করেছেন, "অনুমান ১৭৫০-১৭৭৯ খৃষ্টাব্দের মধ্যে “লক্ষ্মী সরস্বতী” কাব্যখানি রচিত হইয়াছিল। গ্রন্থমধ্যে সন্নিবেশিত কবির আত্মপরিচয় হইতে জানা যায়, মানকর পরগণার অন্তর্গত ক্ষেপুত গ্রামে কবির নিজ বাস ছিল। তিনি মাইতি উপাধি বিশিষ্ট ছিলেন এবং নিজেকে মাহিষ্য বংশ সম্ভূত বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। সে সময় ক্ষেপুত গ্রাম বর্দ্ধমান জেলার অন্তর্গত ছিল; উত্তরকালে উহা মেদিনীপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। এই গ্রন্থখানির মধ্যে ক্ষেপুত গ্রামের তৎকালীন সমৃদ্ধির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। কবির পিতার নাম মুকুল, পিতামহের নাম জগন্নাথ। তিনি লক্ষ্মীর বরপুত্র ছিলেন এবং সে যুগে একটি ধনভাণ্ডার স্থাপন করিয়াছিলেন। কবির বর্ণিত ক্ষেপুতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ক্ষেপুতেশ্বরী আজিও বিরাজমান। আজিও বড়গাজীর পীর ও ফিঙ্গারাজের স্মৃতি তথায় সমুজ্জল।"
কবির নিজের একটি মঙ্গলগানের দল ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন অব্রাহ্মণ। অথচ তাঁর গান এবং লেখার মাধ্যমে দেবতা মাহাত্ম্য প্রচারিত হতে থাকায় সেসময়কার সমাজপতিদের চোখে চক্ষুশূল হন তিনি। তাঁদের কোপানলে এবং রোষানলে পড়ে তাঁকে সমাজচ্যুত হতে হয়। এরপর তিনি নিজের অধ্যবসায় এবং মেধার সাহায্যে আগমশাস্ত্র ও সংস্কৃত কাব্য সাহিত্য অধ্যয়ন করে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ফলে তখন ফের সমাজপতিরা তাঁকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে। তিনি অনুগ্রহ লাভ করেন বর্ধমানরাজ তিলকচাঁদের। কবি তাঁর পুঁথিতে তাঁর কথা উল্লেখ করেছেন--
"বর্ধমান অধিপতি
কীর্তিচন্দ্র নরপতি
চিত্রসেন পুত্র ধনুর্ধর।
কীর্তিচন্দ্র কনিষ্ঠ
ভ্রাত মিত্রসেন নরনাথ
তিলকচন্দ্র পুত্র রাজ্যেশ্বর।।"
কবি শ্রীকৃষ্ণকিঙ্করের লেখায় বহুলভাবে স্থান পেয়েছে কবির বাসস্থান এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার বর্ণনা। সেই সময়কালে রূপনারায়ণ তীরবর্তী হাওড়া এবং পূর্ব মেদিনীপুরের তথা মানকুর ও মণ্ডলঘাট পরগণার গ্রামগুলি কেমন ছিল, তার বর্ণনা মেলে তাঁর লেখা বিভিন্ন পুঁথিতে। বলতে গেলে সেসময় প্রায় প্রতিটি গ্রাম ছিল সমৃদ্ধ এবং জাঁকজমক। সেসময় ক্ষেপুত, শ্রীবরা, ভাটরা, তড়া, গোপালনগর গ্রামগুলি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। এখনও রয়েছে। রূপনারায়ণ তীরবর্তী তৎকালীন বর্ধিষ্ণু গ্রাম ক্ষেপুতের অসাধারণ চিত্র তুলে ধরেছেন পুঁথিতে --
'সাকিম খেপুত পরগণে মানকুর।
রাইমৌজে খেপুত তরক দাসপুর।।
বর্ধমানে বীরসিংহ সাধু ধূসদত্ত।
খেপুতে খেপাইচণ্ডী করিল ব্যার্ত।।
খেপুতে খেপাই আগে ফিঙ্গারাজার পারে।
বড়খান গাজি সাহেব খ্যাত তদন্তরে।।
বিস্তর ব্রাহ্মণগণ খেপুতের মতি।
বিদ্যায় বেদান্ত যেমন বিদ্যাপতি।।'
পালযুগে 'ফিঙ্গা' নামক এক বৌদ্ধসম্প্রদায়ের আধিপত্য ছিল ক্ষেপুত গ্রামে। তড়া গ্রামের রুক্মিণীকান্ত ভট্টাচার্যের গৃহদাহের ফলে তাঁর রচিত রামায়ণ পুঁথিটি সেসময়ে পুড়ে যায়। এটি জানা যাচ্ছে কবির রচনায়। এ ঘটনা না ঘটলে মেদিনীপুরের মানুষ হিসেবে আজ আমরা আরেকটি বৈচিত্র্যময় রামায়ণের সাথে পরিচিত থাকতে পারতাম। কবির রচনায় পাই --
"খেপুতি ভাটরা তড়া
গোপালনগর শ্রীবরা
পঞ্চপাটে পঞ্চ ভট্টাচার্য।
দেব অনুগ্রহে কবি
এ পঞ্চপণ্ডিত সেবি
তবে কৈল কবিতায় ধার্য।।
রুক্মিণীকান্ত ভট্টাচার্য
তড়াবাসী বিদ্যাধুর্য
তার আজ্ঞা করিয়ে পালন।
ভট্টসার্বভৌমবাসে
রামায়ণ রচি শেষে
সপুস্তক মন্দির দা(হ)ন।।"
বর্ধমান রাজ ছাড়াও আরও যে সব বিদ্যোৎজনের আনুকূল্যে এবং সহায়তায় কবি শ্রীকৃষ্ণকিঙ্কর নিজের কাব্যপ্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন, তাঁদের কথাও লিখে গিয়েছেন সুন্দরভাবে।
"কবিত্ব সন্ধান যত শিখাইল মোরে।
রামচন্দ্র পুত্র যুত প্রণিপাত তারে।।
গোবিন্দরাম রাম শান্তিরাম মণিরাম।
খেপতি খুকড়দা কুলটিকরিতে ধাম।।
এই চারি দ্বিজবরে অনুজ্ঞাল মোরে।
কবিত্ব প্রকাশ কৈলু ভারত ভিতরে।।
লালবিহারী বাঞ্ছারাম বৈদ্যনাথ আর।
শূত্রযতজন কত নাম লব তার।।
বিপ্র বেদে শূদ্রপদে রাখ ব্রণমই।
কিষ্টকিঙ্কর মাগে বর দিবে শীতলাই।।"
কিন্তু কবির বহু পুঁথি বিভিন্ন সময় বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আজ তা পাওয়ার সম্ভাবনা কম। গবেষক ড. শ্যামল বেরার সংগ্রহে রয়েছে পঞ্চানন্দ মঙ্গল, লক্ষ্মী চরিত্রের পালা, শ্রীকৃষ্ণকিঙ্কর বিরচিত পাটেশ্বরীর জাগরণ পালা, শীতলামঙ্গলের পুষ্পিকা, শীতলার লঙ্কা পূজা পালা, রাধা কৃষ্ণের রাস বিষয়ক পুঁথি (অনুলিখন ১২৪৪ বঙ্গাব্দ), শীতলামঙ্গল, লক্ষ্মীর দ্বারকা পালা, শীতলার জাগরণ পালার অসংখ্য পুঁথি। ড. ত্রিপুরা বসু মন্তব্য করেছেন, "কবির পুঁথিগুলি সুসম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হলে অবিভক্ত মেদিনীপুর এবং রূপনারায়ণ তীরবর্তী হাওড়া জেলার গ্রামজীবনের শতাব্দী প্রাচীন আঞ্চলিক ইতিহাসের একটি' রূপরেখা জনসমক্ষে উন্মোচিত হবে বলে বিশ্বাস রাখি।" ঘাটাল, দাসপুর, কোলাঘাট এবং পাঁশকুড়া থানা এলাকায় এখনও কবি শ্রীকৃষ্ণকিঙ্করের লেখা মঙ্গলগান গেয়ে আসর মাতান মঙ্গলগানের শিল্পীরা।
🍂
0 Comments