জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫২ / সালেহা খাতুন

ছাত্র শান্তনু ও তার কবিতা

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫২ / সালেহা খাতুন 

দুঃসময় পেরিয়ে এলে অতীতের কথাগুলোকে রসিকতা বলেই মনে হয়। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতায় “রাগী লোক” এর যে পরিচয় দিয়েছেন সে কথাটি আমি খুব মনে রাখি। কেননা আমার চারপাশে রাগী লোকেরই ছড়াছড়ি। আর এটাও জানি দুর্বল মানুষই চিৎকার করেন বেশি। ফলে নীরব থাকি। আর ফিরে পাই তাঁদের ভালোবাসা।

“রাগী লোকেরা কবিতা লিখতে পারে না 
তারা বড্ড চ্যাঁচায় 
গহন সংসারের ম্লান ছায়ায় রাগী লোকরা অত্যন্ত নিঃসঙ্গ 
তারা নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে ভালোবাসে। 
পাহাড়ের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়া জলপ্রপাতের পাশে 
আমি একজন রাগী লোককে দেখেছিলাম 
তার বাঁকা ভুরু ও উদ্ধত ভঙ্গিমার মধ্যেও 
কী অসহায় একজন মানুষ ---
নদীর গতিপথ কেন খালের মতন সরল নয় 
এই নিয়ে লোকটি খুব রাগারাগি করছিল! 
হাতে এক গোছা চাবি 
তবু তালা খোলার বদলে সে পৃথিবীর সব 
দরজা ভেঙে ফেলতে চায়— 
ঐ লোকটি কোনদিন কবিতা লিখতে পারবে না 
এই ভেবে আমার কষ্ট হচ্ছিল খুব ! 
পাহাড় ও জলপ্রপাতের পাশে সেই 
বিশাল সুমহান প্রকৃতির মধ্যে 
বাজে পোড়া শুকনো গাছের মতন দাঁড়িয়ে রইলো 
দাঁড়িয়ে রাগী মানুষ।”

আমার কাছে কবিতাই জীবন আর জীবনই কবিতা হওয়ায় ওসব দুঃখ কষ্ট আমাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না। কদিন আগে আমার ছাত্র শান্তনু বাবাকে হারিয়ে কবিতা লিখেছে আর তা একটি সংকলন গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। ও প্রশ্ন করেছে আমার কাছে, ‘কবিতা আর গান কি শান্তির অনুরণন দিয়ে যায়’? ওকে বলেছি শোক থেকেই তো শ্লোকের জন্ম। নিঃস্তরঙ্গ সমুদ্রে তো আর দক্ষ নাবিক হওয়া যায় না। সংসারেও এই ওঠাপড়া, ঝড়-ঝাপটা আছে। আর প্রতিটি মানুষই কম বেশি এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। কেউ বলে কেউ বলে না। চাতুর্যের আশ্রয় নেয়। জীবনে যত বাধা ততই সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আমার জন্য কেউ ফুল বিছিয়ে রাখবে না, কাঁটা মাড়িয়ে রক্তাক্ত হয়েই চলতে হবে, চলতে হয়,চলতে হচ্ছে।

ঐ যে চব্বিশ আর ছাব্বিশের দুই তরুণ তরুণী এক তরীতে ঠাঁই পেল এও কি কম কথা! কখনও হাল ভেঙে যায়,পাল ছিঁড়ে যায় লুকিয়ে থাকা গ্লেসিয়ার ঘাতকের ভূমিকা নেয় তবুও দুইয়ে মিলে সংসার নামক তরণী বেয়ে চলেছে । একটা সময় নিরুদ্দেশের পথে ভেসে ভেসে এখন খানিকটা থিতু হয়েছে। 

রাগ কি আমারও নেই? না রাগ হয়না? আমারও যে রাগ আছে সে আমি প্রথম শুনি হোমিওপ্যাথির ডাক্তার হাসানের কাছে। প্রচণ্ড মাথা ব্যথার চিকিৎসার জন্য উলুবেড়িয়ার ঐ ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি বলেন রাগ কমাতে। কী আশ্চর্য! নিজেকে চিনি না। আর বলেন আমার কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর গোপাল চন্দ্র বেরা। তিনি সহাস্যে আমাকে বলেন, ‘ম্যাডাম ভীষণ রাগী’। অথচ সবাই বলেন আমি ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। আসলে লোকজনের আচার-আচরণ ভেতরে ভেতরে আমাকে যে ক্ষেপিয়ে তোলে সেটা দেখার দৃষ্টি তাঁর ছিল। ধৈর্য আর সহ্যশক্তির প্রার্থনাই তো সারাজীবন করে এলাম। এখন আর পারি না, লোকে যখন রাগ দেখানোর জন্য আমাকেই টেকেন ফর গ্র‌্যান্টেড ধরে নেয়, সস্তা ভেবে নেয় তখন একটু ঝাঁঝ দেখাই বৈকি। কম তো দেখলাম না! নরম মাটিতেই সবাই আঁচড় কাটে, কী সংসার কী কর্মক্ষেত্র সর্বত্র।বন্ধু নীলাঞ্জনা ঠিকই ধরেছে। আমার মধ্যে ‘কোয়ালিটেটিভ একটা পরিবর্তন’ ও লক্ষ করেছে। 

🍂

ফিরে যাই সেই সাতানব্বইয়ে। উনিশশো সাতানব্বই আমার জীবনের একটা ল্যাণ্ডমার্ক। ঐ বছরই মার্চের দিকে এম.এ.-এর রেজাল্ট বেরোয়। এম.এ.পাশ করি। আমাকে হাতের তালুর মতো চেনেন যিনি,অধ্যাপক শ্যামল সেনগুপ্ত; তিনি আমাকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করেন। বাবাও করেন। এম.এ.পাশ মেয়েকে এলাকার এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক শিক্ষিকা হিসেবে পেতে বাবার কাছে আর্জি জানান। বাবা স্যারের পরামর্শ চান। স্যার না করে দেন। বলেন ওর লক্ষে পৌঁছানোর পথে ঐ চাকরি বাধা হয়ে দাঁড়াবে। স্যার বাড়িতে যে ছাত্রদের পড়াতেন প্রায় দাতব্যের মতো করেই তাদের সপ্তাহে একদিন করে পড়ানোর ভার আমায় দিলেন। দাতব্য বলছি এই কারণে যে আমরা বেশিরভাগ জন ঐ মাসের শেষে স্যারের হাতে কোনো খাম তুলে দিতাম না। কিন্তু আমাকে যখন পড়ানোর দায়িত্ব দিলেন মাসের শেষে তিনি একটি খাম আমাকে ধরিয়ে দিলেন আর বললেন তুমি দেখছি আমার চাকরিটা খাবে। কেননা আমার পড়ানোয় শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত খুশি। সবার প্রিয় হয়ে উঠি। 

প্রথম উপার্জন : সেই শিশুরা, বাবা ও মইনুদ্দিন সাহেব, শামসুদ্দিনদা এবং তাজমহল গ্রামবিকাশ কেন্দ্র

এখানে একটি ছোটো মেয়ের কথা না বললেই নয়। তার নাম শিল্পী। মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতেই থাকে। ওর মা আরজিনা আমাকে অনুরোধ করে সালেহা তুমি ওকে পড়াও। ওর বাড়িতে গিয়ে পড়াতে বলে। তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোজ যাতায়াত করি। সময় অতোটা নেই। তার ওপর বাবা আরজিনাকে বলেন ‘তুমি লক্ষ টাকা দিলেও আমার মেয়ে তোমার বাড়িতে পড়াতে যাবে না। বাচ্চাকে তুমি আমার বাড়িতে পৌঁছে দিও। ও যত্ন নিয়ে পড়িয়ে দেবে’। শিশুটি রোজ আসতো। ঝড় জল তুফান যাই হোক না কেন। আমাকে না দেখে থাকতে পারতো না। পড়াশোনাও মন দিয়ে করতো। একশো টাকা মাইনে দিত। ওর বর্ণ পরিচয় হয় আমারই হাতে।

  প্রথম উপার্জন অবশ্য এরও আগে। তাজমহল গ্রামবিকাশ কেন্দ্র শিশুদের বিকাশের জন্য তাদের অধীন কয়েকটা গ্রামে ছোটো ছোটো স্কুল খুলেছিল। বালোয়াদি, ননফরম্যাল বিভিন্ন নাম ছিল সে সব স্কুলের। বিরানব্বইয়ের নয় জুলাই তাজমহল গ্রামবিকাশ কেন্দ্রে একটা ইন্টারভিউ দিই। ইন্টারভিউ নেন শামসুদ্দিনদা,মিনাদি,আলপনাদি ও অন্যান্যরা। শামসুদ্দিনদা আমার সম্পর্কে সব কিছু জানেন বলে কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। আমার খুব প্রশংসা করলেন। বললেন আমার প্রতিভাকে চেপে রাখা যাবে না। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি আমি কি এতোখানি প্রশংসার যোগ্য?

মনে হয় সে সময়েই তিনশো টাকা মাইনের চাকরিটা তিনমাস করি। ঐ বাচ্চাদের পড়ানো আর বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি টাস্ক করাতে হতো। ওখানেও মিষ্টি মিষ্টি বাচ্চারা দিদিমণি/মণিদিদি বলতে অজ্ঞান। তিনমাসের ঐ রোজগারে ভাইয়ের জন্য বিশেষ হেল্থ ড্রিঙ্ক কিনি।

(ক্রমশ)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments