জ্বলদর্চি

শোভন কামিল্যা (অভিনেতা, মিমিক্রি আর্টিস্ট, ডাবিং শিল্পী, কাঁথি) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১০৭
শোভন কামিল্যা (অভিনেতা, মিমিক্রি আর্টিস্ট, ডাবিং শিল্পী, কাঁথি) 

ভাস্করব্রত পতি

স্বপ্নটা ছিল অনেক। সব স্বপ্ন তো রূপরেখা পায়না সকলের! খুব ছোটবেলায় মাত্র ২৪ দিন বয়স যখন, তখন দুর্ঘটনায় পা হারানো বাবা শিবশঙ্কর কামিল্যাকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। টিকে থাকার লড়াই। একদিকে অভাব অনটন, অন্যদিকে ক্ষুন্নিবৃত্তির উপায় সন্ধান। কখনো সোনা দোকান, কখনো পেট্রোল পাম্প। কাজ চাই কাজ। এক প্রতিবন্ধী বাবার লড়াই। সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে শুধু বাবা নয়, মা শকুন্তলা কামিল্যাও হাত মেলেছিল কাজুবাদাম ছাড়ানোয় রুটি বেকারির রুটি তৈরির কাজে। একটা দমবন্ধ করা কঠিন পরিস্থিতি টপকে উত্তরণের সিঁড়ি খুঁজে পেতে বিস্তর ঘাম ঝরাতে হয়েছে কাঁথির শোভন কামিল্যাকে। 
শোভনের ভয়েস দেওয়া কার্টুন 'গুল্টেমামা'

স্কুল জীবন থেকেই থিয়েটারের সাথে যুক্ত। অসংখ্য অভিনয় করেছেন কাঁথির বুকে। প্রথম থিয়েটিরের দল কাঁথির 'কালপুরুষ'। কলেজে পড়াকালীন মিমিক্রিতে জেলা থেকে রাজ্য প্রতিযোগিতায় সুযোগ জুটে যায় তাঁর। তারপর ইষ্টার্ন জোন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ইউথ ফেস্টিভ্যাল কম্পিটিশনে দ্বিতীয় স্থান পান এই মিমিক্রি তথা হরবোলা বিভাগে। পরবর্তীতে এই মিমিক্রি হয়ে ওঠে জীবনের চলার পথের সঙ্গী। তারপর জনপ্রিয় সিরিয়াল 'দাদাগিরি'তে সুযোগ পেলেন। জি বাংলার 'হ্যাপি পেরেন্টস ডে'র চ্যাম্পিয়ান। কাঁথি হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন শোভন। ইচ্ছে ছিল রসায়ন নিয়ে পড়বেন। হয়নি। জীবনের সব সাধ সকলের যেমন পূরণ হয়না, শোভনেরও হয়নি। 
তাপস পালের শেষ সিনেমা 'বাঁশি' তে তাপস পালের গলায় ডাবিং করেছে শোভন

কাঁথির বুকে টুকটাক শর্টফিল্মে কাজ করতে করতে দিন কাটতো তাঁর। কিন্তু এভাবে তো চলে না! কাজ চাই। উপার্জন চাই। আয় চাই। সর্বোপরি মনের খিদে মেটানোর প্লাটফর্ম চাই। নিজেকে লম্বা রেসের ঘোড়া হিসেবে দেখতে স্বপ্ন দেখছিলেন শোভন। অবশেষে কাঁথি ছেড়ে কলকাতা পাড়ি দিলেন ২০১৬ তে। লক্ষ্য ছিল অভিনয়ে আরো ভালো ভাবে তালিম নিতে হবে। আরও পরিশীলিত করতে হবে নিজেকে। আরও ক্ষুরধার করতে হবে নিজের ক্ষমতাকে। কখনো কখনো রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে রাত কাটাতে হয়েছে মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে। 

কলকাতায় গিয়ে থিয়েটার দলের সাথে যুক্ত থেকে নিয়মিত অভিনয়ে মজে থাকলেন। এখানকার 'চার্বাক' নাট্যদলের সাথে ৬ বছর কাজ করলেন নাট্যকর্মী হিসেবে। নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ করতে লাগলেন অদম্য প্রচেষ্টা এবং জানবার খিদে নিয়ে। শুধু অভিনয় নয়, অভিনয়ের পাশাপাশি ভয়েস ওভার আর্টিস্টের কাজ শুরু করলেন 'পকেট মানি' জোগাড়ের জন্য। কলকাতার বুকে থাকা খাওয়ার খরচ তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। কারও কাছে হাত পেতে নয়, নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে আয় করতে শুরু করলেন ধীরে ধীরে। 
ভয়েস ওভার দেওয়ার বিভিন্ন মুহূর্ত

দিন বদলের সাথে সাথে এটাই হয়ে ওঠে প্রধান পেশা।  'ভয়েস ওভার আর্টিস্ট' হিসেবে প্রথম কাজ করলেন জি বাংলার 'ভুতু' অ্যানিমেশানে। জীবনের অন্যতম একটা মাইলস্টোন। মেদিনীপুরের সন্তান হয়ে ইতিহাস রচনা করলেন সেদিন। দারুন সাফল্য এলো। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে শোভনের। একটু একটু করে আরও কাজ আসতে থাকলো ভয়েস ওভার আর্টিস্ট হিসেবে। 

ক্রমশঃ ব্যস্ততম জীবনে পা রাখলেন নিজের এই ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতাকে পাথেয় করে। কালারস বাংলায় হিন্দি থেকে বাংলা সিরিয়ালের ডাবিং (শনি, মহাকালী, লব কুশ) করা শুরু করলেন। বাংলাতে CID, ক্রাইম পেট্রোল এও ডাবিং করলেন চূড়ান্ত সাফল্যের সাথে। তিনি হয়ে উঠলেন কলকাতার জনপ্রিয় ডাবিং শিল্পী। এরপর আরও অনেক ছবি আর ওয়েব সিরিজে ডাবিং করার সুযোগ জুটে যায়। গর্বিত করলেন মেদিনীপুরের মাটি। মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে গিয়েও যে শহরের ইট কাঠ পাথরের শীততাপনিয়ন্ত্রিত রেকর্ডিং কক্ষে ঝড় তোলা যায় -- 'টুম্পা' শোভন সেটা দেখিয়েছে। 
একটি পুরস্কার নেওয়ার সময়ে শোভন কামিল্যা

অভিনয়ের নেশায় কলকাতা পাড়ি দেওয়া শোভন কামিল্যা নাট্যচর্চার পাশাপাশি টিভির বিভিন্ন শোয়ে অংশ নেওয়ার ফাঁকে তাপস পালের শেষ ছবি 'বাঁশি'তে জড়িয়ে পড়লেন হঠাৎই। তাপস পালের কন্ঠ ডাবিং করলেন এই ছবিতে। আসলে 'বাঁশি' করার পরেই তাপস পালের মৃত্যু হয়। ডাবিং করে যেতে পারেননি। রাহুল দাস ও তুহিন সিংহ পরিচালিত 'বাঁশি' তাই তাপস পালের শেষ ছবি। এতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন অমিত মিত্র। অভিনয় করেছেন তাপস পাল, দেবিকা মুখোপাধ্যায়, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, দেবাশীষ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। মেদিনীপুরের শোভন এই সিনেমায় তাপস পালের গলায় অবিকল ডাবিং করে সংলাপ দিয়ে উতরে দিয়েছেন ছবিটিকে। এই ছবির কল্যাণে চলচ্চিত্র মহলে ব্যাপক পরিচয় জুটে যায় শোভনের। দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেতা স্বরানন্দ এবং অখিল আক্কিনেনির কন্ঠও তিনি বাংলায় দিয়েছেন। 

'দাদুর কীর্তি'তে ঋতব্রত মুখার্জী 'সৈকত' চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই ছবির হিন্দি ভার্সানে এই 'সৈকত' চরিত্রের কন্ঠ দিয়েছেন ডাবিং শিল্পী শোভন কামিল্যা। দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা 'কান্তারা'তে বাংলা সংলাপের ডাবিং করেছেন তিনি। ওয়েব সিরিজ 'কলঙ্ক'তে গৌরব চক্রবর্তীর অভিনীত 'বিহান' চরিত্রের হিন্দি ভার্সানে কন্ঠ দিয়েছেন শোভন। বুড়িমা চিত্রম নিবেদিত সুমন কুমার দাস প্রযোজিত ডাঃ কৃষ্ণেন্দু চ্যাটার্জীর ছবি 'যমালয়ে জীবন্ত ভানু'তে একটি চরিত্রে কন্ঠ দিয়েছেন মেদিনীপুরের শোভন। 

ভয়েস ওভার আর্টিস্ট হিসেবে শোভন ইতিমধ্যে কন্ঠ দিয়েছেন 'মিত্তির পাড়ার মারাদোনা' (জি বাংলা অরিজিনাল), 'রিউনিয়ান', 'শিকারপুর' (জি ফাইভ), 'অখিল' (গোল্ডমাইন), 'মি. মজনু' (গোল্ডমাইন), 'এক্সপ্রেস রাজা' (গোল্ডমাইন), 'জার্সি' (গোল্ডমাইন), 'ক্রিমিনাল জাস্টিস' (হটস্টার), 'সুপার ভি' (হটস্টার) ইত্যাদিতে। এরকম আরও অনেক সিনেমায় তাঁর কন্ঠ যুক্ত হয়েছে। যা দর্শক এবং শ্রোতাদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। 
মায়ের সাথে শোভন

অসংখ্য সিরিয়ালে ডাবিং করেছেন শোভন। সেগুলিও খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে দর্শকদের কাছে। যেমন -- 'জয় হনুমান', 'শিশু ভোলানাথ', 'জোধা আকবর', 'শ্রীকৃষ্ণ লীলা' (জি বাংলা), 'ছোটি সর্দারনী', 'শিবশক্তি', (কালারস বাংলা), 'সবার সাঁই', 'গুল্টে মামা', 'নিক্স' (সোনি আট) ইত্যাদি। এছাড়াও প্রচুর কার্টুনের চরিত্রে কন্ঠ দেওয়ার সুযোগ হয়েছে শোভনের। তাঁর কাজের বিশেষ কিছু উল্লেখযোগ্য কার্টুন হল - 'বাঁটুল দি গ্রেট', 'মটু পাতলু', 'অগি এন্ড দ্যা ককরোচেস', 'জিগ এন্ড শার্কো', 'নারুতো', 'ডিং ডং বেল', 'মহাভারত', 'স্পঞ্জবব স্কয়্যারপ্যান্ট', 'চিকু বান্টি', 'ডিটেকটিভ কোনান', 'অবতার দ্য লাস্ট এয়ারবেন্ডার', 'এঙ্গরি বার্ড ২', 'জঙ্গল বুক', 'বাবলু বাবলু' ইত্যাদি। এগুলি ছোটদের কাছে লোভনীয় হয়েছে শুনতে। আর জনপ্রিয় হয়েছে শোভনের কাজ। 

অভিনেতা হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে অনেকগুলো সিরিয়াল এবং সিনেমাতে। মেদিনীপুরের বুক থেকে উঠে গিয়ে কলকাতার বুকে প্রসার জমানো চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু শোভন কামিল্যা তা পেরেছে। শোভন অভিনীত সিনেমাগুলি হল -- 'কখগঘ' (পরিচালক - ডঃ কৃষ্ণেন্দু চ্যাটার্জী), 'তোমার অসীমে' (পরিচালক - শ্রেয়ম আচার্য), 'শেষমেস' (পরিচালক - আদিত্য  সেনগুপ্ত), 'হে ভগবান' (পরিচালক - রাজদীপ ঘোষ), 'কলকাতা চলন্তিকা' (পরিচালক - পাভেল) এবং 'ডাক্তার কাকু' (পরিচালক - পাভেল)। এছাড়াও যে যে সিরিয়ালে তিনি অভিনয় করেছেন সেগুলি হল 'সাত ভাই চম্পা' (জি বাংলা), 'আমলকী' (জি বাংলা), 'জয়কালী কলকাত্তাওয়ালী' (স্টার জলসা), 'সোহাগ চাঁদ' (কালারস বাংলা) এবং 'মেয়েবেলা' (স্টার জলসা)। শোভন কামিল্যা মেদিনীপুরের ছেলে। পান, ফুল, কাজুবাদামের জেলা থেকে গিয়ে কেউ যদি রূপালী পর্দায় শোনায় "তুই আমাকে চাস তাইতো?", তবে মেদিনীপুরবাসী হিসেবে গর্বিত হতেই হয়।

🍂

Post a Comment

0 Comments